প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,০৮,০৯

0
301

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,০৮,০৯
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৮|

ঘড়ির কাটা টং টং শব্দ তুলে চারটের ঘরে আটকে গেল। আমি বিছানায় কম্বল মোড়ে বসে আছি। কনকনে শীতের রাত। ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছি। দু’ কম্বল জড়িয়েও উষ্ণতা পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কম্বল থেকে অল্প হাত বাড়িয়ে শীত টুপি নিলাম। এলোমেলো পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে কোনরকম হাত খোঁপা করে টুপি চাপালাম মাথায়। কোথা থেকে উড়ে এলো শুঁটকি পোড়া গন্ধ। আমি কপাল কুঁচকে ঘড়ির দিকে চাইলাম। মাথার ভেতরটা ঘড়ির কাটার মতোই ধ্রিম ধ্রিম শব্দ তুলছে। থেকে থেকেই বিষণ্ণ লাগছে। কিছুতেই মন ভালো করা যাচ্ছে না। আমি মন ভালো করার চেষ্টা ছেড়ে উদাস মুখে বসে রইলাম। ঢুলুঢুলু, বিষণ্ণ চোখদুটো নিয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় বলে বিশ্বাস করে ফেললাম। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হলদেটে কাগজগুলোর উপর গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম নিজেকে। ধ্রুবকে। আমার এই পরিস্থিতিকে।

ছেলেবেলা থেকেই অবাধ স্বাধীনতায় বড় হয়েছি আমি। বাবা আর দুই ভাইয়ের আড়ালে উপন্যাসের প্লট ভিন্ন অন্যকিছুর ভাবনা ভাবতে হয়নি। ১২,৭৪২ (কি.মি.) ব্যাসের এই বিশাল পৃথিবীতে বাস্তবতা, নির্মমতা থেকে বহুদূর নরম, আদুরে পুতুলটির মতো গড়ে তোলা হয়েছে আমায়। জ্যোৎস্নায় ঝলসে যাওয়া ওই চাঁদকে সবসময় চাঁদ বলেই মনে হয়েছে। মনের ভুলেও ঝলসানো রুটি মনে হয়নি। বাবা, ভাইদের কোমল প্রশ্রয়ে ভীষণ ছটফটে হয়েছি। জেদি হয়েছি। অধৈর্য হয়েছি কিন্তু কখনো কঠোর প্রতিরোধে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারিনি। চট করে সিদ্ধান্ত নিতে শিখিনি। বাবা আমার ইচ্ছে, অন্যায় আবদারগুলোকে মুক্ত পায়রার মতো ডানা মেলতে দিয়েছিলেন বলেই হয়তো নিজ ইচ্ছেকে প্রতিরোধ করতে শেখা হয়ে উঠেনি। প্রয়োজন হয়নি। তবে আজ প্রয়োজন হলো। মাথার উপর পরীক্ষার চাপ আর নতুন বইয়ের বাড়তি কাজ পড়তেই গড়গড় করে ভেঙে যেতে লাগলো প্রতিরোধ। ধ্রুব আর আমাকে নিয়ে চলা ওই ফিসফিসানো মন্দ কথা মনের উপরও চাপ ফেলল খুব। লেখালেখি, পরীক্ষা, দুশ্চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতা সব মিলিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এলোমেলো হয়ে গেল মন। সমস্যা সমাধানে অনভ্যস্ত আমি ঠিকঠাক তাল খুঁজে পেলাম না। বইয়ের পাতা, মনের পাতা সবই একাকার হয়ে অস্থির হয়ে উঠলাম। এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন থেকে বাঁচতে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, ধ্রুবর সাথে কথা বলব। সরাসরি কথা বলে সমস্যাগুলো একদম ঝাড় থেকে উপড়ে ফেলব। এভাবে ঘন্টা, সেকেন্ড গুণে গুণে বাঁচা সম্ভব না। এবার একটা সমাপ্তি দরকার। পুরো ঘটনাটার সুন্দর একটা উপসংহার দরকার। আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। প্রায় সাথে সাথেই ভুরভুর করে বাড়তে লাগল অস্থিরতা। কয়েক ঘন্টার বিলম্বও সহ্য হলো না। ধ্রুবর সাথে এই মুহূর্তে, এই সেকেন্ডে সব ঠিক করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। আর এক মিনিটও দেরি না। এক মিনিটও না। আমি চঞ্চল পায়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলাম। বুকটা ধুকধুক করছে। বুকের উপর বিশাল পাথর পড়লে যেমন হয়? তেমন ভাবেই হাঁসফাঁস করছে মন। বারবার মনে হচ্ছে, এখন। এই এখনই ব্যাপারটা সমাধান করতে না পারলে দমবন্ধ হয়ে যাবে। নিঃশ্বাস নিতে পারব না। আমার ভেবে রাখা যুক্তিগুলো ঠিকঠাক কাজে দেবে না। উত্তেজনা আর সিদ্ধান্তহীনতায় হাত-পা কাঁপতে লাগল। কী করব? কী করা উচিত? কিচ্ছুটি বুঝতে না পেরে অসহায় হয়ে গেল মুখ। চুলোয় বসানো অসময়ের চায়ের পানিটা গরম হওয়ার আগেই আরও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ভাইদের নীরব প্রশ্রয়ের নরম, আদুরে পুতুলটি আবারও একটা নির্বোধ ভুল করে বসল। মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের কুৎসিত খেলায় একরকম অসহ্য হয়েই ধ্রুব নামক মানুষটিকে ফোন লাগাল। ভাইদের ছোট্ট পুতুল! কাদামাটির মতো সরল মন! একটিবারও ঘড়ির কাটার দিকে খেয়াল করল না। এই ভীষণ অসময়ে সম্পর্কহীন, অচেনা পুরুষটিকে ফোন করা যায় না, এই ছোট্ট শাসনটুকু মনের কোথাও হালকা হাওয়ার মতোও উদয় হলো না। ফোনটা রিং হতেই অদ্ভুত এক উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপতে লাগল। অবাধ্য হৃদপিণ্ডটা বুনো টিয়াপাখির মতো খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল বারবার। বামহাতে ওড়নার কোণাটা চেপে ধরে দরদর করে ঘামতে লাগলাম। গলা শুকিয়ে গেল। ফোনটা বেজে বেজে কেটে যেতেই ডান হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম। কাঁপা হাতে দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো ডায়াল করলাম৷ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ঘুমু ঘুমু ভারী কন্ঠ ভেসে এলো। ভীষণ পরিচিতের মতো বলল,

