-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
এদিকে মেঘকে ওয়াশরুমে না পেয়ে রোদ পুরো রেস্তোরাঁ হন্ন হয়ে খুঁজল। সে কোথাও নেই! আলো এক কোণে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। এই মাত্রই দুষ্টুটা ওয়াশরুমে ঢুকল। এইটুকুন সময়ের মধ্যে কোথায় গেল? ওর সঙ্গে খারাপ কিছু হলো না তো? আবার কোনো বিপদে পড়ল না তো? এসব ভেবে আলোর হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। মেঘকে সেভাবে কেউ খেয়াল করে নি, তাই ওর কথা কেউ
বলতে পারছে না। ওয়াশরুম, গাড়ি, এবং পুরো রেস্তোরাঁর কোথাও সে নেই। রোদ দ্রুত পায়ে রেস্তোরাঁর বাইরে এসে ঘার ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকাচ্ছে। সামনের রাস্তায় শাঁ শাঁ শব্দ করে দ্রুত বেগে গাড়ি চলছে। এবার চিন্তায় রোদের মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। আলো চোখ মুছে দৌড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ ওর চোখ গেল অদূরে একটা ভাঙ্গা গাড়ির নিচে। মেঘ গাড়ির নিচে বসে একটা বিড়াল ছানাকে আদর করছে। আর মুখ নাড়িয়ে কীসব বলছে। আলো রোদকে ডেকে আঙ্গুল দিয়ে সেদিকে তাকাতে ইশারা করল। রোদ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে গিয়ে দেখে মেঘের সারা শরীরে মাটি লেগে আছে। আর ওর হাতে সাদা রঙ্গের আদুরে একটা বিড়াল ছানা। রোদ দ্রুত দুই পা পিছিয়ে নাকে রুমাল চেপে ধরল। ততক্ষণে একের পর এক হাচ্চু! হাচ্চু! আর হা হাচ্চু!বিড়ালের পশমে রোদের ব্যাপক এলার্জি। সে শত চেষ্টা করেও হাঁচি থামাতে পারে না। তাই বিড়ালের থেকে নিজেকে যথেষ্ট দূরে রাখে। রোদকে এভাবে হাঁচি দিতে দেখে মেঘ ভয়ার্ত চোখে তাকাল। ওর তো মনেই ছিল না দাভাইয়ের সমস্যার কথা। সে করুণ দৃষ্টিতে একবার বিড়াল ছানার দিকে তো একবার আলোর দিকে তাকাচ্ছে। অর্থাৎ আমাকে বাঁচাও বউমনি। আলো কিছু একটা বলার আগে রোদ প্রচন্ড রেগে হুংকার দিয়ে বলল,
“এটা তাড়াতাড়ি সরাও মেঘ। আমি খুব রেগে যাচ্ছি, হাচ্চু!”
“না, আমি একে সঙ্গে নিয়ে যাব দাভাই।”
“কখনো না।”
কথাটা বলে রোদ দুই পা এগোতেই মেঘ দৌড়ে গিয়ে আলোর পেছনে লুকালো। আলো পড়েছে মহাবিপদে! এখানে সে বা কী বলবে! এরা কেউই তো কম না। দুই ভাইয়ের কথার যুদ্ধ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। রোদ আগের যুগের নতুন বরদের মতো নাকে রুমাল চেপে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এক পা এগোতেই মেঘ ওর দিকে বিড়ালছানা ছুঁড়ে মারার অভিনয় করছে। রোদ তখন থেমে যাচ্ছে। পরপর হাঁচি দিতে দিতে ওর বেহাল দশা। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে।
