এলোকেশী কন্যা’- [২১]

0
566

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

”আফা ওই মাইয়াডা কেডা? ছ্যার কী বিয়া করছে নি?”

সাবিনা খালার কথা শুনে সার্ভেন্ট রাকা ড্রয়িংরুমে তাকাল। আলো মেঘের সঙ্গে বসে গল্প করছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলাপ চলছে। কেউ শুনলে যেন মহাপ্রলয় ঘটবে। রাকা দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে সবিনা খালার দিকে তাকাল। সাবিনা খালা এই বাসায় ঝাড়-মোছের কাজ করেন। সেই সাথে গোয়েন্দাগিরি করাও উনার স্বভাব। এটা না করলে উনি একদন্ডও শান্তি পান না। মনে হয় পেটের মধ্যে কথার জ্যাম বেঁধে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভোগেন। আর কোষ্ঠকাঠিন্য খুব ছ্যাচড়া একটা রোগ। এই রোগ থেকে মুক্তি পেতেই উনি এই পথ বেছে নিয়েছেন। সময় -সূচী এবং কোনো নিদির্ষ্ট ব্যাক্তি নেই। যখন তখন যার তার উপরে গোয়েন্দাগিরি করা উনার স্বভাব। সেটা কারণে বা অকারণে! রাকার থেকে উত্তর না পেয়ে উনি আবারও একই কথা বললেন। রাকা হাতের প্লেটটা রেখে নিচু স্বরে বলল,
“জানিনা, তবে মেহবুব স্যার বলেছে এখানেই থাকবে।”
“মাইয়া কী ছ্যারের ঘরেই থাকছে নি আফা?”
“জানি না।”
কথাটা বলে রাকা বিরক্ত হয়ে কাজের বাহানা দেখিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। ওর এসব ভালো লাগে না। সে শান্তি প্রিয় মানুষ! কুটকাচালি, ফুসফাস, থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। তাছাড়া রোদ এসব দেখলে চাকরির মায়া ত্যাগ করতে হবে। আর সে এত ভালো চাকরি হারাতে ইচ্ছুক নয়। রাকাসহ বাসা সার্ভেন্টে মোট পাঁচজন। তিনজন মেয়ে আর দুইজন ছেলে। রাকা, সাবা, মিনা, রবি, আর সাগর। এরা সবাই ভিন্ন কাজে নিযুক্ত আছে। মিনা আর সাবা কয়েকদিনের ছুটিতে আছে। তাছাড়া ঝাড়-মোছ, মালি, ড্রাইভার, দারোয়ান এরা আলাদা। রোদের বাবা মা নেই! রোদ সারাদিন অফিসে থাকায় বাসায় সময় দিতে পারে না। তাই বাসার সব কাজ সে মানুষ দিয়েই করায়। তবে রোদের কড়া নিষেধ আছে কুটকাচালি থেকে বিরত থাকার। এসব ওর অপছন্দ! এসব ওর চোখে পড়লে সেই মুহূর্তেই চাকরি শেষ। সাবিনা খালা তবুও থামার মানুষ না। যেদিন রোদের চোখে পড়বে সেদিন বুঝবে। রাকার থেকে
সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে সাবিনা খালা আলোর উপর কড়া নজর রাখল। আলো রোদের কে? উনার জানা চাই-ই চাই। কেন জানবে না? এতদিন এই বাড়িতে কাজ করছে এটা জানা উনার অধিকার।
সকালে নাস্তা সেরে আলোকে সাবধানে থাকতে বলে দুই ভাই বেরিয়ে গেল।মেঘকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে রোদ অফিসে যাবে। আজ বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল। মেঘ তাড়াতাড়িই চলে আসবে। আলো ওদের যেতে দেখে মন ভার করে ওর রুমে চলে গেল। একা একা সময় কাটাতে কিছু একটা করা দরকার। তাই সে ভাবল পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবে। এখানেই যেহেতু থাকবে, সব চিনে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মূখ্য কথা সময়টা কাটলেই হলো। মেঘ চলে আসলেই ওর আর কিছু লাগবে না। এসব ভেবে আলো রুম থেকে বের হতেই একজন মহিলা ওর পথ আটকে পান খেয়ে লাল করা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“মা জননী আপনে যেন কেডা? আপনেরে তো ঠিক চিনলাম না।”
হঠাৎ উনার আগমনে আলো ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে গেল।
এই মহিলা ওর দরজার পাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে খেয়াল করে নি। আলো বুকে থুথু দিয়ে জোরপূর্বক হাসল।আর উনার কথার জবাব কী বলা উচিত আলো ভেবে পেলো না। হঠাৎ ওর মেঘের কথা মনে পড়ায় কিছু ভেবে মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো,
“আমি মেঘের বউমনি।”
সাবিনা খালা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ওর পথ থেকে সরে দাঁড়াল। তারমানে রোদের বউ! রোদ বিয়ে করেছে অথচ উনি জানেনই না। এজন্যই বড়লোকের বাড়িতে কাজ করতে নেই। এরা নিমুকহারাম হয়! বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এলো, তবুও একটা কথা বলল না। গরীব তাই হয়তো। এসবে ভেবে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খালার দুই হাতে বালতি আর ঝাড়ু দেখে আলো বুঝল, উনি রুম পরিষ্কার করতে এসেছেন। তাই উনার কাছে বাঁধা না দিয়ে আলো স্থান ত্যাগ করল। সাবিনা খালা বিরবির করতে করতে নিজের কাজে মন দিলেন।

