সৎ মা,
লেখা : মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২১
গাড়ি নিয়ে আমি যখন রমনাপার্কে ঢুকি তখন গোধূলির সময়। দিনের আলো তার শরীরের সব ভর ছেড়ে হেলে পরেছে। পুরো আকাশে যেন কেও নীলাভ বেগুনি রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। ছাদে থাকার দিনগুলোতে আমি প্রথমবারের মতে গোধূলির সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হই। অন্য যে কোন দিন হলে আমি মুগ্ধতায় মোহিতো হতাম, চোখ বন্ধ করে আকাশের সেই রঙ গুলোকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করতাম।
কিন্তু আমার ভিতরটা জ্বলে পুড়ে এতটাই রঙহীন হয়ে আছে যে কোন রঙই ধারন করার ক্ষমতা তার এখন নেই।
মা চলে যাওয়া পর আমি যখন বাবা, দাদী কিংবা ফুফুদের জিজ্ঞেস করতাম আমা মা কোথায়…?
তারা মুখটাকে বিকৃত করে বলতো
– তোর মা মরে গেছে…
আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম মরেই হয়তো গিয়েছে, কিন্তু ফুফু যখন দাদীকে কথা শুনাতে আড়ালে থেকে আমি ঠিকই বুঝতাম আমার মা খুব খারাপ কিছু একটা করেছেন…
এরপর কিছুদিন যেতেই সব পানির মতো পরিষ্কার হতে থাকলো আমার কাছে। কত কিছু ভেবেছিলাম সেই দিন গুলোতে, তাকে যদি কখনো খুঁজে পাই তাহলে জিজ্ঞেস করবো
তুমি কি ভালো ছিলে সেই দিনগুলোতে…?/
আমাকে ছেড়ে আসার প্রথম রাতে তুমি কি ঘুমাতে পেরেছিলে…?/
আমাকে যে এত কষ্ট পেতে হলো, আমার কি দোষ ছিলো…?
কিন্তু আমি শত চেষ্টা করে তাকে এত কাছে পেয়ে একটা প্রশ্ন ও করতে পারি নি। আমার চোয়ালটা কেমন যেন ধরে আসছিলো। কান্না চেপে রাখলে যেমন হতো ছোট বেলায় তেমনি।
আমার তিন ফুফু আর দাদী মার প্রতি সবসময়ই অসহনশীল আচরন করতেন। বিকেল হলেই তিন বোন এসে পরতেন আমাদের বাসায়। দাদীর ঘরে বসে ফুসুরফুসুর করতেন। কোন এক ছুতো পেলেই মার সাথে ঝগড়া বাঁধাতেন। আর আমার বাবা….
তার তো কথার আগেই হাত চলতো, কোন কিছু না শুনে বুঝেই…
মা সংসারটা অনেক সহ্য করে টিকিয়ে ছিলেন এটা সত্যি। তিনি জিদ করে এসব করছেন তাও….
কিন্তু আমি কেন বলির পাঠা হলাম। আমাকে কেন এত কষ্ট করতে হলো, কষ্ট কি তা না বোঝার বয়সেই।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামলো চারদিকে। চারদিকে অন্ধকার,
কিছুক্ষণের মধ্যে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠলো। চারপাশ এত উজ্জ্বল হয়ে গেলো যে ঘাসের উপর ঝড়া পাতাগুলোর রঙও আমি বুঝতে পারছিলাম। আমার বেঞ্চের সামনে পুকুরের পানিতে চাঁদের ছায়া, মাথার উপরে কাঁঠাল গাছ। আশপাশের দৃশ্য গুলোকে মনে হচ্ছিলো অপার্থিব কোন কিছু। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি উঠে দাঁড়ালাম, মিরপুর বেরি বাঁধে যাবো। বাড়ি ফিরবো দেরি করে। মার সামনে যেন না পরতে হয় তাই।
রুমিনকে ফোন দিবো বলে ফোন বের করলাম, এরিমধ্যে ফোনটা বেজে উঠলো। বের করে দেখি মা ফোন করেছেন। সাইলেন্ট করে ফোনটা রেখে দিলাম। পরের বার যখন ফোন দিলেন তখন রিসিভ করতেই তিনি বললেন
– দিগন্ত কোথায় তুমি…
গ্রাম থেকে তোমার নানী আসছেন, তুমি তাদেরকে মতিঝিল থেকে নিয়ে আসো, আর আসার সময় এক লিটার সরিষার তেল এনো, মুড়ি মাখা খাবে সবাই, এখন রান্নাঘরে গিয়ে দেখি তেল শেষ…
কথাগুলো মুখস্থ বলার মতে বলেই ফোনটা রেখে দিলেন…
এমন একটা ভাব যেন সব স্বাভাবিক। এ কাজটা মা ইচ্ছে করে করেছেন। যাতে আমি যেখানেই থাকিনা কেন তাদেরকে নিয়ে বাসায় ফিরি। তার জন্য তাদের আনার সাথে তেল আনাও যোগ করেছেন।
এখন যদি তারা না আসতেন তাহলে নিশ্চয়ই ফোন দিয়ে বলতেন – হয় আসার সময় যেন অবশ্যই দুই কেজি গোশত নিয়ে আসি, এখনি লাগবে,
নাহলে টকদই, কিংবা তার খুব বিরিয়ানির খেতে ইচ্ছে করছে। মানে এমন আর্জেন্সি এখনি না গেলেই নয়…
প্রথম প্রথম আমি না বুঝলে ও এখন আমি ঠিকই বুঝি তিনি এসব করেন কাজে ডুবিয়ে রেখে আমার মন খারাপ ভুলিয়ে দিতে।
আমি একটু হেসে দিলাম। আমি যে বড় হয়েছি, এসব এখন বুঝতে পারি, ধরতে পারি তিনি কি বুঝেন না। মনের সব কষ্ট কর্পূরের মতে উড়ে গেলো। এরপর বেরিয়ে আমি গেলাম মতিঝিল উদ্দেশ্যে।
সেখানে নানী আর আমার এক মামাতো ভাইকে রিসিভ করে সিএনজিতে তুলে আমিও তাদের পিছনে পিছনে গেলাম। বাসার সামনের দোকান থেকে তেল নিলাম এক লিটার।
বাড়ি ফিরে দেখি সবাই বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছেন। বাবা, চাচা, চাচী, ফুফু, চাচাতো ফুফাতো ভাইবোন সবাই….
