সৎ_মা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৩৫(শেষ পর্ব)

0
443

#সৎ_মা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩৫(শেষ পর্ব)

প্রায় মাস খানিক পর অামার বড় মা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। মিমো আর প্রসূন তাঁকে দেখে এসেছেন। আমি ইচ্ছে করেই যাই নি….

ইদানীং আমি ডুবে আছি ভীষণ বিষন্নতায়। কোন কিছুই এখন আর ভালো লাগে না। নিজেকে ইউজলেস মনে হয়। মনে হয় বেঁচে থাকা মানে ঋণের বোঝা বাড়ানো। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন ক্রমাগত বাড়িয়েই চলছে সেই ঋণ।

এই বিষন্নতা থেকে আমি আমাদের দ্বিতীয় সন্তানের অগমনেও উৎরে উঠতে পারলাম না। আল্লাহ আমাদেরকে একটা পুত্র সন্তান দান করলেন। এজন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমরা তার নাম রাখলাম মৌন….

মৌন এক্কেবারে ওর নামের মতোই। মিমো খুবই জিদ্দি, রাগি, আর সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা একজন। আর মৌন ঠিক ওর বিপরীত। সারাদিন একা একা খেলে। টাইম টু টাইম ওকে খাইয়ে দিলে যে কেও ওকে রাখতে পারে। কিন্তু মিমো যখন হয়েছিল তখন মা রাত জেগে ওকে রাখতেন। সারারাত ও ক্যাওক্যাও করতো। মৌনর দাদী নেই, তাই মৌণকে যেন সেই বুঝ দিয়ে পাঠানো হয়েছে পৃথিবীতে।

এতকিছুর পরও মনে কেন যেন কোন অানন্দ কাজ করছিলো না আমার। প্রসূনের সাথে কথা বলি না প্রায় মাস খানিক। এমনকি ও জীবণের সাথে যুদ্ধ করে যখন ও মৌনকে পৃথিবীতে এনেছে তখনও না।

তারমানে এই না যে আমি ওকে ভালোবাসি না কিংবা আমি দায়িত্ব জ্ঞানহীন। আমি এখনো ওকে ভালোবাসি, ওর সব দায়িত্ব পালন করি শুধু অভিমানে কথা বলি না।

কারনটা ভীষণ করুণ….
প্রসূন যখন ছ’মাসের প্রেগন্যান্ট তখন ওর আর আমার একটা ফালতু ইস্যু নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়, যার কারনে ও ব্যাগেজ গুছিয়ে মিমোকে নিয়ে রাজশাহী চলে যায়।

এত কিছু বোঝার একটা মেয়ে যখন সামান্য ইস্যু নিয়ে ঝগড়া বাধায় আর তাকে পুঁজি করে বাবার বাড়িতে চলে যায়, তাহলে আমি কেন আমার জায়গাতে অন্য কেও থাকলেও তা সহ্য করতে পারতেন না।

আমি আগে মজার ছলে ওকে কম করে হলেও একশ বার বলেছি-
ঝগড়া লাড়াই যা করার করবা বাড়ি বসে…
ঐ ছিঁচকাদুনেদের মতো তল্পিতল্পা নিয়ে বাবার বাড়ি যাবা, আর আমি তোমার বাবার বাড়ির সামনে তোমাকে নিতে ঘুরঘুর করবো এটা ভুলেও ভাববা না…

বাড়ি ছেড়ে ঝগড়া করে যদি একা বের হও ফিরতেও হবে তোমাকে একা। আমি কিন্তু জীবনেও আনতে যাবো না। কথাটা মাথায় রেখো। সবসময় উত্তরে ও হেসে বলতো
– একা যাওয়া আমার বয়েই গেছে….

ও চলে যাওয়ার চারদিন কোনরকমের যোগাযোগ করতে পারি নি আমি। মাকে বলে গেছে ওর খারাপ লাগছে কয়েকদিন ঘুরে চলে আসবে। আমার দূরদর্শী মা অবশ্য ঠিকই ধরেছেন ব্যাপারটা। তিনি ওকে আনতে রাজশাহী গিয়েছিলেন, ও ফিরে নি। আমি জিদ করে বসে আছি, ও কি ফেলনা নাকি..! আমি না যাওয়া পর্যন্ত ও ফিরবে না। মাকে বলে বুঝিয়েছে আপনার ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েন।

আমরা দুজনই দুজনের সীদ্ধান্তে অটল। কিন্তু মা প্রতিদিনই আমাকে বোঝাতেন অসুস্থ মেয়েটা, এ সময় এতো কিছু মনে রাখা ঠিক না, লোকে কি বলবে… এমন আরো অনেক কথা বলে আমার ব্রেইন ওয়াশ করেছেন তিনি। এমনই করে কেটে গেছে মাস দেড়েক……

