সুদর্শন শঙ্খচিল’ [৩৯]

0
497

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

উনার কপালের ভাঁজ আর চিন্তিত ফেস দেখে তুয়া মৃদু হেসে বলল,”আব্বু ইচ্ছের আদর কখনও কমবেনা, কথা দিলাম।” এ কথা শুনে প্রত্যয়ের আব্বু সহ সবার মুখে হাসি ফুটল। তারপর সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। চাঁদ রুমে প্রবেশ করতেই প্রিয়ম চাঁদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রতিবারের মতো এবারও সে অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম। তাই চুপ করে রইল। চাঁদ প্রিয়মের নিশ্চুপতার মানে বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল,”আজ আমি পরিপূর্ণ সম্পূর্ণা।”

এদিকে, প্রত্যয় রুমে এসে দেখে তুয়া ইচ্ছের চুল বেঁধে দিচ্ছে। দু’পাশে দু’টো বেনুণীতে ইচ্ছেকে বেশ লাগছে। প্রত্যয় সোফাতে বসে একটা বই হাতে নিল। তখন ইচ্ছে প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে আদুরে সুরে বলল,”বাবাই! আমাকে আরেকটা ইতু এনে দাও, প্লিজ। শূন্য খাঁচা দেখতে মোটেও ভালো লাগে না।” প্রত্যয় হাতের বইটা রেখে মৃদু হেসে বলল,”আচ্ছা! খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে।” ইচ্ছে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে প্রত্যয়ের গালে আদর দিল। আদরের বিনিময়ে প্রত্যয়ও তাকে আদর দিল। প্রত্যয়ের ইতু নামক পাখিটা বেঁচে নেই। হঠাৎ জ্বরে মারা গেছে। সেদিন ইচ্ছে সারাদিন খুব কেঁদেছিল। সেদিন থেকে প্রত্যয় আরেকটা ময়না পাখির খোঁজ করছে। কিন্তু সব সময় ময়না পাখি পাওয়া যায় না। তবুও সে পাহাড়ি এলাকার একজনকে জানিয়ে রেখেছে। সে পেলে এনে দিবে বলেছে।
তুয়া চুপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের দু’জনকে দেখলে নিঃসন্দেহে মনে হয়, ওরা বাবা মেয়ে।

দু’জনে টুকটাক গল্প করে ইচ্ছে চানাচুরের বাটি হাতে নিয়ে বলল, “আচ্ছা বাবাই আমি এখন রুমে গেলাম, শুভ রাত্রি।” প্রত্যয় মুচকি হেসে প্রত্যুত্তরে বলল,”শুভ রাত্রি সোনা মা।” তুয়া নিজের চুলে চিরুণী করতে করতে বলল,”ইচ্ছে বেশি রাত জাগবেনা শরীর খারাপ করবে।” ইচ্ছে দরজার কাছে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,”পড়া কমপ্লিট করেই ঘুমিয়ে যাব মাম্মাম, প্রমিস। আর আমার বাবাইয়ের ইচ্ছে পূরণ করতে হবে তো।”

কথাটা বলে ইচ্ছে মিষ্টি হেসে স্থান ত্যাগ করল। ইচ্ছের মাম্মাম ডাকটা তুয়ার কলিজা জুড়িয়ে যায়। ওর প্রতিটা দায়িত্বের কথা স্মরণে চলে আসে। যদিও তুয়ারও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সে এখন পারফেক্ট সহধর্মিণী এবং ইচ্ছের মাম্মাম হয়ে উঠেছে। তুয়া বসে ইচ্ছের কথা ভাবছিল। হঠাৎ প্রত্যয়ের দরজা আঁটকানোর শব্দে ভাবনার ছেদ ঘটল। দু’জনের চোখাচোখি হওয়াতে দু’জনে মৃদু হাসল। প্রত্যয় বিনাবাক্যে তুয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তুয়া হেসে আলতো করে প্রত্যয়ের চুলে হাত ডুবাল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু একে অপরের অনুভূতিকে গভীর ভাবে অনুভব করছে। তুয়া যত্ন করে প্রত্যয়ের চুল টেনে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর, প্রত্যয় মুখ তুলে তুয়ার পেটে আদর দিয়ে বলল,” এই অমূল্য উপহারটারের আগমনে আমি খুব খুশি। অনেক অনেক ভালবাসা নিও সোনা বউটা।” তুয়া প্রত্যয়ের কপালে আদর দিয়ে বলল,”ধন্যবাদ প্রিয়।”

