প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,০৬,০৭

0
389

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,০৬,০৭
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৬|

সিঁড়ির নিচে ঝাপসা অন্ধকার। জমিয়ে রাখা পরিত্যক্ত জিনিসগুলোতে ছাড়পোকার গন্ধ। আমি দুরুদুরু বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে আমার থেকে হাত দুয়েক দূরে। দুজনের মাঝেই আকাশ সমান নীরবতা। কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করছি না। আমার গা অন্ধকারে অদৃশ্য প্রায়। ধ্রুবর গায়ে এসে পড়ছে এক মুঠো স্বচ্ছ আলো। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ধ্রুব একমনে সিঁড়ির দিকে চেয়ে আছে। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে সে আর এই আবছা সিঁড়ি ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। আমার অস্তিত্ব সেখানে কল্পনা মাত্র। মনে মনে আমি অত্যন্ত সাহসী বালিকা। চট করে রেগে যেতে পারি। কিন্তু ধ্রুবর সামনে রাগ দেখানো যাচ্ছে না। ধ্রুব অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কথা বলে মেপে মেপে। চোখের দৃষ্টি শান্ত। ভাবখানা এই, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে রেগে যাওয়াও চলবে না। সেই রাগ সে বরদাস্ত করবে না। আমি কয়েক মিনিট স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে উশখুশ করে উঠলাম। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই ধ্রুব আমার দিকে চাইল। আবির যতটা সরল দৃষ্টিতে তাকায় ঠিক ততটাই জটিল দৃষ্টি দিয়ে সে আমায় পর্যবেক্ষণ করল। ডান ভ্রুটা ঈষৎ উঁচু করে নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,

‘ তুমি বেশ সুন্দরী। কিন্তু আমি প্রেমিকা হিসেবে সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করি না।’

আমি চোখ বড় বড় করে চাইলাম। ভ্রু জোড়াতে ঈষৎ সন্দেহী ভাঁজ। ধ্রুব দুই পা এগিয়ে আমার থেকে সচেতন দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি তোমার প্রেমিক হলাম কী করে? উঠতে বসতে, ক্যাম্পাসে, রাস্তায়, টং দোকানে সব জায়গায় তোমার আমার প্রেম কাহিনির চর্চা। ব্যাপারটা কী? কাজটা কী তুমি ঠিক করেছ?’

আমি এবার আকাশ থেকে পড়লাম। হতভম্ব চোখে চেয়ে থেকে বললাম,

‘ কী আশ্চর্য! আমি করেছি মানে! কী করেছি আমি? আমার অবস্থা আপনার থেকেও গুরুতর। আমি মাত্র সেদিন জানলাম আপনি আমার প্রেমিক। এখন এই খবর আমার বাবা না জানলেই হলো। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না, বাবা কতটা ভয়ঙ্কর।’

আমার বাবা ঘটিত চিন্তা ধ্রুবকে খুব একটা চিন্তিত করল বলে মনে হলো না। সে আগের মতোই শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ মেয়ের জামাই হিসেবে তোমার বাবাকে আমার নিজ দায়িত্বে জানিয়ে আসা উচিত। তাকে জানানো উচিত, তার আদরের মেয়ে আমার সাথে নাজমা বোর্ডিং-এ যায়। আমি একা সাফার করব আর তুমি আনন্দে নাচবে তা তো হতে পারে না। তোমার কোনো ধারণা আছে কত বড় ক্ষতি করেছ আমার? আমি লজ্জায় বাবার সামনে মুখ দেখাতে পারছি না।’

ধ্রুবর মুখে নাজমা বোর্ডিং এর নাম শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। বাড়ির বড় ছেলেরা নাকি আদব-আয়দা, ভদ্রতা- সভ্যতার জ্বলজ্বলে প্রতিমা? কিন্তু এ তো দেখি মহা ফাজিল। চরম বেয়াদব। এই অত্যন্ত অসভ্য, বেয়াদব, ভয়ানক ইতর ছেলেটিকে এতোদিন ধোয়া তুলশী পাতা ভেবেছি বলে খুব দুঃখ হলো। যে ছেলে জলের মতো সহজ ভঙ্গিতে এতোবড় খারাপ কথা বলে ফেলতে পারে। সে কখনোই ধোয়া তুলশী পাতা হতে পারে না। সে হবে অত্যন্ত অসভ্য একটা ছেলে। আমার মতো সভ্য মেয়ের উচিত এমন অসভ্য ছেলে দেখলেই রেগে যাওয়া। আমি রেগে গেলাম। বললাম,

‘ আপনি অত্যন্ত অসভ্য একজন মানুষ।’

ধ্রুবর মুখে কোনো রাগের প্রকাশ নেই। তার কন্ঠ চমৎকার। ছাড়া ছাড়া, সুন্দর প্রতিটি উচ্চারণ। মানুষকে মধুর স্বরে অপমান করার শিক্ষাও তার জন্মগত। সে মধুর কন্ঠে বলল,

‘ জোর করে আমার প্রেমিকা হলে তুমি আর অসভ্য হলাম আমি? আশ্চর্য!’

