এলোকেশী কন্যা’- [২৮]

0
586

-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

“উফ! রাক্ষসীর মতো কামড়াচ্ছো কেন?”

কথাটা বলে রোদ আলোকে জোর করে দোলনায় বসিয়ে দিলো। আলো ওড়নাতে নাকের সর্দি মুছে এখনো ফুঁপাচ্ছে।
এই মানুষ ওকে খুব অত্যাচার করছে, খুব! আর রোদ দেখতে চাচ্ছিল, আলো রেগে গেলে কী করে? ওর রাগের পরিসীমা কতটুকু! প্রচন্ড লেগে সে কী করে? রোদ ভেবেছিল, আলো ওকে কঠিন কিছু কথা শুনাবে, অপমান করবে, দরকার হলে দু’চার থাপ্পড় দিবে। কিন্তু এই মেয়ে কিছু করল না, শুধু অশ্রু ঝরানো ছাড়া। হ্যাঁ আর একটা জিনিস করছে, ওড়নাতে নাক মুছে নাকটাকে লাল করে ফেলেছে। দেখতেও বেশ লাগছে!
এতটুকু সময়ে রোদ আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করল, রেগে গেলে আলো কথা বলতে পারে না। হয়তো রাগের চাপে ওর মস্তিষ্ক বাক্য গঠন করতে পারে না। এই সমস্যার মানুষ অহরহ আছে। আগের তুলনায় আলোর রাগ আর ফুঁপানো কমেছে। তখন ওর অবস্থা দেখে অবস্থা দেখে রোদ মুচকি হেসে গলা পরিষ্কার করে বলল,
”এত অভিমান কেন শুনি?”
“মান-অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, সব আপনাদের জন্যই? আমরা করতে পারব না? কেন হ্যাঁ, কেন? একবারও তো ভাবলেন না আমার কষ্ট হচ্ছে নাকি? আমি কেমন আছি? এসব করার মানে’টা আমি এখনো বুঝি নি। আগেই বলতেন আমাকে সহ্য হচ্ছে না।”
কথাগুলো বলে আলো হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। ওর ফর্সা মুখটা কান্নার ফলে লালবর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দু’টো ফুলে উঠেছে। নাকটার তো বেহাল দশা। গোলাপি ঠোঁট জোড়াও ফুঁপানোর সাথে সাথে কেঁপে উঠছে। বেহায়া বাতাসে সামনের চুলগুলোকে অবাধ্য করে তুলেছে। হালকা বেগুনি রংয়ের থ্রি পিছটা শরীরে ফুটে উঠেছে। রোদ আলোর দিকে থেকে চোখ সরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোমার অভিযোগগুলো একটাও সত্যি নয়। তুমি ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো। আমাদের ভালোর জন্যই তোমাকে এড়িয়ে চলেছি! তার আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও। কোনো ভণিতা করবে না।”
আলো চোখ মুছে নাক টেনে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সরাসরি উত্তর দিবে। রোদ ওর দিকে তাকিয়েই অকপট বলে উঠল,
“সত্যি, সত্যিই মেঘের বউমনি হবে?”
আলো মাথা নিচু করে নিলো। এই উত্তর ওর জানা নেই। তবে
রোদ জানত, আলো উত্তর দিতে পারবে না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ঠিক এজন্যই, আমরা তোমাকে এড়িয়ে চলেছি। তুমি এখন আমাদের কাছে অতিথি পাখির মতো। হঠাৎ করে আমাদের জীবনে এসেছো, আবার চলেও যাবে। অথচ দিন-দিন মেঘ তোমার উপরে পুরোপুরি ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর আমার মতে, ঠিক হচ্ছে না। আম্মু মারা যাওয়ার পর মেঘকে আমি অনেক কষ্টে সামলেছি৷ ঠিক কতটা কষ্ট করেছি, বলে বোঝানো যাবে না। এখন মেঘ তোমার মাঝেই আম্মুকে খুঁজে বেড়ায়। আম্মুর মতো করেই তোমার থেকে আদর পেতে চায়। সে বাচ্চা এতকিছু বুঝে না। আবার দেখো, তোমাকেও আমি জোর করতে পারব না। করলে, তুমি সারাজীবন আঙ্গুল তুলে বলবে আমি তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছি। আশ্রয়ের নাম করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছি। তোমার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছি। আর একথাগুলো মানতে পারব না আমি। তুমি তোমার জায়গায় অটল। আর তোমার সিদ্ধান্তকে আমি সন্মান করি। তাই সবদিক বিবেচনা করে এটা করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ তোমার চলে যাওয়াটা মেঘ সহ্য করতে পারবে না। তাই আমি এখন থেকে কৌশলেই তোমার মায়া কাটাতে চাচ্ছি। যাতে অবুজ বাচ্চাটা পুনরায় ধাক্কা না খায়। এছাড়াও
তুমি আমি দু’জনেই অবিবাহিত। আশেপাশের অনেকে চোখে তুমি পড়েছ। উনারা আমাদের সামনে কেউ না কিছু বললেও আড়ালে ঠিকই আঙ্গুল তুলবে। যেহেতু সমাজে বাস করি তাই চাইলেও কারো মুখ বন্ধ করতে পারব না। এটা মানতেই হবে! আর, আর আমিও মানুষ, আমার মন বলেও কিছু আছে। তোমার প্রতি আমি দূর্বল হবো না, এর গ্যারান্টি দিতে পারব না। কারণ একই বাসায় থাকছি, খাচ্ছি, সময় কাটাচ্ছি, এমন কিছু ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর মনের উপরে কারো’র জোর চলে না। হ্যাঁ, তাই বলে ভেবো না রোদ মেহবুব তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমার জন্য মেয়ের অাকাল পড়বে না। রুপে, গুনে, আমার জন্য পারফেক্ট কাউকে পেলেও, আমার ভাইয়ের জন্য মা রুপী বউমনি খুঁজে পাবো কী না এটা পরের কথা। মূখ্য কথা মেঘের তোমাকে চায়, আর তোমাকেই নাকি লাগবে! তাছাড়া বিয়ে, বউ নিয়ে আমি এখনো কিছু ভাবি নি।
সেটা অজানা থাক! শোনো, আমার ভণিতা পছন্দ না বলেই সরাসরি জানালাম। এখন কথাগুলো কী ভাবে নিবা তোমার ব্যাপার। পারলে, আমার কথাগুলো ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভেবে এর
সমাধান খুঁজে বের করো।”
রোদের কথাগুলো আলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনল। ওর ভুল ধারণাগুলোও একনিমিষে ফিকে হয়ে গেল। রোদ এতটা গভীরভাবে ভেবেছে, সে কল্পনাও করে নি। এমন চিন্তা-ধারা ওর মস্তিষ্কেই আসে নি। তাছাড়া রোদের বলা যুক্তিগুলো ওর অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। সে নিজের জায়গায় একদম স্বচ্ছ। ওর কথাগুলো দিয়েই, বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ, ডানে, বামে কী হবে বা হতে পারে। সে কথার মাধ্যেমেই তা বুঝিয়ে দিলো।
সেই সাথে রোদ যে নিদারুণ বুদ্ধিসম্পূর্ণ একটা মানুষ সেটাও বোঝা গেল। এই প্রথম রোদ ওর সাথে একবারেই এতগুলো কথা বলল, বোঝাল! তবে এতকিছুর পরে এখন ওর কী করা উচিত? পরবর্তী পদক্ষেপ নিতেই সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আলো কিছুক্ষণ চুপ করে উঠে দাঁড়িয়ে রোদকে বলল,
“আমার জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন?”
“জীবনকে আর একটাবার সুযোগ দিতাম।”
কথাটা বলে রোদ সামনে এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেষে দাঁড়াল। রোদ জানে, আলোর সমস্যাটা ঠিক কোথায়। কেন সে উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। যদিও ওর বলা কথাগুলো আলো জানত না, অথচ ওর প্রতি রেগে অভিযোগের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে।
