এলোকেশী কন্যা’- [২৪]

0
550

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রায় দশদিন পর,

সন্ধ্যার পর রোদ অফিস থেকে ফিরে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসল। আলো কিংবা মেঘ আশেপাশে নেই! কিন্তু মেঘের রুম থেকে ফুল ভলিউমে গানের সাউন্ড ভেসে আসছে। পড়া বাদ দিয়ে ওরা গান শুনছে! রোদ উঠে দেখতে গেল মেঘের রুমে হচ্ছে টা কী? এদিকে আলো রোদের ব্ল্যাক টাওজারের সাথে ব্লু টি-শার্ট আর মেঘ আলোর লাল ওড়না’টা পেঁচিয়ে পরেছে।
কিছুটা শাড়ির মতো করে আর কি! সাথে কোমর দুলিয়ে ঢং করে হাঁটছে আবার নাচছেও! আজ সকালে রোদ বলেছিল, আজ ওর ফিরতে অনেক রাত হবে। অফিসের কোনো একটা কাজে বাইরে যাচ্ছে। রোদ নেই, তাই কোনো পড়াশোনা হবে না। শুধু মজা আর মজা!
আলো রোদের মতো করে হাঁটা, হাসা, রেগে কথা বলা, এসব অভিনয় করে মেঘকে দেখাচ্ছে। আর মেঘ অভিনয় দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। রোদ চুপ করে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। আলোকে এভাবে দেখবে সে মোটেও কল্পনা করে নি। কারণ ওর সামনে আলো যথেষ্ট ভদ্র হয়ে থাকে। এমন ভাব যেন, ওর মতো ভদ্র মেয়ে দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে না। ওকে দেখে বোঝাও যায় না, সে দুষ্টুও বটে। এদিকে নাচতে গিয়ে মেঘ বেচারার কুঁচি খুলে গেল। এই নিয়ে মোট তিনবার খুলল। আলো বুদ্ধিমতির মেয়ের মতো ওর কোমড়ে বেল্ট বেঁধে দিলো। যাতে আর না খুলে! তারপর দু’জনে মিলে আবার উরাধুরা নাচ শুরু করল। যদিও নাচের কোনো আগা গোড়া নেই। রোদ আঁড়ালে দাঁড়িয়েই ওদের নাচের ভিডিও করে নিলো। তারপর নিঃশব্দে মেঘের রুমের সোফায় গিয়ে বসল। তাতেও ওদের কোনো হেলদুল নেই। ওরা আছে ওদের ধ্যানে। ভাবটা এমন, পৃথিবী উচ্ছনে যাক তবুও এখন নাচ’টা আগে। হঠাৎ নাচতে নাচতে আলোর চোখ পড়ল সোফার দিকে। রোদ চুপ করে বসে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে
মূলত অপেক্ষা করছে কখন এদের লাফালাফির সমাপ্ত হয়।
আচানক রোদকে দেখে আলো চমকে উঠে ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওকে থামতে দেখে মেঘ নাচতে নাচতে সামনে তাকাল। রোদকে দেখে সেও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেমে গেল। তখনও গান বাজছে,’ ওহ সাকি, সাকি রে, সাকি! সাকি!’
রোদকে দেখে আলো টি-র্শাট টেনে টুনে মুখ কাঁচুমাচু করছে।
আর মেঘ রোদের দিকে একবার তো আলোর দিকে একবার তাকাচ্ছে। ওদের দু’জনকে থামতে দেখে রোদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাহ! তোমরা তো দারুণ নাচতে পারো। তোমাদের নাচের একটা স্কুল খুলে দিবো? আলো তোমাকে তো পুরোই রোদের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে, রোদের কার্বন কপি। রোদের মতো হাসা, হাঁটা, রেগে কথা বলা, পারফেক্ট! হুম, মানলাম তোমার সাহস আছে। সমস্যা নেই, তোমার সাহসের পরীক্ষা আমি খুব শীঘ্রই নিবো। মেঘ তোকে একদম মেয়ে লাগছে। রাস্তায় টাকা তুলে আর বলে না, টাকা দে! টাকা দে! তোকে কাল ওদের কাছে রেখে আসব। তোর যখন মেয়ে হওয়ার এতই শখ। কী
