সৎ_মা #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৭

0
349

#সৎ_মা
#মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৭

কি যে ঝড়ের বেগে চলছিলো দিনগুলো। জীবণের বাস্তবতার করুন রূপ আমি দেখেছিলাম সেই দিনগুলোতে। আমি মায়ের হাত ধরে কেঁদে বলেছিলাম মা আমার জন্য আজ তুমি ঘর ছাড়া, আমাকে তুমি মাফ কোরো না মা।
মা ও আমাকে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলো সেদিন।

আমার বাবা এক কথার মানুষ, তিনি যা বলেন তাই করেন। বাবা বলেছিলেন আমি এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিলে বাবা মায়ের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করবেন। আমি বুঝলাম না আমার করা ভুলের জন্য মা কেন তার সংসার হারাবে….!
এটা কেমন বিচার। তবুও বাবাকে এসব কিছুই বলতে পারিনি। শেষে যখন সবদিকেই টানাপোড়েন তখন হাতের সুতাটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। যদিও ঘুড়িটা আগেই কেটে গিয়েছিলো। তবুও নাটাই হাতে বসে ছিলাম মিথ্যে আশা বুকে নিয়ে। কেন যে বুঝিনি সুতাে কাটা ঘুড়ি কখনো ফিরো আসে না। ঝড়ের সেই দিনগুলো যেন কাটছিলোই না,একেকটা দিন কাটানো যেন একেকটা পাহাড় ডিঙ্গানো সমান কষ্টের।

সব ঝড়ই থামে, আমাদেরটা ও থেমে ছিলো।
যেই মা আমার অগোছালো জীবণটাকে গুছিয়ে দিয়েছে অকৃত্রিম মায়া আর ভালোবাসায় তার জন্য আমি নিজের ভালোবাসাকে উৎসর্গ করেছিলাম। মা তাই খুব অপরাধবোধ করতেন এজন্য । আমি মাকে সহজ করার চেষ্টা করতাম।

জেনি এখন ইতালি থাকে। বিয়ের পর প্রায়ই ফোন করতো আমার ফোনে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করতাম জেনি এমন ভাবে কথা বলতো যেন কিছুই হয়নি, সব যেন আগের মতো। কঠিন এই পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা হয়তো ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশী তা আমি জানি, তবে জেনির একটু বেশীই বেশী।

মনে মনে ভাবলাম পিছুটান রেখে কি লাভ কষ্ট পাওয়া ছাড়া,
আমি জেনিকে একদিন কথার ফাঁকে বললাম
-জেনি, তুমি আমাকে আর ফোন কোরো না, তোমার বর কি না কি ভেবে বসে,
– আরে না, কি ভাববে, ও অনেক ভালো মনের একটা মানুষ, He trust me…
– He trust you, but he Doesn’t trust me…
– জেনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়ছিলো সেদিন, এরপর আর কথা হয়নি কখনো….

কষ্ট ছিলো সে দিনগুলোতে। জীবনকে অর্থহীন মনে হতো। বেঁচে থাকার কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। একটু সাহস যদি থাকতো তাহলে আমি ঠিকই আত্ম*হত্যা করতাম। তাছাড়া ধর্মে ও আত্ন*হত্যা মহাপাপ।

এরপর জীবণ ধীরে ধীরে ভালোই কাটতে লাগলো, তবে রাতগুলোর গভীরতার সাথে সাথে আমার কষ্ট গুলোও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যেতো সমানুপাতিক হারে। আস্তে আস্তে মন সামলে নিলাম আমি…..

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম নিজেই জানি না। সকালে দাদী ঘরে এসে ঘুম থেকে তুলে বললেন
– কি অবস্থা তোর হাতের…
– ভালো দাদী বসো বসো…
– আমি কি তোর বৌ দেখে মরতে পারুম নারে…
– আহ্ দাদী, একথা বলতেই কি এতগুলো সিড়ি ভেঙে এসেছো এখানে…
– হ…
– সকাল সকাল শুরু করলা…

হাতের অবস্থা এখন একটু ভালো, তবে বাড়ির পরিবেশ বেশী ভালো না। গতকাল রাতে সীমান্ত বাড়িতে ফিরে নি। মা তাই চিন্তিত। আমি ভাঙা হাত নিয়েই ওর খোঁজ করতে বের হলাম। ও তো এমন কখনোই করে না, ব্যাপারটা অাসলেই চিন্তার। ফোনটাও কাল রাত থেকেই বন্ধ। ওর বন্ধুর কাছে খবর পেলাম ও নাকি বন্ধুদের সাথে পটুয়াখালী গিয়েছে।

