বোধোদয়,চতুর্থ পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
Aditya Kingshuk
সেদিন ছেলেকে যথেষ্ট বুঝানোর পরও সাফিয়া’র দুশ্চিন্তা গেলো না। শাফায়াত কিছু ব্যাপারে যথেষ্ট একগুঁয়ে ও অবুঝ। চেষ্টা করেও তার সিদ্ধান্ত বদলানো যায় না সহজে। ভালো মনে করে ছেলের জন্য যোগ্য বউ আনলেও এখন তাকে হারানোর ভয় পেয়ে বসলো সাফিয়া’র মনে। শাফায়াতের বাবা বেঁচে থাকলে আজকে এমন অন্যায় হতে দিতেন না কখনও। জীবনের সবচেয়ে আপনজন, স্ত্রী’কে শুধুমাত্র বাইরের সৌন্দর্যের কারণে এত অবহেলা করে কেউ? অথচ কি মায়াবী চেহারা মেয়েটার। মানুষ করতে পারেননি ছেলেকে, বুঝলেন। তবে কিভাবে সবকিছু ঠিক করবেন, ভেবে পেলেন না।
ওদিকে শাফায়াতের ক্রমাগত প্রত্যাখ্যানে কেমন যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলো নিশিতা। বিশেষ করে সর্বশেষ যে ঘটনা ঘটলো, এরপর তো আর কোনভাবেই সন্দেহ থাকে না যে শাফায়াত মানসিকভাবে অসুস্থ। নইলে স্বামী-স্ত্রী’র এত আকাঙ্ক্ষিত শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও তার কাছে বিষের সমতুল্য মনে হবে কেন? বিয়ের প্রথম রাত থেকেই নিশিতার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো শাফায়াতের অনীহা। পরে জিজ্ঞেস করে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েও আত্মসম্মানকে একপাশে সরিয়ে রেখে ভালোবাসতে চেয়েছিল মানুষটাকে। আশায় ছিল, সৃষ্টিকর্তা হয়তো তার স্বামীর হৃদয়ে পরিবর্তন আনবেন। হয়তো কোনও এক দিন শাফায়াত নিজের ভুল স্বীকার করে কাছে টেনে নিবে। দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ার অধিকার তো সবারই থাকে। সেখানে নিশিতা শাফায়াতকে একের পর এক সুযোগ দিয়েই গিয়েছে। বিয়ে পরবর্তী রাতগুলোতে তার কান্নার সাক্ষী সৃষ্টিকর্তা। এরপরও কোন পরিবর্তনের দেখা পেলো না। উল্টো তাকে অপমানিত হতে হলো। স্বপ্ন ধরা দিতে গিয়েও ধরা দিলো না।
এভাবে যে চলতে পারে না, সেটা বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে চূড়ান্তভাবে কিছু একটা করবে। এমনিতেও গভীর রাতে ব্যালকনিতে বসে জোছনার দিকে তার নির্নিমেষ চেয়ে থাকাটা চোখ এড়ায়নি তার শাশুড়ি মা সাফিয়া’রও। স্বামীর ভালোবাসা বঞ্চিত একজন নারী’র যন্ত্রণা কতোটা, সেটা নারী হিসেবে তার না বোঝার কথা নয়। একজন নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় ভরসার স্থান তার স্বামী। অথচ এত ভালো মেয়ে হয়েও নিশিতার জীবনে সেই ভরসা যেন ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
অন্যদিকে শাফায়াতের মধ্যেও এক ধরণের দ্বন্দ্ব শুরু হলো যেন। সেই মুহূর্তের পর থেকে নিশিতার স্পর্শ যেন এখনো সজীব তার শরীরে। মাতাল করা এক ঘ্রাণ যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। বুঝতে পারছে তার মন একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিসের ইশারা এসব? তার মনে পড়ে গেলো, শেষ রাতের দিকে নিশিতার কান্না’র কথা। সৃষ্টিকর্তার কাছে এত আকুল হয়ে নিজের ভালোবাসাকে ভিক্ষা চাইতে পারে, এমনটা সে দেখেনি আগে। তবে নিশিতা যেমন কোমল, তেমনই হয়তো কঠোর। অন্তত সেই রাতে যা বললো, সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে শাফায়াতের এই যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি আসন্ন। তার তো স্বস্তিতে থাকার কথা। কিন্তু কেন যেন স্বস্তি পাচ্ছে না সে। নিজের এমন পরিবর্তনে বেশ অবাক হলো শাফায়াত।
–
পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। নিশিতার মুখ গম্ভীর। চোখের নিচে কালি। কেঁদেছে বেশ বোঝাই যাচ্ছে। শাফায়াত তাকাতে পারছে না কেন যেন নিশিতার দিকে। হয়তো একধরণের অপরাধবোধে। সাফিয়ার মনও ভার। সবাইকে নাশতা পরিবেশন করে নিজের আসনে বসলো। সাফিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘তুমি কিছু নিলে না, মা? নাশতা করবে না?’