বলিস তুই?”
রোদের কথা শুনে আলো আর মেঘের করুণ অবস্থা। রোদের তো এখন আসার কথা না। তাহলে? আসবে না জেনেই তো একটু মজা করছিলো। কে জানত, জল্লাদ’টা চলে আসবে? ছিঃ! কী একটা অবস্থা। এসব ভেবে আলো আর মেঘ দু’জনে না দাঁড়িয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইস! কি লজ্জা, কি লজ্জা! যেতে যেতে দু’জনে পণ করল জীবনে আর এমন কিছু করবে না। ওদের এমন কান্ডে রোদ হাসতে লাগল। এতদিন বাসায় এই দুষ্টুমি গুলোই সে খুব মিস করত। বাসাটা আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। রোদ সর্বদা চায়, এই দু’টো পাখিই পুরো বাসা জুড়ে ডান ঝাপটে বেড়াক। তাদের হাসির শব্দে বাসার প্রতিটা দেওয়াল প্রতিধ্বনি হোক। মেঘ’টা আবার আগের মতো দুষ্টু হয়ে বাসাটা মাতিয়ে রাখুক। রোদের এই চাওয়াটা হয়তো পূর্ন হতে যাচ্ছে। একটুপর, রোদ ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে ওদের দু’জনকে পড়তে বসালো। দু’জনেই মাথা নিচু করে বিরবির করে পড়ছে। রোদ আলোর বইয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লাইন মার্ক করে মেঘকে বলল,
“মেঘ তোমার রেজাল্ট কার্ড দেখাও।”
একথা শুনে মেঘ রেজাল্ট কার্ড এনে রোদকে দিলো। রোদ দেখে বলল,
“তোমার বানানো রেজাল্ট কার্ড তোমার কাছেই রেখে দাও। যেটা স্কুল থেকে দিয়েছে, ওটা আমাকে দেখাও।”
মেঘ আজ রোদের কাছে ধরা পড়ে গেছে। সে শুধু পারছে না চিৎকার করে কাঁদতে। তাও কোনোরকমে নিজেকে সামলে আসল রেজাল্ট কার্ড এনে রোদের হাতে দিলো। আর দৌড়ে গিয়ে আলোর পিছনে লুকালো। মেঘ জানে, এখন ওর সাথে কী হবে? এজন্য আর কিছু না ভেবে ওর কানকে প্রস্তুত করে রাখল। ঠিক তখনই, রোদ মেঘের রেজাল্ট কার্ডে চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে বলল,
“এটা কী? তুই পাঁচটা সাবজেক্টে ফেল করছিস? তোকে হোম টিউটর কী শিক্ষায়?”
মেঘ উঁকি দিয়ে একবার রোদের দিকে তাকাল। রোদ রাগে গজগজ করছে! এজন্য মেঘ ভয় পেয়ে আবার মুখ লুকাল। রোদ উঠে মেঘকে ধরতে গেলে, মেঘ আলোকে নিয়েই ঘুরছে।
আলো পড়েছে দুই ভাইয়ের মাঝখানে। রোদ মেঘকে ধরতে গেলে মেঘ আলোকে রোদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। আলো না চাইলেও রোদের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে। আর এই ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। তাই সে মুখ কাঁচুমাচু করছে। মেঘের এই কাজে রোদ আরো রেগে চিৎকার করে বলল,
“তুই কী কোনোদিনও শুধরাবি না? একটাতে ফেল করলে মানা যায়, তাই বলে পাঁচটাতে ফেল করবি? পরীক্ষার খাতায় আদৌও কিছু লিখেছিলি ?
একথা শুনে আলো ভয়ে ভয়ে রোদের থেকে রেজাল্ট কার্ডটা নিলো। মেঘের রেজাল্ট দেখে আলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।

