এলোকেশী কন্যা’- [১৯]

0
599

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

হাসি-কান্না আর সুখ-দুঃখের সমীকরণে আমাদের ছোট্ট
জীবন। কখন কোথায় গিয়ে জীবন থমকে যায়, কেউ বলতে পারে না। এটাও বাস্তবিক দিক! আর ভাগ্যের খেলা, এটার রীতিনীতি কোনো নিয়মকানুন বলে কিছু নেই৷ অদৃশ্যভাবে এটা চলতেই থাকে। না কেউ দেখতে পারে আর না কেউ আটকাতে পারে। তবুও মানবজাতি ভাগ্যেবিশ্বাসী! সেই ভাগ্যের পরিণতি হোক প্রাপ্তির বা অপ্রাপ্তির।
যেমন ভাগ্যে না থাকলে আলোর আজ সব হারিয়ে এখানে আসত না। আপনজনকে হারিয়ে অচেনা কাউকে ভরসা করত না। সেও তো এমনটা চাইনি। তবুও তো হলো! ওর এই ভাগ্য ওকে এখানে এনেছে। এসব ভেবে আলো নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিলো। ঘুমন্ত মেঘ কোলবালিশ জড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাটা সত্যি খুব মায়াবী। খুব অল্প সময়ে আলোর মনে জায়গা করে নিয়েছে। মেঘের প্রতি আলোরও গভীর একটা টান অনুভব হয়। মনে হয় ওর খুব, খুব আপন কেউ!
রিসোর্টে মেঘের বলা কথাগুলো আলোর কানে এখনো বাজে৷ এইটুকুন বাচ্চা অথচ কতটা বুঝদার! এই বয়সেই বাবা মাকে হারিয়ে কত কষ্ট বুকে চেপে রাখে। দাভাই কষ্ট পাবে দেখে বলেও না। অকারণে বাবা মায়ের জন্য জেদও করে না। আর
ওই মানুষটার কলিজা তো এই দুষ্টুটা। উনিও মনে হয় মেঘের জন্য বাঁচার শক্তিটুকু অর্জন করেছেন। পাহাড়ে মেঘেকে না পেয়ে রোদের করুণ অবস্থা সে স্বচক্ষে দেখেছে। রোদের সেই ব্যাকুলতা দেখে ওরও মন কেঁদে উঠেছিল। ওদের ভালোবাসা দেখে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। আলো আনমনে এসব ভেবে মেঘের কপালে একটা আদর দিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলো।
এই ঘুমটা ওর বড্ড দরকার! নাহলে কতশত চিন্তারা এসে ওকে একদন্ডও শান্তি দিবে না।
রোদ অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারের থেকে সব সমস্যার কথা শুনল। দশ লাখ টাকার হিসাবে গড়মিল দেখা দিয়েছে৷ এত
টাকার হিসাব কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। অথচ রোদও এই টাকা তোলে নি। তাহলে? রোদ একে একে ফাইল চেক করে আকাশকে ডেকে পাঠাল। সেই টাকার ব্যাপারটা দেখাশোনা করে। আকাশ জানাল, সে দুই ঘন্টা পর সব হিসাব মিলিয়ে আসছে। রোদ ম্যানেজারকে যেতে বলে গত কয়েকদিন কিছু কাজের ফাইলগুলো দেখতে লাগল।
রোহান সিটি বাজাতে বাজাতে রোদের বাসায় প্রবেশ করল।
ড্রয়িংরুমে কেউ নেই! রোহানকে দেখে একজন সার্ভেন্ট এসে কুশল বিনিময় করল। রোহান হাসি মুখে উত্তর দিয়ে মেঘের খোঁজে রুমের দিকে পা বাড়াল। এবং বলল সে আজ দুপুরে এখানে খাবে। মেঘকে চমকে দেওয়ার জন্য রোহান শব্দহীন পায়ে মেঘের রুমে প্রবেশ করল। মেঘ নেই! কোথায় গেল?
মেঘ রোদের রুমে ভেবে সে যাওয়ার সময় মাঝখানের রুমে উঁকি দিলো। সে মূলত ফ্যানের শব্দ পেয়ে উঁকি দিয়েছে। এই বাসায় মেয়ে! কেমনে সম্ভব? তাও আবার মেঘকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। মেঘ তো সহজে যার তার কাছে যায় না, তাহলে কে এই যুবতি? রোহান বেশ অবাক হলো। মেয়েটা পাশ ফিরে
ঘুমানোর জন্য রোহান তার মুখটা দেখতেও পেলো না। চুলের জন্য মুখটা আড়াল হয়ে আছে৷ সে আর দেখার চেষ্টা করল না। মেঘকে ঘুমাতে দেখে রোহান ড্রয়িংরুমে বসে সার্ভেন্টকে ডেকে বলল,
“রোদ কই? ওই মেয়েটা কে?”
