#সৎ_মা
লেখা : #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ১৬-১৭
পরদিন আমি আবারও গেলাম সীমান্তর বাসায় ওদের ফিরিয়ে আনতে, বৌ আসতে রাজি হলেও সীমান্তর এক কথা, ওর পাওনা ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয়া না পর্যন্ত ও সীদ্ধান্তে অনড়। এদিকে আমি বেচারীকে ভুল বুঝেছি। আমি বললাম সব হবে আগে বাড়ি ফিরে চল, মায়ের শরীরটা বেশী ভালো না,
মায়ের কথা বলাতে কিছু একটা হলো, মাকে দেখতে যাবে কিন্তু ওর ঐ একই কথা, ফিরে যাবে না ও, আমি বললাম তাও চল। শেষমেষ বিকেলে যাবে আমাকে কথা দিলো, আমি ওখান থেকে বের হয়ে গেলাম অফিসে।
বাসায় ফিরে শুনলাম ওরা নাকি এসেছিলো বিকেলে। শুনে আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মার কাছে এসব নাটক চলে না আমার কোন দিনই। তাই তার একটানা তাকিয়ে থাকাকে উপেক্ষা করে আমি রুম থেকে যেন দৌড়ে পালালাম ফোন আসার অযুহাতে। আচ্ছা সব মায়েরাই কি এমন হন….!
এরপর কেটে গেলো চার চারটা দিন। প্রসূন আসার কোন খবরই নেই৷ আমিই মনে হয় দুনিয়ার প্রথম এবং একমাত্র বর, যার হবু শ্বশুরবাড়ির কারো সাথেই এখন পর্যন্ত ভাব হয় নি। মাকেও তো জিজ্ঞেস করা যাবে না ও আসবে কিনা…?
আসলেই বা কবে আসছে…?
মার এখন দিন কাটে শপিং, আর কার্ড বিলি করতে করতে৷ সব কেনাকাটার স্তুপ দাদীর ঘরে। দাদীও খুব খুশি। এক সকালে আমাকে বলে
-বুঝলি ব্যাটা বিয়ের শাড়ি কিন্তু দুইটা কিনবি, একটা আমার আরেকটা তোর বৌর…
আমি উত্তরে হেসে বললাম
-তাই হবে, দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র দাদী আমার…
সেদিন রাতে মা ডেকে বললো রাইসাকে নিয়ে বিয়ে আর বৌভাতের শাড়িটা কিনে আনো, প্রসূনের শরীর নাকি ভালো না, তাই আসতে পারবে না। তোমার ফুফুকে বলেছিলাম, উনি শাড়ির ব্যাপারে ভালো বোঝেন, কিন্তু তার নাকি কোমরে ব্যাথা, তা না হলে তিনি যেতেন।
তার ব্যাথা যে কোথায় তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে…!
কথাটা বলে মা বিছানা গুছাতে গুছাতে একাই হাসলেন। আমি তার এই হাসির রহস্য উদ্ধার করতে পারলাম না।
পরদিন আমি আর রাইসা সাড়ে তিনটায় গেলাম মার্কেটে। রাইসা বুড়ি বিয়ের জন্য নিলো লাল রঙের কাতান শাড়ি। এই একটা শাড়ি কিনেছে না হলেও পনের বিশ দোকান ঘুরে পাঁচ ঘন্টা লাগিয়ে। রেগে তখন আমার মাথা গরম অবস্থা। ফিরবার সময় রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য ওয়েট করার সময় শাড়িটা বের করে আমাকে দেখালো।
আসলেই ভীষণ সুন্দর শাড়িটা, হট রেড রঙের মধ্যে সিলভার কালারের জরির পাড়, সারা শাড়ি জুরে সিলভার রঙের কাজ। কিছুক্ষণ আগেই মনে হচ্ছিলো এত টাকা দিয়ে কেও এই শাড়ি কিনে, কিন্তু মুগ্ধতায় আমার চোখ দুটো বিচরণ করলো পুরো শাড়িটাতে। এত নিখুত কাজ আর এত কোমল লাগছিলো শাড়িটা যে আমি নির্বাক হয়ে দেখছিলাম। তখন আমার কি হয়েছিলো আমি জানি না তবে শাড়িটাকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস মনে হচ্ছিলো। এমনটা একবার হয়েছিলো বাণিজ্য মেলার তুর্কি ল্যাম্পের দোকানে গিয়ে। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে বন্ধুর থেকে টাকা ধার করে সেই ল্যাম্প এনেছিলাম বাড়িতে। যা এখন শোভা পাচ্ছে মার বেডরুমে।
