প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,১০,১১

0
322

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,১০,১১
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১০|

ফেব্রুয়ারির শীতল সকাল। বাতাসে কুয়াশা মাখানো ঠান্ডা স্পর্শ। হালকা করে বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে গিয়ে শা শা করে উড়ছে। তার থেকেও আদর নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে আমার অদ্ভুত অনুভূতির দল। রেললাইনের পাশটাতে ওই উশৃংখল ছেলেদের দল। মোড়ের কাছের বাড়িটির নুইয়ে পড়া জবাফুলের গাছ। মুক্ত আকাশে ক্লান্তি ঢেলে উড়ে যাওয়া ওই ছোট্ট আদুরে পাখি। আর এই রিক্সার নিরন্তর ছুটে চলা। সবকিছুতেই যেন ভরে আছে আজ অস্থির, দমবন্ধ অনুভূতি। বুকের ভেতর আলতো গুদগুদি হচ্ছে। একদম অযথায় লজ্জারাঙা হয়ে যাচ্ছে ঠোঁট। আমি চোখ তুলে চাইতে পারছি না। ঠোঁটের লজ্জাভাব লুকোতে পারছি না। বুকের ভেতর চঞ্চল তুলতুলে ভাবটাকে আটকে রাখতে পারছি না। প্রিয়তার অযথা কথাগুলো শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ওড়নার আঁচলে মুখ ঢেকে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সুপ্ত কোনো গহ্বরে। বরফ শীতল শব্দহীন কোনো হিমাগারে। যেখানে কেউ থাকবে না। চোখ তুলে চাইবে না। চাপা হাসবে না। শুধু থাকবো আমি আর আমার বুকভর্তি সহ্যহীন লজ্জা। উফ! সে কি অসহ্যকর লজ্জা! আমার এই দুঃসহ লজ্জার মাঝেই গন্তব্যে পৌঁছালাম আমরা। ঠিক তার পরপরই আমাদের পেছনে এসে থামলো ধ্রুবদের রিক্সাটা। আমি মুখ নিচু করে নেমে দাঁড়ালাম। আমার অ-শ্বশুর মশাই রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে গুরুগম্ভীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। ভারি একটা ব্যাগ হাতে আবিরও গেল তাঁর পিছু পিছু। ধ্রুব নামল সবচেয়ে আলস্য ভরে। আমি প্রিয়তাকে চোখ রাঙিয়ে তাড়া দিয়েই নিজেদের ব্যাগটা হাতে তুলে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। যেভাবেই হোক ধ্রুবর আগে ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে হবে। কিছুতেই এই অসভ্য লোকটির মুখোমুখি হওয়া যাবে না। লোকটা দুর্দান্ত বদ। আর যায় হোক, লজ্জায় লাল, নীল হয়ে এই বদ লোকের সামনে যাওয়া চলবে না। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। আমার ভাগ্যটাকে শিলনোড়া দিয়ে পিষে ফেলে এগিয়ে এলো প্রিয়তা। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ এই সাত সকালে হঠাৎ এমন লজ্জায় মরে যাচ্ছিস কেন নিশু? তোকে দেখে মনে হচ্ছে, তুই বাসর ঘরে বসে আছিস। আর তোর বর অতি অবশ্যই তোকে খুব দুষ্টু দুষ্টু কথা বলছে। কাহিনি কী জান?’

আমি অসহায় চোখে চাইলাম। প্রিয়তার ঠিক পেছনেই ব্যাগ হাতে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে সাত তলা থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। ‘ভুল সময়ে ভুল কথা বলা’ প্রিয়তাকে কঠিন দুটো চড় বসিয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে বেদুইন হয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। আমি নিরুপায় চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুবর ঠোঁটে তখন অসহ্যকর চাপা হাসি। চোখদুটোতে চকচকে কৌতুক। নিজের এই করুণ পরিণতিতে আমার নির্দোষ অসহায় মন হাহাকার করে উঠে বলল, ‘ হোয়াই মি, বিধাতা? হোয়াই মি?’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কোমল মানসম্মানের ভয়াবহ পেষণটা হজম করে গম্ভীর মুখে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। আবির দু’তলার গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে উপরে উঠতে দেখেই টলমলে সমবেদনা জানিয়ে বলল,

‘ থাক, ভাবী। মন খারাপ করে না। আমরা সবাই ভেবে নিবো তুমি একদম লজ্জা পাচ্ছো না। কেউ তোমাকে দুষ্টু দুষ্টু কথাও বলছে না। কুল।’