“মেহবুব স্যার অফিসে গেছে। আর মেয়েটাকে আমি চিনিনা। তবে স্যার বলেছে, মেয়েটা এখন থেকে এখানে থাকবে। ওই মেয়েটার নাম ‘আলো’।”
সার্ভেন্ট এতটুকু বলে রোহানকে কফি দিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
রোহান কফির মগে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
” তা এই কন্যা দিনের আলো নাকি সূর্যের আলো? ব্যাপারটা খুঁচিয়ে দেখতে হচ্ছে তো।”
তখন একটা মেয়ে হাই হিলের কটকট শব্দ তুলে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসল। রোহান মেয়েটিকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই এখানে কেন?”
রিমি নামের মেয়েটা উত্তর দিলো,” রোদ আসতে বলল। কেন আসতে পারি না?”
“একদম কথা প্যাঁচাবি না ডাইনি।”
ওদের কথার মাঝে আকাশ এসে সোফায় বসে শরীর এলিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে সে প্রচন্ড ক্লান্ত! রিমি মৃদু হেসে আকাশের চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিলো। রিমির কাজই ওর চুল এলোমেলো করে দেওয়া। নাহলে মেয়েটা মনে হয় শান্তি পায় না। যে করেই হোক আকাশে চুল এলোমেলো করবেই।
রোহান চুপ করে একমনে ফোনে চ্যাট করছে। সে ভালোমতো
জানে এরপরের কাহিনী কী হবে? আকাশ প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে রিমির স্পর্শ অনুভব করছে। হঠাৎ স্বজোরে চুলে টান পড়াতে আকাশ ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। রিমিকে দাঁত বের করে হাসতে দেখে আকাশও রিমির চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো। ব্যস, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। এটা রোহানদের মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই সে বিরক্ত হয়ে ফোন স্কলে মনোযোগ দিলো। রিমি আকাশের চুল ছেড়ে তেড়ে গিয়ে রোহানের চুল ধরল। সে কোনো বিরক্ত হবে? রোহান গালি দিয়ে রিমিকে চুল ছাড়তে বলছে, কিন্তু কে শুনে কার কথা! রিমির এক হাতের মুঠোয় রোহানের চুল আর অন্য হাতে আকাশের। ওরা সমানে চিৎকার করছে। তিনজনের চিৎকারে আলোদের ঘুম ভেঙ্গে দু’জনেই দৌড়ে সিঁড়ির কাছে আসল। একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে দু’জনে ওদের মারামারি দেখছে।রোদ বাসায় ফিরে ওদের মারামারি দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“এসেই শুরু করে দিয়েছিস? আকাশ ফাইল এনেছিস?”
“হুম।”
আকাশ চুল ঠিক করে ফাইলটা রোদের দিকে এগিয়ে দিলো। এবার হিসাব বরাবর! কালকে গিয়ে রোদ নিজে এর সমাধান করবে। এসব বিষয়ে আলোচনা করে রোদ রিমিকে বলল,
“ফ্রি আছিস কখন? কিছু কেনাকাটার দরকার ছিল।”
”তুই! আমার সঙ্গে? তাও শপিং!”