শেষে আমার মন গললো অনাগত সন্তানের কথা শুনে। প্রেগন্যান্সির শুরু আর শেষের দিকে জার্নি হার্মফুল দুজনের জন্যই, তাই এখন না আনলে একেবারে বাবু হওয়ার মাস খানিক পর ছাড়া আনা যাবে না। তাছাড়া তারও নাকি দিন কাটে না।

সব ভুলে আমি রাজশাহী গেলাম রাতের গাড়িতে। পরদিন ওদেরকে নিয়ে ফিরবো। আমার শ্বশুর আমার মান ভাঙতে যত রকম কসরত আছে সবই করলেন। আমার অভিমানের সব পাহাড় গুড়িয়ে গেলো আমার মেয়ে মিমোর কাছে এসে জড়িয়ে ধরায়। আধো আধো বুলিতে বাবা ডাক আর আমার বুকের সাথে মিশে থাকার ব্যাপারটা। আমি চোখ বন্ধ করে সেই অনুভব জমা করলাম মনের ব্যাংকে।

আমি সবাইকে বললাম আজই চলে যাবো। কিন্তু তারা আমাকে ফিরতে দিলেন না। ঐ না ফেরাটাই কাল হলো আমার।

সেদিন সন্ধ্যায়ই বাড়ির মিনি বুয়া ফোন করে আমাকে জানায় মা নাকি অসুস্থ কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি সেই মুহূর্তে রওনা দিলাম ঢাকায়। তখন ঢাকাগামী কোন ফ্লাইট না থাকায় গাড়িই হলো একমাত্র ভরসা৷ প্রসূনের মা আমাকে বললো – এ সময় সন্ধ্যা করে ওর যাওয়া ঠিক হবে না, তুমি যাও কাল ওর বাবার সাথে ফিরবে নি।

এতকথার কিছুই বুজলাম না তখন। আমি শুধু এটুকুই বুঝলাম আমার ঢাকায় ফেরা জরুরী। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে শুনি পরিবহন মালিক সমিতির ধর্মঘট। খুনি ড্রাইভারের যাবজ্জীবন সাজার প্রতিবাদে। আমি এক্কে বারে দিশেহারা। কি করবো কিছুই বুঝছি না। শেষে এক ছেলের মোটরসাইকেলে করে আসলাম কিছু পথ আর বাকীটা পথ আসলাম এম্বুলেন্সে করে। আর নদী পাড় হলাম স্পিডবোটে করে। ধর্মঘট আমার কাছে ছিলো শাপে বরের মতো, অন্য সময় হলে এত কম সময়ে কোন দিনও আসা যেত না। যদিও পথে খুব নাজেহাল হতে হয়েছে।

ঢাকায় যখন আসি তখন রাত এরোটা, ততক্ষণে সব শেষ। আমার মা মারা গেছেন।

মিনি বুয়া কাঁদছে আর মায়ের মৃত্যুর বর্ণনা দিচ্ছে- খালায় দুপুর বেলা বলতাছিলো মিনি আমার ভালো লাগছে না, শুয়ে থাকবো কাজ শেষ করে তুমি খেয়ে নিও। আমাকে একটু পানি দিয়ে যেও। সেই পানও খাইয়া খালায় ঐদিক ফিরে শুইলো। ঐ পানিই হের শেষ খাওয়া। বিকালবেলা ফোনের উপ্রে ফোন আসতাছে খালায় ফোন ধরে না। আমি বাইরে থেইক্কা কই ও খালা ফোন ধরেন না কেন….

খালায় কেন ফোন ধরে না আমি তা জানতে ঘরে গিয়ে দেহি খালা টান হইয়া শুইয়া চাইয়া আছে কিন্তু জবান বন্ধ ৷ কাইন্দা আন্মি আমি ছোড ভাইর কাছে গেলাম। তাগোরে না পাইয়া ফোন দিলাম বড় ভাইরে…
হেয় হের ফুবুরে ফোন দিয়া আনাইলো…
হেরপরও খালায় আছিলো, সন্ধ্যার পরেই….