‘ বলো।’

আমি চমকে উঠলাম। হঠাৎ করেই সব কেমন অগোছালো হয়ে গেল। ভারী জিহ্বা নেড়ে ছোট্ট একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলাম না। ধ্রুব বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আমার নীরবতা ভাঙার অপেক্ষা করল। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে বলল,

‘ ফোনটা কী রেখে দেব?’

আমি আরও একবার কেঁপে উঠলাম। ধ্রুবর কন্ঠে সংশয়হীন অধিকারবোধের ছটায় কেঁপে উঠল বুক। গোছালো কথাগুলোও অগোছালো হয়ে গেল। ধ্রুবর অপ্রত্যাশিত স্থিরতায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। অসহায়বোধ করলাম। নিচু কন্ঠে বললাম,

‘ আপনার সাথে কথা ছিলো। জরুরি কথা।’

ধ্রুবর ঘুমু ঘুমু আদুরে কন্ঠটায় তখন আলতো গম্ভীর্যের ছটা। বলল,

‘ বলো।’

চুলোর উপর চায়ের পানিটা তখন অবিশ্রাম ফুটছে। গুরুগুরু শব্দটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দ, নিঝুম ঘরটাতে। আমি ঠান্ডা পড়ে যাওয়া কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে নাকের ঘাম মুছলাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ ফোনে নয়। সরাসরি বলব। ফোনে বলা যাবে না।’

ধ্রুব গম্ভীর কন্ঠে খানিকটা কৌতুক মিশিয়ে বলল,

‘ কেন? প্রোপোজ ট্রোপোজ করতে চাইছ না তো আবার?’

এই পর্যায়ে এসে জড়তা কেটে গেল আমার। ফুঁস করে জ্বলে উঠে বললাম,

‘ বাজে কথা। আপনাকে প্রোপোজ করতে যাব কেন হঠাৎ? আই টোল্ড ইউ বিফোর, আপনার প্রতি আমার কোনো ইমোশন নেই। নেহাৎ একটা উটকো ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছি নয়তো….’

‘ নয়তো?’

আমি উত্তর দিলাম না। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপনি একটু ছাদে আসুন। কথা আছে।’

ধ্রুব যেন হকচকিয়ে গেল। নিজের বিস্ময়টা আড়াল করে বলল,

‘ এখন?’

‘ হ্যাঁ। এখন।’

‘ কয়টা বাজে জানো?’

আমি অভ্যাসবশতই জেদ ধরা কন্ঠে বললাম,

‘ জানি না। আপনি আসুন।’

ধ্রুব ঘুম কাটিয়ে শান্ত, কঠিন কন্ঠে বলল,

‘ পাগলামো করো না নিশু। ঘুমুতে যাও। তোমার জরুরি কথাটা কাল শুনবো। গুড নাইট।’

ফোনের এপাশে নীরব অভিমানে ঠোঁট ফুলালাম আমি। ছেলেবেলা থেকে প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া মনটা খুব ছেলেমানুষি কন্ঠে বলল,

‘ না। এক্ষুনি।’

‘ নিশু!’

ধ্রুবর ভারী, ভয় ধরানো কন্ঠে চুপ করে রইলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,

‘ কাল কথা হবে।’

আমার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। নিছক সিদ্ধান্তহীনতা আর বাচ্চামোই ভর করে নিজেকে কতটা সহজলভ্য করে ফেলেছি বুঝতে পেরেই অনুশোচনায় জ্বলে উঠল বুক। নিজের হেঁয়ালিপনায় রাগ হলো, বিরক্তি এলো। কেন বারবার একই ভুল করি ভাবতে ভাবতেই পুরো পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হলো। ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হলো নিজেকে। রাগ, অভিমান, অপমান সব মিলিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। নিজের ভুলটুকো বুঝতে পারলাম। কিন্তু তারপর? তারপর কী? রেখো দেব? মেনে নেব পরাজয়? কিন্তু এমন রিজেকশনের জ্বালা কী আদৌ সহ্য হবে আমার? ‘না’ শুনতে না পারা মনটা নীরব ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ উঁহু। এখনি। কাল কথা বলার হলে নিশ্চয় এখন ফোন করতাম না? আপনি আসবেন। এই মুহূর্তে আসবেন। ব্যস!’

ধ্রুব বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে গলায় শব্দ করে হাসল। আমি আমার বাদ বাকি আত্মসম্মানটুকু মুঠোয় নিয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগলাম চূড়ান্ত অপমানিত হওয়ার ভয়ে। ধ্রুব যেন আমায় প্রাণ ভিক্ষা দিল। কোনোরকম ফোঁড়ন না কেটে সাধারণ কন্ঠে বলল,

‘ নিশু? তুমি কী বুঝতে পারছ, তুমি আমার সাথে কীভাবে কথা বলছ? ইউ আর বিহিভিং লাইক মাই গার্লফ্রেন্ড। সবার মতো আমিও কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। তুমি সত্যি সত্যিই আমার প্রেমিকা নও তো?’

ধ্রুবর প্রশ্রয় ভেজা তরল কন্ঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। ঝুপ করে নিজের সত্তায় ফিরে গিয়ে বললাম,

‘ বাজে কথা বলবেন না। আসছেন কী আসছেন না?’

