সাঁঝক বাতি-‘ নূরজাহান আক্তার (আলো) [২৭] (অন্তিম পার্ট)

2
836

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২৭]
(অন্তিম পার্ট)

-‘আমার অতীতটাকে কত খন্ড করলে তোমায় পাবো, বললে না তো?

শিফা নির্লিপ্ত দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। মুখভঙ্গি দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই৷ দিগন্ত হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। উত্তরের আশায়। সুখু মাথা নিচু করে হাসছে। যাক শান্তি লাগছে। অবশেষে এক হচ্ছে। প্রাপ্তিও নিশ্চিত। পাগল প্রেমিকরা এমনই হয়। দিগন্তও হচ্ছে। এতে দোষের কিছু নেই। যে
ভালবাসতে জানে; সে বিনাবাক্যে মারতে এবং মরতেও পারে। নয়তো সে প্রেমিক নামে কলংক।
রত্নাকে খবর’টা দিতে হবে। আজ খুশির দিন। এত খুশি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। দিনটা
মনে রাখতে, কাস্টমারদের ফ্রিতে গাঞ্জা বিলাবে। আজ নেশাখোরদের মুখে হাসি ফুটুক। দিগন্তের গাঢ় প্রণয়ের নেশা আর বাকিরা পুরিয়ার নেশায় ডুবুক। মত্ত হোক যার যার নেশায়। হাসি ফুটুক সকলের মুখে। এসব ভেবে সুখু দ্রুত সরে গেল। পূর্নতা পেলে অথবা পেতে দেখলেও সুখ লাগে।
মনে প্রশান্তি বিরাজ করে। তবে সবাই তো আর পূর্ণতা পায় না। পূর্ণতা সৌভাগ্যবানের জিনিস।

দিগন্ত নিশ্চুপ! ওর দৃষ্টিতে শিফাকে নিজের করে পাওয়ার সিক্ত আশা স্পষ্ট। মনে চলছে হাজারো
ব্যাকুলতা। তখন শিফা এগিয়ে দিগন্তকে জড়িয়ে ধরল। খুব শক্ত বাঁধনে। স্ব-জ্ঞানে! স্ব-ইচ্ছায়!সুস্থ মস্তিস্কে! ওর বাঁধন এতটা শক্ত যেন বুকের মধ্যেই ঢুকে যাবে। দিগন্ত স্তম্ভিত। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি। শিফা দিগন্তের গলায় মুখ লুকিয়ে পিঠের শার্ট খামছে উচ্চশব্দে কাঁদতে লাগল। অবাধে ঝরছে অশ্রুধারা। যদি কষ্টটা লাঘব হয়। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। দম আটকে আসছে।যেন
মহামূল্যবান কিছু চিরতরে হারাচ্ছে। যদিও তার হারানোর কিছু বাকি নেই।শিফার অশ্রু দিগন্তের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। দিগন্তে চোখ বন্ধ করে সেটা অনুভব করছে। প্রশান্তিতে ছুঁয়ে গেছে ওর অশান্ত বুকটা। সুখ অনুভূত হচ্ছে। ইস, সময়টা থমকে গেলে বেশ হতো। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস, বছর এসে যুগও এভাবেই পেরিয়ে যেতো।
শিফা গোড়ালি উঁচু করে বাঁধন’টা আরো শক্ত করল। দিগন্তের মুখে হাসির ফুটলো। সেও শক্ত করে বাহুডোরে টেনে কপালে, গালে, থুতনীতে, ঠোঁটে, অসংখ্য আদর দিলো। শিফাও জবাবে
দিগন্তের কপালে আদর দিলো। সময় নিয়ে।ঠিক
তখন ওর অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দিগন্তের বুকের বাঁ পাশে। তখন দিগন্ত ওর গাল ধরে আদুরে কন্ঠে বলল,

-‘স্ব-ইচ্ছায় তোর আদুরে স্পর্শ পাওয়ার বড্ড
শখ ছিলো আমার।’
-‘(শিফা নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে)’
-‘আমি প্রস্তুত, জান।’

শিফার কান্নার গতি বেড়ে গেল। আর দিগন্তের ব্যথাতুর কন্ঠে ‘আহ্’ শব্দ উচ্চারণ করল। ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাসও নিচ্ছে।
তবুও কেউ কাউকে ছাড়ল না। দিগন্ত শক্তভাবে জড়িয়ে রাখল। শিফা ছাড়তে জুরাজুরি করলেও ছাড়ল না। বরং শিফাকে ব্যথিত কন্ঠে বলল,

