সৎ মা,
লেখা : মাহাবুবা মিতু,
পর্ব: ১৮
বাজার থেকে ফিরে অফিসে যেতে যেতে বাজলো নয়টা পয়তাল্লিশ। অফিসে গিয়ে কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরলাম ভীষণ। দুপুরে মার ফোন পেয়ে হুস হলো কয়টা বাজে। দৌড়ে গেলাম বাসায় খাওয়ার জন্য। খেয়ে একটু রেস্ট নেওয়ার সময় বিছানায় পরে থাকা ফোনটাতে চোখ পরতেই মনে হলো ক্ষুদে বার্তার কথা।
ফোনটা নিয়ে কম করে হলেও একশ বার পড়লাম।
ক্ষুদে বার্তাটা পাঠানো হয়েছে দুইটা আটচল্লিশে। পাঠাবে কি পাঠাবে না তা ভেবে হয়তো শেষমেশ পাঠিয়েই দিয়েছে৷ ব্যাপারটা ভেবে আমার হাসি পেলো। তারচেয়ে বেশী হাসলাম আমার প্রতিত্তোর পড়ে-
“শুধু ঘড়ি না, আমার মনটাও রেখে এসেছি রাজশাহীতে, একটু দেখে রেখো”
এটা পড়ে ওর মৃদু হাসির সেই চেহারাটা কল্পনা করলাম। ও শুধু যে হেসেছে তা না, নিশ্চয় আমাকে বকেছে…
কেমন লোক আমি..
কিভাবে পারি এসব কথা লিখতে…
আরো কতো কি ভেবেছ….
একবার ফেন দিবো কি দিবো না ভাবতে ভাবতে ফোনটা দিয়েই দিলাম। এ পাশ থেকে আমি যখন হ্যালো বললাম
ঐ পাশে তখ পিনপতন নিরবতায় ওর নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই লুকিয়ে কোন নির্জন জায়গায় গিয়ে কথা বলছে,স্টোর রুম কিংবা খালি ঘর হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
: হ্যালো…..!
: হুম
: কেমন আছো…?
: ভালো
: জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি…
: ………
: তুমি তো বোবা না….
তাহলে কথা বলো না কেন…?
: ……
: কথা না বললে ফোন ধরেছো কেন…
ফোন কি কেটে দিবো…
: না,
মানে….
: না মানে কি…!
: কি বলবো বুঝতে পারছি না
: ও…
: …
: আচ্ছা একটা কথা…
তুমি ছাঁদে লুকিয়ে দেখতে কেন আমায়…
:……
: আজব মেয়ে তো তুমি
কথা বলছো না কেন…
: সে অনেক কথা, এখন বলতে পারবো না,
: এখন না, তবে কখন…?
: সামনাসামনি বলবো কোন একদিন।
: ও…
: খেয়েছেন…?
: হুম, তুমি…
: হুম
: বিয়ের কেনাকাটা পছন্দ হয়েছে…?
: হুম
: শুধু হুম,
আমার এ কথায় ও হেসে দিলো, চাপা হাসি, তবুও শব্দটা আমার হৃদয় স্পর্শ করলো।
: বাসার সবাই ভালো আছেন…
: হুম,
আপনাদের সবাই ভালো…
: ভালো, তবে দাদী একটু অসুস্থ, বয়স হয়েছে তো,
শরীর দূর্বল।
: ও….
: কাল রাতে ঘুমিয়েছ কয়টায়…
: তিনটা বেজে গিয়েছিল ঘুমোতে ঘুমোতে…
: কেন…
: এমনিই, ঘুম আসছিলো না, বাড়িতে সবাই সজাগ তাই…
শব্দে আমার ঘুম হয় না, আমার ঘুম অনেক পাতলা।
: ও, তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেলো…
: সমস্যা কেন…
: আমার না নাক ডাকার অভ্যাস আছে, ছোট ভাই তাই আমার সাথে না ঘুমিয়ে দাদীর সাথে ঘুমোতো।
(মিথ্যা কথা)
: এ কথার উত্তরও প্রসূন চাপা হেসে দিলো, এর কি মানে তা আমি উদ্ধার করতে পারলাম না।
: আমি কি তোমাকে ফোন দিবো….
: ……
: না মানে…পারমিশন আর কি…
: এখন যখন পারমিশন ছাড়াই ফোন দিলেন,
তাহলে আর পারমিশন নিতে হবে না, বলেই আবার চাপা হাসি…
: তাইতো….!
আমি ওর কথা শুনে একটু লজ্জা পেলাম…,
প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম-
: আচ্ছা ভালো কথা, তা আমার মনটা আছে কেমন….
ভালো তো…
: …..
এরপর হুড়মুড় করে বললো কেও আসছে রাখি,
ভালো থাকবেন…
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলো।
আমি ও ফোন রেখে শুয়ে পরলাম।
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে যাবো এমন সময় মা এলেন আমার ঘরে, বললেন
: কোথাও বেরুচ্ছ নাকি…
: হ্যাঁ মা…
কেন কিছু বলবেন…
: হ্যাঁ, তাড়া থাকলে থাক পরে বলবো নি,
: না মা, তেমন তাড়া নেই বসুন আপনি,
মা আমার বিছানার পাশের সিঙ্গেল সোফাটাতে বসলেন, আমি বসলাম খাটে, বসে বললাম
: জরুরী কিছু কি…
: হুম
: বলুন তাহলে,
: কথাগুলো কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা,
: মা আমি আপানার ছেলে, বাইরের কেও না, যে সাজিয়ে কথা না বললে আপনার লজ্জিত হতে হবে, বলুন..