আমি ‘কুল’ হতে পারলাম না। ঠোঁট ফুলিয়ে করুণ চোখে চাইলাম। প্রিয়তা নির্দোষ চোখে সমবেদনা জানালেও। ধ্রুব গলায় শব্দ করে হেসে উঠল। আমি মনে মনে নিজেকে কঠিন কিছু গালি দিয়ে আগুন চোখে চাইতেই ঠোঁটদুটো চেপে গা জ্বালানো হাসি হাসল ধ্রুব। হাত বাড়িয়ে আমার হাতের ভারি ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে চাপা বিদ্রুপের কন্ঠে বলল,

‘ ইট’স ওকে নিশু। আমরা কেউ বুঝিনি যে তুমি লজ্জা পাচ্ছো।’

আমি জ্বলন্ত চোখে চাইলাম। রুক্ষ কন্ঠে বললাম,

‘ আপনি হাসছেন কেন?’

ধ্রুব উত্তর দিলো না। আমার যেখানে শূন্য হাতেই হাঁফ ধরা অবস্থা। সেখানে দুই হাতে দুটো ভারি ব্যাগ নিয়ে অবলীলায় এক এক করে চারতলায় উঠে এলো ধ্রুব। নিঃশ্বাসে কোনো ক্লান্তি নেই। চোখদুটোতে টলমলে কৌতুক। আমাদের দরজার সামনে ব্যাগটা রেখে আমার দিকে চাইল। তার চোখে মুখে এখনও চাপা হাসির স্পর্শ। আমি তেজ নিয়ে বললাম,

‘ আপনি আবার হাসছেন!’

ধ্রুবর হাসি এবার চওড়া হলো। ঠোঁটের কোণে জ্বালাময় হাসি ল্যাপ্টে রেখে আমার মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে দিয়ে বলল,

‘ আমাকে দেখে এমন লজ্জায় গলে যাওয়ার কারণ কী, ম্যাডাম?’

আমি হতভম্ব চোখে চাইলাম। একটা মানুষ কতটা বদ হলে মুখের উপর এমন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারে তা বহু ভেবেও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বুকের ভেতর বন্দী থাকা করুণ মনটা দেয়ালে মাথা ঠুকে সন্ন্যাস নেওয়ার আয়োজন করলো। ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে কেঁদে ফেলার জোগার হলেও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ বাজে কথা।’

দুপুর দিকে বাজার গোছাতে এসে মাছ দেখে চোখ কপালে তুললেন জমিলা আপা। আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ আজকে কী এই মাছ ছাড়া বাজারে কোনো মাছ উঠে নাই? উপরতলার খালাম্মাদেরও এই মাছই গুছাইয়া রাইখা আইলাম।’

জামিলা আপার মন্তব্যে মৃদু কেশে উঠলাম আমি। মাছটা নিয়ে মনের ভেতর কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। চেনা নেই জানা নেই এমন কারো থেকে এভাবে কিছু নেওয়া সম্ভব? কী ভাবলো তারা? কী মনে করেই বা দিলো এগুলো? আমার মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। মাছগুলো এখন আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় ভেবে আরও বেশি ছটফট করে উঠলো বুক। প্রিয়তাকে ডেকে বলতেই বিস্ময় নিয়ে চাইলো প্রিয়তা। পরমুহূর্তেই কৌতুক হেসে বলল,

‘ আরে ধুর! শ্বশুর বাড়ির জিনিস না? তোর বরই তো দিলো। চিন্তা কী?’

আমি কঠিন চোখে চাইলাম। ধমক দিয়ে বললাম,

‘ একদম শ্বশুর বাড়ি শ্বশুর বাড়ি করবি না। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে দশ বছর যাবৎ সংসার করছি। আজ হঠাৎ সে মাছ কিনে দিয়েছে। চাইলে গোটা মাছের বাজারটাও কিনে দিতে পারে।’

প্রিয়তা উৎসাহ নিয়ে চাইলো। খুশি হয়ে বলল,

‘ চাইলে কিন্তু পারে। হিসেব করে দেখ, তোর শ্বশুরের কিন্তু বেশ ভালোই টাকা। একবার চিন্তা কর! আমরাই মাসে মাসে দশ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি। প্রতি ফ্লোরে যদি দুটো করে ফ্ল্যাট হয় তবে মাসিক ভাড়ায় আসছে এক লক্ষ টাকা। সামনের ছয় তলা বিল্ডিংটাও নাকি তাদের। হে খোদা! ভাবতে পারছিস?’