রোদের করুণ অবস্থা দেখে আলোও মেঘকে নিষেধ করছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! বিড়ালটা ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। এটা সে নিবেই নিবে। মেঘ আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বিড়াল নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পড়ল। তারপর ওর পরনের নতুন শার্ট দিয়ে বিড়ালটাকে ঢেকে রাখল। যাতে রোদ এসে খাবলা দিয়ে না ফেলে দিতে পারে। ওইদিকে ড্রাইভারও তাড়া দিচ্ছে যাওয়ার জন্য। আলো আড়চোখে একবার রোদকে দেখে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ল। রোদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মুখে রুমাল বেঁধে সেও গেল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল তার আপন গতিতে। আলো হাত ধুয়ে মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর মেঘ মাংসের হাড় নিয়ে বিড়ালকে খাওয়াচ্ছে। ছানাটাও বেশ সুন্দর কুটকুট করে হাড় চিবুচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে মেঘের তো খুশির অন্ত নেই। আর রোদ সামনের সিটে বসে মুখে হাত দিয়ে হাঁচি দিচ্ছে। সে শুধু পারছে না মেঘসহ ওই বিড়ালটাকে তুলে আছাড় দিতে। রাস্তায় থেকে কুকুরছানা, বিড়ালছানা, ভেড়ার বাচ্চা তুলে আনা মেঘের একটা বদ অভ্যাস।গতমাসে
ভেড়ার বাচ্চা নেওয়ার জন্য সে কী কান্না। রোদ কোনোমতে ওকে বুঝিয়ে শান্ত করেছিল। একবার প্রতিবেশীর খরগোশ এনে বাসায় লুকিয়ে রেখেছিল। পরে এই নিয়ে কম অশান্তি হয় নি। সে নাকি খরগোশটা প্রথমে কিনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই প্রতিবেশি ওকে দেয় নি, বরং খুব বকেছিল। কেন দিবে না? আর দিবে না তো বকবে কেন? এসব ভেবে মেঘ উনাকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। ওর জন্য একটার পর একটা অশান্তি লেগেই থাকে। তবুও রোদ ভুলেও ওকে বকতে পারে না আর মারা তো দূর। এখন যেমন সে চাইলেই বিড়াল ছানাটাকে ওখানেই ফেলে আসতে পারত। এতে মেঘ খুব কষ্ট পেতো! হয়তো কান্নাও করত। তার কষ্ট হচ্ছে হোক না,তবুও ভাইটা ভালো থাক।
আলো মেঘকে খাইয়ে এক লোকমা মুখে পুরে আড়চোখে রোদের দিকে তাকাল। মানুষটাকে সে খেতে দেখে নি। উনি কী খাবে না? এত বেলা হলো কখন খাবে? নাকি খেয়েছে? ওকে তাকাতে মেঘ বিড়ালের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“বউমনি, আমার দাভাই দেখতে অনেক সুন্দর। চুপিচুপি না সুন্দর ভাবে দেখো।”
মেঘের একটা শুনে রোদ একটা হাঁচি দিয়ে আলোর দিকে তাকাল। আলো ততক্ষণে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়েছে। ইস! মানুষটা ওকে কী ভাবল? এই মেঘটাও না।রোদ আলোর থেকে চোখ সরিয়ে পুনরায় ঘুরে বসল। মেঘ আলোকে লজ্জা পেতে দেখে মিটিমিটি হাসছে আর মনের সুখে কোকাকোলা খাচ্ছে। তখন রোদের সেলফোনটা বিকট শব্দ করে বেজে উঠল। রোদ কলটা রিসিভ করে হুম, হ্যাঁ, না তে উত্তর করতে করতে প্রচন্ড রেগে কথা বলতে লাগল। রাগে শুধু পারছেনা অপর পাশের ব্যাক্তিটাকে গিলে খেতে। আলো আর মেঘ ওর রাগী কন্ঠ শুনে নিজেদের আরো গুটিয়ে নিলো। কেউ আর কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। মেঘ ভয় পেলেও ওর খাওয়া থামে নি, সে ইঁদুরের মতো কুটকুট করে চিপ্স খাচ্ছে। বিড়াল ছানাটাও ভয়ে একটু পিছিয়ে জড়সড়ো হয়ে বসল। আলো ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ সর্বশেষ কথাটা বলল,
“দশ লাখ তো দূর, আমি ফিরে দশ টাকার হিসাবে গড়মিল পেলে ওর খবর আছে!”