-‘শক্রতার বশে বৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম।বউ হয়ে এসে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছিলি এই বুকে। থমকে দিয়েছিলি আমার অতীত। আর স্তব্ধ হয়ে হয়েছিলাম আমি। ছাড়লাম পাপকর্ম। করলাম মাথা নত। হেরেও গেলাম দৃঢ় সংকল্পের কাছে। তবুও বলবো না ভালোবাসি। আটকাবো না পথ। দেখাব না গাঢ় অধিকার। ক্ষত-বিক্ষত এ হৃদয়ে শুধু গেঁথে রাখব তোকে। তোরই হেলায়
গড়ে উঠেছে এই বুকে যন্ত্রনার সমুদ্রপাড়। সেই
যন্ত্রনায় পুড়তে থাকে আমার দগ্ধিত হৃদয়। শুধু তোরই কারণে। তবুও রাখিনি অভিযোগ করিনি অভিশাপ। তুই ভালো থাক। বিষেপূর্ণ অতীতের সুমিষ্ট স্বপ্নগুলো ভিড় করে। নিরব আত্মনার্দে ডুকরে কেঁদে ওঠে মন। তোকে পাওয়ার আকুলতা
জারি করে। শুধু জেনে রাখ,পাপী মনেও আঘাত হানে। কষ্ট জমে বুকের গহীনে। অশ্রুও ঝরে দুটি
নয়নে।শুধু তোর’ই কারণে।তোর’ই প্রণয়াসক্তে।
আমার ভারাক্রান্ত আকাশে অপ্রাপ্ত নক্ষত্র তুই। যে নক্ষত্রের আলো পড়বে না আমার গায়ে। না পারব ছুঁয়ে দেখতে। আমি নামক মায়াতে তোকে জড়াতে পারে নি। পারবেও না। তবুও তুই সুখে থাক। তোর ঘৃণার দৃষ্টির চেয়ে ছুরিকাঘাত ঢের ভালো। ছুরির আঘাতে মৃত্যু। চিরতরের বিদায়। তোর চাহনিতে বার বার মরার চেয়ে এটা উত্তম। জানিস, আমার কষ্ট হয়। বুকে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ বাড়ে। না দেখাতে পারি না আর না বোঝাতে। আমি প্রচন্ড লোভী প্রেমিক।তাই বিনাশ নিশ্চিত জেনেও ভালোবেসেছি। তোকে পাওয়ার কত স্বপ্ন বুনেছি। তবুও আফসোস নেই।
কারণ, আমি তোর কাছে অভিশাপস্বরুপ হলেও তুই আমার কাছে আর্শিবাদস্বরুপ।’

এসব বলে শিফাকে ছেড়ে দিলো। নিজের ভর রাখল পারল না। মুখ থুবকে পড়ে গেল। লাল রক্তে ভিজে আছে সাদা শার্ট। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। দিগন্ত হাসছে। কষ্টমাখা হাসি। ছলছল চোখ। শিফা রক্তাক্ত ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কথার ছলে সে ছুরিটা বসিয়েছে। দিগন্ত বুকের বাঁ পাশে। একবার নয় পরপর তিন বার। দিগন্ত বাঁধা দেয় নি। টু শব্দও করে নি। মেনে নিয়েছে প্রিয়তমার উপহার। শিফা দিগন্তের সামনে বসে পড়ল। বুকফাটা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগল।
দিগন্তের রক্তে সেও রঙিন। হাতের ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে বলতে লাগল,

-‘সব পাপকর্মের হিসাব বরাবর। এটা না করলে বিবেকের কাছে হেরে যেতাম। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হতো।
সব পাপ ক্ষমার যোগ্য না। জীবনও খেলার বস্তু নয়। পারতাম না ক্ষমা করতে। দেওয়াও যেতো না পরবর্তী সুযোগ। আপনি’ও শুধরাতেন না।আপনার শাস্তির জন্য কারাগারও উপযুক্ত নয়। মৃত্যু’ই আপনার জন্য উপযুক্ত শাস্তি। হ্যাঁ মৃত্যু।
মৃত্যু।’

শিফা পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল। যাকে মারতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাকে মেরেই কলিজা ফেটে যাচ্ছে। কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে। দিগন্তের প্রতিটা কাজ সম্পর্কে সে অবগত। ওর ঢাল হওয়ার কথাও। ভালোবাসলে পাপ মাফ হবে না। সে বাস্তবাদী। আবেগকে সে প্রশ্রয় দেয় না। যদি দিতো তাহলে অনেক আগে
দিগন্তকে মেনে নিতো। সুখে সংসার করতো। সব
ভুলে দিগন্তকে সুযোগ দিতো। কিন্তু তা সম্ভব না।
সে এমন একজন মানুষ যাকে অপছন্দ তাকে’ই শেষ করে দিবে। এছাড়া, পালাবার পথ’ও নেই।
কতদিন দেশের বাইরে থাকত? দিগন্ত সত্যি খুব ভালোবাসে। সেও জানে। তবুও নিরুপায়। সে পাপী। পাপীর শাস্তি অবশ্যিক। সব অন্যয় তার সঙ্গে হয়েছে। তাই সেই শাস্তি দিবে। তাই দিলো।
আর দিয়ে সেই দগ্ধ হচ্ছে। শিফার চিৎকারে সুখু দৌড়ে এসে থমকে গেল। দিগন্ত বুক চেপে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সুখু যেতে গেলে দিগন্ত নিষেধ করে থেমে থমে উচ্চারণ করল,

