এল_এ_ডেইস পর্ব ৪১

0
220

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৪১
লেখনী মাহীরা ফারহীন

টিং টিং করে শব্দ হচ্ছে এবং দরজা ঠেলে একেকজন কাস্টোমার ভেতরে প্রবেশ করছে। মানুষে গিজগিজ করছে জায়গাটা। কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন অপেক্ষমান কাস্টোমারদের। আবার অনেকে ডেসার্ট টেক আওয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে। মাহীন ও রায়েদও ডেসার্টের কাঁচের সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে। মাহীন সাথে করে একপিস চিজকেক নিয়ে যেতে চাচ্ছে। বারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা টেকাওয়েগুলো প্যাকেট করছে। মাহীন ডেসার্টগুলো দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল,’আহ চমৎকার!’
বারের পেছন থেকে ছেলেটা বাংলায় বলল, কী বললা?’
মাহীন হঠাৎ ইংরেজি ভাষাভাষীদের মাঝে বাংলা শুনতে পেয়ে চমকে উঠল। সামনে তাকিয়ে বলল,’তুমি বাঙালি?’
শ্যাম বর্ণের ছিপছিপে গড়নের লম্বা ছেলেটা আন্তরিক হেসে বলল, ‘হ্যা। বেশ কিছুদিন পর একজন বাঙালির সঙ্গে দেখা হলো।’

‘নাইস টু মিট ইউ।’

‘তুমি কী ঢাকা বাসি?’ একজন কাস্টোমারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্যাশিয়ারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ছেলেটা।
মাহীন বলল, ‘হ্যা ঢাকায় থাকতাম। তুমি?’
‘আমিও ঢাকায় থাকতাম। ধানমন্ডি।’
মাহীন অবাক হয়ে বলল, ওহ মাই! আমিও ধানমন্ডিতেই থাকতাম।’ রায়েদ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে ওদের কথা শুনছে। যদিও কিছুই বুঝতে পারছে না। আজ এই ভাষাটা না পারার জন্য খুব আফসোস হলো।
‘ছেলেটাও আবার গায়ে পরে একের এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। থামা থামির কোনো নামই নেই। আর মাহীনও কী হেসে হেসে কথা বলছে। কী কথা বলে এমন দেশ উদ্ধার করছে আল্লাহই জানে!’ ভেবে বিরক্তির সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রায়েদ। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ওদের চিজকেক প্যাকেট করে দেওয়া মাত্র রায়েদ প্রায় ছো মেরে প্যাকেটটা নিল। তারপর মাহীনের হাত ধরে বলল, ‘মাহীন! মাহীন আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো।’ মাহীন হকচকিয়ে উঠল। তারপর ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” আসছি।”
ছেলেটাও আবার প্রতুত্তরে বলল, হোপ টু সি ইউ আগেইন।’
রায়েদ প্রায় ঝড়েরবেগে বাইরে বেরিয়ে আসল। মাহীন কিছুটা অবাক হয়েদ বলল, ‘হঠাৎ হলোটা কী? আমাদের কী কোথাও যাওয়ার তাড়া পরে গিয়েছে? এমন ছুটছো কেন?’
রায়েদ শান্ত কন্ঠে বলল, ‘কিছু হয়নি। কতক্ষণ আর একই জায়গায় বসে থাকতাম।’
মাহীন ভ্রু উঁচিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে আসলেই এখানকার ডেসার্ট অসাধারণ ছিল। আবার আসা লাগবে এখানে।’
ওরা হাঁটতে শুরু করেছে। মাথার ওপরের কড়া রোদের তেজ কমেছে। ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাম না জানা গাছগুলো ভেদ করে ঝুড়ি ঝুড়ি মরা আলো এসে পরছে। রায়েদ বলল, ‘নাহ এখানে আর আসবো না। ভালো লাগেনি।’
‘কেন কেন? কী ভালো লাগেনি?’

