দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ১

0
408

দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ১
তামান্না জেনিফার

সুমার নিথর দেহটা ফ্যান থেকে ঝুলছে ৷ আমার মা পাশের ঘরে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে ৷ একটু পরপর মায়ের জ্ঞান ফিরছে আর মা চিৎকার করে কাঁদছে..”ও মনারে , ও সুমারে …মা রে , আমার মনা..”

বাড়ি ভর্তি পুলিশ ৷ সুমার শরীরটা তারা নামিয়ে ফেলেছে ৷ চাঁটাইয়ে মুরে সেই শরীরটা নিয়ে যাচ্ছে এম্বুলেন্সে করে ৷ চাঁটাইয়ের বাইরে থেকে সুমার পা দুটো দেখা যাচ্ছে …. সুমা , আমার ছোট বোন ! আমার পনেরো মিনিট পরে যার জন্ম হয়েছিলো ৷ মায়ের গর্ভে আমরা একসাথেই বেড়ে উঠেছিলাম , অথচ আজ সুমা আমার আগেই আমাকে একলা করে দিয়ে চলে যাচ্ছে ৷ আমার চোখে জল নেই ৷ আমি যেন কান্নাশূন্য মানুষে পরিনত হয়েছি ৷ বাবা আগে চলে গিয়ে ভালোই করেছে , নয়তো মায়ের মতোই আজকের দিনটা সহ্য করতে হতো তার …

*********

সারারাত ঘুমায়নি রিমশা ৷ বারান্দায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো সে ৷ ফেসবুকে তার ফ্যান ফলোয়ারের অভাব নেই ৷ অপরূপা রিমশা মাঝে মধ্যে দুয়েক লাইন কবিতা লেখে ৷ অবশ্য তার ফলোয়াররা সে কবিতার কতটুকু বোঝে রিমশা নিজেও সন্দিহান ৷ তার ফেসবুক সেলিব্রেটি হবার মূল কারন তার চেহারা ৷ রিমশা নিজের মনেই হাসে ৷ ফ্রেন্ডলিস্টে পাঁচহাজারের কোটা তার অনেক আগেই পূর্ন হয়েছে ৷ এই পাঁচহাজারের মধ্যে পাঁচশ জনকেও সে চেনে না ৷ তাতে কি , এই ফেসবুকের লাইফটা তার ভালো লাগে ৷ পরপর তিনবার সুইসাইড এটেম্প নেওয়া রিমশা ফেসবুকে বেশ হাসিখুশি ৷

ভাবনার বেড়াজাল কাটে ফোনের টুং আওয়াজে ৷ নোটিফিকেশন এসেছে ফেসবুকে ৷ রিমশা নোটিফিকেশন চেক করে দেখে আলিশা ইনভাইটেড ইউ টু দ্য গ্রুপ ” দি সুইসাইড ব্যুথ ” ….

প্রতিদিন এমন হাজারো গ্রুপের ইনভাইটেশন আসে ৷ আজকাল গ্রুপের তো আর অভাব নেই ৷ রিমশা এ ধরনের নোটিফিকেশন দেখেও না , কিন্তু আজকে গ্রুপটার নাম দেখেই তার কেমন যেন আগ্রহ জাগলো ৷ সে গ্রুপটার জয়েন রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেললো ৷ তারপর রাত জাগা ক্লান্তি এক পাশে রেখে স্ক্রল করতে থাকলো গ্রুপের হোম পেজ …

সিক্রেট গ্রুপ , এমন নামের গ্রুপ সিক্রেট হবে এটাই স্বাভাবিক ৷ গ্রুপ ডেসক্রিপশনে ছোট্ট করে লেখা ” যারা আত্মহত্যা করতে চান , যোগাযোগ করবেন ৷ ” ব্যস এটুকুই… আর কিছু না !