বাংলাতেঃ ১৮
ইংরেজীতেঃ ০৯
গণিতেঃ ০৭
বিজ্ঞানেঃ ২৩
সমাজেঃ ৩০
ইসলামশিক্ষায়ঃ ৪০
ড্রয়িংঃ ৬৯
শারীরিক শিক্ষাঃ৫৬

রোদ আলোকে সামনে থেকে সরিয়ে মেঘকে ওর সামনে এনে দাঁড় করাল। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে। রোদ ওর মুখ তুলে বলল,
“আট’টা সাবজেক্টের মধ্যে পাঁচটাতেই ফেল করছিস। তোর আর পড়াশোনার দরকার নেই! তোকে রিকশা কিনে দিবো, তুই কালকে থেকে রিকশা চালাবি।”
রোদের কথা শুনে মেঘ সুন্দর করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে রিকশা চালাবে। রোদ শুধুু পারছে না ওকে তুলে আছাড় দিতে। এত কষ্ট করে পড়িয়ে এমন রেজাল্ট করলে, কীভাবে হবে! রোদ মেঘের কান টেনে মেঘকে এক পা তুলে দাঁড়াতে বলল। আপাতত এখন এটাই ওর শাস্তি। মেঘ কান ছুটিয়ে আবারও আলোর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে কেঁদে দিলো।
মানুষ ফেল করে আবার মানুষই তো রিকশা চালায়। আর সে বললই রিকশা চালাবে, তাহলে দাভাই কেন বকবে? সে খুব কষ্ট পাচ্ছে দাভাই কী বুঝছে না? তারমানে দাভাই ওকে আর
ভালোবাসে না! রোদ কিছু বলার আগে আলো মেঘকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইস! এইটুকুন সময়ে বাচ্চা’টা কান্না করে মুখ লাল করে ফেলেছে। আলো ওর ওড়না দিয়ে মেঘের মুখটা মুছিয়ে একটু পানি খাওয়ালো। মেঘ ফুঁপাতে ফুঁপাতে আলোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আলো ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে আদরে সুরে থামতে বলছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘ বলল,
“বউমনি, দাভাই আমাকে শুধু বকা দেয়। আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”
আলো মেঘের অভিমানি কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,
“না মেঘবাবু, দাভাই তোমাকে আগের মতো খুব ভালোবাসে। তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বকেছে। দেখো, দাভাই কত্ত লেখাপড়া জানে। তোমাকেও তো দাভাইয়ের মতো হতে হবে।পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। যাতে সবাই বলে রোদের মতো মেঘও সবদিক থেকে বেস্ট।”
“হুম।”
তারপর এই নিয়ে দু’জনে আরো অনেক কথা বলতে থাকল। আলোর কথা ছলে মেঘকে রাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। নয়তো মেঘ মুখ ফুলিয়ে অভিমান নিয়ে বসে থাকত।আর এই বাচ্চাটার জীবনে সব থাকলেও, ছন্দছাড়া। রোদ যথেষ্ট চেষ্টা করেও মেঘের সব অভাব পূরণ করতে পারে নি৷ যদিও যেটা ওর প্রয়োজন সেটা পূরণ করা সম্ভবও না। যেমন, বাবা মা!
আলো ঘুমন্ত মেঘের কপালে আদর দিয়ে ভালো করে শুইয়ে দিলো। দুষ্টুটার বেশ রাগও আছে ভেবে আলো মুচকি হাসল। তারপর নিঃশব্দে রোদের রুমে গিয়ে দেখল, রোদ উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। আলো নক করে ওখানে দাঁড়িয়ে বলল,
“আসবো? বেশি সময় নিবো না।”
“এসো।”
রোদ আলোকে দেখে উঠে বসল। আলো কিছু বলতে চাচ্ছে, সেটা রোদও বুঝল। আলো কিছুক্ষণ চুপ থেকে রোদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেঘ এখনো ছোট। ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেই হতো, তাই না?”
একথা শুনে রোদ মৃদু হেসে হাতের গ্লাসটা রেখে শান্ত ভাবে উত্তর দিলো,
“আমি জানতাম, তুমি আমার রুমে এসে এসব নিয়ে কিছু বলবে! তাহলে শোনো, বাচ্চারা কাউকে ভয় না পেলে ভালো কথা কর্ণপাত করা তো দূর। নিজের ভুলগুলোও সংশোধন করতে চায় না। এর আগে মেঘকে আমি এভাবে বকা দেইনি। কারণ তখন ওকে বোঝানোর মতো কেউ ছিল না। এখন তুমি আছো! তুমি ওকে বুঝালে মেঘ ঠিক বুঝবে। মেঘ তো আমার প্রাণ! ওকে আমি কষ্ট দিতে পারি, তুমিই বলো? আমি শুধু ওকে ভয় দেখায়, যাতে দুষ্টুমিটা একটু কম করে।”