‘কী আবার ডেসার্ট।’
মাহীন চোখ সরু করে সুর করে বলল, ‘ওহ তাই নাকি? কিন্তু তুমিই না বলেছিলা এখানকার ডেসার্ট অসাধারণ।’
রায়েদ ইতস্তত করে বলল, ‘উম হ্যা। কিন্তু এখন ডেসার্ট গুলো ভালো লাগেনি।’

‘খাওয়ার সময় তো বললা ভালো লাগসে।’ বলল মাহীন।

রায়েদ ভাবল, ওফ এই মাহীন পিছুই ছাড়ে না। কোন ফ্যাসাদে পরে গেলাম। ভাবতে ভাবতে বলল, ‘কিছুটা। যাক ছাড়ো তো।’ তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘আচ্ছা চলো এখনই লেকে রওনা দেই। নাহলে দেরি হয়ে যাবে।’
মাহীন বলল, ‘এক মিনিট আমাদের ওয়াক অফ ফেমে একটা ছবি তোলা হয়নি এখনো।’
‘ওহ হ্যা। তো চলো তুলে ফেলি।’ রাস্তা ধরেই হাঁটছিল এক যুবক। তাকে রায়েদ ওদের কয়েকটা ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করল। মাহীন ও রায়েদ বোর্ডওয়াকের মাঝেই একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা রায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হেই ওয়াটস দিজ? স্ট্যান্ড ক্লোজলি উইথ ইয়োর গার্লফ্রেন্ড বয়।’
মাহীনের গাল দুটো রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। তবে তা সেভাবে প্রকাশ পেলো না। রায়েদ ওর পাশে এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে মাহীনের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। রায়েদের গালেও লালাভা। ছেলেটা হাসি মুখে কয়েকটা ছবি তুলে মোবাইলটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘অন ফ্লিক! ইউ টু লুক সো সুইট টুগেদার।’ তারপর সে চলে গেল। কেন জানি ছেলেটার এসব কথায় কেউ তার ভুল ভাঙিয়ে দিল না। ওদের এক রাশ আরষ্টতা ধরে বসেছে। মাহীন অস্বস্তিতে রায়েদ থেকে একটু পিছে পিছে হাঁটছে। অবশেষে ওরা লাল রঙচঙে স্টার্লাইন সিটি ট্যুর বাসটা খুঁজে পেয়ে উঠে পরল। ‘রডেও’ রোড বেভারলি হিলস ঘুরে তারপর সিলভার লেক নেইবারহুডে যাবে ওরা। বেভারলি হিলসটা আর পায়ে হেঁটে ঘুরা হলো না। বাসে বসেই জায়গাটা উপভোগ করতে হলো। কারণ হাতে সময় নেই। লাল বাসটি দুই তলা। দ্বিতীয় তলা ছাদের ওপর খোলা। ছাদের ওপরই এখন বেশি ভীর। আসনগুলো সব ভরা। বিকেল প্রায় হয়ে এসেছে। এসময় রোদের তেমন তেজ নেই। মরা সোনালি রোদটা গায়ে মাখতে বড় আরাম। বেশ ধীরে সুস্থেই চলছে বাস যেন সবটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। তবুও বেশ বাতাস হচ্ছে। বাতাসের তোড়ে মাহীনের সমস্ত চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। বেভারলি হিলসের শৌখিন নান্দনিক ইউরোপীয় ধাঁচের বাড়িগুলো চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে কিছু কিছু চোখে ধরা দিলো। নাম করা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর জাঁকজমকপূ্র্ণ দোকান। মুরাল অর্থাৎ বর্ণিল রঙে রাঙানো দেয়াল চিত্রগুলো কিছুক্ষণ পর পরই চোখে পরল। একবার দেখা গেল রাস্তায় এক শেতাঙ্গ যুবক দাঁড়িয়ে বেহালায় গেম অফ থ্রোনসের টাইটেল থিমের সুর তুলেছে। পথযাত্রীদের অনেকেই থেমে গিয়ে সেখানে জড়ো হয়েছে। সুরটা মন ভরে শুনে নেওয়ার আগেই বাস জায়গাটা অতিক্রম করে গেল। রায়েদ গান শোনার জন্য এয়ারপড বের করেছে। ব্লুটুথের সঙ্গে কানেক্ট করে একটা এয়ারপড মাহীনের কানেও গুজে দিল। এড সেরনের ‘পার্ফেক্ট’ গানটা চালু করেছে।

