উপন্যাস : #সৎ_মা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ১৩
ঐ বারের জ্বরে ভুগলাম পুরো সাত সাতটা দিন। জ্বর থেকে উঠে প্রথম যেটা করলাম সেটা হচ্ছে সীমান্ত কে বাড়ি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। ওর বাড়ি ছাড়ার কারন – বাড়ি কেন ওকে নির্ভেজাল ভাবে লিখে দেয়া হচ্ছে না, বাবা জানে ও একটু উড়নচণ্ডী, তাই বাবা উকিল ডেকে এমন কিছু করেছে নাকি যাতে ওর প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি করতে হলে আমার অনুমতি লাগে। ওর সেখানেই ক্ষোভ।
সত্য বলতে আমি এসবের কিছুই জানতাম না। ওর কথায় যা বুজলাম আমিই বাবার সব, ও কিছুই না। আর এজন্যই নাকি ওর সাথে এমন করা হচ্ছে। তাই ও সব ছেড়েছুড়ে চলে আসছে।
ঐদিন আমি প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম আমি ওর সৎ ভাই। এ কথা শোনার পর আমি আর একটা কথাও বলতে পারি নি। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে এসেছিলাম।
সীমান্তর যখন জন্ম হয় তখন আমার বয়স নয় কি দশ হবে, তারপরের এই দীর্ঘ সময়ে কখনই আমার একবারের জন্যও মনে হয়নি ও আমার সৎ ভাই। ওর যেদিন জন্ম হলো আমার কি যে খুশি হচ্ছিলো বলার মতো না। বাবার সাথে মিষ্টি কিনতে গিয়েছিলাম, বাড়ি বাড়ি মিষ্টি নিয়েও গিয়েছিলাম। যার বাড়িতেই মিষ্টি নিয়ে গিয়েছি সবাই আমাকে পাচশঁ/একশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে ছিলেন। খুশির খবর নিয়ে এসেছিলাম তাই। এত টাকা আমি জীবণে কোনদিনও হাতে পাই নি আগে। টাকা এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিলো আমার জন্য, যাও দিত দুইটাকা পাঁচ টাকা, টাকা নাকি বাচ্চাদের স্বভব নষ্ট করে। এত টাকা একসাথে পেয়ে তাই তখন আমার মনে হয়েছিলো এমন ভাইবোন আরো অনেকগুলো হলে মন্দ হয় না…!
ওর বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার দায়িত্ব গুলোও বড় হতে থাকে। আমি বড় ভাই ৷ স্কুলের টিফিনের সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টাকা জমিয়ে কাগজের ফুল কিনে আনতাম, ছোট্ট সীমান্ত ঐ কলসি আকৃতির ফুল দেখে খুশিতে হাত পা ছুড়াছুড়ি দেখে খুশিতে আমি কুটকুট। এরপর ওর জন্য আমি ঝুনঝুনি, পানির পট আরো কতকিছু কিনে আনতাম। চোখ বন্ধ করে যখন এসব আমি ভাবছি, আমার চোখ আমাকে না জানিয়েই ভিজে গেলো।
এরি মধ্যে ফোনে অন-নোন নম্বর থেকে ফোন এলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত আমি ফোনটাকে কেটে ওয়াশরুমে গেলাম মুখ ধুতে, পাছে মা না বুঝে যায় কান্নার ব্যাপার। বাসায় ঢুকার সময় দু’বার জিজ্ঞেস করেছেন অসুস্থ শরীরে কোথায় গিয়েছি…?
আমি কোন উত্তরই দেই নি, কারন মা গলার স্বর শুনে মনের খবর বলতে পারে। আমার মা আজব এক মানুষ, আমার চেহারা দেখেই মন পড়ার ক্ষমতা কেবল তারই আছে…
এসে দেখি আবার ফোন এসেছে, ফোন হাতে নিয়ে
বারান্দায় দাড়িয়ে রিসিভ করলাম,
: হ্যালো
:……..
: কে বলছেন..?
: আমি…
: আমি কে…?
: প্রসূন….
: প্রসূন …..!
এরপর হরবর করে একটা মেয়ের কথা শুনতে পেলাম, আমি তখনো নাম আর চেহারার মিল করতে ব্যাস্ত…
প্রসূন……!
তার কথা বালার সারমর্ম হচ্ছে – মা ওদের বাড়িতে গিয়েছে আজ, ওর আর আমার বিয়ের কথা বলতে….
আমি তখন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কি বলছে ও, এমন কিছু তো হওয়ার কথা না…
আর মা…! মা ই বা আমাকে না বলে কেন গেলো ওদের বাড়ি….!
আমি তখন রাগান্বিত কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম।
না দেখেও বুঝতে পারছিলাম প্রসূনের চোখে মুখে তখন আগুন। এ আগুন নেভানোর ক্ষমতা এই পৃথিবীর কারো নেই। আমিও তাই বৃথা চেষ্টা করলাম না। চুপ করে শুধু ওর কথা শুনছিলাম। এই মেয়ে যে এতো কথা বলতে পারে তা আমার কল্পনাতীত, রাগের সময় মেয়েদের মুখে কথার খই ফুটে…
কথাটা যে সত্যি সেবার জানতে পারলাম।
শেষমেষ যখন আমি কিছুই বলছিলাম না, তখন ওর রাগের আগুন যেন নিভলো, কোমল কন্ঠে বললো-
: আমি কারো দয়া নিতে পারবো না, যা হওয়ার হয়েছে…
দোষ আমারই, আমি কেন যেতাম ওখানে, তার শাস্তি ও পেয়েছি আমি, এখনো পাচ্ছি, নতুন করে কাওকে এসব ব্যাপারে জড়াতে চাই না আমি…
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম-
: সম্মান শুধু তোমারই যায় নি, এই ব্যাপারটাতে আমার ও সম্মান জড়িত,
: তো…
: তো আবার কি….!
: দয়া দেখাতে চান…
: দয়া….!
: দয়া না হলে কি, কি চান আপনি…..?
: সবাই তোমার আর আমার ব্যাপারে যে মিথ্যা বলছে সেটাকে সত্য করতে….
আমি স্তম্ভিত…
আমার নিজের কথা শুনে, ক’দিন আগেই যেই আমি ঘটককে বলেছিলাম – কি সব হাটুর সাইজ মেয়ে দেখান, এসব মেয়ে চলবে না বুঝেছেন, এসব আলতু ফালতু মেয়ে দেখালে পদ্মা সেতুতে যে কল্লা নিচ্ছে সেখানে ফেলে দিয়ে আসবো, বোঝা গেছে ব্যাপারটা…!
সেই আমি…..
ফোনের দুই পাশেই পিনপতন নীরবতা,
বেশ কিছু সময় পর বুঝতে পারলাম প্রসূন কাঁদছে…
চলবে…
Previous : https://www.facebook.com/659404701187391/posts/910127196115139/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/911669129294279/