-‘এলোকেশী কন্যা’-
[০৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
বিকালের দিকে অাদিবাসীদের গ্রাম প্রধান মকবুলকে নিয়ে বিচার বসিয়েছেন। মকবুল কিছু বলছে না। যা হচ্ছে মাথা নিচু করে মুখ বুঁজে সব মেনে নিচ্ছে। পুরো গ্রামের লোক এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সবাই রেগে চিৎকার করে মকবুলের কঠিন শাস্তি চাচ্ছে। যাতে কেউ পরবর্তীতে এই নির্মম অপরাধ ভুলেও করার সাহস না করে। বিচারক পুরো ঘটনা মনোযোগ দিয়ে শুনে মকবুলকে বললেন,
“তুই মারচোচ ক্যান মুনরে? যা কচ্চি ছতিক জবাব দে।”
“মুন আমার সাতে ভালোবাছার অভিনয় করেচে তাই ওরে মেরেচি।”
কথাটা শুনে উপস্থিত সবার মাঝে ফিসফিস করে কানাঘুষা শুরু হলো। মুনের মায়ের অবস্থা ভালো না। মেয়ের শোকে কাতর হয়ে উনার বেগতিক অবস্থা। তাই এই বিচারে উপস্থিত হতে পারেন নি। তবে মকবুলের এই কথাটা উপস্থিত কেউ বিশ্বাস করলেন না। কারণ মুন এমন মেয়েই ছিল না। আর করলেও এত নৃশংস ভাবে খুন করতে হবে? মকবুলের এমন যুক্তিহীন কথা শুনে অনেকে রেগে মকবুলকে মারতে গেল। বিচারক দাঁড়িয়ে কোনোমতে সবাইকে শান্ত করিয়ে পুনরায় বিচারকার্য শুরু করলেন।
মকবুল মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। তবে ওর চোখে মুখে আফসোসের চিহ্নটুকু নেই। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে খুন করেও ওর বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ হচ্ছে না। মকবুলের বাবা মা এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। এই অপরাধের জন্য কঠিন একটা শাস্তি মকবুল পাবে, উনারাও জানেন। এই পরিস্থিতিতে উনারা শত চাইলেও আর ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না।
অনেক ভেবেচিন্তে বিচারক জনসম্মুখে একটা রায় ঘোষণা করলেন। মুনকে নৃশংস ভাবে মারার কারণে মকবুলের এক হাত কাটা হবে। এবং তাকে সমাজচ্যুত করা হবে। সেই সাথে তাকে কেউ কখনো কোনো সাহায্য করতে পারবে না। তার সাথে ভুলেও কোনো প্রতিবেশী উঠা বসা করতে পারবে না। আর করলে তাকেও কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। অর্থাৎ মকবুল এখন থেকে একঘরা। এমনকি সে ওর বাবা মায়ের সঙ্গেও আর থাকতে পারবে না। বিচারক এই রায় শুনিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। আর মকবুলের বাবা মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। তবে বাকিরা এই রায়ে খুব একটা সন্তুষ্ট না হলেও মেনে নিলো।
আলো মকবুলের বিচার দেখতে যাওয়ার সাহস পায়নি। সে বাড়িতেই থম মেরে বসে আছে। মকবুলকে সে খুব ভালো জানত এবং সন্মানও করত। অথচ আজকে এই পরিস্থিতি
অবিন্যস্ত ভাবে সব উলটপালট করে দিলো। তবে মুনের এমন নির্মম পরিণতি আলোর মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছে। এই দাগ ওর মন থেকে আদৌ মুছবে কী না তাও জানে না। এখন কারো ভালোবাসা দিয়ে, ওর হৃদয়ে প্রণয়ের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয় কী না শুধু দেখার পালা।
সন্ধ্যার পূর্বে দাদী মলিন মুখে বাড়িতে ফিরে জানালেন, আগামী পরশুদিন মকবুলের ডান হাত কাঁটা হবে। সে যাতে রাতের আঁধারে পালাতে না পারে। তাই রোদ বৃষ্টির মধ্যেও ওকে গাছে বেঁধে রাখা হবে। এবং দুই জন মকবুলকে সর্বদা পাহারা দিবে। ওর শাস্তি সম্পূর্ন না হওয়া অবধি একফোঁটা পানিও তাকে দেওয়া হবে না। এসব শুনে আলোর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে গেল। যে চিরতরে চলে গেছে, তার জন্য অন্যজনকেও অচল করে দিচ্ছে। উফ! কী নির্মম এক পরিণতি!
