সৎ_মা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৩২

0
273

#সৎ_মা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩২

আমার মায়ের দুঃখের বোঝা বাড়তে বাড়তে এমন এক অবস্থায় চলে গেছে যে তার ভিতরে যে একটা মন আছে তার অনু পরমানু জায়গাও এখন আর খালি নেই, সব জায়গা চলে গেছে কষ্টদের দখলে। বাইরে থেকে গাম্ভীর্যের পাহাড় যা ঘিরে রাখা এক অদৃশ্য দেওয়ালে, আর ভিতরে তিনি বড্ড অসহায় আর একা। তিনি তার সবটুকু জ্ঞানের খরচ করেছেন অদৃশ্য এই দেয়াল তৈরীতে।

এভাবেই দিন চলতে থাকলো। একদিন হঠাৎ বড় মায়ের ফোণ এলো, তিনি ভীষণ অসুস্থ সংকটাপন্ন অবস্থা হসপিটাল ভর্তি দিন পনের হবে । শরীরের কোন ভাইটাল অর্গান নাকি ড্যামেজ। একটিবারের জন্য প্রসূন আর মিমোকে নিয়ে যেতে। আমি প্রথমে মায়ের সাথে কথাটা বললাম। মা কিভাবে নিলো বুঝলাম না, তবে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো- ইশ্ আল্লার লীলা-খেলা বোঝা খুবই মুশকিল, তার সব ঠিকঠাক আছে, কিন্তু তিনিই বেঠিক।
আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দিক, আমীন…
আমিও তার দিকে তাকিয়ে থেকে অস্পষ্ট ভাবে বললাম – আমীন।

রাতে মা’ই প্রসূনকে বলে রেখেছেন হসপিটাল যাওয়ার কথা। প্রসূন এতদিন এমন এক ভান ধরে ছিলো যে ও এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। আসলে ও শুরু থেকেই সব জানতো। পাছে আমি কষ্ট পাই তাই কখনো বলতো না এইসব ব্যাপারে।

আমরা তাঁকে দেখতে গেলাম দুদিন পরে। বিকেলে যাওয়ায় লোকটা হসপিটালেই ছিলেন। কত বছর পরে দেখলাম তাঁকে। সালাম দিয়ে অবচেতন মনে বলে ফেললাম – ফুফা ভালো আছেন….

এই লোকটাকে আমি ভীষণ পছন্দ করতাম। বাবার চেয়েও, মাঝে মাঝে আহনাফের সাথে কথা হতো তোর বাবা যদি আমার বাবা হতো…. তাহলে অনেক মজা হতোরে….

আমার কথা বলার সময় হয়তো পৃথিবীর কোন এক প্রান্তের আকাশে রাতের তারা খসে পরছিলো। তাই তো আমার ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে গেলো। সম্পর্কে তিনি এখন আমার সৎ বাবা।

আমার ফুফা ডাক শুনে তার মুখ লুকানোর মতো অবস্থা। আমি কিন্তু তাকে লজ্জা দিতে বলিনি। এমন এক পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিলো আমার মেয়ে মিমো, ওর মার কোল থেকে নিচে নামার জন্য কান্না জুড়ে দিলো। লোকটা মিমোকে কোলে নিতে হাত বাড়ালেন। মিমোও ওমনিই হুমড়ি খেয়ে তাঁর কোলে চলে গেলো। তিনি মিমোকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন,আর আমাদের কথা বলার স্কোপ করে দিলেন।

প্রসূন মার পায়ের কাছে বসলেন, সালাম করলেন পা ছুঁয়ে। মা ইশারায় বললেন কাছে এসে বসতে। আমি তার দিকে তাকতেই পারছিলাম না। মাত্র বছর কয়কে যুগের পরিবর্তন হয়েছে তার শরীরে। রোগ মানুষকে বুড়িয়ে দেয়।

