-‘এলোকেশী কন্যা’-
[৩৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
বর্তমানে,
রোদ আলোর কপালে আলতো করে আদর দিয়ে বলল,
“আছি তো আমি।”
একথা শুনে আলো রোদের হাতটা আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। সে কি বলবে? কার দিকে আঙ্গুল তুলবে? সবাই ওর জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে করে গেছে৷ মুন, মকবুল,আর দাদীমা, এই তিনজনেই ওকে ঋণের দায় চাপিয়ে চলে গেছে। ওর অজান্তে এতকিছু ঘটে গেছে অথচ সে টেরও পায়নি।এ ধাক্কা সে সামলাবে কীভাবে? আদৌও কী সামলে উঠতে পারবে? আলো পুরো কাহিনী জেনে হতভম্ব, নির্বাক, এবং কষ্টে কাতর মানবী। ওর বাকশক্তি যেন লোপ পেয়েছে।ওর মস্তিষ্কটাও
যেন বাক্য গঠন করতে অক্ষম। শরীরটাও ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে অকেজো হয়ে আসছে। আলোর অবস্থা দেখে রোদ দ্রুত পানি খাইয়ে একটু শান্ত করল। আলোর রোদের হাতটা আঁকড়ে ধরে চুপ
বসে রইল। রোদ আলোর অশ্রু মুছে চোখে চোখ রেখে বলল,
“এভাবে ভেঙ্গে পড়লে হবে, হুম? আমরা আছি না! আমাদের জন্য বাঁচবে তুমি। তোমার অশ্রু যে আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে।”
লালবর্ণ ভেজা চোখে আলো মুখ তুলে তাকাল। রোদ শান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর
যেন আলোকে কতশত অজানা কথা জানাচ্ছে।
এই মানুষটা ওর জন্য কত কী না করে যাচ্ছে।সে এখন এই মানুষটার অর্ধাঙ্গীও। অর্থাৎ শরীরের অর্ধেক অংশ। আর এই রোদ নিজে থেকে ওকে দিয়েছে। আলো জবাবে কিছু বলার আগে,মেঘ ড্র্রয়িংরুমে বসে ডোরাকেক খেতে খেতে আলোকে ডেকে উঠল৷ আলোর সাড়া না পেয়ে সে পুনরায় ডাকল। রোদ তখন চেঁচিয়ে উত্তর দিলো,
“মেঘ, তোমার বউমনি একটু পরে আসছে।”
“না, এখনই আসতে বলো। আমি আর বউমনি ফুল কুড়াতে যাব।”
একথা শুনে রোদ বেশ বিরক্ত হলে আলো ওকে থামাল। আলো জানে, সে না গেলে মেঘ থামবে না।মেঘ আজ স্কুলে যাবে না অগ্রিম জানিয়েছে। মারামারির পরেরদিন স্কুলে যায়; বোকারা! মেঘ সেক্ষেত্রে মোটেও বোকা নয়।সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান! জেনে শুনে বাঁশ খেতে সে ইচ্ছুক নয়।যদিও এই
কাজের পেছনে মূখ্য একটা কারণও আছে।গত কাল ছুটির পর মেঘ সাদমানকে ভালো ‘ই মার মেরেছে, মন্দ মারে নি! এই যেমন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাঁতের রক্ত বের করে দিয়েছে। চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে শার্টের দু’টো বোতাম ছিঁড়ে দিয়েছে। মুখের মধ্যে বালু ঢুকিয়ে একটা থাপ্পড় মেরেছে। সবশেষে ওর পায়ের মোছা খুলে মোছার গন্ধ শুকিয়েছে। কারণ সাদমান ওকে সব সময়
খোঁচা মেরে বলে, ‘সে নাকি এতিম! ওর বাবা-মা কেউ নেই।রাস্তার টোকাইদের বাবা-মা থাকে না। মেঘও নাকি টোকাইদের মতো রাস্তার ছেলে।সে
রাস্তায় ছেলের পাশে বসবে না।’
একথা শুনে মেঘ রেগে সাদমানকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। সেই সাথে এটাও বলেছে;’বাসায় এসব
জানিয়ে,দাভাইকে অভিযোগ দিলে আরেকদফা দিবে, সাথে বাথরুমের বদনার পানি খাওয়াবে।’
সাদমান কাউকে বলবেনা তবুও মেঘ রিস্ক নিলো না। সাবধানের মাইর নেই। একথা সে রোদকেও জানাবে না। কারণ ওর সমস্যা’টা তো সমাধান হয়েই গেছে। এখন জানিয়েই বা কী হবে? দেখা যাবে ;সেই উল্টো বকা খাবে। আলোকে এখনো আসতে না দেখে, মেঘ শুয়ে গানের সুরে ডাকতে লাগল,
“বউমনি! ওহ বউমনি! এসো, এসো, তাড়াতাড়ি এসো। আর আমাকে ফু ফু ফুল কু কু কুড়াতে নিয়ে চলো গো।”