এত পছন্দ করে আনলাম নিজের জন্য, কিন্তু মাকে দেখাতে গিয়ে বললাম- মা এটা আপনার জন্য এনেছি, মা তো বাচ্চাদের মতো খুশি। বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলো ল্যাম্পটাকে। তখন আমার মনে হচ্ছিলো মার এই খুশির দাম আমার শখের চেয়ে অনেক বেশী৷ এরপর যে কতবার গেলাম ল্যাম্পের দোকানে এরকম ভালোলাগা আর কখনো কাজ করে নি।
সেদিন রাইসাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম সাড়ে দশটায়। বাসায় ফিরে দেখি মা ফোনে কথা বলছেন। আমি শাড়ির বক্স রেখে ফিরে আসতেই বুঝলাম মা প্রসূনের সাথে কথা বলছে।
কথা বলছে মা, কিন্তু হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন
শুরু হলো আমার। এটা কেমন কথা, কারনই বা কি৷ মা বেশী কথা বলেন না বাইরের কারো সাথে, তবে প্রসূনের সাথে কথা বলছে দেখে ব্যাপারটা ভালো লাগলো।
আমি রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে, মাকে বললাম খাবার দিতে। মা নিজ থেকেই বললো-
: ওদের বাড়িতে তো প্রায়ই কথা হয়, কিন্তু প্রসূন কখনোই আমার সাথে কথা বলে না, হয়তো বলতে চায় না। আজ ওর মা মনে হচ্ছিলো জোর করে কথা বলিয়ে দিলো।
বলেই হাসতে লাগলো…
আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললাম-
: মা ওর এসব ব্যাবহার আমার কাছে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না, ও বিপদে পরে বিয়েটা করছে না তো…
: আরেহ্ না, কথা শুনে তো তা মনে হলো না, এমনিতে সংকোচ আছে, তবে যখন আমি বললাম তুমি আর রাইসা শাড়ি কিনতে মার্কেটে গিয়েছ এর পর কেমন যেন চুপসে গেলো, এরপর একটা কথাও বললো না, সব কথার জবাব হু, হ্যাঁ করে দিলো। এতে কি বোঝা যায় জানো…
: উহুম…
: আমি মেয়ে মানুষ তো, তাই মেয়েদের ব্যাপার চট করে বুঝতে পারি,
আমি কোন কথা বললাম না আর, খেয়ে উঠে গিয়ে, রুমের দড়জা লাগিয়ে ভাবতে লাগলাম, মা কি বললো, কি বুঝলেন তিনি,
এর প্রায় মিনিট খানিক পর আমি হেসে দিলাম, ঐ কারনের হুদিস পেয়ে….
পরদিন আমি ব্যাস্ত থাকায় রাইসাকে বললাম পরদিনের প্ল্যান করতে। পরদিন মা আমাদের সাথে গেলেন৷ অনেক খুঁজে বৌভাতের জন্য নিলেন গাঢ় ব্লু রঙের লেহেঙ্গা। আমি রাইসাকে ইশারায় না করেছি, কারন প্রসূন খাটো, লেহেঙ্গা পরলে লিলিপুটের মতো দেখাবে৷ ও আমার কথা না শুনে উল্টো আমাকে ইশারায় ধমকায়। সব মেয়ে গুলো একেকটা ফাজিল।
বিয়ের শপিং মোটামুটি শেষ। তবুও দেখা যাবে বিয়ের আগের দিন ও কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাকী রয়ে গেছে। আমি তাই বজলুকে বললাম মার আশেপাশে থাকতে। আমি সিএনজি করে অফিসে গেলাম।
বিয়ের যাবতীয় কেনাকাটা পাঠিয়ে দেয়া হলো রাজশাহী। আদিল আর আমার দুই বন্ধুকে দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। আমিও ছিলাম সাথে, তা অবশ্য কেও জানে না। আদিলকেও বলেছি প্রসূনদের বাড়ির কাওকে যেন না বলে। বললে কেলেঙ্কারী অবস্থা হবে।
আমি ওদের বাজারে নেমে গেলাম। তখন পুরো দুপুর মাথার উপর রোদ। আমি নেমেই রেস্টুরেন্টে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করলাম। এরপর একটু ঘুরলাম ওদেরকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম আসতে কতদূর…
ওদের আসার নাম গন্ধই নাই, এরপর আমি গেলাম কাছের মার্কেটে, ফুফুর জন্য একটা সিল্কের শাড়ি কিনবো তাই, ফুফু মার শাড়িটা নাকি পছন্দ করেছেন । শাড়ি কিনে বেরুতেই দেখি….