সীমান্ত ছেলে মানুষ হয়েও মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছে। দ্রুত আসার জন্য সবাই তাগাদা দিয়েছে কিন্তু আমাকে কেওই জানায় নি তার মৃত্যুর খবর।

আমি একেবারে পাথর হয়ে গেলাম, পাগলের মতো করতে থাকলাম আমার মৃত মাকে নিয়ে। সবাই ব্যাস্ত তার শেষকৃত্য করতে। যতদ্রুত মুর্দা মাটি দেয় ততই কম আজাব হয়।

আমি কাওকে মার কাছে ভীড়তে দিলাম না। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে সবকিছু করলাম, এমন যেন কিছুই হয় নি।
আত্মীয়দের সবাইকে খবর দিলাম, আমার মা মারা গিয়েছেন। এদিকে আমার বড় মা অসুস্থ শরীরে তাকে দেখতে সেই রাতেই উপস্থিত, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে যখন তার সাথে আসা মেয়েটা আমাকে খুঁজলেন তখন আমি বের হয়ে দেখি তিনি এতটাই অসুস্থ যে ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছেন না, পরে যাচ্ছেন….

আমি তাঁকে ধরতে যেতে যেতে তিনি সিঁড়িতে বসে পরলেন। আমি তার কাছে গিয়ে তার সাথে আসা মেয়েটাকে রেগে বললাম – তাঁকে কেন এনেছো এখানে, তিনিই তো কত অসুস্থ…

বড় মা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন –
: ওকে বকা দিও না, ও আসতে দিতে চায় নি, আমিই জোড় করে…

আমি তাকে তুলে নিচে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসলাম, তার সাথে রাগ করলাম না, কারন মরা বাড়িতে তো শত্রুও আসে…
আর তিনি তো…..

সবাই কাজে ব্যাস্ত আর আমি আমার মায়ের পাশে বসা।আমার মা মরে গেছে কয়েক ঘন্টা চলে গেছে কিন্তু কি সুন্দর চেহারা, মনে হচ্ছে তিনি ঘুমিয়ে আছেন…
এখনি বলবে- এই মিনি আমার তেলের বোতলটা খুঁজে পাচ্ছি না, একটু খুঁজে দাও তো…

হঠাৎ করেই আমি উঠে দাঁড়ালাম, আমার ঘরে দৌড়ে গিয়ে ফোন খুঁজতে থাকলাম। মিনিট সাতেক খুঁজে সেটাকে পেলাম সাইড টেবিলের ড্রয়ারে, মিনি বুয়া সব ফোন এখানে রেখে দিয়েছেন। পুরো বাড়ি মানুষে ভরতি তাই হয়তো…

আমি ফোন হাতে নিয়ে কল দিলাম আমার ফুফাকে…
জিজ্ঞেস করলাম বড় মায়ের ব্ল্যাড গ্রুপ কি…
এরপর যা হলো সব ঝড়ের গতিতে….

আপনারা কি কিছু বুঝতে পরেছেন…..
.
.
.
.
.

হুম আপনারা ঠিকই ধরেছেন, আমার বড় মা বেঁচে গিয়ে ছিলেন আমার সৎ মায়ের জন্যে । তার কিডনি আর লিভার দেয়া হয়েছিলো বড় মাকে, যা আমার মায়ের ইচ্ছে ছিলো-
এই তো সেদিন তার জীবন-মৃত্যুর সংকটের কথা শুনে বলেছিলেন- তার আগে যদি আমার মরণ হয় তার যা যা লাগে আমার থেকে তাকে দিয়ে দিও…
মা কি মন থেকে এটাই চাইতেন…
বেঁচে থাকা এতটা দুঃসহ কেন হয়েছিল,
কেন তিনি তাঁকে বাঁচাতে এমন কথা বলেছিলেন,
এটা কি বলার জন্য বলা নাকি ছিলো মহত্ত্ব….

আর এজন্য আমাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিলো সীমান্তর সাথে, শেষে ডাক্তার যখন ওকে বোঝালো ওর মা বেঁচে থাকবে আরেক জনের মধ্যে, তখন ও ঠান্ডা হলো। কিডনি দান করার ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম। সব ম্যাচিং হলেই দেয়া যাবে। কোনো একটা ঝামেলা হলে দেয়া যাবে না। বিশেষ করে- ব্লাড গ্রুপ, HLA, ব্লাড ভেসেল পজিশন। হোয়াট এ মিরাকল আমার দুই মায়ের সবই এক, ব্লাড গ্রুপ, আর.এইচ.ফ্যাক্টর, মেডিকেল হিস্ট্রি।

এত ঝড় ঝাপটা সামলে আমার মাকে মাটি দেওয়া হলো দ্বিতীয় দিন বিকেলে। মায়ের জানাজায় কোত্থেকে যে এত মানুষ এসেছিলো আমি জানিনা। কোন জানাজায় এত মানুষ একসাথে আমি জীবনেও দেখি নি। সব কিছু শেষ করে আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন আমার হুদিস হয় কি ঘটে গেছে আমার সাথে। এতক্ষণ যেন আমি কিছুই বুঝি নি।