এসব বলে সে একা একাই বকবক করছে। মুখটা থামলেই যেন ঘোর বিপদ। রান্নাঘরে রাকা আর সাগর দাঁড়িয়ে ওর গান শুনে হাসছে৷ যাকে বলে জখা গান। আলো তখন নিজেকে সামলে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামল। ওর যে এখন অনেক দায়িত্ব, অনেক! যেমন এই দুষ্টুটার ওকে ছাড়া চলবে না।
ওকে খুঁজে না পেলে চিৎকার করে বাড়িটা মাথায় তুলবে। জ্বরের মানুষটার সামনে কাঁদলে সে কষ্ট পাবে। কী দরকার শুধু শুধু ওদের কষ্টের পাল্লা ভারী করার।ওর চিন্তা-চেতনা দু’জনকে ঘিরে’ই ৷ বলা যায়; রোদ আর মেঘ ওর জীবনের প্রদীপ।
যাদের উৎসাহে বার বার হোঁচট খেয়ে দাঁড়ানোর সাহস অর্জন করে। কষ্টগুলোকে বিতারিত করে ওকে হাসতে বাধ্য করে। সর্বদা ওকে আগলে রাখে।তাছাড়াও আলো দু’টো পরিচয়ে পরিচিত; একজনের বউমনিরুপী মা আর আরেকজনের প্রণয়রুপী অর্ধাঙ্গী হয়ে।এই দায়িত্ব ওর কাঁধে। আর এই দায়িত্বের দীর্ঘ মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে।এদের পাশে পেলে সে সব ঝড় সামলে উঠতে পারবে।ওর বিভৎস অতীতকে ঢেকে পুনরায় বাঁচতে পারবে।পারতে ওকে হবেই! কষ্টে ভেঙ্গে চুরে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়েও পুনরায় বাঁচতে শিখলে সে মেয়ে হিসেবে স্বার্থক। কারণ একটা মেয়েই পারে ভাঙা জিনিস জোড়া লাগিয়ে নতুন রুপ দিতে। হয়তো দাগটা থেকে যায় তবুও মানিয়ে নেওয়া যায়। কারণ,মানিয়ে নেওয়া, ত্যাগ, সহ্য, ধৈর্য, যন্ত্রনা, এবং কষ্টের লড়াইয়ে আরেক যোদ্ধার নাম ‘মেয়ে।” অর্থাৎ ওর জীবন যুদ্ধের যোদ্ধা সে নিজে।
আলোকে আসতে দেখে মেঘ উঠে সোজা হয়ে বসে মিষ্টি হাসল। তবে আলোর মুখ মেঘের ভ্রু কুঁচকে গেল। বউমনির মুখ, চোখ, নাক লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই দাভাই আবার বউমনিকে বকেছে। ওর তাকানোর মানে বুঝে আলো হেসে বলল,
“সর্দি লেগেছে মেঘবাবু তাই।”
”নাকি দাভাই বকেছে?”
“না তোতাপাখিটা। তোমার দাভাইয়ের খুব জ্বর এসেছিল, এখনো আছে। যাও, দাভাই তোমাকে ডাকছে।”
আলোর বলতে দেরী মেঘের ছুটতে দেরী হয় নি। আলো মেঘকে আস্তে যেতে বলে খাবার নিয়ে উপরে গেল।রোদের জ্বর সারেনি, এখনো শরীর গরম। সে রুমেই শুয়ে আছে। মেঘ দৌড়ে গিয়ে
রোদের কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করল। তারপর ছলছল চোখে দাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এত্ত জ্বর কী করব আমি? কী করলে জ্বর কমবে দাভাই?”
মেঘের চিন্তির মুখে দেখে রোদ মৃদু হাসল।পুঁচকে মেঘটার এত পাকা পাকা কথা। রোদ মেঘের হাত ওর মাথায় রেখে চুল টানতে বলল। তাহলে জ্বর কমে যাবে।মেঘ রোদের কপালে আদর দিয়ে চুল টানতে থাকল। রোদও মেঘকে আদর দিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করল। একটুপরে আলো খাবার এনে দু’জনকে খাওয়াতে বসে বলল,
“যে খাবে না বলবে তাকে আমি লাল পিঁপড়ার সঙ্গে বিয়ে দিবে।”
আলো ওদের মুখ দেখে মিটিমিটি হেসে দু’জনকে খাওয়াতে লাগল। রোদ মেঘও একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে খেতে থাকল। মেঘ লাল পিঁপড়া বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়। সবাই ওকে পিঁপড়ার বর বলবে।ছিঃ! কী বিশ্রী একটা ব্যাপার। আর রোদ আলোর হাতে খাওয়া মিস করতে রাজি নয়। মেঘের মুখ দেখে আলো হেসে বলল,
”খেয়ে ওষুধ খেলেই দাভাইয়ের জ্বর কমে যাবে। চিন্তার কিছু নেই মেঘবাবু।”
”আচ্ছা।”
রোদ আর মেঘ গল্প করতে লাগল। আর আলো ভাবনার জগতে পাড়ি দিলো,
ওর জানামতে, দাদীমা বরিশাল জেলার মেয়ে। বিয়ের পরও উনি সেখানে দীর্ঘদিন শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। বিয়ের একবছর না গড়াতেই
