বোধোদয়,তৃতীয় পর্ব

0
318

বোধোদয়,তৃতীয় পর্ব
ধারাবাহিক গল্প

জীবনে মাঝে-মধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন মানুষ নতুন করে নিজেকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে। শাফায়াতের মধ্যে হঠাৎ যে মানসিক পরিবর্তন এসেছে, সেটা আসলে মিশ্র অনুভূতির ফল। সেদিনের অপ্রত্যাশিত শাসনের পরও মায়ের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি সে। চড় খেয়ে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিতে দেরী করেনি। সাফিয়া যখন একের পর এক যুক্তি দিয়ে শাফায়াতকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করছিলেন, সবকিছু চুপচাপ শুনছিল সে। একটি কথাও বলেনি। বেশ কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরস্থির’ভাবে বললো,

– ‘তুমি সবসময়ই আমার থেকে ভালো বুঝবে, এটাই সত্য, মা। তবে কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। ভালো করেই জানতে, সম্মতি ছাড়া বিয়ে দেওয়াটা কোন যুক্তিতেই উচিৎ না। তুমি ভাবছো, একজন গুণবতী বউমা নিয়ে এসে জিতে গিয়েছো। এটাকে জেতা বলে না, মা। সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে তার প্রতি জুলুম করলে সৃষ্টিকর্তা ছেড়ে দিবেন না। আর সৌন্দর্যের ব্যাপারটি গুরুত্বহীন নয়, মা। মেয়েদের রূপও দুর্লভতম গুণ। তুমি সেটা বুঝবে না। হয়তো এটা আমারই ব্যর্থতা।’ – বলতে বলতে শাফায়াত বেরিয়ে যেতে নিলো রুম থেকে। যদিও তার কিছুক্ষণ আগেই দরজার পাশ থেকে সরে গিয়েছিল নিশিতা। ভেবেছিলো হয়তো কেউ তাকে খেয়াল করেনি। তবে শাফায়াতের নজর এড়ায়নি তার ছায়া।

মা’য়ের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিল সে। কপালের দু’পাশের রগ দপদপ করছে। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মা যে এভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, ভাবতে পারেনি। যেটা তার পক্ষে সম্ভব না, সেটা নিয়ে এত বেশী চাপ প্রয়োগ করা তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। কি করা যায়, ভাবতে লাগলো। নিশিতাকে দেখলে তার মাঝে কোন আগ্রহ বা ভালো লাগা কাজ করে না। এটা কি শুধুই ইগো? নাকি হৃদয়ের কোন গভীর কোণে এক চিলতে ভালো লাগা চুপটি করে বসে আছে? নাকি আসলেই সে চায় না নিশিতাকে? কিন্তু বিয়ের পর এভাবে দীর্ঘদিন এড়িয়ে চলা কি আদৌ সম্ভব? বিশেষ করে এমন কাউকে, যে সারাক্ষণ কাছেই থাকে? আর ভাবতে পারছে না শাফায়াত। এমন সময় দরজা খোলার শব্দে পাশ ফিরে শুলো সে।

নিশিতা রুমে ঢুকে দেখে পুরো রুম অন্ধকার। বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেখে শাফায়াত শুয়ে আছে। রেগে আছে, বুঝতে পারলো। কিছুক্ষণ আগের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, সেটা ভেবে ভয় লাগছে তার। একই সাথে ক্ষীণ এক আশাও ধরে রেখেছে। যদি মানুষটার মন একটু হলেও পরিবর্তন হয়। তাহলেই এই গুমোট পরিবেশ থেকে রেহাই পায় সে। তার যে দমবন্ধ হয়ে আসছে। তবে সে এটাও ভালো করে জানে, শাফায়াত নিজের বুঝে চলা মানুষ। অন্য কারও দ্বারা তেমন একটা প্রভাবিত হয় না। এতদিনে এটা অন্তত পরিষ্কার তার কাছে।