ধ্রুব হাসল। ধীরে ধীরে গাঢ় হলো তার হাসির আওয়াজ। হাসতে হাসতেই বলল,

‘ আমি মানা করলে কী তুমি কেঁদে ফেলবে, নিশু?’

আমি চমকে উঠলাম। মৃদু শাসনের কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি!’

ধ্রুব তরল হেসে বলল,

‘ থাক। কান্নাকাটির দরকার নেই। আবিরের হাওয়ায় ভেসে আসা ভাবির জন্য এতটুকু রিস্ক নেওয়া যেতে পারে৷ সিঁড়িতে কোনোরকম আওয়াজ না করে আসো। ধরা খেলে বাঁচার চিন্তা ভুলে যেও। আমার নিজেরও বাঁচার সম্ভবনা নেই। তোমাকে বাঁচাতে পারব না।’

আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। ধ্রুব হাসি হাসি কন্ঠে ডাকল,

‘ নিশু?’

আমি সাড়া দিতেই হো হো করে হেসে উঠে বলল,

‘ কিছু না। আসো।’

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে ফোন কাটলাম। ঝোঁকের মাথায় ফোন করে ফেলে যতটা অস্থির হয়েছিলাম। ধ্রুব রাজি হয়ে যাওয়াই আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়লাম। ভয়ে, আতঙ্কে হাত-পা কাঁপতে লাগলো। হৃদপিণ্ড ছুটতে লাগলো দ্রুত। চুলোয় বসানো চায়ের পানি শুকিয়ে এসেছে। যেমনটা শুকিয়ে এসেছে আমার কন্ঠস্বর। আমি হাত বাড়িয়ে চুলোটা বন্ধ করে গোটা এক গ্লাস পানি ঢাললাম গলায়। এক চুমুকে সম্পূর্ণটা শেষ করে ঠান্ডা হয়ে আসা অসাঢ় পা নিয়ে ঘুমন্ত প্রিয়তার পাশে এসে বসলাম। দু’বার মৃদু ধাক্কা দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকি দিলাম ওর গায়ে। প্রিয়তা ধরফর করে উঠে বসল। আমাকে হঠাৎ চিনতে না পেরে চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো। তারপর আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

‘ ভূমিকম্প টূমিকম্প হচ্ছে নাকি নিশু? আর্থকুয়াক হলে কুইক করে নেমে যেতে হয়। বসে আছিস কেন? চল, কুইক করে নেমে যাই।’

আমি কাঁদো কাঁদো চোখে চেয়ে ডাকলাম,

‘ প্রিয়?’

প্রিয়তা ফ্যাকাশে মুখে চাইল। আমার কান্না দেখে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

‘ আমরা কী ভূমিকম্পে চাপা পড়ে মরে গেছি জান? এইটা কী জান্নাত? আমি যে এতো জলদি জান্নাতে এসে পড়ব ভাবতেই পারিনি। আল্লাহ কত দয়ালু! লাভ ইউ আল্লাহ। ইশ! আবেগে ভেতরটা কেমন টলমল করছে।’

প্রিয়তার অযথা কথায় অধৈর্য হয়ে পড়লাম আমি। কটমটে চোখে চাইলাম। ডান বাহুর উপর চটাস করে একটা চড় বসিয়ে বুঝিয়ে দিলাম তার অবস্থান। প্রিয়তা বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে আশেপাশে চাইল। আমি আবারও অসহায় কন্ঠে ডাকলাম,

‘ প্রিয়?’

প্রিয়তা এবার বিরক্ত হলো। অধৈর্য কন্ঠ বলল,

‘ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিস কেন?’

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে চাইলাম। প্রিয়তা কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে নরম কন্ঠে শুধাল,

‘ কী হয়েছে জান? পেট ব্যথা করছে?’

আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে গোটা কাহিনিটা শুনাতেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল তার মুখ। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

‘ তুই এই মাঝরাতে উনার সাথে দেখা করতে যাবি?’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম। আমার অসহায় দৃষ্টি দেখেই ঝুপ করে নরম হয়ে গেল প্রিয়তার দৃষ্টি। আমার থেকেও অসহায় দৃষ্টি মেলে বলল,

‘ মন খারাপ করে না, সোনা। তোর তো কোনো দোষ নেই। আমাদের নিশুর বাপের টাকায় কেনা ফোন। সে যখন ইচ্ছে ফোন করবে। দোষটা তো ওই বেয়াদব ছোকরাটার। এতোরাতে ফোনটা রিসিভ করার কী দরকার ছিলো?’

প্রিয়তার বলার ভঙ্গি আর প্রশ্রয়ে হেসে ফেললাম আমি। আমার ছোট্ট, সুন্দর পৃথিবীতে যে গুটিকতক মানুষগুলো আমার মন খারাপে কেঁদে ভাসিয়ে দিতে পারে। অস্থির হয়ে পড়ে। আমাকে আগলে রাখার জন্য গোটা পৃথিবীর সাথে লড়ে যাওয়ার শক্তি রাখে। সেই মানুষগুলোর মাঝে এই ছোট্ট, সরল মেয়েটির নামটা জ্বলজ্বল করে উঠতেই শান্তিতে ভরে গেল মন। প্রিয়তা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ চল। বেহুদা বসে থেকে লাভ নেই। ব্যাটাকে একটু মশলা মেরে আসি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,

‘ মানে?’