পর্ব: ১৭
প্রসূন আমার সামনে দিয়ে গেলো, দুজন মেয়ে সাথে, হাত ভরা শপিং, ও আমাকে খেয়াল করেনি, হয়তো কল্পনায়ও ভাবে নি আমি রাজশাহী আছি। দেখলে নিশ্চয়ই ভুত দেখার মতো চমকে যেতো। আমি দাড়িয়ে দেখছি ওদের, ওরা সব খাবারের একটা দোকানে ঢুকে কি যেন অর্ডার করছে। আমি উল্টো ঘুরে দাড়ালাম। ভাবলাম পিছন দিক দিয়ে চলে যাই, আবার বলি না, মেয়েটাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে যাই, ওর বোঝা দরকার আছে আমি কি।
বড় বড় দুইবার শ্বাস নিলাম, স্থির হওয়ার চেষ্টা করলাম।
প্রসূন আর একটা মেয়ে খাবারের অর্ডার করতে গিয়েছে, সেল্ফ সার্ভিস তাই দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে খবারের জন্য, আমি ওর পিছনে দাঁড়ালাম। ও দুই হাতে ফুচকা নিলো, সাথের মেয়েটা একটা ফুচকা আর কোল্ড ড্রিংকসের বোতল।
ও ঘুরে এদিক ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করলো, আমি তো সেই লম্বা তাই ঘাড় উঁচু করে দেখার কষ্টটা করে নি, ও যেদিকে যায় আমিও সেদিক যাই, ও তখনো বুঝেনি ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ভাবে হচ্ছে। এরপর বিরক্ত হয়ে যখন আমার দিকে তাকালো ওর হাতের সব খাবার পরলো আমার পাঞ্জাবিতে আর পায়ে । আমার চোখ তখনো ওর দিকেই, এর কয়েক সেকেন্ড পর ও ওর হাতের রুমাল দিয়ে ওগুলো পরিষ্কার করায় ব্যাস্ত হয়ে পরলো, আমি ওকে থামিয়ে বললাম
: দাঁড়াও….
: ও দাঁড়িয়ে গলো,
: কি সমস্যা তোমার…
: কি সমস্যা মানে,
: ফোন দিলাম একদিন, কথা বললা না, ব্যাপারটা কি…
হুম…
ওর সাথের মেয়েগুলো ওর পাশে এসে দাড়িয়ে আমাকে বললো
: কি সমস্যা…
কিরে তুই চিনিস উনাকে…
এরপর প্রসূন কি যেন বললো কানে কনে…
ওরা তো সেই অবাক, তারপর বললো-
: আরে দুলাভাই……
আপনি তো সেই লোক, বিয়ের আগেই শ্বশুরবাড়ি…
তারপর কি খবর…
: তারপর কোন খবর নেই,
ওকে জিজ্ঞেস করেন ওর কি সমস্যা,
এখনো সময় আছে….