প্রসূন যখন তাঁর সামনে বসলেন তিনি হাত দিয়ে ওকে ছুঁয়ে দেখলেন, যেন তার চোখ নেই, হাত দিয়ে ছুঁয়েই তাই তার দেখার চেষ্টা। একেবারে আস্তে করে কথা বলছে। দুই হাত দূরে বসা আমিও শুনতে পেলাম না তাদের কথপোককথন।

একটু পর দেখলাম মার বাম চোখ বেয়ে পানি পরছে গড়িয়ে, কিন্তু তার মুখে খুশির অবয়ব।

আমি কাছে গেলাম বেশ কিছুক্ষণ পর। আমার কাছে আসা দেখে প্রসূন মেয়ের অযুহাতে বাইরে চলে গেলো। মা-ছেলেকে একটু একা থাকতে দিলো। আমি কিছুই বলতে পারলাম না, সব বলে দিচ্ছিলো আমার অবাধ্য চোখ গুলো। আমি মার হাতদুটো স্পর্শ করলাম। এতবছর পর মাকে ছুঁয়ে দেখা, তবুও নিজের মতো করে ছুঁতে পারলাম না, তার হাতে বিদ্ধ ক্যানোলার জন্য।

কাজটা আমাকে করতে হলো খুব সাবধানে। তার হাত ধরে আমি আমার ঠোঁটের কাছে নিলাম। মাথা নিচু করে রাখলাম চোখের পানি লুকাতে। আর মা তার আরেক হাত দিয়ে আমার গিজগিজ করা চুলগুলো নেড়ে দিলেন। কত দিন কত বছর পর এমনটা হলো তার হিসেব করতে হলে এখন খাতা কলম নিয়ে বসতে হবে।

বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো তার সাথে। উদয় এখন দেশের বাইরে আছে। স্টাডি ভিসায় গিয়েছে ছ’মাস ও হয়নি। রাতে উদয়ের বাবা আর দিনে তিনি যখন কাজে যান তখন এক বুয়া তার সাথে থাকেন।

এত বড় পরিবারের একজন হয়েও আজ কতটা একা। কারো সাথেই সম্পর্ক নেই তাদের। দুই পরিবারের কোনটার সাথেই।
তিনি এমন এক কাজ করে বসেছেন যে আজ তার পাশে কেওই নেই।

তিনি মিমোকে কোলে নিতে না পারার জন্য হাউমাউ করে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। লোকটা পাশে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, বার বার বলতে থাকলো- কেঁদোনা তুমি সব ঠিক হয়ে যাবে….

ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লাগলো। বাবা মায়ের এমন বন্ধন আমি দেখে অভস্ত্য না তাই হয়তো…

এরপর আমরা চলে আসলাম। মা বললেন আমি হয়তো বাঁচবো না বেশী দিন, তোমার কাছে একটা চাওয়া আছে,
তুমি আমার কবরের প্রথম মাটিটা দিও…
আমি মার হাত ধরে বললাম – আরো অনেকদিন বাঁচতে হবে আপনাকে, নাতনিকে বিয়ে দিবেন না…
মার চোখে পানি তবুও এ কথা শুনে হেসে দিলেন তিনি।

বাড়ি ফিরে দেখি পুরো বাড়ি অন্ধকার। বাতি জ্বেলে ঢুকতেই মা বললো কে দিগন্ত এসেছো…!
আমি তার ঘরে গিয়ে বললাম – মা আপনি কি অসুস্থ…!
আরে নাহ্ সন্ধ্যার আগে শুয়েছিলাম, উঠে যে বাতি জ্বালাবো আলসি লাগছিলো। তারপর বলো তোমার মা এখন কেমন আছেন….

কথাটা কেন যেন কানে বাজলো আমার। কানে লাগার মতো কথা যদিও না, তবে কেন লাগলো বুঝলাম না। তিনি কিই বা বলতে পারেন এর পরিবর্তে….!

চলবে…

previous : https://www.facebook.com/659404701187391/posts/925402517920940/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/926977714430087/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here