সময়ের চাকা ঘুরে মধ্যখানে একটা দিন কেটে গেল। কালকে রোদদের ফিরে যাওয়ার কথা। আজ আকাশের অবস্থা একটু ভালো। তাই ওরা এসেছে আলোর সঙ্গে দেখা করতে। আলো ওর ছোট্ট দোকানটা খুলে কেবল টুলের উপর বসেছে। তখন রোদ আর মেঘকে দেখে আলো ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ওরা প্রথমে আলোর বাড়িতে গিয়ে ওকে না পেয়ে এখানে এসেছে।
মেঘ আলোকে দেখে দৌড়ে এসে দুই হাত কোমরে রেখে নাক ফুলিয়ে বলল,
“ওই যে পিছনের দিনে আমাকে না বলে চলে আসলে কেন? জানো, আমি কত কষ্ট পেয়েছি।”
আলো মেঘের কথা শুনে মলিন মুখে জোরপূর্বক হেসে বলল,” আমি খুব দুঃখিত মেঘবাবু। আসলে জরুরি দরকারে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি।”
“ওহ।”
মেঘ আলোর দোকানের জিনিসগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। আর তোতাপাখির মতো কতশত বুলি আওড়াচ্ছে। রোদ এতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনের কথা শুনছিল। রোদকে দেখে আলো তাড়াহুড়ো করে ওর টুল এগিয়ে বসতে দিলো। রোদ ওকে ব্যতিব্যস্ত হতে নিষেধ করে টুল টেনে এক পাশে বসল। আশে পাশে বেশ কয়েকটা দোকান। পর্যটকরা ঘুরে ঘুরে তাদের পছন্দসই জিনিস কিনছে। দরদাম করতে করতে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটিও হচ্ছে। রোদ সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আলোর দিকে তাকাল। মেয়েটার মলিন মুখশ্রী দেখে স্পষ্ট , সে ভালো নেই। কিছুক্ষণ আগেও হয়তো কেঁদেছে। ওর চোখসহ টিকালো নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। পরিহিত মেরুন রংয়ের থামির সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে ওড়না নিয়েছে। ফর্সা শরীরে গয়না বলতে কিচ্ছু নেই। যাকে বলে একদম সাদামাটা। রোদ এবার নিজে থেকেই কথা বলল,
“তোমার পুরো নাম কি?
রোদের কথা শুনে আলো মৃদু হেসে উত্তর দিলো, “আমার পুরে নাম আতকিয়া ইবনাত আলো। সবাই আমাকে আলো বলে ডাকে।”
রোদ ওর নাম শুনে পুরো দোকানে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“বাহ! অনেক সুন্দর নাম। তা তুমি কী এই পোশাক গুলো নিজে বানাও?”
“জি।”
“আসলে কালকে আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি। এজন্য আজ আমরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
ওরা চলে যাবে শুনে আলোর মনটা কেন জানি বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। সে বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ছোট করে উত্তর দিলো, “ওহ।”
তখন কয়েকজন পর্যটক এসে আলোর দোকানে এটা ওটা দেখে না কিনেই চলে গেল। ব্যাপারটা রোদের কাছে খারাপ লাগলেও বুঝতে দিলো না। এমন অনেকে আছে। যারা অযথা দোকানদার খাঁটিয়ে পছন্দ হচ্ছে না বলে চলে যায়। তবে এই নিয়ে আলোর মধ্যে কোনো খারাপ লাগা দেখা গেল না। এটা ওর কাছে এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। ওর দোকানে যা আছে সব মেয়েদের জিনিসপত্র। তাই আলো মেঘকে দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। সে পুরো দোকানে চোখ বুলিয়ে তাঁতের তৈরি একটা গামছা মেঘকে দিলো। ছোট সাইজের গামছা পেয়ে মেঘের চোখ দু’টো চকচক করে উঠল। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“ওয়াও! গামছাটা খুব সুন্দর হয়েছে বউমনি।”
মেঘের ‘বউমনি’ ডাকটা আলো ঠিক বুঝতে না পেরে বলল, কী বললে মেঘবাবু?”