রিমশা এনাউন্সমেন্ট পোস্টগুলো দেখতে থাকে ৷ গ্রুপের ফাউন্ডার এডমিনের নাম আঁধার ৷ একটা মুখোশের ছবি দেওয়া প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ৷ রিমশা আগ্রহী হয়ে আঁধার আইডিটাতে ঢোকে ৷ আইডিতে কিচ্ছু নেই ৷ কোন ইনফরমেশনই নেই ৷ এমনকি মেল নাকি ফিমেল এটাও দেওয়া নেই ৷ তারউপর আইডি লক করা ! রিমশা খানিকটা বিরক্ত হয়ে আঁধার আইডি থেকে বের হলো ৷ গ্রুপ থেকে লিভ নিতে গিয়েও এনাউন্সমেন্ট পোস্টটা আবার পড়তে শুরু করলো ৷ এখানে বেশ বিষদ করেই লেখা আছে গ্রুপের উদ্যেশ্য কি ! সেখানে লেখা—

“সুইসাইড করার জন্য যারা সবচেয়ে সহজ এবং কম কষ্টের ঝুকিহীন কিছু খুঁজছেন তাদের সাদর আমন্ত্রন ৷ উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে সুইসাইড ব্যুথ ৷ এটি একটি চারকোনা ঘর সদৃশ্য বস্তু যা সহযেই ভাজ করে বহন করা যায় ৷ ব্যুথে আছে একটি গ্যাস চেম্বার , সুইচ অন করলে সেখান থেকে নির্গত হবে বিষাক্ত গ্যাস , যা মাত্র পাঁচ মিনিটে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করবে ৷ এই মৃত্যু হবে যন্ত্রনাহীন , কিছু বুঝে উঠার আগেই আপনার এপারের যাত্রা সাঙ্গ হবে ৷ ব্যূথের মূল্য মাত্র দশ হাজার টাকা , কোন বার্গেনিং করা যাবে না ৷ তবে শুধুমাত্র টাকা দিলেই আপনি ব্যুথের মালিক হবেন এটা ভাবলে ভুল ভাবছেন ৷ এজন্য অবশ্যই আপনাকে নিচের সবগুলো শর্ত পূরন করতে হবে ৷

১. প্রথমেই ম্যাসেজে বলতে হবে আপনি কেন সুইসাইড করতে চান ৷ যদি মনে হয় আপনার সুইসাইডের কারন যৌক্তিক তাহলেই আপনার কাছে সুইসাইড ব্যুথটি বিক্রয় করা হবে নচেৎ নয় ৷

২.আপনার বয়স আঠারো প্লাস হতে হবে ৷

৩.আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সঠিকভাবে দিতে হবে ৷ এসব তথ্য ভেরিফিকেশন করে যদি মনে হয় ভুল তথ্য দিয়েছেন তাহলে আপনার কাছে সুইসাইড ব্যুথ বিক্রয় করা হবে না ৷

৪.শুধুমাত্র নিজের জন্য কিনতে পারবেন , অন্য কারো জন্য নয় ৷

৫.এ বিষয়ে সকল তথ্য গোপন রাখতে হবে ৷

৬.একান্ত পরিচিত যাকে মনে হয় আসলেই সুইসাইড করতে চায় শুধু তাকেই গ্রুপে এড করতে পারবেন ৷ নচেৎ চিরতরে ব্যান করা হবে গ্রুপে ৷

৭.অযথা প্রয়োজন ছাড়া আঁধার আইডিতে ম্যাসেজ দিতে পারবেন না , এবং কোন পোস্টও দিতে পারবেন না ৷ প্রয়োজনেই কেবল পারবেন ৷

রিমশা ধৈর্য্য ধরে পোস্টটি পড়লো ৷ তারপর নিজে নিজেই বলে উঠলো “পাগল ছাগলে দেশ ভরে গেছে … সুইসাইড ব্যুথ বেঁচে পাগলা , খায়া দায়া কাম নাই আর ! ”

ফেসবুক থেকে বের হয়ে সকালের মিষ্টি আলোয় কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলে রিমশা ৷ এ আলোতে ছবি ভীষণ সুন্দর হয় ৷ গায়ের রং থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হয় ৷ তারপর সেলফিগুলো ইডিট করে আরো একটু সুন্দর করে পোস্ট দেয় নিজের প্রফাইলে … ছোট্ট একটা ক্যাপশন জুড়ে দেয় সাথে !