আলো রোদের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

” আপনার কথা বুঝলাম। তবে আপনিও একটা কথা শুনে রাখুন। ওকে ধমকানোটা আমার একটুও পছন্দ নয়। আপনি এমনটা আর করবে না। মেঘকে আমি যথাসাধ্য বোঝাব। এভাবে শাষণ করলে মেঘের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে।
সে ভাবতে পারে, বউমনি আসার পর দাভাই অনেক বদলে গেছে। আগে দাভাই ওকে বকতো না। কিন্তু এখন মারতেও আসে। মেঘ বাচ্চা, সে বুঝবে না আপনি ওর ভালোর জন্যই ওকে বকছেন। আশা করি, কথাগুলো আপনাকে সঠিকভাবে বুঝাতে পেরেছি, আসছি।”

রোদ চুপ করে আলোর কথাগুলো শুনল। তবে এর উত্তরে কিছু বলল না। কারণ আলোর যুক্তিও হেলা করার মতো না।
আলো একটু এগিয়ে থেমে পিছু ফিরে বলল,

“কথা বলতে আমিও পারি। এতদিন প্রয়োজন হয়নি তাই বলি নি। মেঘ আমাকে দু’টো আসনে বসিয়ে। একটা বউমনি আর অন্যটা মা। ওর দু’টো আবদারই আমি সাদরে গ্রহন করেছি।
সরাসরি ওর মা না হলেও বউমনির আড়ালে মা হয়েই ওকে সারাজীবন আগলে রাখব। তবুও আপনাকে কিছু বলতে দিবো না।”

রোদ ততক্ষণে আলোর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোর রাগান্বিত মুখটা দেখে রোদ মুচকি হেসে আলোর চোখে চোখ রেখে বলল,

“তোমার কথার সূত্র অনুযায়ী বউমনি হয়ে ওকে মায়ের মতো সারাজীবন আগলে রাখবে। বেশ, তা বউমনি হবে কীভাবে? আমার বউ হয়ে?”

একথা জবাব দেওয়ার ভাষা আলো এই মূহুর্তে খুঁজে পেলো না। ওর সাহসটাও নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সব শব্দগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। একরাশ অস্বস্তি এসে ওকে জাপটে ধরল। কথাগুলো গলাতে জমা হয়ে কুন্ডুলী পাঁকিয়ে ফেলল। সাহসী তাৎক্ষণিক আলো মাথা নিচু করে ঝকঝকে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। রোদ হঠাৎ এমন কিছু বলবে ওর ধারণাও বাইরে ছিল। আলোর অস্বস্তিতে ভরা মুখটা দেখে রোদ শান্ত কন্ঠে বলল,

“ভেবে জানিও। এখন রুমে যাও।”

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here