একটুপরে, রিমি হাত ভর্তি শপিংব্যাগ নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলো। রিমিকে দেখে আলোর মুখে হাসি ফুটল। একা একা রুমবন্দি হয়ে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। পাহাড়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো ওর অভ্যাস। আর এখানে এসে ইট পাথরের তৈরী বিল্ডিংয়ে বন্দি হয়ে নিঃশ্বাসটা যেন আটকে আসছিল। রিমি সার্ভেন্টকে পানি দিতে বলে সোফায় বসল। আলো মিষ্টি হেসে রিমির কুশল বিনিময় করল। রিমিও মুচকি হেসে উত্তর দিয়ে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে আলোকে নিয়ে রুমের দিকে গেল। সাবিনা খালা আলোর রুম পরিষ্কার করছে অগত্যা ওদের রোদের রুমে যেতে হলো।
রিমি বেডে বসে হাত ভর্তি শপিংব্যাগের জিনিসপত্র বের করে আলোর সামনে রাখল। পুরো বেড জিনিসপত্রে ভরে গেছে। আলো সেদিকে একবার তাকিয়ে মুখ তুলে রিমির দিকে তাকাল। রিমি আলোর দৃষ্টির মানে বুঝে পা তুলে বসে হেসে বলল,
“রোদের হুকুম, একটা মেয়ের প্রয়োজনীয় যা যা দরকার সব নিয়ে আসতে। শুধু মেকাবের জিনিস ছাড়া। তো মহারাজের হুকুম পেয়ে আমিও এসব নিয়ে হাজির হলাম। সে এ ব্যাপারে আনাড়ি।”
আলো এতকিছু দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। সে তো এসব কিছু চায়নি, তাহলে? অকারণে রোদ এতগুলো টাকা নষ্ট করল। আলোর মলিন মুখ দেখে রিমি টপস, স্কার্ট, কুর্তি, লং কামিজ, ফেসওয়াশ, হ্যান্ডব্যাগ, স্লিপারসহ আরো অনেক
কিছু বের করে আলোকে দেখাচ্ছে। এখানে হেয়ার ওয়েল
থেকে শুরু করে নেইল কাটার অবধি সব আছে। সব ব্র্যান্ডের জিনিস! কোনটা কী কাজে ব্যবহার হয় রিমি সেটাও বলল। আলো মলিন হেসে ছলছল চোখে হুম, হ্যাঁ, করছে দেখে রিমি ওর হাত ধরে বলল,
“আলো, কয়েকটা কথা বলি মন দিয়ে শোনো। তুমি যা ভাবছ আসলে তা নয়। রোদ তোমাকে অপমান করার জন্য এসব আনতে বলে নি। এর পেছনেও যথেষ্ট একটা কারণ আছে।
রোদ শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং চতুর একটা ছেলে। সে কথায় নয়, বরং কাজে ওর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। রোদ সব জেনে বুঝে আমাকে এসব আনতে বলেছে। কেন জানে? এর কারণ মেয়েলি কিছু জিনিসের কথা হুট করে কাউকে বলা যায় না, বিশেষ করে কোনো ছেলেকে। একটা মেয়ের মাসে কত কী প্রয়োজন হয় সেটা কেবল আমরাই জানি, তাই না? আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পারছ?”
আলো মাথা নিচু করেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। রিমি ওর মুখটা তুলে চোখে পানি মুছিয়ে বলল,
“সেটাই, খুব প্রয়োজন হলেও তুমি রোদকে বলতে পারতে না। তাছাড়া রোদ খুব কম সময় বাসায় থাকে। কখন কী লাগে বলা তো যায় না। এজন্যই রোদ আমাকে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে।যাতে তুমি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে না পড়ো। তাছাড়া যেহেতু এখানেই থাকবা তাই সবকিছুর প্রয়োজন আছে। আমি ভেবে চিন্তে সব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই এনেছি। যেগুলো প্রত্যহ দিনে আমাদের কাজে লাগে। আর আমার বন্ধুটা রাগী হলেও এতটাও খারাপ না আলো। সে আর যাই করুক,কারো দায়িত্ব পালনে ত্রুটি রাখে না।”
আলো ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে আবারও মাথা নাড়াল। সে এসব ঋণ কীভাবে শোধ করবে? রোদ ওকে কেন এত ঋণী বানাচ্ছে? সে কী জানে না, এই মেয়েটা আর ঋণের ভার সহ্য করতে পারছে না। ঋণের ভারে যে সে নুইয়ে পড়ছে। বিবেকে বাঁধছে। আলোকে স্বাভাবিক করতে রিমি টপস স্কার্টের সাথে ওড়না নেওয়ার কৌশলটাও দেখাল। সে ফ্যাশান ডিজাইনার বিধায় ফ্যাশান সম্পর্কে ধারণা দিতে বেশ পটু। ওর অভিজ্ঞতা ওকে পটু করেছে। আলো চুপ করে রিমির কাজ, কথাবার্তা,