কথাটা বলে রোদ কল কেটে পানি খেয়ে সিটে হেলান দিলো। এইটুকু সময় রুমাল সরিয়ে কথা বলাতে ওর হাঁচি শুরু হয়ে গেছে। সে পুনরায় মুখে রুমাল মুখে বেঁধে চোখ বন্ধ করে নিলো। মেঘ তখন আলোর কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“এটা নতুন কিছু না। অনেক কিছু বাকি আছে, আগে বাসায় তো চলো।”
মেঘের কথা শুনে আলো কিছু ভয়ে পেয়ে মনে মনে বলল,”এ তো দেখি আরেকটা মাতবর। আল্লাহ! আল্লাহ গো, আমাকে রহম করো গো মাবুদ। ”
ওদের ফিসফিসানি কথা শুনে রোদ চোখ বন্ধ করে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“আচ্ছা, তোমার বাবা -মাকে তো দেখলাম না।”
” আমার রক্তের সম্পর্কের আর কেউ বেঁচে নেই।”
আলোর কথা শুনে রোদ তাৎক্ষণিক কথা কাটাতে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অনেক ঘুরাঘুরি হলো। বাসায় গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া শুরু করবে। তা না হলে কী হবে, আশা করি আমাকে আর বলতে হবেনা।”
”আরে না। এবার এত এত পড়ব যে একদিনেই ডাক্তার হয়ে যাবো।”
“দেখা যাবে।”
আলো ওদের দুই ভাইয়ের কথা শুনে মুচকি হাসল। এভাবে গল্প করে, ঘুমিয়ে, অনেক রাতে ওরা চট্টগ্রামে এসে পৌঁছাল। ওই রাস্তায় বাস ট্রাকের মারাত্মক এক্সিডেন্টে শতশত গাড়ি জ্যামে আটকে গিয়েছিল। সেই জ্যাম ছুটতেই এত দেরী। ওরা আজও ঢাকাতে পৌঁছাতে পারল না। অনেক চেষ্টা করেও তো সম্ভব হলো না। এতক্ষণ একনাগাড়ে বসে থাকতে থাকতে আলো মেঘ খুবই ক্লান্ত। আর আলো এর আগে কখনো এত লম্বা জার্নি করে নি। তাই কষ্টটা একটু বেশি হচ্ছে। ওদের নিয়ে আপাতত টানাটানি না করে উত্তম। একথা ভেবে রোদ একটা আবাসিক হোটেলের দুইটা রুম বুক করল। হোটেলটা বেশ উন্নতমানের। ড্রাইভার ততক্ষণে উনার প্রাপ্য মজুরি নিয়ে বিদায় নিয়েছেন। হয়তো আরেকটা ট্রিপ নিয়ে আজ রাতেই রাঙামাটি ফিরে যাবেন। রোদ একেবারে ওদের রাতের খাবার অর্ডার করে রুমে প্রবেশ করল। আলো দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ঝাপসা চোখে সোফায় গিয়ে বসল। ওর প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে। মেঘ অনেকক্ষণ আগে রোদের বুকে ঘুমিয়ে গেছে। রোদ ওকে শুইয়ে দিয়ে আলোকে জিজ্ঞাসা করল,
“শরীর বেশি খারাপ করছে?”
আলো জবাবে মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। রোদ ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে, অনেক জ্বর। জ্বরের জন্য পুরো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠিক করে দাঁড়াতেও পারছে না। রোদ এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এই মেয়ে এই তোমার জ্বর আসল কখন? আমাকে বলো নি কেন?”