I found a love for me
Darling, just dive right in and follow my lead
Well, I found a girl, beautiful and sweet
Oh, I never knew you were the someone waiting for me

‘Cause we were just kids when we fell in love
Not knowing what it was
I will not give you up this time
But darling, just kiss me slow
Your heart is all I own
And in your eyes you’re holding mine

Baby, I’m dancing in the dark
With you between my arms
Barefoot on the grass
Listening to our favourite song
When you said you looked a mess
I whispered underneath my breath
But you heard it,
Darling, you look perfect tonight

গানটা শেষ হতেই মাহীন বলল, ‘একটা বাংলা গান শোনাই?’

‘বাংলা গান? শোনাও। তুমি গান গাইতে পারো জানতাম না তো।’ আমুদে গলায় বলল রায়েদ।
মাহীন হেসে বলল, ‘আমি গান গাবো না তো। আমি বলছি মোবাইলে চালু করছি।’

‘ওহ হ্যা শুনে দেখা যায়। কিন্তু তুমি একটা গান গেয়ে শোনাবা?’
‘উম সেটা পরে দেখা যাবে। আগে গান চালু করি।’
রায়েদ নিজের মোবাইলটা ওর হাতে তুলে দিল। বাতাসের ঝাপটায় চুল বারবার মুখের ওপর এসে পরছে। মাহীন সরিয়ে দিচ্ছে আবার। মাহীন লগ্নজিতা চৌধুরীর প্রেমে পরা বারণ গানটা চালু করল।

প্রেমে পরা বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল থাকলেও
হাত ধরা বারণ

তোমায় যত গল্প বলার ছিলো,
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে
ছড়িয়ে রয়ে ছিল
দাওনি তুমি আমায় সেসব
কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ

গানটা শেষ হতেই রায়েদ বলল, ‘মেয়েটার কন্ঠ বড়ই অদ্ভুত। আচ্ছা এটা কী কোনো স্যাড গান নাকি?’