অঙ্গভঙ্গি, সব খেয়াল করছে। রিমি দেখতে বেশ নজরকাড়া। ওর কথা বলার অার্ট’টা দারুণ। আলোর মতো কথা বলতে বলতে মাঝপথে ভুলে যায় না। অথবা থতমত খায় না। আলো দৃষ্টি সরিয়ে ড্রেসগুলো দেখে আমতা আমতা করে বলল,
“আপু, আমি এমন ড্রেস আগে পরি নি। তাই কেমন জানি লাগছে।”
“ওরে বোকা রে আগে পরো নি, এখন পরবা! আর এগুলো সব মার্জিত পোশাক। আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, ব্যাপার না।”
কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। অথচ ওরা খেয়ালই করে নি। গল্প করতে করতেই ওরা সব জিনিসগুলো গুছিয়ে নিলো। এদিকে মেঘ চিৎকার করতে করতে রুমের দিকেই আসছে। সে স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। আর এসেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। মেঘ দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“বউমনি ভয় টয় করো নি তো? আমি তো তোমার চিন্তায় মন দিয়ে ক্লাসও করতে পারি নি। ওমা, কটকটি কখন আসলা?
আমার জন্য কিছু আনো নি?”
রিমি ওর ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে মেঘকে দিলো। মেঘ সেটা নিয়ে দাঁত বের করে হাসল। তারপর তিনজনে বেরিয়ে সুইমিংপুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসল। ওদের দেখে সাবিনা খালা কাজ সেরে মুখ বাঁকিয়ে বিদায় নিলেন। ওইদিকে রোদ
সুজনকে ওর কেবিনে ডেকে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে। ওকে না বলে টাকা তোলার কারণ জানতে চাচ্ছে। সুজনকে শুধু ঘাম মুছছে আর আমতা আমতা করছে। এভাবে ধরা খাবে সেও কল্পনা করে নি। ওকে চুপ থাকতে দেখে রোদ দশ লাখ টাকা আর রেজিগনেশান লেটার কালই জমা দিতে বলল। না হলে ওর নামে কেস ফাইল করতে বাধ্য হবে। সুজন ছলছল চোখে হাত জোড় করে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। রোদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সুজন নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে বলল,
“প্রিয় মানুষটার ক কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই না বলে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি ভাইয়া। আসলে সূচির হার্ট অপারেশন করতে দশ লাখ টাকার খুব দরকার ছিল। তুমি তখন ঢাকার বাইরে ছিলে। অনেক চেষ্টা করেও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নি। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি।”
একথা শুনে রোদ উঠে স্বজোরে সুজনের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রাগে ওর পুরো শরীর কিড়মিড় করছে। অথচ ওকে দেখতে যথেষ্ট স্বাভাবিক লাগছে। হাবভাব এমন যেন এটা হওয়ারই ছিল। সুজন গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে থাপ্পড় খাবে সে মোটেও কল্পনা করে নি। রোদ ঠান্ডা মাথায় সুজনের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বেশ ধারালো কন্ঠে বলল,
“টাকা কী তোর বাবা দিয়ে যায়? নাকি বাতাসে উড়ে আসে? যে যখন তখন এসে টাকার নিয়ে যাস?”

কথাটা বলে রোদ সুজনের বুকে স্বজোরে ধাক্কা দিলো। সুজন চেয়ার ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, রোদ ওকে মেরেছে, কলার ধরেছে, ধাক্কাও দিয়েছে। সে এখনো অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে।

To be continue……………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here