রিমির রিয়েকশক দেখে আকাশ আর রোহান শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর রোদের পরবর্তী কথাটা শুনে তিনজনেই চোখ বড় বড় তাকাল। কারণ রোদ বলেছে, লেডিস জিনিসপত্র কিনতে ওর সাহায্য করতে। এসব বিষয়ে সে আনাড়ি! তখন মেঘ দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নেমে ওদের কাছে গেল। দুষ্টু মেঘকে পেয়ে ওরা কাতুকুতু দিতে লাগল। মেঘের তো হাসি থামে না। সেও উচ্চশব্দে হেসে ওদেরও কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করছে। আলো চুপ করে এসব দেখে রুমের দিকে পা বাড়াল। ওখানে যাওয়াটা ঠিক হবে কী না সে বুঝতে পারছে না। যদি রোদ বিরক্ত হয়? অথবা ওই মেহমানরা যদি ওকে পছন্দ না করে? মূলত এসব ভেবেই সে রুমে যাচ্ছিল। হঠাৎ রোদ আলোকে যেতে দেখে ডেকে নিচে আসতে বলল। ততক্ষণে সবার নজর আলোর উপর। আলো মৃদু পায়ে ওদের সামনে গিয়ে সালাম দিলো। রোহানরা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সালামের উত্তর নিলো। ওদের এভাবে তাকাতে দেখে আলো একরাশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আলোকে পাশে রিমিকে দেখিয়ে বলল,
“বউমনি, এটা কটকটি(রিমি)। পাশের জন হচ্ছে (আকাশ) সোনাপতি বিটকেল আর ওইটা মিস্টার চিংগাম।”
এত সুন্দর মানুষগুলোর নাম শুনে আলো বেশ অবাক হলো। শহরের মানুষ এমন নাম হতেই পারে ভেবে সে চুপ থাকল। শহরের মানে বলে কথা! রোদ খেয়াল করল রোহান, রিমি, আর আকাশ ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু জানার প্রবল ইচ্ছায়। বিশেষ করে মেঘের মুখে বউমনি ডাক শুনে ওদের হার্ট এ্যার্টাক করার উপক্রম। রোদ ব্যাপারটা বুঝে আলোকে ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। আলোও
জানল এরা তিনজনে রোদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আকাশ রোদের অফিসে চাকরি করে। রোহান একজন সাংবাদিক আর রিমি ফ্যাশান ডিজাইনার। রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে অল্প কথায় ওর এখানে আসার কারণটা জানাল। সব শুনে ওরা কেউ আলোকে স্বান্ত্বণার বাণী দিলো না দেখে
আলোর ভালো লাগল। রিমি আলোর থুতনী ধরে মুচকি হেসে বলল,
“দোয়া রইল, তুমি অনেক বড় হও! আর হ্যাঁ, আমরা কিন্তু খুব কথা বলি, তাই মেপে গুনে কথা বলতে পারব না। এখন তুমি পরিবারের একজন। আর এই পরিবারটা আমাদের কাছে কী কয়েকদিনেই বুঝে যাবে।”
“জি।”
তখন মেঘ ভ্রু কঁচকে রিমির কথার প্রতিবাদ করে বলল,”এই কটকটি, আমার বউমনি আরো বড় হবে কেন? এখনই তো মেলা বড় আছে। তুমি দেখি কানাও আছো!”
মেঘের একথা শুনে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর আড্ডা শেষ করে সবাই দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসল। আলো মেঘকে খাইয়ে দিচ্ছে আর ওদের ঝগড়া দেখছে। এরা সবাই খুব মিশুক! ওদের কান্ড দেখে না হেসে পারছে না। ওর মনটা এখন বেশ ভালো হয়ে গেছে। বিষন্নতা দূর করতে বন্ধুদেরও প্রয়োজন আছে। সে আজ খুব করে অনুভব করছে। আকাশ আর রোহান রিমিকে কথার খোঁচা মেরে রাগিয়ে দিচ্ছে। মেঘ ওদের সঙ্গে তাল মিলাচ্ছে আর রিমি রাগে ফোসফাস করছে।
তবে রোদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সে পূর্বের মতোই প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না। দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে ওরা সন্ধ্যার পূর্বে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। রিমি রোদকে বলল কালকে শপিংয়ে যাবে। কালকে সকালে সে কিছু ফ্রি আছে।
তিনজনে হাসি মুখে আলোর থেকে বিদায় নিলো। আলোও তাদের আবার আসতে বলে সাবধানে যেতে বলল। তখন রোহান দাঁড়িয়ে গিয়ে মুচকি হেসে আলোকে বলল,
“তোমার একটা নাম দিলে তুমি রাগ করবা?”
আলো না বোধক মাথা নাড়াতে গিয়ে হঠাৎ করে রোদের দিকে চোখ পড়ল। এই মেয়ে আসলেই অদ্ভুত! কথা বললে মনে হয় ওর খুব কষ্ট হয়। যে যাই বলুক, নাড়া সে নাড়াবেই।
রোদকে তাকাতে দেখে আলো মাথা নাড়ানো থামিয়ে মুখে উত্তর দিলো,”জি না।”
রোহান আলোর উত্তর শুনে বলল,
“আজকে থেকে তোমাকে আমি ‘পাহাড়ি ফুল’ বলে ডাকব।”
“আচ্ছা।”
“পছন্দ হয়েছে?”
“জি।”

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here