পরে ঝামেলা হওয়ার চেয়ে আগেই হওয়া ভালো।
: আরে শেষ সময়ে এসে কিসব আবোল তাবোল বলছেন… ঝামেলা থাকলে কেও নিজের বিয়ের শপিং করতে আসে…
শোনেন আপনার দুজন বসেন এখানে, আমরা ওপাশে বসছি, কথা বলে দুজনের ঝামেলা মিটিয়ে নিন…
একথা বলে মেয়ে দুইজন চলে গেলো, আমি বসলাম, ওকে বললাম বসতে, ও অনেকক্ষণ পর গুটিসুটি হয়ে বসলো।
আমি প্রসূনকে বললাম তোমার যদি এ বিয়ে নিয়ে কোন সমস্যা থাকে আমাকে বলতে পারো, আমিও শখে কিন্তু এ বিয়েটা করছি না, আমরা দুজনই পরিস্থিতির শিকার।
এ কথা,শুনে ও মাথা উচু করে তাকালো আমার দিকে, তারপর বললো
: আপনার উপর আমার অনকে রাগ, কারন ঐ দিন ছাদের দড়জা লক না করলে আমার, আমার পরিবারের সাথে এমন হতো না, তাছাড়া আপনার মা আমাকে যেভাবে অপমান করেছেন তা ভোলা কি এতই সহজ..
তিনিই আবার দিন ঘুরতেই ছেলের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসে, ফোন করে বলে শাড়ি পছন্দ করতে ঢাকায় যেতে…
একবার ভাবুন তো, ব্যাপারগুলো কি এতই সোজা…
: বুঝলাম, বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছো তুমি, তাইতো…
একেবারে ঝড়ের গতিতে প্রসূন বললো
: না,
মানে…
ও মাথা নিচু করে রেখেছে ওর উত্তরের জন্য হয়তো…
এরি মধ্যে ফোন আসে আমার বন্ধু রুমিনের। ওরা গাড়িতে উঠবে, আমি কোথায় তা জানতে চাইলো, আমি বললাম আমি মেইন রোডের ডানদিকের মার্কেটে আছি,
এরপর খুব দ্রুত প্রসূনকে বললাম
: যা হয়েছে প্লিজ সব ভুলে যাও, অতীতকে ভুলতে হয় না তা ঠিক, কিন্তু অতীতের সাথে বসবাস করলে তুমি ঠিকভাবে বাঁচতে কিংবা সামনে এগুতে পারবে না।
আমার এখন যেতে হবে, বাসার কেও জানে না আমি এসেছি এখানে, কেন এসেছি এখানে জানতে চাও..
প্রসূন মৃদু হেসে মাথা নিচু ঝাকিয়ে উত্তর দেয় না…
ওর উত্তর দেওয়াটা ভালো লাগলো আমার, মাথা ঝাঁকিয়ে না বলছে কিন্তু মুখে মৃদু হাসিই বলে দিচ্ছিলো ও জানে উত্তর টা।
আচ্ছা ভালো থাকো তুমি, আমি চললাম, খুব দ্রুত আমাদের দেখা হচ্ছে….
বলেই আমি চলে এলাম। টেবিলে কথা বলার সময় আমার হাতঘড়িটা ইচ্ছে করে খুলে রেখে এসেছিলাম। অন্তত এটা দেখে যেন আমাকে মনে করে ও…
সেদিন রাতের একটা বাজলো বাসায় আসতে আসতে। ওরা পৌছেছে বারেটায়। আমি দেড়িতে গিয়েছি। যাতে কেও না বুঝে। শাড়ির ব্যাগ ফুফুর বাসায় পৌছে দিয়েছি। বলেছি রুমিনকে বলে আনিয়েছি৷ ফুফু রাতের খাবার খাইয়ে তারপর ছাড়লেন। তাই বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই ঘুম।
সকালে উঠে দেখি ফোনো একটা ক্ষুদে বার্তা এসেছে-
“আপনার ঘড়িটা এখানে ফেলে গেছেন ভুলে…”
শুধু এটুকুই
প্রতিউত্তরে আমি লিখেছিলাম-
“শুধু ঘড়ি না, আমার মনটাও রেখে এসেছি রাজশাহীতে, একটু দেখে রেখো”
দিনটাই শুরু হলো ফুড়ফুড়ে আমেজে৷ মা সকাল সকাল আমাকে এত বড় একটা লিস্ট দিলেন বাজারের। বাজার করা আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে, তবুও আনন্দ মনে সেই লিস্ট নিয়ে বাজারে গেলাম আমি।
চলবে…
(দেরি হওয়ায় দুই পর্ব একসাথে দিলাম ☺)
previous
:https://www.facebook.com/659404701187391/posts/912488122545713/
Next: https://www.facebook.com/659404701187391/posts/915402522254273/