প্রিয়তা আমার ডান হাতটা টেনে ধরে বলল,

‘ মানে কিছুই না। তোর হয়েও না হওয়া প্রেমের জন্য এতটুকু ডেডিকেশন দেওয়া যেতেই পারে। তোর জন্য পাহাড়াদারও সই। তোদের প্রেমের ঘাটে আমি হবো দক্ষ পাহাড়াদার।’

ঘড়ির কাটাটা যখন সাড়ে চারটা ছুঁইছুঁই ঠিক তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম আমরা। একদম নিঃশব্দ পায়ে, কচ্ছপের গতিতে পেরিয়ে গেলাম পাঁচ তলার সিঁড়ি। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড নামক টিয়াপাখিটা যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শুকিয়ে আসা কন্ঠনালীটা স্থবির হয়ে গেল নানা আশঙ্কায়। পাঁচ তলার সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদের সিঁড়ি পেরুতেই চোখে পড়ল সচেতনভাবে খোলে রাখা দরজা। অনুভব করলাম ‘অপরিচিত হয়েও পরিচিত’ মানুষটির উপস্থিতি। প্রিয়তা আমার ডানহাতটা আলতো চেপে ধরে অভয় দিল। আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে দরজাটা আলতো ধাক্কা দিতেই এক মুঠো ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল আমার চোখ-মুখ। বুকের ভেতর অল্পবিস্তর সাহস জড়ো করে অবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে পা বাড়ালাম। ধূ ধূ নীরব ছাদের নিস্তব্ধতা যেন চোখের পলকেই গ্রাস করল আমায়। কোথা থেকে ছুটে এলো গম্ভীর, শান্ত স্বর। মৃদু কেঁশে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে বলল,

‘ এইযে, এদিকে ম্যাডাম।’

আমি পাশ ফিরে চাইলাম। দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী পুরুষটিকে দেখে ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো মন। ধ্রুব আমায় দেখে মৃদু হাসল। হাতের ফোনটা পকেটে গুঁজে বুকের ওপর হাত মুড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ধ্রুব তার গম্ভীর, শান্ত চোখদুটো মেলে আমার ছোট্ট, কোমল মুখটির দিকে চেয়ে রইলো অপলক। ধ্রুবর এমন দ্বিধাহীন মাদক চাহনিতে এলোমেলো হয়ে গেলাম আমি। চোখদুটো সরিয়ে নিয়ে আড়চোখে চাইলাম। ধ্রুব তখনও অনড়, অবিচল।

‘ বলছো না যে?’

রাতের শেষ প্রহরে, ধূ ধূ নিস্তব্ধ ছাদে হঠাৎ ধ্রুবর কথায় চমকে উঠলাম আমি। অসচেতন কন্ঠে বললাম,

‘ হু?’

অনুসন্ধানী, তীক্ষ্ণ চোখদুটো আমার মুখের উপর মেলে রেখেই উত্তর দিলো ধ্রুব,

‘ যা বলতে ডাকলে। বলো, শুনি।’

আমি আলতো ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। মান্ধাতার আমলের মস্তিষ্কটা সাথে সাথেই ফিডব্যাক দিলো। ভয়াবহ দুঃসংবাদ দেওয়ার মতো জানাল, ডিয়ার নিশু? উই আর এক্সট্রিমলি সরি। মস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাসের নিঃসরণ মাত্রাহীনভাবে বাড়ছে। আমাদের হাতে কিচ্ছু নেই। এই দীর্ঘদেহী মানবটির সামনে শরীরের কোনো সিস্টেমই ঠিক রাখা যাচ্ছে না। তুমি বোধহয় তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছ। এই পরম দুঃসংবাদ শুনে থমথমে মুখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ দেখুন… ‘

ধ্রুব আমায় থামিয়ে দিয়ে মাঝ পথেই বলল,

‘ কী দেখাতে চাও?’

ধ্রুবর কন্ঠে আদ্র কৌতুকের ছোঁয়া পেতেই ক্ষেপে গেল মন। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললাম,

‘ ফাজলামো করছেন?’

ধ্রুব খুব নির্দোষ কন্ঠে বলল,

‘ ফাজলামো কেন করব? তোমার সাথে কী আমার ফাজলামোর সম্পর্ক? এমন একটা রাতে কী দেখাতে চাও তাই ভেবে চিন্তা হচ্ছিল। একটু পরই তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠে পড়বে সবাই। বাইরে তোমার কাজিনও দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চয়। উল্টাপাল্টা কিছু…’

আমি ধমক দিয়ে বললাম,

‘ একদম চুপ।’

ধ্রুব মিটিমিটি হেসে বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল,

‘ আচ্ছা।’

ধ্রুবর সেই হাসি দেখে আবারও বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম আমি। অধৈর্য, অসহায় চোখে চেয়ে থেকে একদম মুখস্থের মতো বলে গেলাম,

‘ দেখুন, ভাইয়া।’

ধ্রুব আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হয়ে বলল,

‘ ভাইয়া ডাকছো কেন?’

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই গলায় শব্দ করে হাসল ধ্রুব। কোনোরকম নিজের হাসি থামিয়ে বলল,

‘ আচ্ছা, আচ্ছা বলো।’

আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললাম,

‘ আপনার আর আমাকে নিয়ে যে রিউমারটা আগুনের গতিতে ছড়াচ্ছে তাতে আমার কোনো হাত নেই। আমি নিজেই ভুক্তভোগী এবং মহাবিরক্ত। এই শহরটা আমার ভীষণ প্রিয়। এজন্যই এই শহরে থাকা, পড়াশোনা করা। আমি এই শহরটা ছাড়তে চাইছি না। দু’দিন পর আমার এক্সাম অথচ আমি পড়াশোনাটা পর্যন্ত করতে পারছি না। আমার দমবন্ধ লাগছে, ধ্রুব। প্লিজ, আমায় আর দুশ্চিন্তা না দিয়ে একটা সমাধান বের করুন। আই রিকুয়েষ্ট ইউ!’