আজিমপুর কবরস্থান থেকে বাড়ি ফিরে আমি গোসল করে খাটে বসলাম । তখন আমার মনে হতে লাগলো আমার সব শক্তি শেষ। এক কদম ও পা ফেলবার শক্তিও নেই আমার। আমি যখন বিপদে পরতাম মা সবসময় বলতেন জীবণে যখন খারাপ সময় আসবে তখন এসবকে পাত্তা না দিয়ে তুমি তোমার করনীয় করবে, কাঁদতে হলে বিপদ পেরিয়েই কেঁদো। এ কথা ভাবতেই আমার চোখের পানি রক্ষার যে বাঁধ আমি দিয়েছিলাম গত তিনদিনে তা ভেঙে গেলো। দড়জা আটকে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলাম আমি।

তখন থেকে আমার মনে হতো প্রসূন যদি এমনটা না করতো, আমি যদি ওকে আনতে না যেতাম তাহলে আমার মা মারা যেতেন না…. আমি কাছে থাকলে কিছু একটা করে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম…

ঠিক কত সময় কেঁদেছি তা আমি জানি না। ফুফু এসে দড়জায় নক করতে করতে একসময় চলে গেলেন, আমার চোখে আমি অন্ধকার দেখলাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। গত তিনদিনে আমার উপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের প্রভাব একে একে হানা দিতে থাকলো শরীরে।

পরদিন ঘুম ভাঙলে আমি জ্বরের শরীরেই গেলাম আমার মায়ের ঘরে। মায়ের ঘরে ঢুকতেই প্রথমে ড্রেসিং টেবিল তারপর তিন কপাটের বিশাল আলমারী, এক কোণে খাট তার বিপরীতে ওয়ারড্রব। সেখানে আমাদের সবার ছোটবেলায় একসাথে তোলা ছবি। সেখানে আমার মায়ের কোন ছবি নেই।
মা অবশ্য তেমন ছবি তুলতেন না। ছবি খুঁজতে আমি আলমারী খুললাম। থরে থরে সাজানো সবকিছু। এক কপাটে শুধু শাড়ি গুলো ঝোলানো, বাবা নেই বছর কয়েক হলো তবুও বাবার কাপড়গুলো কত যত্নে আছে এখনো। শীতের কাপড়গুলো মাঝখানের কপাটে সাজানো। প্রতিটা শাল আর গায়ের চাদর জিপ লক ব্যাগে রাখা। কোণে কোণে গুজে রাখা ন্যাপথলিন। আমি কাপড়গুলোতে হাত বুলালাম, এখানে আমার মায়ের স্পর্শ আছে, প্রথম কপাট থেকে একটা শাড়ি বের করে আমার বুকে জড়িয়ে রাখলাম। তখন আমার মনে হচ্ছিলো এই শাড়িটাই আমার মা…, আমার চোখের পানিতে হলুদ রঙের শাড়িটা ভিজে গিয়েছিলো।

আমার মায়ের জায়নামাজ, তজবি, ড্রেসিংটেবিলের এক কোণে রাখা, তেলের বোতলটা হাতে নিয়ে বলি একমুহূর্ত তেল না দিয়ে থাকা মা টা এখন আছে কিভাবে সেখানে, সেখানেও কি তার মাথা ঘুরাচ্ছে তেল না দেওয়ার কারনে।

ওয়ারড্রবের এক কোণে কোরআন শরীফ রাখা, পড়ার বই গুলোর একটা বই উল্টানো। বইটার নাম-“রিয়াদুস সালেহীন ”
বইটা আমি হাতে নিয়ে দেখি ৩৪ নং পৃষ্ঠা ভাজ করে রাখা, চিহ্ন দেওয়া এ পর্যন্ত পড়া তাই হয়তো….

আচ্ছা তিনি কি জানতেন এটা তার আর শেষ করা হবে না…
বইটাকে বন্ধ করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে কাঁদলাম, মা কোথায় আছেন আপনি….

হঠাৎ পেছন থেকে প্রসূন আমার কাধে হাত রেখে বললো –
: আপনি আর এমন করবেন না ,
মা সব দেখছে, আপনার কষ্ট দেখলে মা ও কষ্ট পাবে….