মাহীন জিজ্ঞেস করল, ‘স্যাড গান কেন মনে হলো?’
‘এটার মেলোডিটাই এমন। বাই দ্যা সুন্দর ছিল। আচ্ছা এটার নাম কী?’
‘প্রেমে পরা বারণ।’
‘এটার মানে কী?’
‘ফলিং ইন লাভ ইজ নট এলাওড।’
রায়েদ অবাক মুখে বলল, ‘ওরে তাই তো বলি এটার মেলোডি স্যাড স্যাড কেন। আমি তোমাকে সুইট গান শেনালাম। আর তুমি আমাকে সাওয়ার গান শোনালা।’
মাহীন হাসল। বলল, ‘এটা আমার বেশ ভালো লাগে। তাই।’ দুই তলা বাসের ছাদ থেকে লম্বা তাল গাছগুলোকে দেখে এখন মনে হচ্ছে সেগুলো যেন পাশেই মাথা একটু উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। বেভারলি হিলস এ নেমে গিয়ে মাহীন ও রায়েদ আরেকটা স্টার্লাইন বাসে উঠলো। কারণ একটা বাস সাধারণত একই এলাকার মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে বেড়ায়। অন্য এলাকায় যায় না। এই বাসে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সিলভার লেক পার্ক নেইবারহুডে এসে পৌঁছল। এটা লস এঞ্জেলসের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সুখী নেইবারহুড। এলাকাটা একটি লেক জুড়ে গড়ে উঠেছে বলে নাম, সিলভার লেক। ‘ওয়েল কাম টু সিলভার লেক ‘সানসেট জাঙ্কসন’ নামক বড় একটি গাঢ় নীল ব্যানার পার করে এলাকাটায় প্রবেশ করল ওরা। ছবির মতো সুন্দর ঝকঝকে শহরটা। ওরা বাস থেকে আগেই নেমে গিয়ে লেক পর্যন্ত হেঁটে পৌছালো। লেকের পানি গাঢ় নীল। ঠিক প্রশান্তের মতো। লেকের চারিপাশ রেলিং দিয়ে বেড়া দেওয়া। লেকের পাশের হাঁটার প্রশস্ত রাস্তা পার করে টিয়ে রঙের নরম ঘাসের ভূমি উঁচু হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। গিয়ে মিশেছে রাস্তার সাথে। এর মাঝে সিডার ও পাইন গাছের দেখা মিললো। কোথাও কোথাও হালকা গোলাপি ফুলে ছাওয়া দু একটা এলমেনড্রো গাছও দেখা গেলো। গাছে গাছে ডাল পালার আড়ালে বসে সুন্দর সুর তুলে গান গেয়ে চলেছে ক্যানারি পাখি। কখনো কখনো আবার নাইটিংগেলের তীক্ষ্ণ ডাকও শোনা যাচ্ছে। লেকে একটি মাত্র বোট চলছে। তাতে বেশ কিছু যাত্রী লেক উপভোগ করছে। রোদের প্রতিফলনে চিকচিক করে উঠছে লেকের পানি। মাহীন পানির দিকে চোখ রেখে প্রসন্ন কন্ঠে বলল, মজার ব্যাপার হচ্ছে এমন একটা লেক একবার একটা কার্টুনে দেখেছিলাম। অনেকটা এমনই দৃশ্য ছিল।’
‘তুমি এখনো কার্টুন দেখো?’
‘নাহ। ছোটবেলায় দেখতাম। সেটার কথা মনে পরেছে।’
‘কোন কার্টুন দেখতা?’
‘ডোরেমন।’
‘ডোরেমন? এটা কোন কার্টুন?’
মাহীন এমন ভাবে রায়েদের দিকে তাকাল যেন এহেন আশ্চর্যজনক কথা ও এর আগে কখনো শোনেনি। অবাক কন্ঠে বলল, ‘তুমি ডোরেমন দেখো নি কখনো? সিরিয়াসলি?’

‘সিরিয়াসলি আমি কখনো দেখিনি। আমেরিকায় যেসব কার্টুন হতো সেসব দেখেছি। কিন্তু এমন কিছু তো ওর মধ্যে ছিল না।’

মাহীম মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম বোধহয় জ্যাপনিজ কার্টুন বলে আমেরিকায় এয়ারড হতো না। তো তুমি কী ধরনের কার্টুন দেখতা?’

রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ‘সে অনেক আগের কথা। কয়েকটার নাম ভুলে গিয়েছি বোধহয়। কিন্তু আমি স্পঞ্জবক্স স্কয়ারপ্যান্টস, বাগস বানি, টম এন্ড জেরি, দ্যা রোড রানার, হরিড হ্যানরি এসব দেখতাম।’
‘ওয়েল টম এন্ড জেরি এবং স্পঞ্জবক্স স্কয়ারপ্যান্টস আমিও দেখতাম। বাগস বানি টিভি তো হতো কিন্তু আমার ভালো লাগতো না। আর বাকিগুলো বোধহয় বাংলাদেশে হতোই না।’
রায়েদ হেসে বলল, ‘মজার ব্যাপার হলো আমরা কার্টুন নিয়ে আলোচনা করছি।’
মাহীন হাসল। বিকেলের সোনাবরণ রোদ মাহীনের গা ছুয়ে দিয়েছে। কালো চুল রোদের আলোয় হালকা বাদামী দেখাচ্ছে। কাজলে আঁকা কাঠ বাদামের মতো কালো চোখের মণি থেকে হালকা বাদামি রঙ ছিটকে বেরোচ্ছে। সব মিলিয়ে চিকচিকে সোনালি রঙা পবিত্র এক আলোতে যেন সিক্ত হয়ে আছে মাহীন। রায়েদ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে মাহীনের দিকে। এর চাইতে সুন্দর মুখ যেন এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। মনে হলো ইশ এই মুহূর্তে একটা জিনিস যদি এখানে থাকতো সবকিছুই পরিপূর্ণ হয়ে যেত। এমন মুহূর্ত যদি আর না আসে। আসলেই তো এমন স্বর্গীয় মুহূর্ত মানুষের জীবনে কয়বার আসে? রায়েদের মনে হলো সেই একটা কাজ যেন এই মুহূর্তটার জন্যেই থেমে ছিলো। সেটা না করলেই নয়। এবং সেই জিনিসটাও তো এই পার্কে আছে। এতক্ষণ মনে আসেনি কেন? তাহলে দেরি কিসের? হঠাৎ কথাটা মাথায় আসতেই মাহীনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এদিক ওদিক চাইল। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মাহীন একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি।’
বলেই রাস্তা ধরে দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে লাগল। যত দূরে যাচ্ছে ক্রমেই ওকে অনেক ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর দেখাচ্ছে। মাহীন অপেক্ষায় ওর পানে চেয়ে রইল। একবার ভাবল যাবে ওর পেছন পেছন। আবার ভাবল, না থাক যখন অপেক্ষা করতে বলেছে তো অপেক্ষা করাই ভালো। পাঁচ ছয় মিনিট পর আবার ফিরে আসতে দেখা গেল রায়েদ কে। দ্রুত গতিতে হেঁটে কাছিয়ে আসছে। কিছুটা হাঁপাচ্ছে। কাছে আসতেই মাহীন জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ কী হলো? কোথায় গিয়েছিলে?’
রায়েদ এক মুহূর্তে ব্যায় করে বুক ভরে শ্বাস নিল। এক হাত পেছনে নিয়ে রেখেছে যেন কিছু একটা আড়াল করছে। মাহীনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রায়েদ বলল, ‘আচ্ছা মাহীন মনে আছে, গতবার তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে। যে, আমার জন্য ভালোবাসার প্রতীক কোন ফুল?’
হঠাৎ এই কথা শুনে মাহীন থমকে গেল। হৃদয় দ্রুত গতিতে স্পন্দন করতে শুরু করল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘হ্যা করেছিলাম। এবং তুমি বলেছিলা, এখনো ঠিক নেই। যখন কোনো ফুলকে বেছে নিতে পারবা। সবার আগে আমাকেই বলবা।’
রায়েদ প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘এখন হঠাৎ মনে হলো আমি ফুলটা পেয়ে গিয়েছি। দেখতে চাও কোন ফুল?’
মাহীন আগ্রহীভরা কন্ঠে বলল, ‘হ্যা। কোন ফুল?’
রায়েদ ওর ডান হাতটা পেছন থেকে সামনে আনল। ওর হাতে এক গুচ্ছ হালকা বেগুনি রঙের ঝিরিঝিরি ভারবেনা ফুল। মাহীন স্তম্ভিত একই সঙ্গে আবিষ্ট হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফুলগুলোর দিকে। রায়েদের বলা কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে ব্যস্ত মস্তিষ্ক। রায়েদ উৎসুকভাবে তাকিয়ে ছিল মাহীনের দিকে উত্তরের আশায়। কিন্তু মাহীন ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। রায়েদ মাহীনের এক হাত তুলে ফুলগুলো ধরিয়ে দিলো ওকে। তারপর অর্ধেক গুচ্ছ ফুল নিয়ে মাহীনের কানে গুঁজে দিতে দিতে বলল, ‘মনে আছে আমি কী বলেছিলাম? ভারবেনা ফুল ঠিক তোমার। না আসলে তোমারই প্রতিক। আরোগ্যতা এবং পবিত্রতা।’