আমি উত্তর দিলাম না। প্রিয়তা হাহাকার করে উঠে বলল,

‘ এদের মাসিক টাকার হিসেব করে তো আমারই মাথা চক্কর দিচ্ছে, বন্ধু। দুনিয়া ঘুরছে। এরা মাসে মাসে এতো টাকা করে কী? হায় আল্লাহ! হে খোদা! হে বিধাতা! আমাকে দিয়ে দিতে পারে না?’

আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রিয়তার কথায় আকাশসম বিরক্ত হয়ে চিরচিরে মেজাজ নিয়ে ধ্রুবকে ফোন লাগালাম। কেউ টাকার বস্তা নিয়ে বসে থাকলেও তার থেকে বিনা পয়সায় মাছ নিয়ে খেয়ে ফেলব তা তো হতে পারে না। কক্ষনো না। আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলাম। দুইবারের মাথায় ফোন রিসিভ হলো। আমি কিছু বলার আগেই বলল,

‘ তুমি চকলেট?’

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ওপাশ থেকে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠটা খুব আদর নিয়ে বলল,

‘ আমি চকলেট। তুমি চকলেট নিয়ে আসো। একটা পিও পিও গাড়ি নিয়ে আসবা। ছোট বাইয়া আমাকে… আমাকে….আমাকে এমন জোর-রে আছাড় মারছে। ছাদ থেকে ফেলে দিবে। তুমি ওকে মারবা।’

আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। চিরচিরে মেজাজটা হঠাৎ উৎফুল্লতায় ভরে উঠল। আলতো হেসে বললাম,

‘ তোমার বড় ভাইয়া কোথায় চিওমিও?’

চিওমিও থেমে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভারি অবাক হয়ে বড় ভাইয়াকে ডাকল। ধ্রুব বোধহয় ঘুমুচ্ছিল ভাইয়ের ডাকাডাকিতে সাড়া দিতেই চিওমিওয়ের বিস্মিত কন্ঠে ভেসে এলো,

‘ এখানে মেয়ে কতা কয়। বাবা নাই। আতা গাছে তোতাপাখি। ডালিম গাছে মউ। তুমি.. তুমি বউ?’

চিওমিও কার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম আমি। সেকেন্ড কয়েক পারিপার্শ্বিক শব্দের পর ধ্রুবর ঘুমু ঘুমু গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো। ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

‘ আবির যাও। আবির ডাকে।’

‘ আবির যাব না। আবির মারে।’

‘ আর মারবে না। মা যাও। দেখে আসো, বাবা এসেছে।’

তারপর কয়েক সেকেন্ড চপল পায়ের শব্দ। আমি চুপ করে রইলাম। চঞ্চল পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যেতেই ধ্রুব অদ্ভুত কৃতিত্বের স্বরে বলল,

‘ বলো।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। এই লোক বরাবরই এমন অদ্ভুত উষ্ণ কন্ঠে কথা বলে কেন? যেন কত দীর্ঘ এই পরিচিতির ব্যপ্তি। কত লম্বা এই সাংসারিক জীবন। কত ছোটখাটো অভিযোগ তাকে জানানো বাকি। আর সে উষ্ণ গলায় ঢেলে দিচ্ছে তারই আহ্বান। গম্ভীর প্রশ্রয়। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ মাছের দাম কত?’

ধ্রুব বুঝতে না পেরে বলল,

‘ কীসের মাছ?’

‘ আজ সকালে যে মাছ কিনলেন সেটা।’

ধ্রুব অবাক হয়ে বলল,

‘ কেন?’

আমি একটু থেমে অপ্রস্তুত কন্ঠে বললাম,

‘ আপনাদের মাছের একটা পুঁটলি আমাদের ব্যাগেও এসেছে। সেটা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়৷ তাই দামটা বললে সুবিধা হতো….. ‘

বাক্যটা কীভাবে শেষ করব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। ধ্রুব স্বভাবজাত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ মাছটা বাবা কিনেছেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করো। আমাকে ফোন করেছ কেন?’

আমি একটু হোঁচট খেলাম। বললাম,

‘ আপনার বাবার নাম্বার তো আমার কাছে নেই ধ্রুব।’

‘ আচ্ছা। আমি পাঠাচ্ছি নাম্বার। ফোন করে জেনে নাও।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘ মাছের পুঁটলিটা তো আপনার বাবা আমাদের ব্যাগে চালান করেনি ধ্রুব। যে চালান করেছে উত্তরটা তার কাছেই চাওয়া উচিত নয়?’