মনে ভুল ধারণা পোষণ করে কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। এজন্য রোদ সত্যিটা জানাল। এখন আলো যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই’ই হবে। ওর নেওয়া সিদ্ধান্তের উপরেই এখন সব নির্ভর করবে। দেখা যাক, আলোর সিদ্ধান্ত কী হয়! রোদ আলোর জবাবে জীবনকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলল, কারণ ওর ভাষ্যমতে, ভালোবাসা তিতা না মিঠা নিজে পরখ করে দেখা উচিত। কোনটার কেমন স্বাদ নিজে যাচাই করা উচিত।তিতা আর টক দু’টো জিনিস খেলেই মানুষ প্রথমে মুখ বিকৃত করে। তার মানে এই না দু’টো একেবারেই অখাদ্য। অখাদ্য হলে তিতা আর টক বলে কিছু হতো না। এই দু’টো জিনিসের প্রতি কারো চাহিদাও থাকত না। ঠিক তেমনি; ভালোবাসাও!
টক, ঝাল, তিতা,মিষ্টির সংমিশ্রণে নিদারুণ একটা অনুভূতি।
মৃদু বাতাস দু’জনের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। আলোকে চিন্তায় মগ্ন দেখে রোদ বলল,
“রুমে যাও অনেক রাত হয়েছে।”
“আমি আপনার যোগ্য নই।”
“বুঝলাম।”
কথাটা বলে রোদ আলোকে নিচে যেতে ইশারা করল। কথায় কথা বাড়ে। ধারালো যে তীর ছুঁড়েছে এতেই কাজ হয়ে যাবে।
আলো উঠে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে রোদ সামনে দৃষ্টি রেখে বলল,
“যতদিন না তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে, ততদিন এভাবেই সময় কাটবে। আশা করি এই নিয়ে অযথা যুক্তি আরোপ করবে না, যাও।”
আলো ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। অর্থাৎ
ওর সিদ্ধান্ত না জানানো অবধি রোদ মেঘকে আলোর কাছে আসতে দিবে না। এমনকি সে নিজেও এড়িয়ে চলবে। নিজের জন্য নয়, ভাইয়ের জন্য রোদকে স্বার্থপর হতে হচ্ছে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। গতসপ্তাহে মাঝরাতের দিকে মেঘ খারাপ স্বপ্ন দেখে রোদের কাছে ছুটে এসেছিল। কেঁদে চোখ মুখ লাল করে নেতিয়ে পড়েছিল। রোদ ওকে শান্ত করিয়ে স্বপ্নের কথা জানতে চেয়েছিল। স্বপ্ন’টা ছিল; ‘আলো ওকে রেখে কোথাও চলে যাচ্ছে। মেঘ কেঁদে থামতে বললেও আলো থামছে না। আম্মুর মতো করে বউমনিও তাকে রেখে চলে গেছে।’সেদিন রাতে মেঘ কেঁদে কেঁদে তার বউমনিকে চেয়েছে। বউমনিকে সারাজীবন বাসায় আঁটকে রাখতে শেকল বানাতে বলেছে। যাতে বউমনি ওকে রেখে কোথাও যেতে না পারে। তাই রোদ ভেবেচিন্তে আলোর জন্য শক্তপোক্ত অদৃশ্য এক শেকল তৈরী করতে চাচ্ছে। আর শেকলটার নাম, ‘কবুল।’

একমাত্র এটাই আলোকে আঁটকানোর উপযুক্ত শেকল। রোদ যথাশীঘ্রই ওকে আটকেও ফেলবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা!
এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে রোদ ওর রুমে চলে গেল। ঘড়িতে টিকটক শব্দ করে সময় অতিরিক্ত হয়ে ভোরের দেখা মিলল। চারদিকে আলো ফুটে নতুন এক প্রানবন্ত সকালের উপস্থিতি জানান দিলো। ব্যস্ত নগরীও ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ঘড়িতে বাজে আট’টা তিন। রোদ বাসায় নেই! মেঘ আর আলো দু’জনে মুখোমুখি খেতে বসেছে। মেঘ মিষ্টি হেসে কিছু বলার আগে আলো উঠে চলে গেল। একবার পিছু ফিরে তাকালোও না। মেঘ ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু ঝরাল। বউমনিও ওকে আর ভালোবাসে না। মাথা দু’হাতে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বিরবির করে
বলল,
“সবাই আমাকে রেখে চলে যায়। কেউ আমাকে ভালোবাসে না, কেউ না।”

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here