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ফোঁসে উঠে বললাম,

‘ নিজেকে আপনি কী মনে করেন, বলুন তো? প্রিন্স অব দ্য টাউন? শহরের সব মেয়ে আপনার প্রেমিকা হওয়ার জন্য মরে যাচ্ছে?’

ধ্রুব রাগল না। দুয়েক পা এগিয়ে সচেতন দূরত্বটুকু মিটিয়ে দাঁড়াল। ঘড়ি পরা ডানহাতটা আমার মাথার পেছনে রঙ চটা দেয়ালের উপর রেখে সহজ কন্ঠে বলল,

‘ আর কেউ যাচ্ছে কি-না বলতে পারি না। আমি মেয়েদের খুব একটা খেয়াল করি না। কিন্তু তুমি তো খুব যাচ্ছ।’

ধ্রুব হঠাৎ কাছে আসায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি। প্রচন্ড ভয় আর অস্বস্তিতে থিতিয়ে গেল আত্মবিশ্বাস। এক সমুদ্দুর রাগটা টুপ করে ছোট্ট ডোবায় রূপ নিলো। আমি রাগ প্রকাশের যথাসাধ্য চেষ্টা করে বললাম,

‘ বাজে কথা! আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও ইন্টারেস্ট নেই। পথ ছাড়ুন।’

ধ্রুবর মাঝে পথ ছাড়ার কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। সে বামহাতটা পকেটে গুঁজে চুপচাপ চেয়ে আছে। ছাড়পোকার গন্ধগুলো মিলিয়ে গিয়ে চারপাশটা ধীরে ধীরে ধ্রুবময় সুবাসে ভেসে যাচ্ছে। ধ্রুব উদাস কন্ঠে বলল,

‘ দেখো নিশু। আমি তোমার সাথে কোনো রকম ঝামেলা করতে চাইছি না। তুমি নিজে ঝামেলা পাকিয়েছ। তোমার উচিত ঝামেলাটা সল্ভ করা। গত দু’দিন আগেও আমি তোমার নাম জানতাম না। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলাম, নিশু নামের অত্যন্ত সুন্দরী একটা মেয়ে আমার প্রেমিকা। অথচ এই সুন্দরী প্রেমিকাকে আমি চিনি না। বাসায় ফিরে শুনলাম আমার ছোট ভাই হঠাৎ তার ভাবী পেয়ে গিয়েছে। ভাবীকে তার পছন্দ হয়েছে। সুতরাং তার টাকা প্রয়োজন। বন্ধুদের ট্রিট দিবে। অথচ তার একমাত্র বড় ভাই হয়ে, তার ভাবী সম্পর্কে আমার কোনো ধারণায় নেই। ক্যাম্পাসে একটা কাজে গিয়ে দেখি বন্ধুরা আনন্দে অভিভূত। প্রাক্তন স্যারদের ঠোঁটেও মিটিমিটি হাসি। এই পুরো ঘটনাগুলো আমাকে নিয়ে ঘটছে অথচ আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তার থেকেও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল আজ সকালে। বাবার সাথে বাজারে গিয়েছি। ফেরার পথে গলির মোড়ের পরিচিত মনিহারী দোকানদার বাবার সামনেই ডেকে বললেন, “মামা, মামী কিন্তু এক নাম্বার।” চিন্তা করতে পারছ পরিস্থিতি? আমি এই মুহূর্তে বাবার সামনে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পর্যন্ত পাচ্ছি না। আমার জায়গায় আবির হলেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমি! মাই গড! আমি তো নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না!’

ধ্রুবর বিশাল দুঃখকথন শোনে আমার খুব দুঃখ হলো। আবেগে গলে গিয়ে তার জন্য বড্ড মায়া হলো। আহারে! বেচারা! তার অবস্থা আমার থেকেও ভয়াবহ। কিন্তু আমার মায়া মায়া ভাব বেশিক্ষণ টিকল না। ধ্রুব জলের মতো সহজ কন্ঠে হুমকি দিয়ে ফেলল,

‘ আমার এই যাবতীয় সমস্যাটা শুরু হয়েছে তোমার থেকে। তুমি আমার জীবনে এসে, গোটা জীবনটাকে একটা আতঙ্ক বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছ। এজন্য তোমায় শাস্তি পেতে হবে। হয় আমার জীবনটা আগের মতো করে দাও, নাহয় তুমিও অশান্তিতে ডুবে মরে যাও।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,

‘ মানে?’

‘ মানেটা সহজ। তুমি এই ঝামেলাগুলোর সমাধান টানতে না পারলে আমি তোমার শ্রদ্ধেয় বাবার কাছে সমাধান চাইব।’

আমি হতবাক,

‘ কীসের সমাধান?’