কথা শেষে চোখ তুলে ধ্রুবর দিকে চাইতেই খেয়াল হলো, কী অবলীলায় পাল্টে গেছে আমার সম্বোধন। আমার থেকে বয়সে এতোবড় একজন মানুষকে নাম ধরে সম্বোধন করেছি ভেবে নিজের মনেই চমকে উঠলাম। ধ্রুব আমার দিকেই চেয়ে আছে। অনুভূতিশূন্য, শক্ত মুখ। কপালের কুঞ্চনে গাম্ভীর্য। ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে নিরুপায় হয়ে বলল,

‘ আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো পার্মানেন্ট সমাধান নেই নিশু। সমাধানটা তোমার কাছে। তুমি যতদিন এখানে থাকবে ততদিন এই গুজবের কোনো উপসংহার টানা সম্ভব হবে না। আমি তোমাকে ফোর্স করছি না। কিন্তু তোমার উচিত বাসাটা ছেড়ে দেওয়া। “আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড” বলে একটা কথা আছে। তুমি তাদের চোখের আড়াল হলেই ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে ওরা। নয়তো প্রতিনিয়ত তারা আমাদের খেয়াল করবে। আগ্রহ জন্মাবে। নতুন নতুন কথা উঠবে।’

আমি মাথা নোয়ালাম। ধ্রুবর মুখে আমার বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথাটা শুনে কেমন এক মন খারাপে থম ধরে গেল বুক। তার অবলীলায় ছোঁড়া প্রতিটি বাক্যই নির্মমভাবে বুঝিয়ে দিল, আমার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। আমি তার কাছে অনুভূতিহীন সমস্যা মাত্র! এমন উদ্ভট চিন্তায় নিজের মনেই চমকে উঠলাম আমি। মনকে এই প্রথম ভয়াবহভাবে শাসালাম। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বললাম,

‘ বেশ! আমি বাসাটা ছেড়ে দেব।’

ধ্রুবর অপলক দৃষ্টিটা এবার একটু কাঁপল। মৃদু হেসে বলল,

‘ আমাদের একে অপরের সাথে আর কখনো কথা না বলাই শ্রেয়। অল দ্য বেস্ট, নিশিতা।’

ধ্রুবর মুখে আমার পুরো নাম শুনে টলমলে আবেগে ভরে গেল মন। পরমুহূর্তেই বোবা অভিমানে ঝুম হয়ে বললাম,

‘ থেংকিউ। ইউ ট্যুউ।’

ধ্রুব মাদক হাসল। কাছের এক মসজিদ থেকে আরও একটি নতুন দিনের আহ্বান আর এই অদ্ভুত সম্পর্কের বেদনাদায়ক সমাপ্তির ঘোষণা ভেসে আসতেই নড়ে উঠলাম দু’জনে। ঠোঁটের কোণে অহেতুক হাসি টানলাম। ধ্রুব নরম কন্ঠে বলল,

‘ তুমি নেমে যাও। আমি কিছুক্ষণ থাকব।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব ঠোঁট টেনে হাসলো। আমি প্রিয়তাকে নিয়ে ঘরে ফিরে এসেই বিছানায় গা এলালাম৷ কম্বলে মুখ ঢাকতেই প্রচন্ড মন খারাপে ছেয়ে গেল মন। ধ্রুবর প্রতি রাগ হলো। জেদ হলো। কেন সে এতো নির্লিপ্ত আচরণ করলো? কতো অবলীলায় জানিয়ে দিলো তার সাথে কথা না বলার আদেশ। ধ্রুবর নির্লিপ্ততায় বুকের ভেতর শুরু হলো অপ্রত্যাশিত রক্তক্ষরণ। ধ্বংসাত্মক এক ঝড়। প্রিয়তা আমায় একটি কথাও জিজ্ঞেস করল না। কম্বলের নিচে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ ইট’স ওকে, জান।’

প্রিয় মানুষের প্রশ্রয়ে হঠাৎ কেমন ফুপিয়ে কেঁদে উঠল মন। কেন কাঁদলাম? কীসের দাবীতে এই চোখের জল? তা নিয়ে একবিন্দুও ভাবতে ইচ্ছে হলো না। প্রিয়তার উষ্ণ শরীরের ওমে ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘ আই হেইট হিম, প্রিয়। আই হেইট হিম।’

প্রিয়তা হাসল। আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ আই নো, জান। ইউ শুড হেইট হিম। আই হেইট হিম অলসো।’

আমি আর প্রিয়তা চুপটি করে দিনের সবচেয়ে সুন্দর আহ্বান শুনলাম। পুব আকাশে ছড়িয়ে পড়া লাল আলোয় পাখিদের আনন্দ দেখলাম। হাজারখানেক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভীষণ অকারণে, ভীষণ অকারণ এক মানুষের জন্য অকারণ কাঁদলাম। ঘরে বাজার বলতে কিচ্ছু নেই। ছোট ভাইয়ার করে রাখা বাজার শেষ হয়েছে আজ দুদিন হলো। জমিলা আপা রান্না করতে এলেই চেঁচামেচি করবে ভেবেই ঝটপট উঠে পড়ল প্রিয়তা। আমাকে টেনেটুনে উঠে বসালো। অলস মন নিয়ে জীবনের প্রথমবার কাঁচা বাজারে যাব বলে তৈরি হলাম। আর তখনই অদ্ভুত এক কান্ড ঘটল। বাজারের ব্যাগ হাত বেরিয়ে পাঁচ তলার সিঁড়িতে পা রেখে জুতোর বেল্ট লাগাতে গিয়েই খেয়াল করলাম তিন জোড়া পা পথ না পেয়ে থমকে গেল আমার থেকে হাত খানেক দূরে। আমি ধীরে ধীরে চোখ তুলে চাইলাম।

# চলবে…..

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৯|

সকালের প্রভাতছটা আলো আছড়ে পড়ছে সিঁড়ির গায়ে। লম্বা, সরু আলোর রেখায় লক্ষাধিক ধুলো-বালির সমাহার। আমি সেই আবিল আলো ভেদ করে চোখ তুলে চাইলাম। অস্বচ্ছ আলোয় পাঁচ তলার সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা থমথমে, গম্ভীর মুখখানি দেখেই তটস্থ হয়ে গেল মন। কলের পুতুলের মতোই টুপ করে সোজা হয়ে গেল শরীর। মেরুদণ্ড বরাবর বয়ে গেল অদ্ভুত শীতল শিহরণ। প্রিয়তা দরজায় তালা ঝুলিয়ে পেছনে ফিরেই চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই সূক্ষ্ম আমোদে চকচক করে উঠল ছলছলে হরিণনয়ন। আমার কানের কাছে মুখ নুইয়ে কৌতুক করে বলল,