সোফা বুক হওয়ায় অনেকেই অনায়াসেই বসে আছেন মেঝেতে। এমন আড্ডা প্রায়ই হয় এ বাড়িতে। ইদ কিংবা অন্য কোন ছুটিতে। চাচাতো ফুফাতো ভাইবোন সবাই ব্যাস্ত পড়াশোনা নিয়ে। একমাত্র রাইসা ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করে। বাকী সবাই ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে।
যে যেখানে চান্স পেয়েছে, সেখানেই ভর্তি হয়ে গেছে।
আর নামিরা থাকে অস্ট্রেলিয়া। পড়াশুনা করতে গিয়ে বিয়ের কাজটাও সেড়ে ফেলেছে ও। বিয়ে করেছে সুইডিশ এক ছেলেকে। ভদ্রলোক অসম্ভব সুন্দর। আমার বিয়ে উপলক্ষে গতকাল দেশে এসেছে ও। ওর বর ব্যাস্ত তাই আসতে পারেনি৷
বাবা সবার বড় হওয়ায় সবাই এখানেই আসে আড্ডা দিতে, এই আড্ডা চলে মাঝরাত পর্যন্ত। এতগুলো মানুষের নাশতা, রাতের খাবারের যোগাড় করতে মার পুরোটা সময় কেটে যায় রান্নাঘরে। তাতেও তার কোন ক্লান্তি নেই। আগের মা থাকতে এমনটা খুব কমই হতো, একরাশ বিরক্তি নিয়ে মা রান্না করতেন রান্নাঘরে। দুই মায়ের পার্থক্য এখানেই হয়তো৷ একজন মানুষ ভালেবাসেন আরেক জন ভালোবাসতেন একা থাকতে।
বাড়ি ঢুকতেই দেখি মা সবাইকে চা দিচ্ছেন। এরপরই বুয়া এসে দিয়ে গেলো এক মগ কফি, ঠিক যেন এটা আগে থেকেই তৈরী করে রাখা ছিলো আমার জন্য, আসবো আর দিবে আমাকে। আমি চুমুক দিতেই বুঝলাম এটা আমার মায়ের তৈরী করা কফি। বুয়া কফি বানালে এত চিনি যে একবার মুখে দিলেই পুরো মুখ চিনির খনিতে রূপান্তর হয়। কফিটা মার তৈরী তবুও বুয়াকে দিয়ে পাঠালেন তিনি। এটারও একটা কারন আছে….
কফি খেতে খেতে আমি ভুলেই গেলাম যে একটু আগেও আমি বিষাদে সাগরে ডুবে ছিলাম। অন্যমনস্ক আমি হাসির রোল শুনে তাদের সাথে আমিও যোগ দিলাম। আমিও হাসছি, তবে কেন হাসছি তা জানি না…..
এরিমধ্যে ফোণ আসে প্রসূনের। রুমে গিয়ে দেখি চাচী আর এক ফুফু আমার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের কথার বিষয় ডালা সাজানো। আমি তাদের এই উচ্ছাস দেখে মনে মনে বলি – জীবণটাকে যত মন্দ ভাবি ততোটাও মন্দ নয় এ জীবণ…
কথা বলার সুবিধা করতে না পেরে আমি চলে গেলাম ছাদে। বেশ কিছু সময় কথা হলো প্রসূনের সাথে। ফোন রিসিভ করতেই প্রসূন বললো
– এখন যদি আপনি আমার সামনে থাকতেন আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতাম।
আমি কিছু না বুঝেই কৌতুহলে জিজ্ঞেস করলাম
– কেন কি হয়েছে…,
কোন সমস্যা….!
– কি হয়েছে আপনি জানেন না, আপনাকে যতাটা ভালো লোক ভেবেছিলাম ততোটা ভালো আপনি নন…
– কেন….
আমি আবার কি করলাম….
– দাঁড়ান আমি ছবি পাঠাচ্ছি, দেখে আমাকে কল দিন…..
ওর পাঠানো ছবি দেখে আমি হেসে দিলাম,
গতকাল আমি আর আদিল মিলে ওকে বিবিএ ভর্তি করিয়ে দিয়েছি বেসরকারী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাগজপত্র সব আদিলের কাছে রাখা। ওকে বলতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও আদিল ভর্তির কাগজপত্রের ছবি হোয়াটসএপে পাঠায় প্রসূনকে। এসব দেখে ও নাকি খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলো
এমন একটা মুহুর্তে চাচাতো ফুফাতো ভাইবোন সবাই ছাদে উঠলো…., বেচারীকে আর ফোন করা হলো না।
লুকিয়ে কথা বলায় সবাই মজা নিলো আমার সাথে……
আমি ফোন রেখে ওদের সাথে আড্ডায় ডুব দিলাম। তার আগে ছোট্ট করে একটা টেক্সট পাঠালাম-
“কাল আমি রাজশাহী আসছি,
কেও জড়িয়ে ধরে কাঁদবে বলে…… ”
চলবে…
previous : https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=916957155432143&id=659404701187391
Next :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=918478518613340&id=659404701187391