– ‘ইচ্ছে করছে না, মা।’ – মৃদু স্বরে বললো নিশিতা।
– ‘তোমার অবস্থাটা বুঝি, মা। চেষ্টা তো কম করলাম না। লাভ কিছু হলো, বলো? কুলাঙ্গার সহজে বদলায় না। ওকে আমি ঝাঁটাপেটা করবো একদিন, দেখে নিও।’ – জ্বলন্ত চোখে ছেলের দিকে তাকালেন সাফিয়া।
শাফায়াত যেন আজকে সব মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে। কিভাবে নিশিতার কাছে, মায়ের কাছে নিজেকে ব্যাখা করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। তার এমন দোলাচলের মাঝেই নিশিতা বলে উঠলো,
– ‘মা, আপনাকে আগেই বলেছিলাম, আপনি যদি আপনার ছেলেকে বোঝাতে না পারেন, তবে আমাকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। কারও সমস্যার কারণ হতে চাই না। আর এভাবে তো দু’টো জীবন নষ্ট হওয়ার মানে হয় না। আপনি হয়তো ভালো মনে করেই আমাকে এই সংসারে এনেছেন। তবে যে উপলক্ষ, সে-ই যখন চায় না, তখন আর নিজেকে অপমানিত হতে দিবো না। এটা তো শুধু আমার একার অপমান নয়, আমার পরিবারও এখানে জড়িত। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি চলে যাবো। বাবা-মা’কে রাতেই জানিয়েছি। ওনারা কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবেন।’
শাফায়াত যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলো না। বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকলো নিশিতার দিকে। নিজের স্ত্রী’কে এড়িয়ে চলার যে বজ্রকঠিন প্রতিজ্ঞা এতোদিন তাকে অমানুষ করে রেখেছিল, আজ যেন এক কথায় সব প্রতিরোধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। সাফিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। নিশিতার হাত দু’টো জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বললেন,
– ‘তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, তাই না, মা? আসলেই মানুষ করতে পারিনি ছেলেকে। আমারই ব্যর্থতা। বিশ্বাস করো মা, কোনোদিন কষ্ট পাইনি এই ছেলের থেকে। এতোটুকু কষ্ট কোনোদিন দেয়নি সে। অথচ আজ কি দেখতে হচ্ছে আমাকে? এত পাষাণ কিভাবে হলো আমার ছেলে? খোদাই ভালো জানেন। ক্ষমা করে দিও, মা’ – কণ্ঠে গভীর হতাশা সাফিয়ার।
– ‘দয়া করে এভাবে বলবেন না, মা। আপনি আপনার সর্বোচ্চ করেছেন। যে বদলানোর নয়, তার থেকে কোন কিছু আশা করাও ঠিক নয়। আমারই ভুল, মা। বোকার মতো ভালোবেসেছিলাম। ভাবিনি এভাবে শাস্তি পেতে হবে।’ – নিশিতার কণ্ঠ আজ আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত।
– ‘এভাবে একা করে যেও না আমাকে, মা।’ – সাফিয়ার কণ্ঠে অনুনয়।
– ‘জীবনে মাঝে মাঝে প্রাপ্তির মর্ম কি, সেটা বোঝার দরকার হয়, মা। নইলে অনুভূতিগুলো সহজেই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আপনাকে ছেড়ে যাবো না মা, কথা দিলাম। তবে আজকের মতো আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিন, মা। যদি সত্যিই আমার ভালো চান।’ – নিশিতার কথা শেষ না হতেই কলিংবেল বাজলো।
–