ধ্রুব বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে বলল,

‘ না। উচিত নয়। সকালে বাবার সামনে ওভাবে দেখা হওয়াও উচিত ছিল না। এখন আমায় ফোন করেও উচিত কাজ করোনি। কাল রাতে মানা করেছিলাম তোমায়।’

আমি ভয়াবহ এক ধাক্কা খেলাম। অপমানে জ্বলে উঠল বুক। থমথমে কন্ঠে বললাম,

‘ আমি শখ করে আপনার সাথে দেখা করতে যাইনি ধ্রুব। ইট জাস্ট হ্যাপেন্ড।’

ধ্রুবর স্বাভাবিক অথচ শীতল উত্তর,

‘ সেটা তুমি আর আমি জানি নিশু। বাবা জানেন না।’

তারপর একটু থেমে হাসিমুখে শুধাল,

‘ যায়হোক, তোমরা কবে শিফট হচ্ছো? কোনো প্রয়োজন হলে ইউ ক্যান আস্ক আবির৷ ও হেল্প করবে।’

ধ্রুবর শীতল বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। তার আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হলাম। হাসিমুখে বিষ ঢেলে দেওয়ার মতো শোনাল তার কথা। আত্মসম্মানের জ্বালাপোড়নটা সয়ে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ থেংক্স বাট নো নিড।’

#চলবে….

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|১১|

জীবনটা যদি একটা উপন্যাস হয়? তবে আমি হলাম সেই উপন্যাসের সবচেয়ে অদ্ভুত চরিত্র। ভীষণ খোলা আকাশে উড়তে না জানা একমাত্র পাখি। যার প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িমা। সমুদ্দুর সমান জড়তা আর ভয়। এই জড়িমার ঘোরে থিতু হয়ে থাকা অলীক মেয়েটির সবচেয়ে স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো তার অত্যধিক আত্মসম্মানবোধ। যেখানে সে প্রগাঢ়, দ্বিধাহীন, স্থির। একমাত্র এখানে এসেই প্রজ্বলিত হয় তার উত্তাপ। অসহ্য বৈরাগ্য। এবারেও তাই হলো। ধ্রুবর সূক্ষ্ম অপমানটা আমার বিপদাত্মক আত্মসম্মানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটালো। টলমলে আবেগগুলো কপূর্রের মতো উবে গিয়ে থমথমে জেদে পূর্ণ হলো বুক। সর্বদা ভীরু চোখদুটোতে ভর করলো অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ। আমি চট করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, এ জীবনে ধ্রুব নামক মানুষটিকে বিন্দুমাত্র ভাববো না। প্রশ্রয় দেব না। পৃথিবী দু’ভাগ হয়ে গেলেও না। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। ধ্রুব যে আমার জীবনের সাথে কত রকমভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তা আমি ঠিক সেই দিনটিতে উপলব্ধি করতে পারলাম না। ধ্রুবর নাম্বারটা মুঠোফোন থেকে এক রকম নাই করে দিয়ে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটা নিলাম। প্রিয়তাকে ডেকে বললাম,

‘ দুইদিনের মাঝে বাসা চেঞ্জ করব। বাসার ব্যবস্থা কর।’

আকাশে তখন ভীষণ মেঘ। ফেব্রুয়ারিতেও কেমন অদ্ভুত, থমথমে আষাঢ়িয়া রূপ। ধ্রুবর বারান্দার লতানো গোলাপের ডগাটা ঝুলে পড়েছে আমার বারান্দা ছুঁই ছুঁই। রক্তিম ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গোটা ডাল। নিভে আসা মধ্যাহ্ন বাতাসে মৃদু মৃদু দোলছে পুষ্পরাজ্ঞীর ঝাড়। বারান্দার পাঁচিলে ঠেস দিয়ে প্রেমালাপে ব্যস্ত প্রিয়তা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে চাইল। প্রচন্ড বিস্ময়ে ফোনের লাইন কাটতে ভুলে গিয়ে চেয়ে রইল অপলক। সেকেন্ড কয়েক নীরবতার পর চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘ মানে কী!’

আমি শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ মানেটা খুব সহজ। এই সুন্দর, স্বচ্ছল বাসাটা পরিবর্তন করে নতুন একটা বাসায় উঠবো আমরা এবং অবশ্যই তা মীর বাড়ি বা তার আশেপাশের এলাকার ত্রিসীমানার মাঝে থাকবে না।’

প্রিয়তা ঝুলে পড়া চোয়ালে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে বলল,

‘ আশেপাশের এলাকায় থাকবে না তো কোথায় থাকবে? দশ মাইল দূর?’