নিশিতা যে তার পাশে এসে বসেছে, চোখ বন্ধ অবস্থায়ও বুঝতে পারলো শাফায়াত। প্রতিটি মানুষের শরীরে এক ধরণের আপন করে নেওয়া গন্ধ থাকে। যা একান্ত কাছের মানুষটাই শুধু বুঝতে পারে। এই মুহূর্তে সে নিশিতার শরীরের সেই গন্ধটা পাচ্ছে। পাশ ফিরতেই একধরণের মন-মাতানো শুভ্রতা আরও বেশী করে অনুভব করতে লাগলো সে। চোখ না খুলেই হাত বাড়িয়ে নিশিতার বাঁ-হাতটা ধরলো সে। কেঁপে উঠলো নিশিতা। স্বামীর প্রথম স্পর্শ। কত যে আকাঙ্ক্ষার ! এই দিনটার জন্য কত অপেক্ষা তার। কোমল এক অনুভতি যেন শিহরন ছড়ালো শরীরে। চোখ মেলতেই দেখলো তার একদম কাছে বসে নিশিতা। চোখ বন্ধ মেয়েটার। তিরতির করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। যেন অপেক্ষা আরও কিছুর। অপেক্ষা নিজেকে সমর্পণের। ধীরে ধীরে নিশিতার মুখ নিজের মুখের দিকে এগিয়ে আনতে লাগলো শাফায়াত। তবে দু’জনার ঠোঁট এক হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মুখ সরিয়ে নিলো সে। নিশিতাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে এলো।

– ‘সরি। কোন এক ঘোরে ছিলাম হয়তো। মাথা কাজ করছে না আসলে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। কিছু মনে করো না’

নিশিতার যেন না পাওয়াটাই নিয়তি। অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো অবস্থা হলো তার। কিভাবে যে সে নিজেকে এই মুহূর্তে সামলে নিয়েছে, সেটা শুধু সে-ই জানে। নিজের স্বামী তাকে ভালোবাসা’র জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে, এমন দিনও তাকে দেখতে হলো। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে জানতে চাইলো,

– ‘বিনা অপরাধে এভাবেই শাস্তি দিতে থাকবে আমায়? একটুও কি মায়া হয় না আমার প্রতি? সত্যি করে বলো তো, একটুও কি ভালোবাসো না আমায়?’

কি বলবে শাফায়াত ? মনের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত থেকে আজ ক্লান্ত সে। ক্ষণিকের জন্য আবেগের কাছে পরাজিত হলেও তার মন তো আগের মতো নেই। হৃদয়ের একটা অংশ যে বারবার নিশিতার স্পর্শ চাইছে, তা অস্বীকার করবে কিভাবে সে? নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতা তেমন নেই বলেই কি এই অনুভূতি? নাকি স্ত্রী’র প্রতি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জান্নাতী ভালোবাসার ইঙ্গিত? একটু ভেবে বললো,

– ‘তোমার প্রতি আমার অনুভূতি নেই, এটাই এতদিন জেনে এসেছো। এখনও এটাই সত্য। সত্যি বলতে সেই মুহূর্তে নিজেকে চিনতে পারিনি। হয়তো এটা তোমার প্রতি নতুন কোন অনুভূতির কারনেও হতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত নই। আগেও বলেছি, কিছু আশা করো না। এখনও বলছি।’

নিশিতার কান্না এখনও থামেনি। তবে কমে এসেছে। ভালো করেই বুঝলো, শাফায়াতের মনের দরজা তার জন্য এখনও খুলেনি। চোখ মুছে ঠাণ্ডা গলায় বললো,

– ‘তোমাকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে বলি। তুমি যা করেছো, সেটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। কোনভাবেই মা’কে টেনে এনে নিজের ভুলকে জাস্টিফাই করো না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারে না, এটা কোন যুক্তিতেই মানা যায় না। আমার জীবন ও সময় এভাবে নষ্ট করার কোন অধিকার তোমার নেই। তাই আমি একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাই। যথেষ্ট হয়েছে। আর না। হয় এই সংসার থাকবে, নয়তো থাকবে না। ভেবো না, সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের বাজে চোখে দেখা হয় বলে আমি পিছিয়ে যাবো। আমার পরিবার আমার পাশে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস। কালই আমি বাবা-মা’কে আসতে বলবো।’ – বলেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। পেছনে রেখে গেলো ভালোবাসতে ব্যর্থ অথচ নিজের অন্যায় সিদ্ধান্তে অনড় এক পুরুষকে।

Aditya Kingshuk

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here