-‘এলোকেশী কন্যা’-
[০৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
পরেরদিন সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে নতুন দিনের সূচনা করল। ঝলমলে রৌদ্রজ্জ্বল দিনের আগমনে প্রকৃতি পুনরায় নিজের প্রকৃত রুপে ফিরে এসেছে। মৃদু বাতাস, বুনো পাখিদের কলবর, মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ, আর সবুজের সমারোহে অপরুপ এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে। কাক ডাকা ভোরে কয়েকজন পাহাড়ি তরুণী পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে। এই পথ দিয়ে তারা রোজ যাওয়া-আসা করে। এরা পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট দোকান গুলোতে হরেক রকম জিনিস বিক্রি করে। কত শত পর্যটকরা এসে তাদের পছন্দ মতো জিনিসপত্রও কিনে। সেখানে সারি সারি দোকান গুলোতে, তাঁতের শাড়ি, গামছা, থামি, আচার, ফলপাকড়, শামুকের তৈরী মালা দুলসহ আরো নানান জিনিস পাওয়া যায়। সুলভ মূল্যের কারণে ক্রয়-বিক্রয়ও ভালোই হয়।
একদল তরুণীর পেছনের সারিতে দু’জন গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। তাদের একজনের হঠাৎ চোখ গেল জঙ্গলের দিকে । তরুণী থমকে দাঁড়িয়ে ওর পাশে জনকে আঙ্গুলের খোঁচা মেরে বলল,
“বু ওতা কী লে? দেকে তো মানুচ মুনে ওচ্ছে?”
“কই?”
মুন নামের মেয়েটি ওর পাশের জনকে জঙ্গলে তাকাতে
ইশারা করল। মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে মুনকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়াল। ওরা সেখানে পৌঁছে দেখল, একটা ছেলে অজ্ঞান অবস্থায় উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ছেলেটার সাদা শার্ট রক্তে ভিজে চুপচপে হয়ে গেছে। মুন রক্ত দেখে নাক ছিঁচকে দুই পা পিছিয়ে গেল। ওর পাশের মেয়েটি মৃদু স্বরে বেশ কয়েকবার ছেলেটাকে ডাকল। ছেলেটার কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে একই অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবকে পড়ে আছে। মুন আশে পাশে একবার চোখ বুলিয়ে সতর্কতার কন্ঠে বলল,
“বু চল আমলা পালাই। এতা মুনে হয় মলা মানুচ।”
“উফ! চুপ কর।”
কথাটা বলে মেয়েটা বসে অনেক কষ্টে রোদকে চিৎ করল। রোদের মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মেয়েটি রোদের নাকে, বুকে, কান পেতে নিঃশ্বাসের গতি পরীক্ষা করল। তারপর মুনের থেকে পানি নিয়ে মেয়েটি রোদের মুখে পানির ছিঁটা দিলো। রোদের নিঃশ্বাস ধীর গতিতে চলছে। মেয়েটি ওর দুই হাত দিয়ে আস্তে আস্তে রোদের বুকে চাপ দিলো। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। মেয়েটি উপায় না পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মুনের দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকাল। মুন না বোধক মাথা নাড়িয়ে মেয়েটিকে নিষেধ করছে। মুন বুঝতে পেরেছে ওর বু এর তাকানো মানে। মুনের নিষেধ অগ্রাহ্য করে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে রোদের নাক চেপে ধরে রোদের ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। মুন ওর বু এর কাজে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে একটা পা পিছিয়ে গেল। সে বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি রোদকে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সূর্যের তাপে মেয়েটির নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। ঘামটুকুতে শিশির বিন্দুর মতো অদ্ভুত এক সৌন্দর্য লুকায়িত আছে। মেয়েটি পরপর দুই বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। হার না মেনে সে পুনরায় চেষ্টা করায় রোদ মৃদু ভাবে নড়ে উঠল। রোদকে নড়তে দেখে আবার শ্বাস দিয়ে নাক ছেড়ে দিলো। রোদ পরপর জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলো। মেয়েটি রোদের মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে বুকে হালকা ভাবে চাপ দিতে লাগল। রোদ হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রোদকে নিঃশ্বাস নিতে দেখে মেয়েটি মৃদু হেসে ধীর কন্ঠে ডাকল,
“শুনছেন! এই যে! কি হয়েছে আপনার?”