‘ তোর শ্বশুর তো হেব্বি দেখতে, নিশু।’

আমি কঠিন চোখে চাইলাম। তটস্থ হাতে গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে শশব্যস্ত পায়ে সরে দাঁড়ালাম। ধ্রুবর বাবা অর্থাৎ আমার অ-শ্বশুর মহাশয় দীর্ঘদেহী পুরুষ। স্বাস্থ্যবান শরীরে হালকা রঙের ফতুয়া ও সাদা পাজামা। ঢলঢলে চেহারায় মেহেদী রাঙা দাড়ি। চোখদুটো ভয় ধরানো শীতল। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। গায়েগতরে ধ্রুবর মতো হলেও চেহারাটা একটু ভিন্ন রকম। আমি শুকনো ঢোক গিলে আড়চোখে ভদ্রলোকের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভাইয়ের দিকে চাইলাম। ধ্রুব পিঠের পেছনে হাত বেঁধে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অস্বস্তিতে কালো মুখটা অল্প একটু নোয়ানো। আবিরের হাতে গুটিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগ। চোখদুটোতে চকচকে খুশি। আমি চোখ সরিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াতেই উচ্ছ্বাসে ফেঁটে পড়ল আবির। খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠে বলল,

‘ আরে ভাবী… ‘

প্রায় সাথে সাথেই ভারি পায়ে আবিরের ডান পা’টা চটকে দিয়ে কেশে উঠলো ধ্রুব। বড় ভাইয়ের সতর্কবার্তায় সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখ। ডান পা’টা ধরে লাফিয়ে উঠে যন্ত্রণায় কুঁচকানো মুখে বলল,

‘ ভা-বী না, আপু। নিশু আপু ভালো আছো?’

আমি উত্তর দিলাম না। প্রিয়তা ঠোঁট টিপে হাসল। সুযোগ বুঝে আহ্লাদে গলে গিয়ে অত্যন্ত লক্ষ্মী মেয়েটির মতো বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম, চাচা।’

আহ্লাদে গলে যেতে যেতেই দুই আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে আমার পিঠের পেছনটাই তীক্ষ্ণ আঘাত করল প্রিয়তা। ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে ইশারা করতেই শশব্যস্ত হয়ে একদম না শোনার মতোই মৃদু স্বরে বললাম,

‘ আসসালামু আলাইকুম।’

আমার কন্ঠটা কানে যেতেই কেশে উঠলো ধ্রুব। ভদ্রলোক গম্ভীর, শীতল চোখে ছেলেদের দিকে তাকালেন। বাবার দৃষ্টির ভয়েই কী-না কে জানে? অত্যধিক লজ্জায় দিশেহারা হয়ে লাল হয়ে গেলো ধ্রুবর ইস্পাত কঠিন মুখ। আমতা আমতা করে বলল,

‘ বাবা? আপ..আপনারা আসুন। আমি নিচে যাচ্ছি।’

কথাটা বলে এক মিনি সেকেন্ডও অপেক্ষা করল না ধ্রুব। আমাদের পাশ কাটিয়ে বাতাসের বেগে ছুটে গেল নিচে। অদ্ভুত কোনো কারণে বিস্ময়কর লজ্জায় মিইয়ে গেলাম আমিও। অকারণ লজ্জায় অস্থির হয়ে পড়তেই হস্তী গম্ভীর পায়ে পাঁচ তলার সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নেমে গেলেন ভদ্রলোক। বাবার পিছু পিছু বাধ্য বাচ্চাটির মতো মাথা নুইয়ে নেমে গেল আবির। বুঝলাম, ছেলেদের প্রতি আমার অ-শ্বশুর মশাইয়ের আচরণ খুব একটা বন্ধুসুলভ নয়। বরং ভয় ধরানো, শীতল। আমি আর প্রিয়তা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রিয়তা আমার দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। আমি কটমটে চোখে চাইতেই প্রেতাত্মার মতো বিল্ডিং কাঁপিয়ে হেসে উঠল প্রিয়তা। আমার লাল হয়ে যাওয়া ছোট্ট মুখটির দিকে চেয়ে বলল,

‘ দেবর, বর, শ্বশুর সবার সাথে তোর সিঁড়িতেই দেখা সাক্ষাৎ হয়ে গেল নিশু। এখন শুধু শাশুড়ী মহাশয়ার অপেক্ষা। সত্যিই যদি তোদের কখনো বিয়েশাদি হয় তাহলে বাসরটা সিঁড়িতে সাজালে কেমন হয়, বল তো? তারপর ধর ডেলি….’

প্রিয়তার কথায় পেটের ভেতর আলতো সুড়সুড়ি হলেও আগুন চোখে চাইলাম আমি। প্রিয়তা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত থামল না তার হাসি। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমার কিছু মারাত্মক অশ্লীল কথা বলে ফেলতে ইচ্ছে করছে নিশু। পেটটা ফেঁটে যাচ্ছে। বলে ফেলি?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। প্রিয়তার মুখের লাগাম ছুটে যাওয়ার আগেই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম গ্রাউন্ডে।

ধ্রুবদের বিল্ডিং থেকে সাংকিপাড়া কাঁচা বাজার কেবল দশ মিনিটের পথ। হাঁটা পথে পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় অনায়াসে। আমি আর প্রিয়তা হাঁটা পথ ধরলাম। বেশ কিছু কাঁচা সবজি কিনে মাছের বাজারে ঢুকতেই মাথায় হাত পড়লো দুজনের। জীবনের প্রথম বাজারে এসেছি। চারদিকে হৈ হৈ মানুষ। মাটিটা প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। পা’টুকু ফেলার জো নেই কোথাও। দোকানে দোকানে সারি সারি মাছ। কিছু কিছু মাছের দৈর্ঘ্য দেখে বিস্মিত দু’জনের চোখ। এদিক-ওদিক ঠেলা ধাক্কায় একরকম বিহ্বল হয়ে পড়লাম আমরা। কোন মাছটা কিনবো? কীভাবে কিনবো? দাম কেমন? কিচ্ছু না জানা আমরা হঠাৎই নিজেদের গৌণ মূর্খ বলে আবিষ্কার করলাম। প্রিয়তা আর আমি কিছুক্ষণ মুখ কাঁচুমাচু করে একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানের সব মাছ আমার কাছে একরকম মনে হলেও একটা মাঝারি আকারের মাছের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললাম,

‘ মামা এটা কী মাছ?’

