বোধোদয়,দ্বিতীয় পর্ব

0
440

বোধোদয়,দ্বিতীয় পর্ব
ধারাবাহিক গল্প

সেদিনের পর থেকে নিশিতা বেশ চুপচাপ হয়ে গেলো। শক্ত মানসিকতার হলেও নিজেকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তার। থেকে থেকেই কান্না দলা পাকিয়ে আসছিলো। একই সাথে ভয়ও হচ্ছিলো। কখন না জানি শাশুড়ির সামনে ভেঙ্গে পড়ে। তবে শাফায়াতের মা’ও বেশ বিজ্ঞ মহিলা। নিজের ছেলেকে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে ! নিশিতার মন যে বেশ বিক্ষিপ্ত এবং তার জন্য যে শাফায়াতই দায়ী, সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হলো না তাঁর। এক সন্ধ্যায় নামাজের পর নিশিতাকে ডেকে কাছে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– ‘তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ, বউমা?’ – কোমল গলায় প্রশ্ন করলেন।
– ‘তেমন কিছু না, মা। আমি ঠিক আছি।’ – কিছুটা সতর্ক হয়ে উঠলো নিশিতা।
– ‘তোমাদের মধ্যে কি সমস্যা, কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছি। আমার ছেলেকে আমি ভালো করেই চিনি। তার ওপর জীবনে খুব কম সময়ই অসন্তুষ্ট হয়েছি। কোনদিনও আমার অবাধ্য হয়নি। তবে আজ দুঃখ পেলাম সে খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করলো দেখে। এত অবিবেচক কি করে হতে পারলো সে?’ – শাফায়াতের মা’য়ের কণ্ঠে হতাশা।
– ‘আপনি যা ভাবছেন, এমন কিছু না, মা। আপনি দয়া করে দুশ্চিন্তা করবেন না।’ – শাশুড়িকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো নিশিতা।
– ‘ দেখো, বউমা। আমি সবই বুঝি। বিয়ের মাত্র কিছুদিন গিয়েছে। এর মধ্যে মন খারাপ করে থাকো বেশীরভাগ সময়। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদো। এসবের কারণ কি, বলো? এত অবুঝ মনে করো না আমাকে। যদি আমাকে নিজের মা মনে করো, তাহলে মা’কে বলতে আপত্তি থাকার কথা না।’

শাশুড়ির এমন কথায় নিশিতা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। চোখে অশ্রু ফিরে এলো আবার। হৃদয়ের সব কষ্ট যেন ঝরে পড়ছিলো একেকটি মুক্তো বিন্দুতে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু সামলে নিতে পারলো সে। অশ্রুসজল চোখে শাশুড়িকে প্রশ্ন করলো,

– ‘আপনি কি জানতেন না মা, সে রাজী ছিল না? সে কি বিয়ের আগে কিছুই বলেনি আপনাকে?’
– ‘বলেছে। তবে যে অবুঝ, তাকে বুঝানোর চেষ্টা করা বৃথা। জীবনসঙ্গী বাছাই করা খুব সহজ কিছু না। এখানে শুধুই আবেগকে প্রাধান্য দেয়াটা বড় ধরণের নির্বুদ্ধিতা। তোমাকে বেছে নিয়ে আমি ভুল করিনি, বউমা। সেটা ভালো করেই জানি। সৃষ্টিকর্তার কাছে এজন্য সবসময় শোকর করি।’ – শাফায়াতের মা’য়ের কণ্ঠে সন্তুষ্টি।

এই মুহূর্তে, মা’য়ের মতো আপন করে নেওয়া এই শুভাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিলো নিশিতার। তবে সে এটাও বুঝলো, তার ভেঙ্গে পড়া চলবে না। শাশুড়ির এক হাত নিজের হাতে জড়িয়ে বললো,

– ‘এখন আমার কি করা উচিৎ,মা? বলে দিন। দিনের পর দিন এত অবহেলা পেতে পেতে আমি ক্লান্ত। আপনার ছেলে যে আমাকে একদমই পছন্দ করে না, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এভাবে তো বেশীদিন থাকা সম্ভব না।’
– ‘মা রে, অমানুষ দেখতে মানুষের মতোই হয়। তাই তাদের চেনা যায় না সহজে। আমার ছেলে যে অন্যায় তোমার সাথে করছে, এজন্য সৃষ্টিকর্তা তাকে ক্ষমা করুক, নইলে ওর কপালে দুঃখ আছে। তুমি কষ্ট পেও না, মা। তোমার ধৈর্যের ফল তুমি পাবে।’

