উপন্যাস: সৎ মা, লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ২০

0
295

উপন্যাস: সৎ মা,
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ২০

সুন্দর একটা ছেলে গেইট খুলে জিজ্ঞেস করলো
: কাকে চাই…
কাকে চাই…
কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগলো। কি উত্তর দিবো ওকে – মাকে চাই বলবো, নাকি বলবো মিসেস লুৎফুন্নাহার কে চাই..

ছোট বেলায় শুনতাম বাবা মাকে লুৎফা বলে ডাকতো, এতবড় আর জটিল নাম তাই হয়তো। আমি ও কি তাই বলবো। যে আমার বাবার লুৎফা কে চাই…

এই ছেলেটা কে তাও বোঝা যাচ্ছে না, ও কি আমার ভাই…
কি সব ভাবছি আমি, আমার একটাই ভাই, সীমান্ত।
এত ভাবনা ভেবে আমি ওকে বললাম
– আজিজ সাহেব তোমার কি হন,
– আমার বাবা, কেন বলুন তো…
– তোমার মা কি বাসায় আছেন…?
– হুম,
– একটু ডেকে দাও,
– আচ্ছা আপনি দাঁড়ান একটু।
বলে ছেলেটা দড়জা আটকে ভেতরে গেলো।
আমি ঘুরে দাড়িয়ে ঘাম মুছছি, বেশ কিছু সময় পর গেইট খোলার শব্দ কানে আসলো, আমি ঘুরে দেখার শক্তিটুকুও পাচ্ছিলাম না। ইচ্ছে হচ্ছিলো কার্ড ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যাই…, কিসের দোয়া, কিসের এত সৌজন্যতা, কিচ্ছুর দরকার নেই আমার।

কিন্তু আমি তা পারলাম না, মানুষের মন যা সবসময় চায় তা করতে পারে না। নিরুপায় আমি বাধ্য হয়ে ঘুরে দাড়ালাম…
নির্বাকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ।

সামনে যিনি দাড়িয়ে তিনি আমার মা, আমি মানতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিলো এত বছর ব্যবধানে আমি বড় হয়ে গেছি ঠিকই, কিন্তু মার বয়স তো বারেই নি বরং কমেছে।

মা যখন আমাদের ছিলো তখন তিনি সুতি শাড়ি পরতেন। ফুল লতাপাতা আঁকা ছাপার শাড়ি, কখনো বা চওড়া পারের টাঙ্গাইল শাড়ি। হাতে সোনার দুটি চুড়ি, গলায় চেইন আর নাকে ছিলো ছাতার মতো বড় একটা নাক ফুল। আর কোমর ছাড়ানো চুলগুলো সব সময় থাকতে খোপা করা। এক্কেবারে পাক্কা গৃহিণীর রূপ।

মা এখন সেলোয়ার-কামিজ পরে আছেন৷ হাতজোড়া খালি তার, নাকে ছোট্ট পাথরের নাক ফুল। ক্ষুদ্র ঐ পাথরের ঝলকানিই বলে দিচ্ছে তা হীরার তৈরী। আর কাধ সমান চুলগুলো খোলা। গায়ের রংও খুলেছে ভীষণ।

আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল জায়গাতে এসে পরি নিতো…!
পরে চোখ যখন গালের ছোট্ট কালো মিশমিশে তিলটাতে গেলো তখন মনে হলো না, ঠিক জায়গাতেই আছি আমি……

দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকা আমার মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন –
– কেমন আছো….
আমি যন্ত্রের মতো উত্তর দিলাম
– ভালো,
মনে মনে ভাবছিলাম আমাকে কি চিনে ফেললো…
নাকি অন্য কেও ভাবছে…
– এসো ভিতরে এসো….
আমি আমাকে চেনা আচেনার দ্বিধা দ্বন্ধে বাসায় ঢুকলাম।
ভিতরটা ঢুকে আমি সোফায় বসলাম,
তিনি বাসার ভিতরে গেলেন আমাকে বসিয়ে।
কিছুক্ষণ পর একজন এসে আমাকে পানি আর নাশতা দিয়ে গেলেন। আমি ওকে বললাম উনাকে আসতে বলো আমার আবার তাড়া আছেন।

মেয়েটি চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর মা বসার ঘরে এলেন, বললেন কিছুই তো খেলে না।

আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। কান্নার পর মানুষের চোখ যেমন ফুলে যায় তার অসম্ভব সুন্দর চোখদুটো এখন সে অবস্থা। একটু পরপরই নাক মুছছেন রুমালে। তখন আমি বুঝলাম তিনি এতক্ষণ কান্না করে আসলেন।