রোদ ধীরে ধীরে একবার চোখ খুলে আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। ওর শরীরে উঠে বসার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। পুরো শরীরের অসহ্য ব্যাথায় জর্জরিত সে। চোখ দু’টোও ক্লান্ত হয়ে বুজে আসছে।
কালকে মেঘের ওই অবস্থায় দেখে রোদের মস্তিষ্ক অচল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। পরে জঙ্গিরা এসে পানি ঢেলে ওকে সজাগ করেছিল। রোদ সজাগ হয়ে বার বার আঁকুতি করে মেঘের কথা জিজ্ঞাসা করছিল। ওরা কিছু বলছিল না শুধু উচ্চশব্দে হাসছিল। তখন আচানক একটা মেয়ে এসে বিশ্রী ভাবে রোদের পুরো শরীরে হাত বুলাতে লাগল। রোদ এসব সহ্য করতে না পেরে রেগে মেয়েটার মুখে একদলা থুথু ছুঁড়ে মারল। ওর এই কাজে বাকিরা রেগে রোদকে চামড়া জাতীয় কিছু দিয়ে খুব মারতে লাগল। সেটা দিয়ে মারার সঙ্গে সঙ্গে রোদের শরীরের চামড়া ফেটে রক্ত গড়িয়ে গেল। তখন রোদের মুখ দিয়ে একটা কথায় বেরিয়ে ছিল,’ ম মা।’
ওদের মারের চোটে একপর্যায়ে রোদ পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপরে ওর আর কিছু মনে নেই।
মেঘের কথা স্মরণে আসতেই রোদ উঠতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। মেয়েটি রোদের হাতের বাঁধন খুলে ওকে উঠে বসতে সাহায্য করল। রোদ আশে পাশে চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে মেঘের নাম ধরে ডাকল। কিন্তু মেঘকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বলির জায়গায় রক্ত রোদ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মুন ভয়ার্ত চোখে রোদের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
“এ মানুচটা পাগল নাকি? এমন করচে কেন? আমাকে কাড়লে দিবে না তো?”
মুন দাঁত দিয়ে নক কেটে পেছাতে পেছাতে দৌড়ে পালালো। রোদ উঠে খুঁড়িয়ে হেঁটে সব জায়গায় মেঘকে খুঁজতে লাগল। মেয়েটাও রোদের পেছন পেছনে যাচ্ছে আর চিন্তিত স্বরে করছে,
“এই যে আপনি থামুন! আপনার পায়ে থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কি খুঁজছেন, আমাকে বলুন?”
“আ আমার ছোট্ট ভাই। ওরা আমার ভাইকে বলি… ।”
এতটুকু বলে রোদ আর কিছু বলতে পারল না। ওর চোখ দিয়ে অঝরে ঝড়ে গেল কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। রোদ পাগলের মতো মেঘকে ডাকছে আর এদিক-ওদিক খুঁজছে। ওর শরীরে অসহ্য ব্যাথা নিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেঘকে খোঁজার। অজানা একটা ভয়ে রোদের বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। সে মনে প্রাণে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে, ওর নিষ্ঠুর মন যেটা ভাবছে সেটা যেন না হয়।
মেয়েটাও রোদের সঙ্গে বলির স্থানে গিয়ে দেখল সেখানে কিছু নেই। তবে কারো রক্ত পড়ে আছে। আর রক্ত দেখে মনে হচ্ছে কাউকে জবেহ করা হয়েছে। রোদ থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটু দূরে একটা বস্তা দেখতে পেল। সে কিছু একটা ভেবে বস্তুা খুলে দেখল পঁচা শকূরের মাংস। পঁচা মাংসের গন্ধে সে পেট চেপে ধরে বমি করতে লাগল। সেই গন্ধে বমির সাথে ওর নাড়ি ভুড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম। খালি পেটে বমি করা যে কত কষ্টকর সে হারে হারে টের পাচ্ছে। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে পানি এনে রোদের দিকে পানি এগিয়ে দিলো। রোদ কুলি করে চোখে মুখে পানি দিয়ে ওখানে ধপ করে বসে পড়ল। ওর শরীরটা আর চলছে না। এখন নিজের শরীরের ভাড়টুকুও ওর অসহ্য লাগছে। সে খুব করে চাচ্ছে, এই মূহুর্তে
মৃত্যু এসে ওর দুয়ারে কড়া নাড়ুক। ওর প্রাণ পাখিটা উড়ে যাক অচেনা এক পথের বাঁকে। সে সাদরে গ্রহন করতে চাচ্ছে ওর মৃত্যুটাকে। কারণ মেঘকে ছাড়া ওর বাঁচার ইচ্ছেটুকু যে এখানেই শেষ।
রোদের দিক থেকে চোখ সরাতেই মেয়েটার চোখ পড়ল বস্তার পাশে থাকা রক্তের ফোঁটার দিকে। সে রক্তের ফোঁটা অনুসরণ করে জঙ্গলের দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। তারপর কিছুদূর যেতেই দেখতে পেল, একটা ফুটফুটে বাচ্চার অর্ধ শরীর মাটিতে পুঁতে রাখা। বাচ্চাটার শুধু মাথাটুকু বেরিয়ে আছে আর বুক অবধি মাটি দিয়ে ঢাকা। মেয়েটা চিৎকার করে রোদকে বলল,
“এই যে শুনছেন এখানে আসুন। এখানে একটা বাচ্চাকে পেয়েছি।”
কথাটা শুনে রোদ দ্রুত পায়ে হেঁটে সেখানে গেল। মেঘের এই অবস্থা দেখে রোদ পাগলের মতো হাত দিয়ে মাটি সরাতে লাগল। মেয়েটিও রোদের সাথে হাত লাগল। তারপর দু’জনে মিলে অনেক কষ্টে মেঘকে উদ্ধার করল। রোদ মেঘকে বুকে জড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ভাই! এই ভাই! মেঘ আমার সোনাটা কথা বল। দাভাই ডাকছে তো কলিজাটা উঠ। এই মেঘ আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস! এই মেঘ! মেঘ!”