-‘আমার প্রিয় বউয়ের দেওয়া সর্বপ্রথম ও শেষ উপহার। আমি খুশি জান। খুব খুশি।’
-‘ছ্যার, ছ্যার হসপিটালে যেতে হবে। উঠুন, প্লিজ উঠুন।’
-‘কাঁদবি না সুখু। ছাড় আমাকে! আমি একদম
ঠিক আছি।’
-‘ম্যাডাম ছ্যারকে হসপিটালে নিতে হবে। নাহলে ছ্যার মরে যাবে, ম্যাডাম প্লিজ কিছু বলুন। ছ্যার, তাকান। ম্যাডাম ছ্যার মরে যাবে, মরে যাবে।’

শিফা থম মেরে গেছে। সুখুর চিৎকার ওর কানে যাচ্ছে না। সুখু পাগলের মতো কাঁদছে। দিগন্তের হাত ধরে টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে। দিগন্ত’ই উঠছে না। বরং ওর হাতটা ছাড়িয়ে অনেক কষ্টে শিফার কোলে মাথা রাখল। দুই হাতে শিফার কোমর চেপে পেটে মুখ গুজল। যে মারল আবার তাকেও জড়িয়ে নিচ্ছে। ঠিক কতটা বেহায়া হলে কেউ এমন করে! সত্যিই সে বেহায়া, লজ্জাহীন, এক প্রেমিক পুরুষ। নয়তো এত ঘৃণা, অবহেলা,
কটুবাক্যের পরেও এত ভালোবাসত না। দিগন্ত
চাইলে শিফাকে আটকাতে পারতো। জোরপূর্বক বন্দি করতে পারত। বন্দি পাখিকে করে। প্রিয়কে নয়! দিগন্ত জানে ওর কিছু শিফা নিবে না।তবুও
সব শিফার নামে।অনেক আগে হসপিটালও ওর
নামে করে দিয়েছে। শিফা অঝরে কাঁদছে। দিগন্ত তখন অস্পষ্ট স্বরে বলল,

-‘সবটাই কি আমার কর্মফল নাকি নিয়তি?’
-‘জানি না। কিচ্ছু জানি না।’
-‘স্মৃতির চৌকাঠে আমার প্রেমটুকু গেঁথে রাখিস। আর মনে করিস, এই পাপীর প্রণয়ের গল্পকথা।’

শিফা দিগন্তের মুখে অসংখ্য আদর দিলো। সে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে ডাকতে লাগল। স্বপ্নীলের জন্য এতটা কষ্ট হয় নি। তাহলে দিগন্তের জন্য হচ্ছে কেন? ওরা দু’জনই তো খারাপ। শিফাকে এমন করতে দেখে দিগন্তের অশ্রু ঝরছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। দিগন্ততে ছটপট করতে দেখে শিফা ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,

-‘বোধহয় আমিও ভালোবাসি তোমায়।’
-‘আমি স্বার্থক।’
-‘আমাকেও মেরে দেন।’
-‘তোমার মাঝেই আমি জীবিত থাকব, প্রিয়।’
-‘অভিযোগ? ‘
-‘নেই। তবে?’
-‘কী?’
-‘ভালোবাসি।’

শেষ মুহূর্তে এসে দিগন্তের মুখে হাসি ফুটল। এই মধুমাখা কথাটা শুনতে অপেক্ষারত ছিলো। সে
সত্যিই স্বার্থক। দিগন্ত শেষবার শিফাকে জড়িয়ে ধরল রক্তাক্ত বুকে। তারপর অনেক কষ্টে বলল,

-‘মরে গেলে ভেবে না ফাঁকি দিয়েছি। সাঁঝক বাতি হয়ে এসে বলব; তোমায় ভালোবাসি।’

সমাপ্ত….!!
(বিঃদ্রঃ- পরিসমাপ্তিতে পাপ এবং প্রণয়ের জয়)

2 COMMENTS

  1. Ending ta koster hobe bhabini ata🙂 akta golpo holao coker pani jano bada manse na ending ta happy holao parto atao bolbo. apni oshadharon prothibar manush. Atar jodi part 2 den tahole khushi hobo🙂

Leave a Reply to Amir & Jannat Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here