ধ্রুব এবার এক অবিশ্বাস্য কথা বলে ফেলল। খুবই সহজ সাবলীল ভাষায়, একদম ভালো মানুষটির মতো বলে ফেলল,

‘ তুমি যে তার ভয়ে আমাদের বাচ্চাটাকে এবোর্ট করে ফেললে, তাতে আমি কতটা দুঃখিত। মর্মাহত। সেটা তাকে জানাতে হবে না? আমি এর সমাধান চাই। আমার বাচ্চার ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে।’

আমি স্তব্ধ চোখে নিজের উদরের দিকে চাইলাম। ডানহাতটা নিজের পেটের উপর রেখে হতভম্ব চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব খুব ভালো মানুষটির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার ভদ্র, নম্র, আদুরে মুখটি দেখে পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র মানুষ ভেবে ভুল হয়ে যাওয়ার মতো ভালো মানুষ। আমি কয়েক সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে স্তম্ভিত কন্ঠে উঠলাম,

‘ বাচ্চা! কীসের বাচ্চা! কীসের এবোরশন! আপনি এতো খারাপ!’

ধ্রুব মৃদু হাসল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ধরে রেখে আমার জীবনের সবচেয়ে আনসল্ভড সমীকরণটা বুঝিয়ে দিল,

‘ আমি যেমন তোমার প্রেমিক না হয়েও প্রেমিক? তুমি যেমন আমার প্রেমিকা না হয়েও প্রেমিকা? ঠিক তেমনই আমাদের বাচ্চা না হয়েও বাচ্চা। এবোরশন না হয়েও এবোরশন। বুঝেছ প্রিয়তমা?’

আমি শুকনো মুখে মাথা নাড়লাম। আকস্মিক ঘটনাসমূহে আমার মান্ধাতার আমলের স্লো মস্তিষ্কটা সুযোগ বুঝে আরও একটু স্লো হয়ে গেল। মাথাটা হঠাৎ করে পুরোনো দিনের টেলিভিশনের মতো ঝিরঝির করে উঠল। ধ্রুব ভুবন ভুলানো হাসি হেসে সমবেদনা দিল,

‘ তোমাকে আমি বুদ্ধিমতি ভেবে ভুল করেছি। তুমি আসলে ভয়াবহ গাধা প্রজাতির মেয়ে। গাধা বলেছি বলে কষ্ট পেও না। গর্দভ টাইপের রমণীদের ইন শর্ট গাধা বলা যেতে পারে। তোমার স্লো মস্তিষ্ক নিয়ে এতো চিন্তা করার দরকার নেই। এই ফর্মূলাটা তোমার বাবার জন্য। তিনি বুঝলেই হবে।’

আমি মুখ কালো করে চাইলাম। এতোবড় অপমানের পরও চুপ করে বসে থাকা চলে না। ভয়াবহ প্রতিবাদের ডাক দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমি অত্যন্ত চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। মনে মনে গণঅভ্যুত্থানের মতো ভয়াবহ আন্দোলন করে ফেললেও কারো সামনে ‘অ তে অসভ্য’ পর্যন্ত বলতে পারি না। সেক্ষেত্রে প্রিয়তা আমার ডানহাত। একাই একশো পুরুষকে হাওয়াই উড়িয়ে দেওয়ার মতো দূর্দান্ত প্রতিভা তার আছে। এই মুহূর্তে প্রিয়তার কথা খুব মনে পড়ছে। প্রিয়তাটা পাশে থাকলে বেশ হতো! জব্বর একটা জবাব দেওয়া যেতো। আমি হতাশ কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি খুব খারাপ মানুষ।’

ধ্রুব উত্তর দিল না। আমার মুখের উপর ঝুঁকে কিছু একটা বলবে তার আগেই সিঁড়ির রেলিঙে আরেকজন ধ্রুবর চেহারা দেখা গেল। চেহারাটি রেলিঙের উপর ঝুঁকে পড়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘ ভাইয়া তুমি সিঁড়ির তলায় কী করছ?’

ধ্রুব মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে সরে দাঁড়াল। আমাকে আড়াল করার চেষ্টা করে গম্ভীর, শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। উত্তর দিল না। আবির তার ভাইয়ের থেকেও দুই ডিগ্রি উপরে। ভাইয়ের শক্ত চাহনি পুরোপুরি উপেক্ষা করে, গলা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘ কী আশ্চর্য! ভাইয়া- ভাবী তোমরা দু’জনে সিঁড়ির তলায় কী করছ?’

ধ্রুব দু’হাত পকেটে গুঁজে খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ হা-ডু-ডু খেলছি। তোর এখানে কী? ঘরে যা।’

আবির প্রত্যুত্তর করার আগেই আবিরের দুই পায়ের ফাঁক গেলে সিঁড়ির দুই শিকের মাঝ দিয়ে ছোট্ট গোলগাল এক মাথা বেরিয়ে এলো। বড় বড় চোখদুটোতে এক ঝাঁক বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ আমিও হাডু হাডু খেলব বয়ো ভাইয়া।’

ধ্রুব চিওমিওকে দেখে স্তম্ভিত চোখে চাইল। শীতল চোখে চেয়ে তার থেকেও শীতল কন্ঠে ডাকল,

‘ আবির!’