মেঘের সাড়াশব্দ নেই। মেয়েটি পানি এনে মেঘের মুখে ছিঁটা দিয়ে বলল,
“ওর মুখে দ্রুত কৃত্রিম শ্বাস দেন। ধীর গতিতে এখনো ওর শ্বাস চলছে।”
মেঘের এই অবস্থা দেখে রোদের মাথা কাজ করছে না। মেয়েটি ওকে ধাক্কা দিয়ে পুনরায় একই কথা বলল। রোদ নিজেকে সামলে মেঘের নাক চেপে কৃত্রিম শ্বাস দিতে লাগল। আর মেয়েটি মেঘের বুকে ধীরে ধীরে চাপ দিতে লাগল। একপর্যায়ে মেঘের শরীর মৃদু ভাবে কেঁপে উঠল। মেয়েটি মেঘের মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে ডাকতে লাগল। মেঘ ধীরে ধীরে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। রোদকে দেখে মেঘ মৃদু স্বরে বলল,
“দা দা দাভাই ক কষ্ট হচ্ছে।”
“এই তো আমি সোনা। তাকাও, তাকাও আমার দিকে।”
মেঘ আবার চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। রোদ মেঘের গালে হাত রেখে আদুরে সুরে ডেকে যাচ্ছে। মেঘের অসাড় শরীর মেঘের বুকে লেপ্টে আছে। মেয়েটি জানে এই জায়গাটা ওদের জন্য নিরাপদ নয়। তাই সে রোদকে বলল,
“পাহাড়ের নিচে আমার বাড়ি। আপনারা আমার বাড়িতে চলুন, এই জায়গাটা কারোর জন্যই নিরাপদ নয়।”
কথাটা শুনে রোদ আর কিছু ভাবল না। সে রক্তাক্ত এবং ব্যাথাযুক্ত শরীরে মেঘকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটি ওর ব্যাগ নিয়ে ওদের সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। রোদ অনেক কষ্টে মেঘকে কোলে নিয়ে নিচে নেমে, ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পাশের পাহাড়ের দিকে। মেয়েটির বাড়ি পাশের ছোট একটা পাহাড়ের নিচে। বাঁশ, টিন আর ছনের তৈরী ছোট একটা বাড়ি। মেয়েটি রুমে দরজা খুলে মেঘকে খাটে শুয়াতে বলে গেল পানি আনতে। রোদ অতি সাবধানে মেঘকে খাটে শুইয়ে দিলো। মেয়েটি বালতিতে পানি এনে মেঘের মাথায় পানি ঢেলে শরীর মুছিয়ে দিলো। রোদ অশ্রু ঝরিয়ে আদুরে সুরে মেঘকে ডাকছে আর হাত পা তেল দিয়ে মালিশ করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর, মেঘ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে,’ দাভাই!’ বলে চিৎকার করে উঠল। রোদকে ওর সামনে দেখে মেঘ ভয়ে রোদের বুকে হামলে পড়ল। দু’জন ভাই একে অপরের জড়িয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে লাগল। ওদের কান্না দেখে মেয়েটিও নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। মেঘ রোদের বুকে মুখ লুকিয়ে শব্দ করে কেঁদে অস্পষ্ট স্বরে বলছে,
“দাভাই! দাভাই! ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে দাভাই। বাঁচাও আমাকে, বাঁচাও!”
“এই তো আমি সোনা। কিচ্ছু হবে না তোমার। এই তো আমি তাকাও, দেখো দাভাই তোমার সঙ্গে আছি।”
কথাটা বলে রোদ খেয়াল করল জ্বরে মেঘের শরীর থরথর করে কাঁপছে। রোদ মেঘকে বুক থেকে সরিয়ে মৃদু ভাবে ঝাঁকিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে ডাকছে। কিন্তু মেঘ ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে রোদের বুকে লুটিয়ে পড়েছে। মেঘকে কাঁপতে দেখে মেয়েটি কাঁথা আনার জন্য পা বাড়াতেই, একজন বৃদ্ধ মহিলা এসে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“আলো! তুই মরদ মানষ্যেরে ঘরে আনসোস ক্যান? লোকে জানলে আমাগোরে থুতু দিয়া খেদাইয়া দিবে। এক্ষুণি এগোরে বাইর কইরা দে কইতাছি। এক্ষুণি দে!”
To be continue……..!!