‘ দরকার হলে তাই। প্রয়োজনে চরপাড়া বাসা দেখব। নয়তো গুলকিবাড়ি অথবা ইটাখলা রোড।’

প্রিয়তা আর্তনাদ করে উঠে বলল,

‘ পাগল! ওদিকে কেন যাব অযথা? ক্যাম্পাস থেকে কত দূর হয়ে যাবে ভাবতে পারছিস?’

‘ ভাবতে পারছি। কিন্তু কিছু করার নেই। তাই ভাবাভাবি বন্ধ করে বাসাটা দেখে ফেল। আমরা কালই শিফট হচ্ছি।’

‘ মানে কী? শিফট হচ্ছি বললেই কী শিফট হওয়া যায় নাকি?সব বাসার মালিক তো তোর আমার শ্বশুর নয় যে চেহারা দেখেই চট করে বাসা দিয়ে দিবে। তাছাড়া এখানে কী সমস্যা? দিব্যি আছি।’

আমি ভ্রু বাঁকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলাম। আমার কঠিন দৃষ্টির সামনে প্রিয়তা কিছুটা থমকালো। অপ্রস্তুত হলো। অতঃপর মিনমিন করে বলল,

‘ প্লিজ জান। বাসা পাল্টানোটা ভীষণ ঝামেলা হবে। আর এতো তাড়াতাড়ি? অসম্ভব। এটলিস্ট একটা মাস হাতে রাখ। তাছাড়া বাড়ির মালিককেও জানানো হয়নি। এক মাস আগে না জানালে তারা বাড়ি ছাড়তে দিবে? ঝামেলা করবে না?’

আমি থমথমে মুখে বসে রইলাম। মস্তিষ্কে তখন কঠিন জেদ। মনের ভেতর অবুঝ বাচ্চামো। দুনিয়াদারির যুক্তিগুলো অপ্রাসঙ্গিক, অনর্থক। বুকের ভেতর একটাই তেজ, আমার চাওয়ায় শেষ চাওয়া। সেখানে সম্ভব অসম্ভবের প্রশ্ন আসছে কেন? আসবে কেন? আসা উচিত নয়। আমি ফুঁস করে শ্বাস ফেলে বললাম,

‘ বেশ! তবে আমি ওদিকে কোনো হোস্টেল দেখে শিফট হয়ে যাচ্ছি। তুই থাক বাসায়। লিড আ হ্যাপি লাইফ।’

প্রিয়তা অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ অযথা জেদ করছিস নিশু। কী সমস্যা হচ্ছে তোর এখানে?’

আমি মেজাজ নিয়ে বললাম,

‘ কী সমস্যা হচ্ছে বুঝতে পারছিস না? আই কান্ট টলারেট হিম। আমি চাই না মনের ভুলেও ধ্রুব আমার সামনে পড়ুক। ব্যস!’

কথাটুকু বলে বারান্দা ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম আমি। প্রিয়তা এলো আমার পিছু পিছু। ঘ্যানঘ্যান করে বলল,

‘ রাগ করে না সোনা। জাস্ট ইগনোর হিম। আমরা নিজের টাকায় থাকছি। তার ঘাড়ে বসে তো খাচ্ছি না।’

আমি উত্তর দিলাম না। প্রিয়তা যুক্তি দিয়ে বলল,

‘ জরিমানা দিয়ে বাসা ছাড়লেও কী এমন হুটহাট নতুন বাসা পাওয়া যাবে নিশু? আর তুই যদি বাসা ছেড়ে হঠাৎ হোস্টেলে উঠিস জেঠু প্রশ্ন করবে না?’

আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বাড়ির সব থেকে অব্যবহৃত, প্রাচীন টেলিফোনটিতে ফোন লাগালাম। এই টেলিফোনটি চিলেকোঠার ঘরে ছোট মামার সবচেয়ে আগ্রহের সম্পত্তি। ছোট মামা বছরের বেশির ভাগ সময়ই নিরুদ্দেশ থাকেন। খোঁজ খবর থাকে না। প্রত্যেকবার ফিরে এসেই তিনি টেলিফোনটা সারাতে দেন। টেলিফোন সারানোর দশ বারো দিনের মাথায় আবারও ডুব দেন কোনো এক অচিনপুরের অচিন কোনো আস্তানায়। ছোট মামার সেই জাদুর টেলিফোন এখন সচল আছে নাকি অবহেলায় ফ্যাকচার হয়ে পড়ে আছে, ধারণা করা যাচ্ছে না। আমি ধারণা করার চেষ্টা ভুলে ফোনে মনোযোগ দিলাম। সুপ্রসন্ন ভাগ্যখানা আরও একটু সুপ্রসন্ন হয়ে মৃতপ্রায় টেলিফোনটির জীবিতাশার বার্তা শোনাল। প্রায় তার পরপরই ভারি, গম্ভীর কন্ঠ বেজে উঠল,

‘ কী করছিস, টুনটুনি? টুনটুনি কী টুনটুন করছে?’