সাথে সাথেই কয়েক জোড়া চোখ স্প্রিংয়ের মতো ঘুরে এলো আমার উপর। আমি চোখদুটো তুলে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ধ্রুবরা এই দোকানেই মাছ দেখছে খেয়াল হলে পৃথিবীর একমাত্র মাছের দোকান হিসেবেও এই দোকানের চৌকাঠ মারাতাম না আমি। নিজের গালে কঠিন একটা চড় বসানোর দুর্দমনীয় ইচ্ছেকে প্রশ্রয় না দিয়ে আড়চোখে চাইলাম আমি। ধ্রুবর বাবার ঠান্ডা দৃষ্টি আর ধ্রুবর কৌতুকে ভরা চাহনি দেখে আমার সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, হে বিধাতা? দয়া করে এই শেষ বারের মতো পৃথিবীটা দু’ভাগ করে আমায় ভেতরে ঢুকিয়ে নাও। এই ভয়াবহ অস্বস্তি থেকে রক্ষা করো। আমি জীবনেও আর নামায ছেড়ে দেব না। দিনে তিনবেলা করে দান করব। সত্যি! সত্যি! তিন সত্যি! আমার ‘তিন সত্যি’ কাজে দিলো না। বিধাতা আমার আকুতি শুনলেন না। বিশাল একটা মাছ কাটতে কাটতে মাছওয়ালা মামা মৃদু হাসলেন। বললেন,

‘ এইটা রুই মাছ মামা।’

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, আসমানটা ফেঁটে যাক। আমার মান্ধাতার আমলের অত্যধিক স্লো মাথাটা পাকা তরমুজের মতো ফেঁটে ভর্তা হয়ে যাক। নয়তো এখনই ওই সামনের রেললাইনটাতে শুয়ে পড়ি। একটা দৈব ট্রেন এসে ছিন্নভিন্ন করে দিক আমার বেয়াদব মস্তিষ্ক। আমি আড়চোখে চাইলাম। ধ্রুব তখনও ঠোঁট টিপে হাসছে। তার এই গা জ্বালানো বিশ্রী হাসিটা দেখেই মেজাজ জ্বলে গেল আমার। ধ্রুব নামক বেয়াদব লোকটাকে সটান একটা চড় বসাতে ইচ্ছে হলো। আমি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। নিজেকে যথারীতি শান্ত করে প্রিয়তার হাতটা টেনে মৃদু কন্ঠে বললাম,

‘ চল, অন্য দোকানে যাই।’

প্রিয়তা অবাক চোখে চাইল। আমার বাদ বাকি মানসম্মানটুকুও মশলা বাটার মতো পিষে ফেলে বলল,

‘ কেন? এমনিতেও তো কোনো মাছ চিনিস না। রুই-কাতলা সবই আমাদের এক। এইখান-ওইখান থেকে কেনাও ওই একই। তাহলে শুধু শুধু না ঘুরে এখান থেকে কিনে নিলেই তো হয়?’

আমি কঠিন চোখে চাইলাম। আমার অ-শ্বশুর মশাইয়ের ভয়াবহ ভদ্র ছেলেটার ঠোঁট টেপা হাসি এবার দীর্ঘ হলো। চট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চাপা হাসিতে ভরিয়ে ফেলল ঠোঁট। আমার সারা শরীর রি রি করে উঠল প্রচন্ড মেজাজ খারাপের দায়ে। প্রিয়তার দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘ যাবি তুই?’

প্রিয়তা এবার আর তর্ক করার সাহস করে উঠল না। আমি মনে মনে নিজেকে চড়, লাথি, থাপ্পড় আর কঠিন কিছু গালি দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম৷ মাছের বাজারের মাছগুলোকে আমার হঠাৎ পরীক্ষার খাতার সবচেয়ে কনফিউজিং চার অপশনের মতো মনে হলো। কোনটা থেকে কোনটা সিলেক্ট করব, কিচ্ছু বুঝে পেলাম না। আমার অ-শ্বশুর মশাইকে দেখলাম বিশাল বড়ো বড়ো তিনটা মাছ কাটিয়ে বাজারের ব্যাগে চালান করে দিলেন। বিস্মিত প্রিয়তা গলা নামিয়ে বলল,

‘ তোর শ্বশুরবাড়ির সব ক’টা রাক্ষস নাকি রে? এতো মাছ দিয়ে করবেটা কী?’