“সুপ্রভাত সুহৃদ ”

মুহূর্তেই লাইক কমেন্ট আর রিয়েক্টে ভরে যায় সে পোস্ট ৷ দশ মিনিটে লাইক কমেন্ট এক হাজার ছাড়িয়ে যায় ৷ রিমশা নিজের মনেই হাসে … হেসে হেসেই আবার বলে “পাগল ছাগলে দেশ ভরে গেছে.. এই পোস্টে এত লাইক কমেন্টের কি আছে …পাগলের দল সব …চিকিৎসা দরকার সবার..”

দরজায় নক করছে কেউ ৷ রিমশা জানে মর্জিনা বুয়া নক করছে ৷ বিরক্তি নিয়ে বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খোলে সে ৷ হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মর্জিনা , সে জানে তার আপা সকালে নাস্তা করেই ঘুমায় ৷ যত দ্রুত সম্ভব নাস্তা তৈরি করে সে তাই , মানুষটা যত তাড়াতাড়ি খাবে তত তাড়াতাড়ি ঘুমাবে ৷ একটা মানুষ কিভাবে সারারাত জাগে মর্জিনার মাথায় খেলে না !

রিমশা চুপচাপ সুবোধ বালিকার মতো নাস্তা খেয়ে নেয় ৷ তারপর কড়া ডোজের সিডেটিভ খেয়ে বিছানায় যায় ৷ সারারাত এ বিছানা ফাঁকা পড়ে ছিলো ৷ কড়া সিডেটিভেও রিমশার ঘুম আসে না ৷ জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করে সে ..

রিমশার বাবা রাশেদুর রহমান ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ীদের একজন ৷ রিমশার মা মারা গেছেন অনেক আগেই ৷ ভদ্রলোক মেয়ের কথা ভেবেই হয়তো আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি ৷ অবশ্য রিমশার ধারনা তার বাবা বিয়ে করেননি সময় পাননি বলে ৷ ভদ্রলোক সারাদিন ভীষন ব্যস্ত থাকেন ৷ মেয়ের সাথে তার দেখা হয় সপ্তাহে একদিন , রবিবার ৷ ঐদিন তার বাবা অফিসে যান না , সারাদিন নিজের ঘরেই থাকেন ৷ রিমশার সাথে তার তেমন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক না , তবুও রবিবার রিমশার মন ভালো থাকে ৷ বাবা বাসায় আছে এই বোধটুকুও স্বস্তির ….

সিডেটিভ কাজ করতে শুরু করেছে ৷ রিমশা ঘুমিয়ে পড়ছে অতি দ্রুত ৷ তার চিন্তাগুলো এখন কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে ৷ তার মনে হচ্ছে সে যেন কোন একটা নৌকায় … মাঝ নদীতে মাঝিহীন সেই নৌকা দুলছে , সেই দুলুনি যেন ছোটবেলার দোলনার মতো ৷ ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যায় , গভীর শব্দহীন অতল ঘুমে …

**********

সুমা মারা যাবার কিছুদিন পরেই আমি আঁধার আইডিটা খুলেছিলাম ৷ কেন খুলেছিলাম জানি না ৷ দুবছর হয়ে গেছে সুমা আমাদের মাঝে নেই ৷ আমার জমজ বোন , আমার পনেরো মিনিট পরে যার জন্ম হয়েছিলো দু’বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ৷ আঁধার আইডিটার কল্যানে গত দুই বছরে আমি এমন অনেক সুমাকে পেয়েছি ৷ সবাই মরতে চায় ৷ মৃত্যু কতটা সহজ শব্দ তাদের কাছে ৷ আমি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনি ৷ আমার সুমার কথাগুলো আমার শোনা হয়ে উঠেনি , আমি জানিনা কোন কষ্ট বুকে নিয়ে আমার বোনটা চলে গেলো ৷ তবে আঁধার জানে আঁধারে থাকা হাজার খানেক সুমার গল্প ৷ আমার গ্রুপ “দি সুইসাইড ব্যুথ” জানে সুমাদের গোপন গাঁথা ৷ আঁধার হয়ে আমি আঁধারের গল্প শুনি ৷ মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠে ভাবি পৃথিবী কি সত্যিই এতটা কদাকার ! মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে ভাবি মৃত্যুর জন্য এত ক্ষুদ্র কারনও কি যথেষ্ট ?

ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো ৷ আবার কেউ আঁধারকে ম্যাসেজ দিয়েছে ….

চলবে …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here