উনার স্বামী রেজা শেখ মারা যান। আর স্বামীর অবর্তমানে উনি শশুড়বাড়িতেও টিকতে পারেন নি। মূখ্য কথা টিকতে দেয় নি। বাবার বাড়িতেও ঠাঁই হয় নি। গ্রামের মানুষের কটু কথা আর বদ নজর থেকে বাঁচতে ঢাকায় চলে আসেন। বাচ্চা
নেই, খেয়ে পরে একা বাঁচতে গার্মেন্টের কাজে যুক্ত হন। শিক্ষিক মহিলা বিধায় উনার ভালো পদে চাকরিটাও হয়। কিছুদিন পর, কারো সূত্র ধরে রাঙামাটিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আলো উনার নিজের নাতনি নয়, এটা আলোও জানে। তবে আলোকে উনি কোথায় পেয়েছেন? একথা দাদীমা বলেন নি আর সেও জোর করে নি। প্রথমে একথা জেনে কষ্ট পেলেও দাদীমার আদর পেয়ে মানিয়ে নিয়েছে।গতরাতে
আলো সব জানার পর এটাও বুঝেছে ;দাদীমা গোপনীয় কোনো কাজে যুক্ত ছিলেন। এজন্য মানুষ মারার ভয়ংকর কাজেও পিছু পা হতেন না। কিন্তু কী সেই কাজ? কীভাবে করবে রহস্য উন্মোচন? কে জানাবে সত্যিটা? এসব ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আলো মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ রোদকে প্রশ্ন করল,
”দাভাই, ওই দুষ্টু মানুষগুলো আমাদেরকে না মেরে ছেড়ে দিয়েছিল কেন?”
হঠাৎ একথা শুনে রোদের ভ্রু দু’টো কুঁচকে গেল।মেঘ রোদের ফোনে কার্টুন দেখছে। সেখানে মটু -পাতলু জঙ্গি সেজেছে। ওদের পোশাকে দেখে মেঘের সেদিনের কথা মনে পড়ে গেছে। আলোও সেদিনের ঘটনার কথা জানে।হঠাৎ রোদ আদর চেয়েছিল কেন? এটা ভেবে আলোর মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তাই রোদের জ্বর কমলে নিজেই সব বলেছিল। ওদের তিন’জনের মাথায়
একটা প্রশ্ন কড়া নাড়ল,
“জঙ্গিরা ওদের না মেরে ছেড়ে দিয়েছিল কেন?”
ওদিকে মাতবরের গ্রামে অঘটন যেন পিছু ছাড়ছে না। পূর্ণির ছোঁড়া সেই অস্ত্রের কোপে মাতবরের করুণ অবস্থা। সেই স্থানে পঁচন ধরে;বিশ্রী গন্ধ ছড়াচ্ছে। কেউ উনার কাছে ঘেঁষতেও পারছে না।হাকিম আজ চিকিৎসার সময় খেয়াল করেছেন
;মাতবরের ক্ষতস্থানে পোকা কিলবিল করছে।এ কথা উনি কাউকে জানান নি। ধীরে ধীরে উনার
হাতের সাথে পুরো শরীরেও পঁচন ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাকিম সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারছে না। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, ওই অস্ত্রে বিষাক্ত কিছু ছিলো। নাহলে এমন হওয়ার কথা না। হাকিমের এই ধারণা একদম নির্ভুল! পূ্র্ণি যার থেকে অস্ত্র নিয়ে ছুড়েছিল,সে ওই অস্ত্র দিয়ে’ই বিষাক্ত কিছু গাছ এবং পাহাড়ি জঙ্গল পরিষ্কার করেছিলেন।ওই জঙ্গলের ঝোঁপে বিষাক্ত পোকা- মাকড়ের বাসা ছিল। এছাড়া ওই লোক আসার পথে অস্ত্র দিয়ে একটা সাপের মাথায় কোপ বসিয়েছিলেন।
সাপটার বিষাক্ত এবং পেটে বাচ্চা ছিলো। কোপে ছটফট করতে করতে সাপটা মারা যায়। লোকটা অকারণে সাপটা মেরেছিলেন।এসব বিষাক্ত বিষ মাতবরের শরীর প্রবেশ করে শোচনীয় অবস্থা।ওই বিষগুলো উনার শরীরে পঁচনের সাথে সাথে শরীর কালচে হয়ে রক্ত চলাচলও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। মাতবরের ছটফটাছফানি কান্না সহ্য করার মতো না।
কথায় আছে, সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন ছেড়ে দেন না। হয়তো এজন্য প্রকৃতির বিষ ঘুরে ফিরে মাতবরের শরীরে। নয়তো এমন হওয়ার কথা তো ছিল না।
এছাড়াও গত দুইদিন থেকে মতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কলার গাছ কাটতে গিয়ে আর ফিরে নি। দলবল হন্ন হয়ে খুঁজেও তার খোঁজ মিলছে না। কোথায় গেছে, কে জানে! তবে ওখানকার অনেকে মোনাজাতে বসে কেঁদে মন থেকে দোয়া করছে,
“পাপ এবং পাপের চারা দু’টোই যেন নিঃশেষ হয়।”
To be continue……..!!