নিশিতার বাবা, সুফী আকন্দ, একজন সাবেক অধ্যাক্ষ। মেয়েকে মানুষ করার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি রাখেননি। মায়ের মতোই গুণবতী হয়েছে মেয়ে। বিয়ের পর যতবারই মেয়ের সাথে তার কথা হয়েছে, সবসময় চেষ্টা করেছেন মানসিকভাবে মেয়ের পাশে থাকার। নতুন পরিবারে কিভাবে মানিয়ে নিবে মেয়ে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও নিশিতার মায়ের অগাধ আস্থা মেয়ের প্রতি। স্ত্রী’র আত্মবিশ্বাস তাকেও প্রভাবিত করেছিলো গতকাল রাতের ফোনটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত। মেয়েটা বাবা-ভক্ত ছোট থেকেই। ফোন দেওয়ার আগে যে ভালোই কেঁদেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি তাঁর। তবে স্ত্রী’কে কিছু জানাননি। প্রেশার বাড়তে পারতো। সকালে স্ত্রী’র কাছে জরুরী কাজের নাম করে চলে এসেছেন বেয়াইনের বাসায়। ফোনটা পাওয়ার পর দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হয়নি তেমন রাতে।
দরজা খুলে বাবা’কে ড্রইংরুমে বসালো নিশিতা। পরিবেশ থমথমে, বুঝতে পারলেন সুফী সাহেব। নিশিতাই মুখ খুললো,
– ‘তোমাকে কাল রাতে সবই বলেছি, বাবা। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে নেই আমার। ব্যাগ গোছানোই আছে। তুমি একটু বসো, আমি তৈরি হয়ে আসছি। আশা করি, তুমি বাঁধা দিবে না।’
– ‘আরেকবার ভেবে দেখো, মা। এভাবে আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিও না।’
– ‘আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবা। তুমি চাইলে ওর সাথে কথা বলতে পারো। তবে তাতে কোন লাভ হবে না।’
কথা বলতে বলতেই সাফিয়া’র আগমন। কুশল বিনিময় শেষে বললেন,
– ‘কি বলবো আসলে, ভাই। ক্ষমা চাওয়ার মতো মুখ নেই আমার। ছেলেটা আমার আসলে ভীষণ একগুঁয়ে। এতভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, শুনলোই না। এতো লক্ষ্মী একটা মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিতে একটুও অনুশোচনা কাজ করলো না তার। কি যে ভাবে নিজেকে।’
– ‘ছিঃছিঃ বেয়ান, এভাবে বলবেন না, প্লিজ। আপনি যা করেছেন আমার মেয়ের জন্য, সবই জেনেছি আমি। একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমি কি একটু কথা বলে দেখবো জামাইয়ের সাথে?’
– ‘ভালোই হয়। একটু দেখেন তাহলে কথা বলে, ভাই। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।’
–
নিশিতার বাবা আসার পর শাফায়াত নিজের রুমে চলে এসেছিল। নিশিতা যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিবে ফাইনালি, সেটা ভাবতে পারেনি। পুরো বিষয়টিই মানতে পারছে না এখনও। যদিও সে যা করেছে, এর প্রতিক্রিয়া এমন না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক হতো, বিশেষ করে নিশিতার মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারীর ক্ষেত্রে। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে এতদিন। কষ্ট জমে অভিমানের পাহাড় হয়ে গিয়েছে ভেতরটা। কিভাবে সে সামাল দিবে পরিস্থিতি? ভাবতে ভাবতেই নিশিতা ঘরে এসে ঢুকে। কোনদিকে না তাকিয়ে তৈরি হওয়ার রুমের দিকে যেতেই পেছন থেকে নিশিতার হাত ধরে তাকে আটকায় শাফায়াত। তবে মাথা নিচু। সে অবস্থায়ই বলে,
– ‘এভাবে চলে যাচ্ছো যে?’