চোখের পানি মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিশিতা। বললো,

– ‘দোয়া করবেন, মা। তবে একটা বিষয় আপনাকে জানিয়ে রাখি। আপনার ছেলে যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে হয়তো আমাকে বাধ্য হয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আশা করি, এমন কিছু করতে হবে না। আপনার ছেলেকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করবেন। আসছি।’ – বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো নিশিতা।

ছেলের বউয়ের মানসিক দৃঢ়তা ভালো লাগলো শাফায়াতের মা’য়ের। তবে একই সাথে ছেলের ভবিষ্যতে কালো ছায়া দেখতে পেলেন যেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, ছেলের সাথে কথা বলবেন।

শাফায়াত তখন বাসায় ছিল না। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে সে যুক্ত। ছুটির দিনগুলো নিয়ম করে সে ওখানেই কিছুটা সময় দেয়। বিকেল থেকে এ কারণেই বাইরে ছিল সে। সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। এমন সময় নিশিতা রুমে ঢুকে কফি নিয়ে। বেড সাইড টেবিলে রাখতে গিয়ে ঘুমন্ত স্বামীর দিকে চোখ পড়ে। কি নিষ্পাপ চেহারা ! বুকের ওপর ফেলে রাখা খোলা বই। ঘরে বেডসাইড ল্যাম্প ছাড়া কোন আলো নেই। শাফায়াত বেশী আলো’তে ঘুমাতে পারে না। বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। বেশ রোমান্টিক পরিবেশ। নিশিতার ইচ্ছে করছে শাফায়াতের চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে। হাত বাড়াতে গিয়েও কি ভেবে গুটিয়ে নিলো। অভিমানে বুকটা ভার হয়ে আছে এখনও। এমন অপমান তাকে কেউ কোনদিন করেনি, যেটা শাফায়াত করেছে। এত সহজে নিশিতা ভুলে যাবে না সবকিছু। কফিটা ঢেকে রেখে নামাজের জন্য প্রস্তুত হতে গেলো সে।

সেদিন রাতে সকলের খাদ্য গ্রহণ পর্ব শেষ হতেই শাফায়াতের মা শাফায়াত’কে ডেকে পাঠালেন রুমে। মায়ের গলার স্বর বেশী সুবিধার লাগলো না তার কাছে। দেশসেরা কলেজের জাঁদরেল অধ্যাক্ষ মা’কে সে সমঝে চলে ছোট থেকেই। তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে নিজস্ব কিছু বোধও তার তৈরি হয়েছে, সেটাকেও অস্বীকার করে না সে। মা-ই সবসময় সঠিক, এমন যুক্তি আগে মানলেও এখন তার সেই বিশ্বাস শক্ত নেই আর। তাই মা’কে কিভাবে মোকাবেলা করবে, সে ব্যাপারে খানিকটা দুশ্চিন্তা কাজ করলেও ভয় করছে না সেভাবে, বুঝলো সে। রুমে ঢুকে মা’য়ের বিছানায় বসলো।

– ‘কিছু বলবে, মা?’
– ‘বলার জন্যই ডেকেছি। তোর সমস্যা কি আসলে?’ – কণ্ঠে যে বেশ বিরক্তি, বুঝতে পারলো শাফায়াত।
– ‘কোন সমস্যা নেই তো মা। কি বুঝাতে চাইছো আসলে?’ – যেন বুঝতেই পারছে না শাফায়াত, এমন ভাব ধরলো।
– ‘বউমা’কে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে থাকে সারাদিন। কান্নাকাটিও করেছে। এভাবে ওর হক নষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছে তোকে?’ – গম্ভীর মুখে সরাসরি প্রশ্ন করলেন শাফায়াতের মা।
– ‘মা, শোন। কথা বেশী বাড়াবো না। প্রথমত, এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, আমি তোমাকে বিয়ের আগেই সবকিছু শেয়ার করেছিলাম। আমার মত ছিল না, সেটাও জানতে। নিশিতা ভালো মেয়ে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তোমার কাছে হয়তো সৌন্দর্য কোন ম্যাটার করে না, তবে আমার কাছে করে। আর বিয়েটা আমার। তাই আমার মতামত সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ ছিল। আজকে বাবা বেঁচে থাকলে তিনি আমার কথাকেই গুরুত্ব দিতেন বলে আমার বিশ্বাস। আমাকে সবচেয়ে ভালো তিনিই বুঝতেন। কিছু মনে করো না, মা। তুমি কোনদিন আমাকে বুঝো নি, বোঝার চেষ্টাও করো নি।’ – এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো শাফায়াত।

