বোধোদয়,প্রথম পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
Aditya Kingshuk
বিয়ের পর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী’র প্রতি স্বামী একটু বেশী আগ্রহ দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে শাফায়াতের পক্ষ থেকে এমন কোন কিছু দেখতে না পেয়ে একটু অবাকই হয় নিশিতা। বিয়ের রাত থেকেই শাফায়াতের কেমন যেন নির্লিপ্ত স্বভাব। আপাতদৃষ্টিতে, বিয়েতে দু’জনের কারোরই অমত ছিল না। দুই পরিবারের সম্মতিতে সম্পূর্ণ অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ তাদের। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের আগে একবার দেখা ও আলাপও হয়েছে। শাফায়াত’কে তখন বেশ ভালোই লেগেছিল নিশিতার।
তবে শাফায়াতের বিষয়টি ভিন্ন। নিশিতা মূলত তার মায়ের পছন্দ ছিল। অত্যন্ত পর্দাশীল নম্র-ভদ্র, সংসারী মেয়ে। ঠিক যেমন তার মা চান এবং তার আগ্রহেই মূলত বিয়েটা হয়। যদিও শাফায়াতের কিছু ব্যাপারে ব্যক্তিগত পছন্দ ছিল যা তার মায়ের সাথে মিলেনি। তবে এক কথার মানুষ, মা’য়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার মতো সাহস থাকলেও অশান্তি করতে চায়নি সে। তবে এটাও সত্য, পুরো ব্যাপারটা মেনেও নিতে পারেনি মন থেকে।
সপ্তাহ পার হয়ে যায়। এর মধ্যে যে নিশিতা চেষ্টা করেনি, তা নয়। তবে শাফায়াত সচেতনভাবেই তাকে এড়িয়ে চলে। বইয়ের প্রতি শাফায়াতের ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক। কাজ থেকে ফিরে বই নিয়েই তার সময় কেটে যায়। একজন মানুষ যে তার ভালোবাসা পাওয়ার আশায় সর্বক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকে, সেটা যেন তার খেয়ালই থাকে না।
তবে একদিন নিশিতার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে। সেদিন একটু তাড়াতাড়িই কাজ থেকে ফিরে যথারীতি বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলো শাফায়াত। নিশিতা বাসার কাজ সেরে শাফায়াতের কাছে এসে বসে। তার স্থির দৃষ্টি শাফায়াতের দিকে। ব্যাপারটা খেয়াল করে শাফায়াত। বইয়ের দিকে চোখ রেখেই প্রশ্ন করলো,
– ‘কি দেখছো এভাবে?’
– ‘তোমাকে’।
– ‘আগে মনে হয় দেখোনি?’ – মুচকি হাসলো শাফায়াত।
– ‘তোমার কি মনে হয়, আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক?’ – সরাসরি প্রশ্ন নিশিতার।
– ‘অস্বাভাবিক কিছু তো ঘটছে না’ – শাফায়াতের চোখ এখনও বইয়ের দিকে।
নিশিতা’র রাগ বাড়ছিলো। চট করে শাফায়াতের হাত থেকে বইটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো বিছানার অপর পাশে। ঘটনা জটিল বুঝতে পারলো শাফায়াত। তবে বইয়ের প্রতি এমন আচরণ মানতে পারলো না। যদিও মাথা ঠাণ্ডা রাখলো।
– ‘এসবের মানে কি?’ – শীতল কণ্ঠ শাফায়াতের।
– ‘তোমার কোন ধারণা আছে কি করছো তুমি?’ – রাগে যেন ফেটে পড়লো নিশিতা।
– ‘কিছুই করছি না। যে যার মতো আছি।’
– ‘নিজের মতো থাকার জন্যই বিয়ে করেছিলে? আমার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই তোমার?’
– ‘কে বলেছে নেই? বিয়ে মানেই সারাজীবনের দায়িত্ব গ্রহণ। তোমার সমস্ত আর্থিক-সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আর কি চাও?’