– ‘কেন যাচ্ছি, সেটা ভালো করেই জানো। সিন ক্রিয়েট করো না।’ – কড়া স্বরে বললো নিশিতা।
– ‘তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশের ভাষা আমার নেই। সকাল থেকেই ভাবছিলাম, তোমাকে সরি বলবো। যা হয়েছে, সবকিছুর জন্য। আমি আসলে অমানুষের মতো অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এতোটুকু উপলব্ধি ছিল না নিজের। তুমি যে আমায় কতোটা ভালোবাসো, সেটাও উপলব্ধি করত পারছি, বিশ্বাস করো। এভাবে আমায় রেখে চলে যেও না।’ – শাফায়াতের কণ্ঠে মিনতি।
জীবন যে কতো অদ্ভুত, সেটা আরও একবার দেখলো নিশিতা। তবে তার কিছুই করার নেই। কখনও কখনও নিজের মূল্য নিজেকেই বুঝতে হয়। অন্য কেউ না বুঝলেও। সেটাই নিজের প্রতি নিজের সম্মান। শাফায়াতকে সে ভালোবাসে। আর এই ভালোবাসার মর্যাদা রাখতেই সে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেন অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই প্রাপ্তির পূর্ণতা পাওয়ার প্রচেষ্টা।
– ‘যত কিছুই বলো না কেন, লাভ হবে না। সিদ্ধান্তে কোন নড়চড় হবে না। আমার এত বছরের সাজানো স্বপ্ন তুমি ধ্বংস করে দিয়েছো। বিয়ের পর শুধু স্বামীকে ভালবাসবো বলে সব আবেগ-অনুভূতি জমিয়ে রেখেছিলাম। বিনিময়ে শূন্যতা ছাড়া আর কি পেলাম? কিচ্ছু না। এভাবে অপমানের প্রয়োজন ছিল না।’ – নিশিতার একেকটা কথা যেন আজ চাবুকের বাড়ি ! নিজেকে বেশ অসহায় লাগছে শাফায়াতের। নিশিতাকে কিসের জোরে আজ থামাবে সে? অস্বীকার না করলেও মন থেকে তো মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে গত রাতে নিশিতাকে কাছে টেনেও ভালোবাসায় না ভরিয়ে প্রত্যাখ্যানের পরই হয়তো বোঝা হয়ে গিয়েছে সম্পর্কের শেষ আশাটুকুও আর অবশিষ্ট নেই।
নিশিতা হাত ছাড়িয়ে চলে যেতেই রুমের বাইরে সাফিয়া’র ডাক শুনতে পেলো শাফায়াত। রুম থেকে বের হতেই সাফিয়া গম্ভীর স্বরে বললেন,
– ‘ড্রইংরুমে যাও। বেয়াই তোমার সাথে কথা বলতে চান।’
শাফায়াত যে আজ চোখে চোখ রেখে কথা বলবে, সেটুকু মানসিক শক্তিও হারিয়েছে। তার শ্বশুর বেশ সজ্জন মানুষ। এমন অমায়িক ভদ্রলোক দ্বিতীয়টি দেখেনি সে। তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। নিশিতা কি বলেছে তার বাবাকে, জানে না শাফায়াত। তবে আজকের আচরণ যে অনেকটাই ভিন্ন হবে, সেটা নিশ্চিত। তাছাড়া সে তো নিজের কাছেই বড় অপরাধী। মুখোমুখি বসতেই সুফী সাহেব এগিয়ে আসলেন। শাফায়াতের চেহারা মলিন। ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে যেন। সুফী সাহেব হয়তো কিছুটা টের পেলেন শাফায়াতের মানসিক অবস্থা। তবে অবাক হলেন না। মেয়ের অপমান তাকেও ভেতরে ভেতরে কঠিন করে তুলেছে। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
– ‘নিশিতা আমাকে সবই বলেছে। এরপরও আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
– ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, বাবা। বিয়ের পর থেকে নিশিতার প্রতি যে অন্যায় করেছি, তার প্রায়শ্চিত হয়তো করতে হবে আমাকে। এরপরও আপনাকে বলছি, মন থেকে আমি অনুতপ্ত। নিশিতাকে আমি প্রথমে পছন্দ করিনি, সেটা সত্য। তবে দিন দিন তার ভালোবাসার বাঁধনে যে জড়িয়ে পড়েছি, সেটা আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে। আজ বলতে কোন দ্বিধা নেই আমার, আমি তাকে হারাতে চাই না।’ – শাফায়াতের কণ্ঠে হাহাকার।
সুফী সাহেব কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না। নিশিতা তাকে যা বলেছে, পুরো বিপরীত পরিস্থিতি এখন। শাফায়াতের ব্যাপারে যা শুনেছেন তিনি, কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। এভাবে তো আরও জটিল হয়ে উঠবে পরিস্থিতি। কি বলবেন ভাবতে ভাবতে নিশিতার ডাক কানে এলো,