আমি চোখ রাঙিয়ে চাইলাম। ধমক দিয়ে বললাম,

‘ একদম শ্বশুর বাড়ি শ্বশুর বাড়ি করবি না। সব জেনেশুনেও অযথা ক্ষেপাচ্ছিস কেন আমায়? এই বেয়াদব, অসভ্য ছেলেটাকে আমি মরে গেলেও বিয়ে করবো না। পৃথিবীর একমাত্র ছেলে হলেও না।’

প্রিয়তা মুখ ভেঙাল। এই ভিড়ের মধ্যেও দ্রুত পা চালিয়ে বলল,

‘ এইজন্যই তো রাতে কেঁদেকেটে মরে যাচ্ছিলি।’

প্রিয়তার কথাটা শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছানোর সাথে সাথেই নিজের গালে আজকের দিনের তিন নম্বর চড়টা বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। এই বেয়াদব ছেলের জন্য ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছি ভাবতেই দৈব ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে ইচ্ছে করল মস্তিষ্ক। শেষমেশ মাছ কেনা ক্ষান্ত দিয়ে মাছের বাজার থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। পুরো বাজার ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অজস্র কাঁচা বাজারে ভরিয়ে ফেললাম দু’দুটো বাজারের ব্যাগ। ভয়াবহ ভারি ব্যাগদুটো টানতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো দুজনার। বাজার থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে মোড় পর্যন্ত যেতেই হাঁপানি শুরু হয়ে গেল প্রায়। প্রিয়তা হাতের কাছের একটা রিকশাকে ডেকে শুধাল,

‘ মামা, সামনের মোড় পর্যন্ত যাবেন?’

রিকশাচালক অলস ভঙ্গিতে বলল,

‘ যামু তয় তিরিশ টাকা।’

আমি আর প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে চাইলাম। প্রিয়তা মারমুখো হয়ে কিছু বলবে তার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল গমগমে এক কন্ঠস্বর। মেঘমন্দ্র কন্ঠে শুধাল,

‘ রিকশা সামনের মোড়ে যাবে?’

রিকশাওয়ালা এবার কিছুটা তটস্থ হলো। মিনমিন করে বলল,

‘ জি। যামু।’

আমি মাথা নুইয়ে আড়চোখে চাইলাম। আমার অ-শ্বশুর মহাশয়ের পেছনে বাজারের ব্যাগ হাতে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসভ্য ছেলেটার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তখনই। ধ্রুব কয়েক সেকেন্ড আমার চোখের দিকে চেয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবির ধীরে ধীরে আমাদের দিকে চেপে এসে দাঁত বের করে হাসল। আমার অ-শ্বশুর মশাই গমগমে কন্ঠে শুধালেন,

‘ কত নিবা?’

‘ বিশ টাকা, চাচা।’

রিকশাওয়ালার আকস্মিক কথা বদলে চোখ বড় বড় করে চাইলাম আমরা। চোখের আগুনে ঝলসে দেওয়ার মতোই বিদ্রোহী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো প্রিয়তা। ভাবখানা এই, এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয়বার এমন বাটপারি চিন্তা করলে ঠ্যাং ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেব একদম। চ্যাংড়া রিকশাওয়ালা প্রিয়তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। আমার অ-শ্বশুর মশাই মেঘমন্দ্র কন্ঠে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,

‘ পনেরো টাকা দেওয়া হবে।’

একে তো স্থানীয় লোক। তারওপর দু’দুটো শক্তি সামর্থ্য ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে প্রত্যুত্তর করার সাহস না পেয়ে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল অল্প বয়স্ক রিকশাচালক। আমি আর প্রিয়তা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য একটা রিকশা দেখতে উদযোগ করতেই আমাদের দিকে চাইলেন ভদ্রলোক। আমাদের দুজনকে দুর্নিবার বিস্ময়ে ছুঁড়ে দিয়ে অদ্ভুত কোমল কন্ঠে বললেন,

‘ যাও, উঠো।’

আমি আর প্রিয়তা একে অপরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে অস্পষ্ট কন্ঠে বললাম,

‘ জি?’

ভদ্রলোক শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,

‘ উঠো।’

আমি আর প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড স্থির দাঁড়িয়ে থেকে রিক্সায় উঠতে নিতেই বাবার সূক্ষ্ম ইশারায় মাথা নেড়ে এগিয়ে এলো ধ্রুব। একদম নিঃসংকোচে আমার হাত থেকে ভারি বাজারের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে তুলে দিল রিক্সায়। আমি আর প্রিয়তা রিক্সায় চেপে বসতেই নিজেদের ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা মাছের বিশাল একটা পুটলি আমাদের ব্যাগে চালান করে দিতে দিতেই ঠোঁট টিপে হাসল ধ্রুব। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে একবার ব্যাগ তো একবার ধ্রুবর দিকে চাইলাম। হতভম্ব হয়ে বললাম,

‘ এসব? এসব কী?’

ধ্রুব উত্তর দিল না। ততক্ষণে আরও একটি রিক্সা ডেকে তাতে চেপে বসেছে আমার ‘হঠাৎ পেয়ে যাওয়া’ শ্বশুর মশাই আর অতি আদুরে দেবর। ধ্রুব তীব্র অধিকারবোধের সাথে রিক্সা ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে গা জ্বালানো হাসি হাসল। আমার ছোট্ট, বিভ্রান্ত মুখটির দিকে চেয়ে নিচু কন্ঠে বলল,

‘ মান-ইজ্জত তো শেষ করে দিলেন ম্যাডাম। এখন থেকে একটু বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনাদের জন্য তো ‘ মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটাই আর থাকছে না। আবির ভেবে ধ্রুবকে শাসানো যেমন চলবে না। ইলিশ ভেবে বোয়াল খাওয়াও চলবে না। দে হ্যাভ ডিফারেন্ট টেস্টস্, মিস. প্রেমিকা।’

আমি উত্তর না দিয়ে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব তার বিশেষ গা জ্বালানো হাসিটা হেসে সরে দাঁড়াতেই রিক্সা ছুটলো শা শা। শীতের সকালের জল মেশানো ফিনফিনে বাতাসটা গায়ে লাগতেই তুলতুলে অনুভূতিতে ছেয়ে গেল বুক। প্রিয়তা কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বলল,

‘ ব্যাপারটা কী হলো বল তো? তোর শ্বশুর কী তোদের সম্পর্ককে নীরব সম্মতি দিয়ে দিল? নয়তো বাতাসে ভেসে আসা পুত্রবধূর প্রতি এতো মায়া কেন? আশ্চর্য!’

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here