– ‘আমার অধিকারের কোন মূল্য নেই তোমার কাছে? বিয়ের পর এতোগুলো দিন হয়ে গেলো। একদিনও আগ্রহ দেখিয়েছো আমার প্রতি? ভালোবেসে কাছে টেনেছো একবারও?’ – নিশিতার চোখে অশ্রু।
শাফায়াতেরও যে খারাপ লাগছে না, এমন না। কিন্তু তার ভেতরের জেদ তাকে ভেঙ্গে পড়তে দিলো না। মায়ের প্রতি তার ক্ষোভ সহজে যাবে না। মাঝখান থেকে তার স্ত্রী কষ্ট পেতে থাকবে, যদিও এই ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। ইগো তাকে অন্ধ করে দিয়েছে, বেশ বুঝতে পারলো।
– ‘কেঁদো না। সমস্যাটা একটু জটিল। তবে তোমাকে বুঝিয়ে বললে বুঝবে আশা করি।’ – নিশিতার অশ্রু মুছে দিলো শাফায়াত।
– ‘বেশ, তাহলে বুঝিয়ে বলো।’
– ‘ ঠিক আছে। শোন। বিয়ে নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তাধারা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সবসময় শারীরিক ও মানসিক সৌন্দর্য, দু’টোর গুরুত্বই সমান। যে কোন একটাকেও কম্প্রোমাইজ করা আমার জন্য কঠিন। একজন ভালো মানুষ অথচ দেখতে তেমন সুন্দর না, এমন কাউকে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে কখনও চাইনি। এখন পর্যন্ত তোমাকে যতোটা দেখেছি, তুমি অবশ্যই একজন ভালো মেয়ে। ধার্মিক, সংসারী, পর্দা মেনে চলো, আমার পরিবারকেও আপন করে নিয়েছো। সবই ঠিক আছে। কিন্তু..’
– ‘কিন্তু কি?’ – নিশিতার কণ্ঠে কৌতুহল।
– ‘নিরপেক্ষ দিক থেকে বিচার করলে তুমি চোখে পড়ার মতো সুন্দরী নও। আবার এটা ভেবো না যে আমি তোমাকে অপমান করছি। আল্লাহ্র সব সৃষ্টিই সুন্দর। আমি শুধু আমার প্রেফারেন্স শেয়ার করলাম।’
ভেতরটা কষ্টে ফেটে গেলেও নিশিতা নিজেকে সামলে নিয়েছে এতোক্ষনে। শাফায়াতের কিঞ্চিৎ হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো,
– ‘এসব তোমার বিয়ের আগে ভাবা উচিৎ ছিল। বিয়েটা কোন ছেলেখেলা না।’
– ‘মা’কে শেয়ার করেছিলাম। মানাও করেছিলাম। কোনভাবেই রাজী হলেন না। ওনার ধারণা, তুমি বাড়ির বউ হিসেবে যোগ্যতম। সেই সাথে আমাকেও ভালোভাবে গুছিয়ে রাখতে পারবে। তোমার গুণ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই আমার। যথেষ্ট দায়িত্ববান তুমি। ঠিক কোন জায়গায় আমার সমস্যা হচ্ছে, সেটা আশা করি বুঝতে পেরেছো। অবশ্য, আরেকটা কারণও আছে।’
নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও নিশিতা টের পেলো তার ভেতরের ক্ষোভ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তবে মাথা গরম করে পরিস্থিতি জটিল করলো না। সিদ্ধান্ত নিলো, পুরোটা শুনবে। শাফায়াত একটু থেমে আবার বললো,
– মোহরানা’র ব্যাপারে তোমার পরিবারের সিদ্ধান্ত ভালো লাগেনি আমার। আমি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি, মোহরানা একান্তই স্বামী-স্ত্রী’র ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তোমার পরিবার জোর করে বিশাল মোহরানার ভার চাপিয়ে দিয়েছে আমার উপর। এই মোহরানা আমার কয়েক বছরের আয়ের সমান। কিভাবে এখন শোধ করবো, বলো? ভেবেছিলাম, বিয়ের রাতেই তোমাকে পুরোটা শোধ করবো। কিন্তু পারলাম না।’ – শাফায়াতের কণ্ঠে স্পষ্ট আফসোস।
– ‘এখানে আমার দোষটা কোথায়?’