আবিরের মুখ নিমিষেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার দুই পায়ের ফাঁকে শুয়ে থাকা চিওমিওকে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল,

‘ আমি একে আনিনি। ও একা একাই আমার পিছু পিছু চলে এসেছে। এই উঠ।’

চিওমিও দুইহাতে সিঁড়ির দুটো শিক ধরে থেকে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল,

‘ আমি হাডু হাডু খেলব। খেলবই।’

আমি স্তম্ভিত চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ তোমার ছোট দেবর।’

দেবর! কীসের দেবর! আমি বিস্মিত চোখে চাইলাম। আমার থেকেও বিস্মিত কন্ঠ ভেসে এলো দু’তলার সিঁড়ির গোড়া থেকে,

‘ ইয়া আল্লাহ! মাঝ সিঁড়িতে শুয়ে এমন ব্যালি ডান্স কেন করছ চুচু? চুচু পুপুদের ব্যালি ডান্স করতে হয় না।’

চিওমিও ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। শিকের ভেতর থেকে মাথা বের করে প্রিয়তাকে দেখলো। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ আমাকে চুচু ডাকবে না।’

সিঁড়ির নিচ থেকে প্রিয়তার মুখভঙ্গি ঠিক বুঝা গেল না। তবে ব্যর্থ অবিশ্রান্ত আবির তাকে আর প্রত্যুত্তরের সুযোগ দিল না। হাঁপ ধরা কন্ঠে বলল,

‘ একে একটু ধরো তো ঝগড়াঝাঁটি। একে টেনে তুলতে পারলে তোমাকে পাঁচ টাকা বকশিস দেওয়া হবে।’

প্রিয়তার ফুঁসে উঠা কন্ঠস্বর,

‘ আপনি আমাকে ঝগড়াঝাঁটি কেন ডাকছেন? আমার নাম ঝগড়াঝাঁটি? তাছাড়া আমি এখন ফুল মুডে আছি। প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। এসব পাঁচ টাকা ফাঁচ টাকায় আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনার চুচুকে একটু তুলে ধরুন। আমি চলে যাই।’

চিওমিও এতোক্ষণ শান্ত হয়ে বসেছিল। আবির তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করতেই আবারও শিকের ভেতর মাথা ডুকিয়ে চিল্লাচিল্লি জুড়ে দিল,

‘ আমি হাডু হাডু খেলব। খেলবই।’

প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,

‘ হাডু! এটা আবার কেমন খেলা? হাঁটুতে হাঁটুতে বাড়ি দিয়ে খেলে নাকি? চুচু? আসো, আমি দিয়ে দিচ্ছি তোমার হাঁটুতে বাড়ি।’

এ পর্যায়ে আঁচলখানা কোমরে পেঁচিয়ে আবিরের সাথে সাথে প্রিয়তাকেও কাজে লেগে যেতে দেখা গেল। আবির অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ আরে বাপ! ভাইয়া এখানে হাডু হাডু খেলছে না। বউ বউ খেলছে। বউ বউ খেলতে বউ লাগে। ভাইয়ার বউ আছে। তোর তো নেই।’

চিওমিও এবার বিষয়ের গভীরতা বুঝতে পেরে বিজ্ঞ চোখে ধ্রুব আর আমার দিকে চাইল। হাত উল্টে ঠোঁট উল্টাল,

‘ আমার বউ নাই। আমার বউ কেন নাই?’

ঠিক তখনই প্রিয়তার চোখ পড়ল নিচে দাঁড়ানো আমার উপর। আমাকে দেখা মাত্র চোখ বড় বড় করে চাপা আর্তনাদ করে উঠল সে,

‘ নিশু! তুই এমন চিপাই চুপাই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ইয়া আল্লাহ! কি করছিস তুই সেখানে? ইয়া খোদা! এমন অশ্লীল অশ্লীল চিন্তা আসছে কেন আমার! তুই এই লোকটাকে চুমু টুমু খেয়ে ফেলিসনি তো নিশু?’

ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে চাইল। আমি অস্বস্তিতে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ঠোঁটে মৃদু হাসি টানার চেষ্টা করলাম। ধ্রুব সিঁড়ির নিচ থেকে সরে গিয়ে আবিরদের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। চিওমিও এর দিকে চেয়ে আচমকা ধমকে উঠল,

‘ উঠো! এই মুহূর্তে উঠবে।’

ধমক খেয়ে চিওমিওের কান্না বন্ধ হয়ে গেল। ধ্রুব নামক বড় ভাইয়াকেই বোধহয় সে একমাত্র ভয় পায়। তবে খুব একটা হেলদোল দেখাল না। স্টিলের মতো সোজা হয়ে বসে অভিমানী চেহারা নিয়ে থম ধরে বসে রইল। কান্না করার সাহস যেমন পেলো না। উঠে যাওয়ার সাহসও যেন হলো না। ধ্রুব তাকে কোলে তুলে নিয়ে আবিরের দিকে তাকাল। আবির মিনমিন করে বলল,

‘ আমি কী করেছি? আমি কী জানতাম তুমি ওখানে রোমান্স করছ? জানলে কী আসতাম? আমাকে বকলে কিন্তু আমি মাকে বলে দেব…..’