মাহীন কেঁপে উঠল। ওর হৃদয় দ্রিমদ্রিম করে স্পন্দন করছে। এত জোড়ে হৃৎস্পন্দনের শব্দ হচ্ছে যে মনে হয়, তা রায়েদও শুনতে পাবে। সারা শরীর জুড়ে ভালোলাগার শিহরন বয়ে চলেছে। আশেপাশে সবকিছু যেন থেমে গেছে। কোনো কিছুর শব্দও কানে আসছে না। শুধু রায়েদের কথাগুলোই কানে বাজছে। মাহীন বারবার চেষ্টা করছে কী বলা যায় তা গুছিয়ে নিতে। কিন্তু কী গুছিয়ে নিবে যখন মাথা শূন্য হয়ে আছে। রায়েদ পরিষ্কার ভাবে কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলেছে। মাহীন লেকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিল। লেকের নীল পানিতে আকাশের লাল কমলা রঙের ছোঁয়া লেগেছে। স্বচ্ছ ভাবে লেকের পানিতেও যেন আরেকটা আকাশ ভেসে উঠেছে। আকাশের বুকে ধীর গতিতে চলতে থাকা বড় ভেলার মতো রুপালি মেঘগুলোও যেন থেমে গেছে। থেমে গেছে মাহীনের উত্তরের অপেক্ষায়। রায়েদও আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাহীন অবশেষে আবার রায়েদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর নিজের হাতে থাকা ভারবেনা ফুলগুলো উঁচু করে ধরল। তরল সোনার মতো কিরণ হালকা বেগুনি ভারবেনা গুলোকে সিক্ত করে স্বর্গের এক টুকরো ফুলের মতো করে দিয়েছে। মাহীন ফুলগুলোর দিকে একবার তাকালো তারপর রায়েদের চোখে চোখে তাকাল। ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল,
‘তুমিই তো বলেছো…যে এটা…আমার ফুল। আমার..প্রতীক।’ অনেক কষ্টে গলা দিয়ে কথাগুলো বের করল। রায়েদ অতি ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করে আছে পরের কথাগুলোর জন্য। চোখে মুখে আগ্রহ উপচে পরছে। বুকে নিদারুণ হইচই। মাহীন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললো, ‘তাহলে আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম এই ফুলগুলোকে ভালোবাসার।’
রায়েদের ঠোঁটের কোণে তিরতির করে হাসি ফুটে উঠল। মাহীনের উত্তরটা দেওয়ার সাথে সাথেই যেন রুপালি মেঘগুলো চলতে শুরু করল। ক্যানারি, নাইটিংগেল ও ভিরি পাখি ডাকতে শুরু করল। চারিপাশে সবকিছুই হঠাৎ ঝলমল করে উঠল। মনে হলো কেউ কোনো স্বপ্ন দেখছে। এখনই ঘুৃম ভেঙ্গে গিয়ে চোখের পাতা মেললেই সব গায়েব। রায়েদ অবশেষে বলল, ‘বলো আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো?’
মাহীন এবার হালকা হেসে বলল, ‘না আমরা বাস্তবেই আছি। যদিও আশেপাশের কোনো কিছুকেই বাস্তবিক মনে হচ্ছে না। কেন বলো তো?’
রায়েদ এবার লেকের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মাহীনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তা তো আমার জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছে এমন মুহুর্তে আর কখনো আসবে না।’
মাহীনও সামনে ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকাল। প্রমত্ত কন্ঠে বলল, ‘জানো সূর্যাস্তই হচ্ছে এটার প্রমাণ যে কোনো কিছুর শেষটাও কত সুন্দর হতে পারে।’ রায়েদ কোনো কিছু বললো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল, ‘এল এয়ের এই দিনটা আমার জীবনের আকাশে এক অবিস্মরণীয় টুকরো হয়ে তাঁরার মতো জ্বলে থাকবে। দ্যাটস হোয়াই পিপস সে এল এ ডেইস আর দ্যা বেস্ট!’

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here