– ‘তোমার দোষ, তুমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করো নি। তোমার উচিৎ ছিল এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার পাশে থাকা। মোহরানা সবসময় স্বামী’র সামর্থ্য অনুযায়ী হওয়া উচিৎ। নইলে এটা ভবিষ্যতে অনেক বড় দায় হিসেবে থেকে যায়। অবশ্য, তোমার দোষ দিয়ে কি হবে? আমার মা’ই তো আমার দিকটা একটুও ভাবেননি। আমার পছন্দ-অপছন্দের কোন মূল্যই তিনি দেননি। হয়তো মা হিসেবে নিজের এতকালের অবদানের হিসেব মেলালেন। মাঝখান দিয়ে তোমার-আমার সম্পর্কটা ঝুঁকিতে পড়ে গেলো।’
– ‘এভাবে বলো না। মা নিশ্চয়ই সন্তানের অমঙ্গল চান না।’
– ‘অমঙ্গল চান না, সেটা জানি। তবে বিয়ের মতো সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ ছেলের অমতে গিয়ে নিজের গোঁয়ার্তুমি বজায় রাখাটা কোন ধরণের কল্যাণ কামনা করা?’ – শাফায়াতের ক্ষোভ টের পেলো নিশিতা।
– ‘রিয়্যাক্ট করো না। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। মা’কে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকা যায় না। অনেক সময় সৃষ্টিকর্তা বাবা-মা’য়ের মাধ্যমে এমন অনেক কিছু আমাদের দান করেন, যার মর্ম আমরা সেই মুহূর্তে বুঝি না, কিন্তু পড়ে ঠিকই মনে হয়, যা হয়েছে, এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারতো না।’ – নিশিতা ঠাণ্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করে।
– ‘তাই নাকি? এ বাড়িতে এসেছো ২ সপ্তাহও হয়নি। এখনই শাশুড়ি মায়ে’র পক্ষ নেওয়া হচ্ছে? ভালো।’ – শাফায়াতের বিদ্রুপ।
– ‘উনি আমার শাশুড়ি হলেও তাকে নিজের মা’য়ের চাইতে কোন অংশে কম মনে করি না। আর মা’য়েদের কোন পার্থক্য হয় না। মা সবসময় মা’ই হয়।’
নিশিতার কথা শেষ হতেই শাফায়াত উঠে দাঁড়ালো। চোখেমুখে তখনও রাগের ছাপ। বিছানার অন্য প্রান্তে পড়ে থাকা বইটা তুলে নিয়ে বললো,
– ‘যা বলার বলে দিয়েছি। তোমাকে মেনে নেওয়া আমার জন্য কঠিন হবে। একজন মানুষ, যাকে আমি ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন, প্রতি বেলা দেখবো, তার শারীরিক সৌন্দর্য আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত চাহিদা। এই ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই দয়া করে আর বিরক্ত করো না আমাকে। কোন কিছু আশাও করো না’ – এটুকু বলেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। একবারও নিশিতার দিকে তাকালো না।
এই অবস্থায় ভেঙ্গে পড়াটা যে কোন মেয়ের জন্যই স্বাভাবিক। তবে নিশিতা একটু আলাদা ধাতুতে গড়া। এটা পরিষ্কার যে, ওর সামনে কঠিন লড়াই। তবে সে যে মানসিকভাবে শক্ত, সেটা তার পরিচিত সবাই স্বীকার করে। শাফায়াতকে সে বোঝাবে বাইরের সৌন্দর্যটাই আসল নয়, অন্তরের সৌন্দর্যটাই আসল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো নিশিতা।