‘ তোমার টুনটুনি টুনটুন ঠুনঠুন কিছু করছে না। টুনটুনির মাথা খারাপ। ভীষণ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।’

‘ সেকি! রাগ হবে অ-ভীষণ। চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে। আমরা তাকে বলব ফুড়ুৎ রাগ। ফুড়ুৎ রাগ না হয়ে ভীষণ রাগ হওয়ার কারণ কী? মাথায় একটা কঠিন ভান দিয়ে রাখ। ভীষণ রাগে মাথা ফাটাফাটি হলে হবে আরেক যন্ত্রণা।’

আমি গম্ভীর কন্ঠে বললাম,

‘ কঠিন ভান দিয়ে হবে না। তার থেকেও শক্ত ভান দিতে হবে। সেটা হলো বুদ্ধির ভান। হঠাৎ একজনের ধারণা হয়েছে আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মারা যাচ্ছি। তার এই ধারণাটা মিথ্যে করে দিতে কী করা যায় বলো তো?’

ছোটমামা সেকেন্ড বিলম্ব না করেই উত্তর দিলেন,

‘ বিয়ে করে ফেল।’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,

‘ বিয়ে করে ফেলব?’

‘ অবশ্যই বিয়ে করে ফেলবি। বিয়ে করে তাকে মামা হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে বুঝাবি হাবুডুবুর কোনো চান্স নেই। তুই অলরেডি ডুবে গেছিস। ডুবে যাওয়া মানুষ হাবুডুবু খায় না।’

আমি হতাশ হয়ে বললাম,

‘ এই ছোট্ট একটা ধারণা পাল্টানোর জন্য আমায় অপরিচিত এক ভদ্রলোককে বিয়ে করে আরেক অপরিচিত ভদ্রলোককে মামা হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে ফেলতে হবে ছোটমামা?’

ছোটমামা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ হ্যাঁ, হবে।’

আমি বিরক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ ছোটমামা! কান্ট ইউ বি আ লিটল মোর সিরিয়াস?’

ছোটমামা কন্ঠের গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

‘ অবশ্যই আমি সিরিয়াস। এতো সিরিয়াস আমি দ্বিতীয়বারের মেট্রিক পরীক্ষাতেও হইনি।’

আমি ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,

‘ তুমি দ্বিতীয়বারের মেট্রিক পরীক্ষায় ফেইল করেছিলে ছোটমামা।’

ছোটমামা ফেইল বিষয়ক প্রসঙ্গ টানলেন না। খুব সহজ কন্ঠে বললেন,

‘ মানুষকে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ আঘাত আর অপমান করা যায় কেবলমাত্র অবহেলার মাধ্যমে। ‘ভালোবাসি না’ শব্দটির চেয়েও ধারালো হলো নিঃশব্দ উপেক্ষা। উপেক্ষা গোটা মানুষকেই বদলে দেয়, ধারণা তো গৌণ সুতো মাত্র।’

ছোট মামার কথায় ঝুপ করেই শান্ত হয়ে গেলো মস্তিষ্ক। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। জেদটা না কমলেও এই মুহূর্তে বাসা পরিবর্তনের পাগলামোটা কমলো। ধ্রুবকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার লোভ হলো। চোখ-নাক-মুখ বন্ধ করে তৃতীয় সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে ধ্রুব বলে পৃথিবীতে কেউ নেই। আমার জীবনের অলিতে-গলিতে কোথাও কোনো ধ্রুবর ছাপ নেই। কিন্তু নেই বললেই কী হলো? ভাগ্যবিধাতা কী তাই মেনে নিলো? নেন কখনো? আমার বেলাও নিলেন না।