সিঁড়ির ধাপের সাথে সাথে ওদের কথাবার্তার স্বরও মিলিয়ে গেল খানিকবাদেই। প্রিয়তা সিঁড়ির উপর মর্মাহতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

‘ আমিও জেঠুকে বলে দেব। তুই আমাকে না বলেই ব্রেকিং নিউজ ঘটিয়ে ফেলেছিস! চুমু খেয়ে ফেলেছিস! উফ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’

আমি অসহায় দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সিঁড়ির নিচের অন্ধকার থেকে সরে এসে সিঁড়ির উপর পা ফেলতেই অপরিচিত নাম্বার থেকে ক্ষুদে বার্তা এলো,

‘ তোমাকে বাহাত্তর ঘন্টা দেওয়া হলো। ইউর টাইম স্টার্টস্ নাও। ডু অর ডাই।’

#চলবে….

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৭|

ধ্রুবর দেওয়া বাহাত্তর ঘন্টা যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেল। তখন শীতকাল। অথচ সারাবেলা আষাঢ়িয়া বর্ষা। ঝুমঝুম করে জল পড়ছে। আমি উত্তেজনা আর ভয়ে ঘরময় পায়চারী করছি। প্রিয়তা মুখের সামনে বিশাল এক আয়না ধরে রূপচর্চায় ব্যস্ত। তার মনে এখন বিশাল দুঃখ। সুন্দর, ঢুলঢুলে মুখখানিতে অ্যালোবেরা মেখে মাঝে মাঝেই দুঃখী দুঃখী চোখে তাকাচ্ছে। সম্প্রতি তার ধারণা হয়েছে, ধ্রুবর সাথে আমার ‘মহাপাপ’ ধরনের সম্পর্ক আছে। এই ‘মহাপাপ’ সম্পর্কের ‘মহাপাপী’ কে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না। দুঃখে তার প্রাণটা ফেঁটে যাচ্ছে। টাইটানিক পোজে, সাংকিপাড়ার রেললাইনটাতে মাথা দিতে ইচ্ছে করছে এই নিয়ে তেরো বার।

‘ কামডা কিন্তু আপনে ঠিক করেন নাই আফা। আপনে বড় ভাইজানের সাথে পেরেম করেন এইডা আমারে কইলে কী আমি কাউরে কইতাম? কইতাম না। এই জমিলা কতা লাগানোর মানুষ না। নিচের তলার রিনি আফা যে উত্তরের বিল্ডিংয়ের পোলাডার লগে পেরেম করে, আমি কাউরে কইছি? কই নাই।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পায়চারি থামিয়ে জমিলা আপার মুখোমুখি বসলাম। জমিলা আপা এই বিল্ডিংয়ের সরকারি আপা। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার তাকে ‘আপা’ বলে ডাকতে হয়। কার ঘরে কী হচ্ছে? কোন তলার ভাবী নতুন শাড়ি কিনেছে? কার বর বউয়ের আঁচলে বন্ধী? কোন মেয়েটা ভেগে গিয়েছে? কোন মেয়েটা কত নাম্বার ছ্যাঁকা খেয়েছে? সবকিছুই তার কাছে আবহাওয়া কর্মীদের মতোই ঝকঝকে, পরিষ্কার। আমি তাকে মধু গলায় আপা ডাকলাম। বললাম,

‘ জমিলা আপা? আপনার বড় ভাইজানের সাথে আমার কোনো প্রেম ট্রেম চলছে না। যে আপনাকে খবরটা দিয়েছে, সে অত্যন্ত মিথ্যাবাদী। দ্বিতীয়বার দেখা হলে তাকে কষে একটা চড় মারবেন। এক চড়ের জন্য একশো টাকা।’

জমিলা আপা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। পুঁইশাকের ডাঁটা বাছতে বাছতে মুখ বাঁকালেন। চোখদুটো সর্বজান্তার মতো চিকচিক করে উঠল। বললেন,

‘ এখন আর মিছা কইয়া কী হইবো আফা? বিল্ডিংয়ের বেবাকে জানে আপনার লগে বড় ভাইজানের ইটিশ পিটিশ সম্পর্ক। বড় ভাইজানই তো আপনাগো এই বাসাটা খুঁইজা দিছে। সঙ্গে পাঁচশো টাকা ফিরি। বড় ভাইজান তো আমাগো মাটির মানুষ। নইলে পাঁচশো টাকা ফিরি দিতো?’

আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম। মাথার উপর বিশাল আকাশটা টুপ টুপ করে ভেঙে পড়ে গেল। পাঁচশো টাকা ফিরি! মানে কী? আমি প্রেমিকের ফিরি দেওয়া বাসায় থাকছি? এতোবড় অপমান! রাগ আর বিস্ময়ে থমথমে মুখে বসে রইলাম আমি। প্রিয়তার মুখটা সদ্য স্বামীহারা বিধবার মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হাতের আয়নাটা ছুঁড়ে ফেলে এক ছুটে আমার পাশের সোফায় এসে বসলো। চোখ বড় বড় করে চেয়ে বলল,

‘ পাঁচশো টাকা ফিরি থুক্কু পাঁচশো টাকা ফ্রী! নিশু? তুই চুপিচুপি পাঁচশো টাকা মেরে দিচ্ছিস অথচ আমাকে বলিসনি? ইয়া আল্লাহ! ইয়া খোদা! আমি এসব কী শুনছি? জমিলা আপা? আমাকে টেনেহিঁচড়ে রেললাইনের উপর ফেলে দিয়ে আসেন। আমি আর বাঁচতে চাই না।’

আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। দুই হাতে মাথা চেপে স্থির চোখে চেয়ে রইলাম সাদা ধবধবে ফ্লোরে। জমিলা আপাকে কঠিন কিছু কথা শোনাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ইচ্ছে সফল হলো না। প্রিয়তা আর জমিলা আপার আহাজারিতে দিশেহারা হয়ে পড়লো আমার সাদামাটা উত্তর। মাস দুই আগে যখন বাবা বাসা ঠিক করে দিয়েছিলেন, তখন যে আমি ‘জমিলা আপার বড় ভাইজান’ তো দূর বড় ভাইজানের বাবাকেও চিনতাম না, সে কথা কেউ বিশ্বাস অব্দি করলো না। প্রচন্ড রাগে আমার মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো। চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,

‘ আমার বাবার যথেষ্ট টাকা আছে। আপনার বড় ভাইজানের পাঁচশো টাকার অফার আমার প্রয়োজন নেই। এসব ছাঁইপাশ কথা আমাকে বলবেন না। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

প্রিয়তা ভ্রু উঁচিয়ে চাইল। ঠোঁট উল্টে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে বলল,

‘ সম্পর্ক নেই? সিঁড়ির তলায় দাঁড়িয়ে চুমু টুমু খেয়ে ফেলছিস আর বলছিস সম্পর্ক নেই? তুই আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলি নিশু? আমি তোকে নিজের আত্মা মনে করি আর তুই!’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে প্রিয়তার দিকে চাইলাম। জমিলা আপা আকস্মিক ব্রেকিং নিউজে চোখ বড় বড় করে চাইলেন। কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা খোঁজে না পেয়ে গগনবিদারী চিৎকারে কাঁপিয়ে দিলেন সারা ঘর। হয়তো-বা পুরো ময়মনসিংহ শহর। মার্বেলের মতো গোল গোল চোখদুটো দিয়ে আমায় এক রকম ছেঁকে ফেলে বললেন,

‘ হায় আল্লাহ! কয় কী? এই কতাখান খালাম্মারে আমি কেমনে কমু? আস্তাগফিরুল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! বড় ভাইজানের মতো এমুন ভালা মানুষ এগোলান করে? আমার তো দুনিয়াডা ঘুরতাছে আফা। আফা আজকে আমার ছুটি। আমি আজকে রাঁন্ধন বাড়ন করতে পারতাম না। আমার কলিজাডা ধুকপুক ধুকপুক করতাছে।’

আমি হতাশ চোখে চাইলাম। জমিলা আপার ধুকপুক ধুকপুক যে আজ রাতের মাঝেই পুরো দেশের ধুকপুক বাড়িয়ে দিবে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহও রইলো না। রাগে দুঃখে প্রিয়তার পিঠে সটান একটা চড় বসালাম। প্রিয়তার কোনো ভাবান্তর হলো না। টি-টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি গিলে মাতালের মতো পড়ে রইলো। আমি একা একা পাঁচশো টাকা মেরে দিয়েছি এই ভয়াবহ সংবাদ তার হজম হচ্ছে না। আমার এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেওয়া অসম্ভব! আমার মনটা হঠাৎই খুব খারাপ হয়ে গেল। এই অযাচিত ঝামেলাগুলো মনে পড়েই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। বুকের ভেতর সাধু-সন্ন্যাসীর মতো বসে থাকা বেয়াদব মনটা তীর্যক হেসে বলল,

‘ পড়ো! আরও পড়ো ময়মনসিংহ। বাবা মানা করেছিল না? এবার মন দিয়ে প্রেমের পড়া পড়ো।’