আমি চোখ মুছলাম, ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম –
আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী।
তুমি এমন না করলে,
তোমাকে আমি নিয়ে আসতে যেতাম না,
আর সেখানে না গেলে আজ আমার মা বেঁচে থাকতেন।

প্রসূন বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,
যেন ও ওর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না…

তুমি আমার সামনে আসবে না, তোমাকে যেন আমার দৃষ্টির ত্রিসীমানায় না দেখি, যদি দেখি তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো….

উত্তরে প্রসূন শুধু কাঁদল,
আর আমি আমার মায়ের ঘরে থাকা শুরু করলাম। মিমো থাকে আমার সাথে, আর মিনি বুয়া প্রসূনের সাথে থাকে।

প্রসূন সত্যিই আমার সামনে আসতো না, আমি মায়ের ঘরের ভিতর নিজের দুনিয়ায় বুদ হয়ে থাকতাম। আমি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। দৈনন্দিন কাজের পর মায়ের ব্যাবহার্য জিনিস দেখাই যেন আমার কাজ শেষে একখন্ড অবসর। মিনি বুয়াকে আমি বলে রেখেছি – মার ঘরের যেই জিনিস যেভাবে আছে সেভাবেই যেন থাকে। কারন আমার মনে হয় মা আছেন আমাদের আশেপাশে, কোন জিনিস ওলটপালট দেখলেই হয়তো রাগ করে বলবেন-
মিনি এটা কোন কাজ হলো বলো..?
যাও এক্ষুনি এটাকে ঠিক করে নিয়ে আসো….

সারা পৃথিবী যখন সৎ মায়ের বিপক্ষে কথা বলে, আমার বলা কথা গুলো সত্যিই হারিয়ে যাবে তাদের কথার ভীড়ে। কারন আমি সৌভাগবান একজন। যাকে আপন মা ফেলে গেলেও সৎ মা বুকে টেনে নিয়েছিলো পরম মমতায়। আমি আজও আমার স্মৃতিতে আমার মাকে খুঁজি। গভীর রাতে চোখের পানি ফেলে মনে মনে বলি- মা আজও আপনাকে অনেক ভালোবাসি, আপনার জায়গা সবার প্রথমে,যা কেও কোনদিন নিতে পারবে না।

পুনশ্চ :
প্রসূনের সাথে আমার শীতল সম্পর্কটা একসময় ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে, ওর চুপ থাকা, আমার সামনে না আসায় ওর অপরাধবোধ ফুটে উঠেছিলো, প্রসূন একটিবারের জন্যও আমার কাছে আত্মাপক্ষ সমর্থন করতে আসে নি, আমার দেওয়া অপবাদ মাথা পেতে নিয়েছে। মৌন পৃথিবীতে আসার অনেক অনেক পর আমাদের এই দূরত্ব ঘুচতে থাকে।
আর সীমান্ত…..
মা কে হারিয়ে খাওয়া ধাক্কায় বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে ওর। মাঝে মাঝে ওকে দেখলে মনে হয় মা যদি দেখতেন তার বখে যাওয়া ছেলেটা কত ভালো হয়ছে আজকাল। মা আমাকে কখনোই ওর ব্যাপারে দায়িত্বের কথা বলে নি। শুধুমাত্র একটি কথাই বলেছিলো ও যখন মালমা মোকদ্দমা নিয়ে ঝামেলায় পরলো তখন- “তুমি ওর পাশে তুমি অবশ্যই দাঁড়াবে তুমি ছাড়া ওর কেও নেই পাশে দাঁড়ানোর” একটা বাক্যেই বুঝিয়েছেন কত দায়িত্ব ওর প্রতি আমার। আমি সেটাকেই পালন করার চেষ্টা করি।
আর আমার বড় মা..
তিনি হসপিটালে থাকার সময় থেকে কতবার আমাকে ডেকেছেন, আমি যাইনি, এমনি আমার মায়ের মৃত্যুর আজ এত বছর চলছে আজ অবধি আমি তার কাছে যাই নি, কেন যেন মনে হয় আমি সেখানে গেলে আমার মা কষ্ট পাবেন। ঠিক যেমনটি বিয়ের কার্ড নিয়ে যাওয়ার দিন পেয়েছিলেন। পাক্কা দেড় ঘন্টা গাড়ির কাঁচ আটকে গরমের ভিতর আমার ফিরবার অপেক্ষায় গাড়িতে বসে ছিলেন, কখন আমি ফিরবো তার জন্য। সেদিন হয়তো তার অনেক কষ্ট হয়েছিলো আমাকে সেখানে পাঠাতে….

The End..

previous :
.https://www.facebook.com/659404701187391/posts/927865364341322/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here