– ‘এসো, বাবা। আমি তৈরি।’
– ‘এখানে এসে বসো একটু, মা।’ – সুফী সাহেব মেয়েকে কাছে ডাকলেন।
– ‘বলো, বাবা। বেশী দেরী করবো না। মা চিন্তা করবে।’
ততক্ষনে নিশিতার পিছু পিছু সাফিয়াও হাজির হয়েছেন। সবার উপস্থিতিতে সুফী সাহেব বললেন,
– ‘এখানে দু’জনই আছো। তাই কিছু কথা বলি। শাফায়াতের কথা শুনে মনে হলো সে যা করেছে, সেজন্য অনুতপ্ত। আরেকটা সুযোগ সে আশা করছে। বিবাহিত জীবনে কম্প্রোমাইজ ও স্যাক্রিফাইস – দু’টোর গুরুত্বই আছে এবং সেটা দুই পক্ষকেই করতে হয়। একপাক্ষিক প্রচেষ্টা খুব কমই সফল হয় সংসারে। আমি আমার মেয়েকে কোন কিছু চাপিয়ে দিবো না। যদি তার মনে হয় সে যা করছে, সেটা যৌক্তিক, তাহলে সেটাই মেনে নিবো। বিয়েটা তার, সিদ্ধান্তও তার হওয়া উচিৎ।’
সাফিয়া ভেবেছিলেন নিশিতার বাবা মেয়েকে বোঝাবেন। যখন দেখলেন, তিনি মেয়ের ওপরেই সব ছেড়ে দিলেন, তখন ক্ষীণ আশাটুকুও যেন মিলিয়ে গেলো তার। নিশিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাকিয়ে রইলো শাফায়াতের দিকে। অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সে। এরপর নিশিতা বললো,
– ‘ভাগ্যকে দোষ দিবো না আমি, কারণ মানুষ যা করে, সবই কর্মফল। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করি মাত্র। এই ক’দিনে এই সংসারকে যেভাবে আপন করেছি, সেভাবেই চেষ্টা করেছি ওকে আপন করতে। সৃষ্টিকর্তা সাক্ষী। শুধু একটু ভালোবাসাই চেয়েছিলাম। খুব বেশী কিছু তো চাইনি। জীবনের চাহিদাগুলো ছোট করে নিয়ে এসেছিলাম। তবুও না পাওয়ার দলেই নাম লেখালাম দিনশেষে। এখন আর দুঃখ করি না। কখনও করবোও না। মেনে নিলাম, এটাই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ছিল।’ – নিশিতা চেষ্টা করলো নিজেকে শক্ত রাখতে।
সুফী সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। উঠতে উঠতে শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ‘নিজের সন্তান বলে বলছি না। নিশিতার মতো মেয়ে দুর্লভ। ঠুনকো কারণে যে নেয়ামত পেয়েও হারালে, এজন্য যেন সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ক্ষমা করেন। আমি কথা দিতে পারছি না সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, তবে যা করেছো, এজন্য শাস্তি তোমার প্রাপ্য।’
সাফিয়া যেন আজ পাথর। হীরের টুকরো বউমা’কে এভাবে ছেড়ে দিতে হচ্ছে, কোনভাবেই মানতে না পারলেও কিছু করার নেই তাঁর। সুফী সাহেব বেয়াইন’কে বললেন,
– ‘আমি চেষ্টা করবো, আপা। ওর মা কি রিঅ্যাক্ট করবে, জানি না। তবে নিশিতা শেষ পর্যন্ত কি চায়, সেটাই মুখ্য। আমি নিশ্চিত, কোন অবিবেচক সিদ্ধান্ত নিবে না সে। দোয়া রাখবেন।’
নিশিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি এগুচ্ছি, তুমি আসো, মা।’ – বলেই বেরিয়ে গেলেন।
নিশিতা শাশুড়িকে সালাম করে জড়িয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। নিজের মায়ের মতো আপন এই বৃদ্ধা যে তার কতোটা জুড়ে রয়েছে, সেটা শুধু সেই জানে। অশ্রু বাঁধ না মানতে চাইলেও জোর করে নিজেকে শক্ত রাখলো সে। বেরিয়ে আসার সময় শাফায়াতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। শাফায়াতও তাই। তবে আজ প্রথমবারের মতো তার জন্য শাফায়াতের চোখে হালকা অশ্রুবিন্দু দেখতে পাওয়াটাই যেন তার পরম পাওয়া। ভেতরের দুর্বলতাকে পাত্তা না দিয়ে এই দৃশ্য থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। তবে শেষ মুহূর্তে হয়তো একটু হলেও প্রাপ্তি তার সঙ্গী হলো।