এক জীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রী মানুষ করেছেন শাফায়াতের মা, সাফিয়া বিনতে সিদ্দিকী। অনেকে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে, অনেকে মানুষের বেশে আদতে অমানুষ হয়েছে। নিজের সন্তানকে গড়ে তুলতে গিয়ে ঠিক কোথায় ভুল করেছেন, আজ যেন সেই হিসেব মেলানোর পালা তার। পরিবারের প্রতি ছেলের দায়িত্ব পালনে কোনোদিন কোন ত্রুটি দেখেননি তিনি। মা হিসেবেও ছেলের থেকে সম্মান পেয়ে এসেছেন সবসময়। সেই সন্তান আজ এভাবে তার সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলবে, সহ্য করতে পারলেন না তিনি। সোজা এসে শাফায়াতের বাঁ গালে চড় বসিয়ে দিলেন।

শাফায়াত হতভম্ব। এই প্রথম মা তার গায়ে হাত তুললো !

– ‘কুলাঙ্গার ! তোর এত বড় সাহস ! তোর বাবা মারা যাওয়ার পর তোকে এই পর্যন্ত কে এনেছে? সব ভুলে গেলি? কি ভেবেছিস? অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস? এত উঁচুতে উঠেছিস যে কেউ তোর নাগাল পাবে না, তাই না? তোর বাবা কোনোদিনও অন্যায়কে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেননি। সেখানে এত বড় অন্যায় করার পরও ওনাকে টেনে এনে নির্লজ্জের মতো জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছিস? লজ্জা করে না তোর? – রাগে যেন ফেটে পড়লেন সাফিয়া।

‘আর কি বললি? সৌন্দর্যের কথা? দেখার জন্য চোখ লাগে, বুঝলি? নিজের দিকে একবারও তাকিয়েছিস যে আরেকজনের ব্যাপারে এভাবে কথা বলিস? কোনদিক থেকে কম তোর বউ? শিক্ষা, গুণে, দ্বীনদারী’তে – কোন দিকে কম? দেখতেও যথেষ্ট মায়াবী। যেভাবে অল্প সময়ে এই সংসারের সাথে মানিয়ে নিয়েছে, সেটা খুব কম মেয়ের পক্ষেই সম্ভব। যা পেয়েছিস, তার জন্য শোকর কর, বদমাশ ! নিশিতার মতো এত ভালো একটা মেয়েকে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকবি তুই? কক্ষনো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে তওবা কর। এভাবে তুই নিজেও ভালো থাকবি না, আমাদেরও ভালো থাকতে দিবি না। ভালো হয়ে যা। বউমা’কে আর কষ্ট দিস না। নইলে বিপদে পড়বি’ – শাফায়াতের মা’য়ের সতর্কবাণী ছেলের প্রতি।

এদিকে রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল নিশিতা। শাশুড়ি স্বামীকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর নিশিতা বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল। তাই অঘটনের আশংকায় রুমের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। যা ভেবেছিল, ঠিক তাই হলো। শাশুড়ির কথায় ভরসা পেলেও আসন্ন পরিস্থিতি কি হতে পারে, ভেবে শিউরে উঠলো সে।

এদিকে জীবনে প্রথমবারের মতো মা’য়ের এমন শাসনের ফল হিসেবে শাফায়াতের মধ্যে হয়তো কোন ভাবান্তর দেখা গেলো। তবে তার নীরবতা যে খুব একটা স্বাভাবিক নয়, সেটা বুঝতে পারলো তার মা। ছেলেদের এই মানসিক পরিবর্তনের সাথে তিনি পরিচিত। আর সব ছেলের মাঝে পরোক্ষভাবে হলেও বাবা’র ছায়া থাকেই। হয়তো সেই ছায়াটাই প্রকট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বিষয়টি দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলো সাফিয়া’কে।

Aditya Kingshuk

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here