আলোর কাছে ধরা খেয়ে মেঘ আড়চোখে একবার রোদের দিকে তাকাল। তারপর দাঁত বের করে হেসে সাহস নিয়ে বলল,
“তোমাকে আমি খুব ভালোবেসে বউমনি ডাকলাম। তুমি রাগ করো না প্লিজ!”
মেঘের কথা শুনে রোদের মধ্যে কোনো জড়তা কাজ করল না। সে টুলের উপর বসে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে পাহাড় দেখছে। মেঘের কথা আলো তেমন ভাবে আমলে না নিয়ে মুচকি হাসল। কালকে ওরা চলে যাবে। আর হয়তো কখনো দেখা হবে না। তাই সে নিষেধ করে বাচ্চাটার মন খারাপ করল না। রোদ মেঘের কথাটা এড়াতে, আলোকে টুকটাক প্রশ্ন করে অনেক কিছুই জানতে পারল। আলোরও ওদের সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওর মনটা একটু হয়েছে।
একটুপরে, আলো ওদের বসতে বলে সামনের দোকান থেকে পাঁকা পেঁপে , আখ, আর পেয়ারা কেটে ধুয়ে এনে ওদের খেতে দিলো। রোদ এখানেও এই মেয়ের অতিথিপরায়ণতা দেখে বেশ অবাক হলো। সে আসা অবধি দেখছে দোকানে এক টাকাও বিক্রি হয় নি। তবুও মেয়েটার মধ্যে মন খারাপের রেশটুকুও নেই। মেঘ পাঁকা পেঁপে দেখে ফট করে তুলে খেতে লাগল। তারপর মুখ ভর্তি পেঁপে নিয়ে অস্পষ্ট ভাবে রোদকে বলল,
“উম! উম দ দা দাভাই এ একটা খাও, দারুণ খেতে।”
রোদ মেঘকে আস্তে ধীরে খেতে বলল, নাহলে আবার ওর গলায় আঁটকে যেতে পারে। রোদের পেঁপে পছন্দ না। তাই না খেয়ে চুপ করে বসে আছে। আলো নিজে উঠে রোদের দিকে পেঁপে এগিয়ে দিলো। রোদ ভদ্রতা সূচক একটা পিস তুলে মুখে নিয়ে বেশ অবাক হলো। সত্যিই পেঁপেটা দারুণ খেতে, খুব মিষ্টি! ঢাকায় হ্যারিকেন নিয়ে খুঁজলেও এমন মিষ্টি পেঁপে পাওয়া যাবে না। মেঘ তো এবার রোদকে পেঁপের ভাগ দিতে নারাজ। তাই আলো হেসে রোদের জন্য আরেকটা আনতে চাইল। রোদ ওকে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করল। তারপর রোদ গামছা আর ফলের টাকা আলো দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু আলো টাকা না নিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
“উপহারের টাকা নিতে নেই। আমি গরীব, আমার সাধ্যমতে মেঘবাবুকে একটা উপহার দিয়েছি। আপনি টাকা দিয়ে আমাকে লজ্জা দিবেন না।”
আলোর কথা শুনে রোদ রুমালে মুখ মুছে মুচকি হেসে বলল,
“বেশ, উপহারের টাকা নিও না। তবে ফলের টাকাটা নাও। এবার টাকা ফিরিয়ে দিলে আমরা সত্যিই আর আসব না, আগেই জানিয়ে দিচ্ছি।”
To be continue………!!
(আজকের ভুল গুলো নিজ দায়িত্ব শুধরে নিবেন, ইয়ে মানে ইডিট করতে পারি নি)