সেদিন দুপুরে দুপুর কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো। শীতের দিনে আষাঢ়িয়া বর্ষায় ভেসে গেলো পিচঢালা রাস্তা। মুদি দোকানের চকচকে টিনের চালা। আমি লাইব্রেরি যাব বলে বের হয়েছি মাত্র। হাতে কালো রঙের ছোট্ট, হালকা ছাতা। বাইরে ঝুমঝুম বৃষ্টি। জলে জলে ভেসে যাচ্ছে গেইটের বাইরের বারান্দাটা। আমি খুব সাবধানে সিঁড়ি পেরিয়ে গেইটের বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তার জলের দিকে খানিক্ষন এক ধ্যানে চেয়ে থেকে ছাতাটা মেলতেই কোথা থেকে ছোটে এলো ধ্রুব। ডান হাতে ভাঁজ করা এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ। মাথাভর্তি চুলগুলোতে মুক্তোর ফোঁটার মতো জল। উজ্জ্বল শ্যামলাটে মুখটিতে ভেজা বৃষ্টির অত্যাচার। গায়ের কালো রঙের শার্টটার গুনে গুনে তিনটি বোতাম খোলা। আমি আড়চোখে চাইলাম। বোজে আসা দিনের অল্প আলোয় একপলক দেখেই কঠিন প্রতিরোধে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম দ্রুত। ধ্রুব মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আমার দিকে চেয়ে সহজাত হাসল। আমি ভ্রু জোড়া কুঁচকে কঠিন মুখে গন্তব্যে পা বাড়ালাম। ধ্রুব অবাক হয়ে বলল,

‘ এই বৃষ্টিতে কোথায় যাচ্ছো, ভাবী?’

আমি চমকালাম। থমকালাম। অবাক বিস্ময়ে ফিরে তাকাতে বাধ্য হলাম। ছেলেটা আবির বুঝতে পেরে মনে মনে ভীষণ পাপবোধ হলো। সংকোচ হলো। আবিরের ধীরস্থির ব্যবহার আর বোজে আসা আলোয় দুই ভাইকে গুলিয়ে ফেলেছি বলে নিজের কাছেই কেমন অদ্ভুত ঠেকলো। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাসটা চাপা দিয়ে ঘার ফিরিয়ে নিরুত্তর সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আবির খুব সরল কন্ঠে ডাকল,

‘ তুমি কী কোনো কারণে রাগ করেছো ভাবী? কথা বলছো না কেন?’

আমার বুকের ভেতর ছুটন্ত অনুভূতিরা উল্টোপথে দৌঁড়াল। বুঝলাম, ধ্রুবকে যেমন তেমন আবিরকে এড়িয়ে যাওয়া এক্কেবারে অসম্ভব। আমি ফিরে চাইলাম। নিজেকে যাথাযথ শান্ত করে আবিরের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। কঠিন কন্ঠে বললাম,

‘ আমাকে আর ভাবী ডাকবে না, আবির। এন্ড নাউ, আই এ্যাম ভেরি সিরিয়াস।’

আবির আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে সরল কন্ঠে শুধাল,

‘ তুমি রাগ করেছ কেন ভাবী? আমি কী কোনোভাবে তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?’

আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের দিকে চাইলাম। বেচারার মনটাকে ভেঙে দিয়ে কঠিন কন্ঠে বললাম,

‘ তোমার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নেই যাতে তুমি আমায় কষ্ট দিতে পারো বা আমি তোমাকে সেই সুযোগ দিতে পারি। ইউ আর আ আউটসাইডার টু মি। আ আননোন আউটসাইডার। আমি কোনো অপরিচিত ব্যক্তির থেকে ভাবীর মতো আন্তরিক সম্বোধন শুনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব না।’

আবির স্তব্ধ চোখে চেয়ে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো। আমার চোখ তুলে দ্বিতীয়বার আবিরের চোখের দিকে চাওয়ার সাহস হলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালাম। আবির সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। কয়েক পা এগিয়ে কী মনে করে আবারও থেমে গেলাম আমি। পিছিয়ে গিয়ে আবিরের সামনে দাঁড়াতেই তটস্থ চোখে চাইলো আবির। হাতে তার মুঠোফোন। আমি বিনাবাক্য ব্যয়ে ব্যাগ থেকে হাত খরচের শেষ পাঁচশো টাকার নোটটা আবিরের হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিলাম। আবির স্তম্ভিত কন্ঠে বলল,

‘ এটা কী? টাকা কেন?’

আমি উত্তর দিলাম না। আবির করুণ কন্ঠে বলল,

‘ ভাইয়ার সাথে ঝামেলা হয়েছে?’