আমি অসহায় মুখে বসে রইলাম। বসার ঘর থেকে উঠে নিজের ঘরে দোর দিতেই চোখ ছাপিয়ে জল গড়ালো। ঘড়ির কাঁটা গুলো টং টং করে জানান দিলো, আর মাত্র চল্লিশ ঘন্টা! মাত্র চল্লিশ ঘন্টায় কী করে কী করব আমি? ক্যাম্পাসে, মহল্লায় মাইক মারব? নাকি দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার লাগাব? নাকি ফেস্টুন নিয়ে জনসভা করব? নিজের অসহায়ত্বে নিজেরই খুব মায়া হলো এবার। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, আহারে! ভোলাভালা, অবুঝ বাচ্চাটা! থাক, কান্না করে না।

দুপুরে গড়িয়ে বিকেল হতেই আচমকা থেমে গেল বৃষ্টি। আকাশ ছাপিয়ে ঝকঝকে রোদ উঠল। আমি আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসলাম। বারান্দার পাঁচিলে মাথা হেলিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে চাইলাম। মাথার উপর ঝকঝকে আকাশ দেখতে দেখতেই বুঝি চিন্তারা সব মিলিয়ে গেল। বুকের ভেতর ভর করলো প্রেমময় রবীন্দ্র। ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে নিঃশব্দ মনটা আলতো আলতো নড়েচড়ে উঠল,

‘ হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি,
ছুটি নে কাহারো পিছুতে;
মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে।’

রবীন্দ্র ভাবটা বেশিক্ষণ টিকল না। মুখের উপর আচমকা জল এসে পড়ায় কবি কবিভাব উবে গেল। হতচকিত আমি সোজা হয়ে বসলাম। প্রথম দফায় কিচ্ছুটা বুঝতে না পেরে বোকার মতো মুখ মুছলাম। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে বসে থেকে পাঁচ তলার বারান্দার দিকে চাইলাম। আর তারপরই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমার। পাঁচ তলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে চিওমিও। ছোট্ট একটা মগ থেকে হাতখানি বড় এক পাইপে জল ঢালছে। আর সেই জল এসে পড়ছে আমার বারান্দায়। আমি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এদের তিন ভাইয়ের নতুন নতুন নাটক দেখে আমি বিভ্রান্ত, হতচকিত। তবে চিওমিওয়ের মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে মনের সুখে আমাকে লক্ষ্য করে জল ছুঁড়াছুঁড়ির চেষ্টা চালাতে লাগল। আমি বরাবরই চুপচাপ। বড় ভাই জোরপূর্বক বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছে তাকেই কিছু বলতে পারিনি। ছোটোজনকে কিছু বলবো এ যেন এক অলীক কল্পনা। তবে প্রিয়তা থেমে থাকল না। সে আমাকে স্তব্ধ হয়ে উপরের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ছুটে এলো বাইরে। পাঁচিলে ছড়িয়ে রাখা জামা-কাপড়ের এহেন দশা দেখে হাহাকার করে উঠল। বারান্দা থেকে ঝুঁকে উপরের দিকে চেয়েই লম্বা হাত দিকে টেনে ধরলো পাইপের মুখ। চিওমিও ছোট্ট গোল মুখটা হেলিয়ে পাইপ আটকে যাওয়ার কারণ দেখলো। তারপর প্রাণপণ উপরের দিকে টানতে টানতে বলল,

‘ আমার! আমার!’

প্রিয়তাও কম যায় না। পাইপটি টেনে ধরে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ আমার!’

চিওমিওের তখন কেঁদে ফেলার দশা। তিনটা ভাই-ই ভয়াবহ ড্রামাবাজ। সুযোগ বুঝেই দুনিয়া হেলিয়ে দেওয়ার মতো চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘ আমার। ছাড়! ছাড়! বাইয়া!’

ঠিক তখনই চিলের মতো উড়ে এসে রেলিঙের উপর ঝুঁকে পড়ল একটা মুখ। নিচের দিকে চেয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ এই ঝগড়াঝাঁটি? তুমি আমার ভাইয়ের খেলনা নিয়ে টানাটানি করছ কেন? ছাড়ো।’

প্রিয়তা ফুঁসে উঠে বলল,

‘ আরেকবার ঝগড়াঝাঁটি বললে ইট ছুঁড়ে মারব। আমাদের জামা কাপড়ের এহেন দশা করে এখন আমাকেই ধমক! পাইপ আমি ছাড়বো না। জোর যার মুলুক তার। দেখি কে জেতে? নিশু?ধর!’

আমি হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আবির খপ করে পাইপের অন্য মাথা চেপে ধরল। প্রিয়তা চেঁচামেচি করে ঘর মাথায় করলো। জমিলা আপাকে একশো টাকার লোভ দেখিয়ে নিজের দলে বেড়িয়ে নিয়েই চললো প্রাণপণ লড়াই। আমি হতভম্ব হয়ে এদের পাগলামি দেখলাম। আবির অভিমানী কন্ঠে বলল,

‘ ভাবী! তোমার চোখের সামনে এমন ভয়াবহ একটা কান্ড ঘটে যাচ্ছে আর তুমি কিচ্ছু বলছো না? তোমার ইনোসেন্ট দেবর দুটোর প্রতি কী কোনো মায়া দয়া নেই?’