আমি কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না,এরিমধ্যে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
– তোমার দাদী কেমন আছেন…
আমি তখন নিশ্চিত হলাম তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন, আমি উত্তরে বললাম
– ভালো
– তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে, তা মেয়েদের বাড়ি কোথায়?
একথার উত্তরে আমি ঠিক তার চোখের দিকে তাকালাম, তিনি কেমন যেন বিব্রতবোধ করলেন।
আমি কার্ডটা টেবিলের উপর রেখে বললাম
– আগামী তেইশ তারিখ আমার বিয়ে, তাই আপনাকে জানাতে আসলাম। আমার জন্য দোয়া করবেন
– শুধু জানাতেই এসেছ, দাওয়াত করবে না।

এমন প্রশ্ন শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না,তাই খানিকটা বিব্রতবোধ করলাম।
তিনি প্রসঙ্গ বদলাতে বললেন
– তোমার বিয়ে, শুনে খুবই খুশি হলাম, মন থেকে দোয়া করি জীবনে সুখি হও।
বেশ খানিকটা সময় নিরব থেকে তিনি বললেন
– তুমি একটু বসো আমি আসছি
– না, আমি বসতে পারবো না, আমার তাড়া আছে…
– প্লিজ বসো, জাস্ট ফাইভ মিনিট….
তিনি পাঁচ মিনিটের আগেই চলে এলেন, সাথে এলো ঐ ছেলেটা, তিনি আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন
বললেন
– উনি তোমার বড় ভাই দিগন্ত, ইংলিশে অনার্স মাস্টার্স, এখন নিজের বিজনেস দেখাশোনা করছে, আর দিগন্ত এ হচ্ছে উদয়, এ বছরই ভার্সিটিতে ভর্তি হলো মার্কেটিং এ।

আমি তেমন সাড়া দিলাম না, মুখে কৃত্রিম হাসি হাসলাম, ছেলেটা বাইরে চলে গেলো, বললো ভাইয়া আপনি থাকেন আমার একটা কাজ আছে আমি বাইরে যাচ্ছি, আমি বললাম
– ঠিক আছে,
ও চলে যাওয়ার পর আমার মা টেবিলে একটা বাক্স রাখলেন। কিসের বাক্স বোঝা যাচ্ছে না। তবে বাক্সটা খুবই সুন্দর।
এরপর তিনি বললেন
– আমি অতীত কিছু ঘাটতে চাই না, তবে আমি স্বীকার করছি তোমার সাথে আমি যা করেছি তা অন্যায়। কিন্তু তখন আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য তোমার বাবাকে আর তোমার দাদী ফুফুদের শিক্ষা দিতে চেয়েছি, যা করেছি একেবারেই ঝোঁকের মাথায়। কষ্ট দিতে গিয়ে তোমাদের চেয়ে বেশী কষ্টে পুড়েছি আমি৷ আমি তোমাকে দেখতে যাবো, তোমার খোঁজ নিব তেমন পরিস্থিতি ও ছিলো না।

কথাগুলো শুনে আমি কল্পনায় আমার ছোটবেলার সেই বিভৎস দিনগুলোতে চলে গিয়েছিলাম। মাকে না ধরে ঘুমালে আমার ঘুমই আসতো না, সেই আমি ঘুমাতাম দাদীর সাথে,যেই আমি দাদীর পানের জর্দার গন্ধে দাদীর কাছেই ঘিরতাম না।

অনেক চেষ্টা করলাম কান্না না করবার জন্য। কিন্তু চোখের পানির বাঁধ ভেঙ্গে গেলো আমার। মা ও কাঁদছেন।

এরপর তিনি বললেন, বক্সের মধ্যে একটা চেইন আছে। এটা তোমার বউর জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার।
আমি কোন কথা না বলে উঠে পরলাম, বললাম
– এটা আমি নিতে পারবো না, আমি চললাম, ভালো থাকবেন আপনি…
বলেই দরজা খুলে আমি বেরিয়ে পরলাম। মা তখনো দু হাতে মুখ চেপে কাঁদছেন….

সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে পারছিলাম না আমি। চোখমুখ মুছে গাড়ি বের করে সোজা চলে গেলাম। আমাদের কালো গাড়িটা তখনো দাঁড়ান ছিলো রাস্তার অপরদিকে। আমি থামলাম না। তখন মনে হচ্ছিলো দূরে কোথাও যদি চলে যেতে পারতাম, যেখানে কেও আমাকে জানবে না, চিনবে না…
তাহলে হয়তো মনটা শান্ত হতো…..

চলবে…
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/916139242180601/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/917682085359650/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here