আমি চটে যাওয়া মেজাজ নিয়ে তাকালাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘ তোমার ভাইয়ার সাথে কী ঝামেলা হওয়ার মতো কোনো সম্পর্ক আমার আছে আবির?তোমার ভাইয়া অত্যন্ত বেয়াদব এবং অসভ্য একটা ছেলে। তাকে বলবে সে যেন লাইব্রেরি থেকে একটা বই কিনে ‘হাউ টু বিহেভ’ পার্টটা খুব ভালো করে আত্মস্থ করে।’

আবির বোকার মতো মাথা নাড়ল। তারপর ফোনের দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ আত্মস্থ করবে, বুঝেছ?’

মুঠো ফোনটা যেন হঠাৎ সচল হয়ে উঠল এবার। ওপাশ থেকে মৃদু শব্দে হাসল কেউ। তারপর তরল কন্ঠে বলল,

‘ তোর ভাবীকে জিজ্ঞেস কর, এমন রিভিউ দেওয়ার কারণ কী? তোর ভাইয়ার অপরাধ?’

আমি স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইলাম। এরা দুই ভাইই যে সৃষ্টিছাড়া বেয়াদব তা বুঝতে এতো দেরী করে ফেলায় কঠিন দুটো চড় বসাতে ইচ্ছে হলো গালে। রাগে আগুন হয়ে, আর একটি বাক্যও ব্যয় না করে হনহন করে নেমে এলাম ঝুম বৃষ্টিতে। মাথার ভেতর গদগদে রাগ নিয়ে প্রায় অন্ধের মতো টাউনহল পর্যন্ত হাঁটলাম আমি। সালোয়ারের অর্ধেকটা ভিজে সার হলো। সেই সাথে ভিজলো বাহুর কাছের অংশ। টাউনহলে পৌঁছে হঠাৎ সিদ্ধান্তে গাঙিনাপাড়ের অটো ধরতেই আরো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল। একদম অপরিচিত এক ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন,

‘ আপনি নিশু না?’

আমি অবাক হয়ে চাইলাম। কোনোরকম মাথা নেড়ে বললাম,

‘ জি। আপনি?’

ভদ্রলোক হাসলেন। নম্র কন্ঠে বললেন,

‘ আমি আপনাদের ক্যাম্পাসেরই প্রাক্তন ছাত্র। ধ্রুবর ব্যাচমেট।’

আমি কী বলব বুঝতে না পেয়ে ঠোঁট টেনে হেসে চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোকও আগ বাড়িয়ে কিছু বললেন না। তবে বিপত্তি ঘটালেন অন্য জায়গায়। অটো থেকে নেমেই চট করে আমার ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। দরকারের সময় কন্ঠ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ রোগটা নিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম। অসহায় প্রতিবাদ করে বললাম,

‘ সেকি! আপনি দিচ্ছেন কেন? প্লিজ এমনটা করবেন না। আমার ভাড়াটা আমি নিজে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।’

ভদ্রলোক হেসে বললেন,

‘ আপনি আমাদের ছোটবোন হোন। ছোটবোনের জন্য এতোটুকু করায় যায়। তাছাড়া ধ্রুব আমার জন্য অনেক করেছে। সে হিসেবে এটা কিছুই না।’

আমি চূড়ান্ত অসহায়ত্ব নিয়ে চাইলাম। ভদ্রলোক আমাকে সহজ করতে সহাজাত কন্ঠে শুধালেন,

‘ ধ্রুবর তো জয়েনিং ডেট এসে গেছে,তাই না?’

আমি উত্তর দিলাম না। বলতে হয়, উত্তর দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। ভদ্রলোকের প্রশ্নটা না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। ধ্রুবর কাজকর্ম তো দূর গোটা ধ্রুবর মাঝেই আদতে ভীষণ অজ্ঞ আমি। সে যে কীসে পড়াশোনা করে, কী করতে তার পছন্দ, তার কিছুই একবিন্দু জানি না আমি। অথচ এদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আমি তার বিয়ে করা বউ। আমার কাছে তার খবরের ঝুড়ি। আমার মেজাজ খারাপটা তরতর করে বাড়তে লাগল। দুপুরের সকল প্রতিজ্ঞা ভেস্তে দিয়ে আমার ছোট্ট মস্তিষ্কটা আবারও ধ্রুবময় হয়ে গেল। প্রচন্ড রাগ অথবা অসহ্য বিরক্ত নিয়েও তাকেই ভাবতে লাগলাম। ভাবতে বাধ্য হলাম। বারবার, প্রতিবার তার নামের দোহায়টা একদম অসহ্য ঠেকলো এবার। পেটের ভেতর পাঁক দিয়ে উঠল অসহ্য বিরক্তি।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here