: তোমার বিয়ের তারিখ তো এগিয়ে এলো, তাই কথাটা না বললই নয়, আগে বলো তুমি আমার কথা রাখবে..
: মা, এত গড়িমসি করছেন কেন, বলে ফেলুন তো…
: না মানে, তুমি কিভাবে নেও তা ভেবেই আজ সারা দিন পার আমার।
: বলুন না…
: বলছিলাম কি…
তুমি বিয়ের কার্ড নিয়ে আজকালকার মধ্য তোমার মার কাছে যাবে, তার ছেলের বিয়ে, তাঁকে তো জানানো দরকার, তাই না…
: মা আপনার মথা ঠিক আছে তো…
: হুম, ঠিক আছে।
যত যাই হোক উনি তো তোমার মা হন, কার্ড দেওয়াটা শুধুমাত্র সৌজন্যতা, তিনি যে আসবেন না, তা তিনিও জানেন,আর আমরাও জানি, তবুও তুমি একবার দেখা করো তার সাথে, মায়ের দোয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিস, বুঝেছ…!
: আপনি যা বললেন তা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ, আমি আপনার এ কথা রাখতে পারবো না।
: বাবা, আমি বুঝি তোমার ব্যাপারটা তবে দয়াকরে তাকে তুমি ভুল বুঝো না। তার পরিস্থিতি আমার চেয়ে ভালো কেও বুঝবে না। আমি নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে তাই মাটি কামড়ে পরে ছিলাম, সংসারটা টিকে গেছে , তোমার মা তো ধনী পরিবারের আদরের সন্তান, তাই হয়তো সহ্য করতে পারেন নি, উনাকে আমি কখনোই দোষ দেই না…
: মা আপনার সব কথা আমি মানলাম…
কিন্তু একবার আমাকে বলেন – কেন তিনি দুনিয়ার এত মানুষ থাকতে মেঝ ফুফার সাথেই চলে গেলেন….
জানি এর উত্তর আপনি দিতে পারবেন না।
মা যখন তার হাত ধরে চলে গেলো তখন আমি মাত্র ছয় বছরের ছোট্ট একটা ছেলে। যার দুনিয়াটাকে চেনাজানার শুরু হয়েছিল মাত্র। আপনি জানেন না সেই চেনাজানার শুরুর দিনগুলোতেই আমাকে কত কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে।
খেলতে গেলে বন্ধুরা বলতো কিরে তোর মা নাকি তোর ফুফার সাথে পালিয়েছেন। প্রথম প্রথম বুঝতাম না এসব, ফুফু এসে যখন দাদী আর আমার সাথে বাজে ব্যাবহার করতো তখন আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি ব্যাপারগুলো, অনেক ছোট বয়সেই আমাকে অনেক বড় হতে হয়েছিলো, কথাগুলো হজম করার জন্য, শুরুতে মনে হতো মরে যাই। সেই দিনগুলো যে কি বিভৎস ছিলো তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না।
আমি খুবই শান্ত ছেলে ছিলাম। কিন্তু এসব কথার প্রতিষোধক হিসেবে আমাকে হিংস্র হতে হতো ওদের প্রতি। যাতে এসব আমাকে কেও জিজ্ঞেস করার সাহস না পায়, এরপর অবহেলায় যত্নহীন আমি পড়াশোনায় হয়ে গেলাম ব্যাক বেঞ্চার….
জীবণটা গোছানোর শুরুতেই এলোমেলো হয়ে গেলো,
আমি একা খেতে পারতাম না তখনো, মাকে ধরে না ঘুমালে আমার ঘুমই আসতো না, সেই আমার কিভাবে দিন কাটবে তা তো তিনি ভাবেন নি, সংসারে বনিবনা না হলে অনেকেই সন্তান বুকে নিয়ে সংসার ছেড়ে চলে যায়, তিনি গেলেন আমাকে ফেলে রেখে, ব্যাপারটা একটু হলেও ভালো হতো…
: তোমার বাবার সাথে জিদ করে তিনি এ কাজ করেছেন।
: জিদ….
হুহ্, তার প্রতি এখন আমার কোন ক্ষোভ কিংবা ভালোবাসা কোনটাই নেই,
: এসব কথা বলবার সময় এখন না বাবা, আমি তোমার মনের অবস্থাটাও বুঝি। কিন্তু তুমি তাও যাবে তার কাছে, এটা আমার অনুরোধ আর আদেশ, শত হলেও উনি তোমার মা…
: মা…
তিনি কি এটা মনে রেখেছেন, এত বছরে একবারও কি আমার খোঁজ নিয়েছেন, কেমন আছি, কিভাবে কাটছে দিন, তাহলে আমি কেন…
: আমি এত সব বুঝি না বাবা, তুমি যাবে তোমার মায়ের কাছে, তাকে তোমার বিয়ের কথা বলবে, কার্ড দিবে, দোয়া চাইবে, দরকার হলে আমি যাব সাথে, তুমি উপরে যাবে, আমি গাড়িতে বসে থাকবো তোমার ফিরবার অপেক্ষায়……
চলবে….
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/914689362325589/
Next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/916139242180601/