আলোর থেকে উত্তর না পেয়ে রোদের মন চাচ্ছে থাপড়ে গাল লাল করে দিতে। এত জ্বর নিয়ে চুপ করে আছে, ফাজিল একটা। রোদ আলোকে দাঁড় করিয়ে ফ্রেশ হতে একেবারে ওয়াশরুমে রেখে আসল। কয়েকদিন ধরেই ওর খুব ধকল যাচ্ছে, শরীরে আর কুলাচ্ছে না। মূলত এজন্যই জ্বর এসেছে। রোদ ঘুমের ঘোরেই মেঘকে খাইয়ে আলোকেও খাওয়ালো। তারপর ট্রলি থেকে জ্বর আর মাথা ব্যথার ঔষধ এনে খাইয়ে আলোকে ঘুমাতে বলল। আলোও ভদ্র মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করল। জ্বরটা আরো বাড়ছে। মাথা ব্যথায় ঘুমও আসছে না।
সে চোখ বন্ধ করে আছে ঠিকই। কিন্ত চোখের কোণা বেয়ে অঝরে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে গেলে বেশ হতো।
রোদ ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে এসে দেখে আলো নিরবে কাঁদছে। আলোর ঘুমের সমস্যা হবে বলেই সে পাশের রুমে গিয়েছিল। রোদ আলতো করে আলোর মাথায় হাত রেখে বলল,
“মাথাব্যথা কমে নি?”
“উহুম!”
রোদ আলোর পাশে বসে আস্তে আস্তে ওর কপাল ম্যাসাজ করতে লাগল। একটু আরাম পেয়ে আলোর চোখ দু’টো ঘুমে বন্ধ হয়ে আসল। ক্লান্ত শরীরে ঘুমটা যেন ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। তারপর রোদ ওঠে পানিতে রুমাল ভিজিয়ে আলোর কপালে রাখল। জ্বরের উত্তাপে রুমালটা সাথে সাথে গরম হয়ে যাচ্ছে। প্রানবন্ত মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে পাংশুটে
হয়ে গেছে। রোদ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,
“রেখে আসলে যে কী হতো, আল্লাহ মালুম! যে মুখচোরা একটা মেয়ে।”
রোদ হঠাৎ খেয়াল করল আলো বিরবির করে কিছু একটা বলছে। রোদ কান পেতে ওর অস্পষ্ট কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল। এবং সারমর্ম বুঝল কেউ জোরে ধমকালে ওর জ্বর আসে। রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীরে বসে অনেক রাত অবধি জলপট্টি দিতে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পর আলোর জ্বরটা ধীরে ধীরে কমতে লাগল। তখন রোদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওখানে বসেই ঘুমিয়ে গেল। ওর শরীরটাও খুব ক্লান্ত। গত কয়েকদিন ধরে ওর উপর দিয়েও কম ধকল যাচ্ছে না। তার উপরে এত লং জার্নি! পরেরদিন খুব সকালে কিছুটা সুস্থবোধ করেই আলোর ঘুম ভেঙ্গেছে। ওর শরীরে এখন জ্বর নেই। ততক্ষণে মেঘ উঠে লাফালাফি শুরু করেছে। বিড়াল আর পাখির গভীর শোকে সে বসে ডোরা কেক খাচ্ছে। তার মুখটা বন্ধ নেই! ওদের অনবরত বকবকানি শুনে অগত্যা রোদকেও উঠতে হলো। তাছাড়া তো উপায় নেই। তারপর তিনজনে নাস্তা সেরে সব গুছিয়ে ঝটপট রেডি হয়ে নিলো। এবং যথাসময়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছাল। বিড়াল ছানাটাকে মেঘ কালকে রাস্তাতেই ছেড়ে দিয়েছে। রোদের কষ্ট হচ্ছে দেখে। সে দাভাইয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। প্রথমে ভেবেছিল একটুপরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি বরং রোদের হাঁচিটা আরো বেড়ে গিয়েছিল। তাই মেঘও আর জেদ করে নি। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পর ওরা ঢাকায় পৌছাল। তারপর নিজেদের গাড়ি করেই বাসার পথে রওনা দিলো।
আর আলো পদার্পণ করল নতুন এক শহরে অচেনা মানুষের ভিড়ে। শুধুমাত্র কারো ভরসার হাতকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার আকাঙ্খায়। ওর রঙ্গিন স্বপ্নগুলোকে ডানা মেলে উড়তে দেখার প্রবল বাসনায়। হয়তো এখান থেকে শুরু তার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। আর নয়তো এখানেই শেষ তার জীবনের নব্য গল্প।
To be continue….!!