আমি উত্তর দিলাম না। আবির জমিলা আপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ জমিলা আপা? আমি তোমাকে দুশো দেব। ছেড়ে দাও।’

জমিলা আপা গদগদ হেসে হাতের পাঁকড়টা কিছু হালকা করতেই চোখ পাকিয়ে তাকাল প্রিয়তা,

‘ আমি তিনশো দেব।’

জমিলা আপা আবারও বদ্ধ পরিকর হয়ে ষাঁড়ের শক্তিতে নিচের দিকে টান লাগালেন। আবির ব্যস্ত হয়ে বলল,

‘ আমি চারশো দেব।’

চিওমিও পাইপটা ছেড়ে দিয়ে আবিরের দিকে চাইল। ছোট্ট ছোট্ট হাতে ভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে হাত পাতলো,

‘ আমি চাশো নিব। দাও।’

এই বৃহৎ নাটকের এই পর্যায়ে ভীষণ বাবু সেজে নিচের দিকে উঁকি দিল পেটানো শরীরের ভয়াবহ অসভ্য লোকটা। নেশা ধরানো গম্ভীর চোখদুটো মেলে আমার দিকে চেয়ে রইলো। স্থির, অপলক। কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে আমার চোখদুটোও ঠেকলো তার চোখে। কয়েক সেকেন্ডের নীরব হিল্লোল শেষে ডান ভ্রুটা খানিক উঁচু করল সে। মূর্তির মতো কাটা কাটা মুখটি স্থির থাকলেও নেশালু চোখদুটোতে বয়ে গেল মৃদু হাসির ঢেউ। আমার দিকে চোখ রেখেই নিচু হয়ে এক টানেই ছিনিয়ে নিলো গোটা পাইপ। প্রিয়তা আর জমিলা আপা নিজের খালি হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে একবার ধ্রুব তো একবার আমার দিকে চাইল। ধ্রুব তখনও আমার দিকে চেয়ে আছে। এদিকে চেয়েই একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছে পাতলা, লম্বা পাইপ। প্রিয়তা ধ্রুবর দৃষ্টি খেয়াল করেই সাপের মতো ফুঁসে উঠল। জ্বলে উঠে বলল,

‘ তোর বরের জন্য হেরে গিয়েছি। নিজের বরকে একটু হাতে রাখতে পারিস না?’

জমিলা আপাও সুর তুললেন,

‘ আপনে ভাইজানরে কইলেই কিন্তু আমরা জিত্তা যাইতাম। আপনের জন্য পাঁচশো টাকা ফিরি দিছে আর একটা পাইপ ফিরি দিতে পারতো না?’

আমার মেজাজটা আবারও গ্যাস বেলুনের মতো ফুলে উঠল। জমিলা আপাকে একটা রাম ধমক দিয়ে কটমটে চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব তখনও শান্ত, স্থির। অথচ তার চোখদুটোতে মিষ্টি হাসির হুল্লোড়। আমি দপদপে রাগ নিয়ে ব্যালকণি ছেড়ে শোয়ার ঘরে এলাম। আগেপিছে কিছু না ভেবেই কালকে যে নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছিল সে নাম্বারে ডায়াল করলাম। বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে হাসি হাসি গলায় উত্তর এলো,

‘ বলো।’

আমি রাগান্বিত কন্ঠে বললাম,

‘ বলো! কীসের বলো? আপনি হাসছেন কেন?’

আমার অধৈর্যে গলায় আওয়াজ করে হেসে ফেলল ধ্রুব। কৌতুক করে বলল,

‘ পাঁচশো টাকা ছাঁড় দিয়েছি তবু হাসতে পারব না?’

ধ্রুব আমায় ইচ্ছে করে রাগাতে চাইছে বুঝতে পেরেও রাগে-দুঃখে শরীর জ্বলে উঠল আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘ তাহলে এসব আপনার কাজ! জমিলা আপাকে আপনিই বলেছেন এসব?’

‘ উঁহু। মায়ের কাছে শুনলাম। তিনিও বোধহয় জমিলা আপার থেকেই শুনেছেন। তাঁর লক্ষ্মীমন্ত ছেলে চারতলার মেয়েটার প্রেমে ভেসে যাচ্ছে, এই দুঃখ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। পাশের বাড়ির আন্টির কল্যাণে তিনি বিশ্বাস করেছেন, তুমি আমাকে ঔষধ করেছ। নয়তো এতো ভালো ছেলেটার এমন মাথা খারাপ হওয়ার কথা নয়। সত্যিই করেছ নাকি অ-প্রেমিকা?’

এই পর্যায়ে এসে রেগে যাওয়ার মতো ধৈর্যও আমার রইলো না। ভীষণ ক্লান্ত গা’টা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বললাম,

‘ আপনি এতো খারাপ কেন অ-প্রেমিক?’

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here