বাড়ি ফিরে মাকে খবরটা জানিয়ে বললাম চিন্তা না করতে। আমি দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমাতে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির অবস্থা থমথমে, মা দাদীর ঘরে কাঁদছে।
বাবা আবার মায়ের গায়ে হাত তুললো না তো, তাই আমি আঁড়ি পেতে শুনবার চেষ্টা করেছিলাম, মা কাঁদছে আর বলছে-
– নিজের সন্তান কিভাবে পারলো এটা করতে, অন্যের সন্তান মানুষ করছি, আর নিজের পেটে ধরছি একটা অমানুষকে।
দাদী ধার কন্ঠে বলছেন
– কাইন্দোনা তো বৌ, কান্দার কি হইছে, পোলা বিয়া করছে এটা তো খুশির খবর।
জবাবে মা বললো
– মা আপনিও আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন। আমার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করছেন না। সৎ ছেলে হয়ে নিজের পছন্দ কোরবানি করলো সৎ মায়ের সংসার বাঁচানোর জন্য, আর নিজের পেটেরটা কবর খুড়লো মার জন্য। এখন আমি কি করবো, কিছুই মাথায় ঢুকছে না, ওর বাবা এসব শুনলে আমাকে খুনই করে ফেলবো।

এ কথার শেষ হতেই আমি দাদীর ঘরে ঢুকলাম। মা আমাকে দেখে মুখ আড়াল করে বের হয়ে গেলেন। আমি দাদীর কাছে সব শুনলাম। মনে মনে হাসলাম বড় ভাই যা পারে নি, ছোট ভাই তা করে দেখালো৷

সবার কথার ধরন শুনে বোঝা যাচ্ছিলো এসব ব্যাপারে আমার মা এবং ভাইয়ের উপর রাগ করা উচিত। বিশেষ করে ফুফু আর চাচীরা। তাদের কে আমি এড়িয়েও যেতে পারছিলাম না হাত ভেঙ্গে বাড়িতে বসে থাকার কারনে।

তবে একজন বড় ভাইয়ের যা করা উচিত আমি তাই করেছিলাম। পুরো ব্যাপারটা আমি পানির মতো সোজা করে দিয়েছিলাম। তবে বাবার শর্ত আমার বিয়ের আগে বৌ ঘরে তুলতে পারবে না। কিন্তু বৌ তো বাবার বাড়িতে ফিরে যেতেও পারবে না। কারন সবাই জানাজানি হয়ে গেছে মেয়ে পালিয়েছে।

অবশেষে আমার ঘর ছেড়ে দিলাম ওদেরকে। সীমান্ত এতদিন থাকতো দাদীর ঘরে। এখন বৌ নিয়ে তো এভাবে থাকা যায় না, তাই আমিই আমার রুমটা ছেড়ে দিয়েছিলাম ওদেরকে। এজন্য অবশ্য বাবা আর মায়ের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। বাবা বেচারা আমার জন্য রাগ দেখাতে পারছে না।

শেষমেষ আমার জায়গা হলো ড্রইং রুমে। এত বড় আমি দাদীর সাথে থাকতে পারবো না তাই….
বাবা অবশ্য পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদেরকে চলে যেতে বলেছেন। দেওয়াল ভেঙে বড় একটা ফ্ল্যাট বানাবে। কিন্তু ভাড়াটিয়া যাবে তিন মাস পর। তাই এই তিন মাস আমার জায়গা হলো ছাদের ট্যাংকির পাশের ঘরটাতে। ঘরটা বানিয়েছিলেন দারওয়ান এর জন্য। সবাই অবশ্য না বলেছিলো, আমিই জোর করে উঠেছিলাম আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে।

সত্যি বলতে আমার একেবারেই যে খারাপ লাগে নি তা না…
আমার খারাপ লেগেছিলো, তবে আমার আগে বিয়ে করেছে তার জন্য না, অজানা এক কারনে মন খারাপ ছিলো।

দাড়ওয়ানদের জন্য তৈরী বলে ঘরটাতে একটা দীন ভাব ছিলো। তবে আমার কাছে ছাদের গাছ, চাঁদের আলো, টিনের চালে বৃষ্টির পানি পরার শব্দ, এসবের জন্য ভালোই লাগতো। তবে দিনের বেলা ঘরটা একেবারে তেতে থাকতো গরমে।

হাত ভাঙা বলে যখন তখন নিচে যেতে পারি না, হাতের ব্যাথা পুরো শরীরকে কাবু করে ফেলেছে এই এক সমস্যা। দাদী বহু কষ্টে পাঁচ তলা বেয়ে আমাকে দেখে যেত একবার করে। আমি বহুবার নিষেধ করা সত্ত্বেও আসে, ভালোবাসার টানে। তাই আমি আর নিষেধ করি না। ভালোই লাগে এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা পেতে…

চলবে….
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/904242666703592/
Next
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/906403153154210/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here