তারপর থেকে শুরু হলো চাঁদ তুয়ার প্রতি সবার যত্ন নেওয়া। ছোট্র ইচ্ছেও এখন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওদের যত্ন নেয়। বাসার প্রত্যেকটা সদস্য ওদের প্রতি খুব যত্নশীল। প্রত্যয় প্রিয়ম নিজেদের বউয়ের জন্য কখনও একা কিছু আনেনা। কিছু আনলে সবার জন্য আনে। ‘আমার বউ একা খাবে’ এমন মনোভাব ওদের কারো’র মনে নেই। চাঁদের খুব একটা বমি হয়না! সে প্রায় সবকিছু খেতে পারে। কিন্তু তুয়া খাবারের গন্ধও সহ্য করতে পারেনা। ওর পছন্দের জিনিসগুলোও এখন অপছন্দের লিষ্টে যুক্ত হয়েছে। তুয়ার আব্বু আম্মু এসে তুয়াকে দেখে গেছে। তাদেরও খুশির অন্ত নেই। উনারা তুয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তুয়া রাজি হয়নি। প্রত্যয়ের আব্বু আম্মুও চাচ্ছিলেন না, তুয়া যাক। কিন্তু উনারা মুখ ফুটে বলতে পারছিলেন না। তুয়ার না যাওয়াতে প্রত্যয়ের মুখে আগে হাসি ফুটেছে। আর তুয়া মূলত যায়নি চাঁদের জন্য। তুয়া বাপের বাড়ি গেলে চাঁদ মন খারাপ করত। সব মেয়েরা এই সময়টা মায়ের কাছে থাকতে চাই। আর সেখানে চাঁদের তো বাবার বাড়ি নেই। তুয়ার সিধান্তে তুয়া আব্বু আম্মু অখুশি হয়নি। বরং হেসে মাথায় হাত রেখে বলেছেন, ”আমার মা টা অনেক বড় হয়ে গেছে।”

তারপর শারীরিক, মানসিক, সমস্যা গুলো নিয়ে চাঁদ তুয়ার দিন কাটতে লাগল। প্রত্যয় প্রিয়ম ওদের যথেষ্ট খেয়াল রাখে। প্রত্যয় প্রিয়ম যেই ফল কাটুক ওদের দু’জনের জন্য ফল কাটবে। দু’জনকে এক ডক্টরই দেখেন। দু’জনের জন্য আরাম দায়ক পোশাকও এক, শুধু ভিন্ন কালারের। দু’টো বউ সবার থেকে সমান ভালবাসা পায়। এখানে ইচ্ছেও বাদ যায় না। সে সবার চোখের মণি। আর পূত্রবধূদের এটা ওটা এনে খাওয়ানো প্রত্যয়ের আব্বু রোজকার কাজ। উনি আজ বিকেলে মূলত চাঁদ তুয়ার জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। ওরা দু’জনে মুখে স্বাদ পাচ্ছে না। বমি করে ওদের রুচি বেহাল দশা। তাই উনি ওদের জন্য ঝাল করে পেয়ারা মাখা এনেছেন। চাঁদ খাচ্ছে, আর ঝালের গন্ধে তুয়ার বমি বমি পাচ্ছে। না খেলে বাবা কষ্ট পাবে ভেবে সে একপিস খেল। এবং সাথে সাথে বমি করে দিল। আর পুরো বমি গিয়ে পড়ল প্রত্যয়ের আব্বু গায়ে। তুয়া এবার লজ্জায় কেঁদে দিল। প্রত্যয়ের আব্বু হেসে তুয়াকে পানি খাইয়ে মাথা হাত বুলিয়ে বললেন,”ব্যাপার না মা এটা ধুলেই পরিষ্কার করে যাবে। কিন্তু তুই কাঁদলে আমি খুব কষ্ট পাব। দাদু হবো আর এসব না সহ্য করলে হবে?”

কথাটা শুনে চাঁদ তুয়া হাসল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার মুখ মুছিয়ে বমি পরিষ্কার করে বললেন,”তাই তো! তোদের এ বাড়িতে ভালো রাখার জন্য এনেছি। তোরা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকব, বুঝলি?”

এদিকে, কালকে রাতে ইচ্ছের চানাচুর শেষ। সে আজ সারাদিন চানাচুর খায়নি। প্রিয়ম চানাচুর এনেছে কিন্তু তুয়া লুকিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে আগে অল্প করে চানাচুর নিতো। আর এখন বাটি ভর্তি করে নেয়। এতো চানাচুর খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই তুয়া লুকিয়ে রেখে। এখন ইচ্ছের স্কুল ব্যাগে চানাচুরের প্যাকেট থাকে। ক্লাস চলাকালীন শিক্ষকের আড়ালে চানাচুর খাওয়া ইচ্ছের আরেক অভ্যাস। আজ সে কোচিং থেকে ফিরে চানাচুর না পেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। প্রত্যয় হসপিটালে আর প্রিয়ম গেছে ওর প্রোগ্রামে। এখন ওরাও কেউ বাসায় নেই। কে ওকে চানাচুর এনে দিবে? ইচ্ছে ছলছল চোখে প্রত্যয়ের আব্বুর দিকে তাকালেন। উনি
ইচ্ছেকে রুমের যাওয়ার ইশারা করলেন। ইচ্ছে উনার ইশারা বুঝে দৌড়ে রুমে চলে গেল। হ্যাঁ! ওর দাদুজান চানাচুর এনেছে। ইচ্ছে মুখে চানাচুর পুরে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলল, “দাদুজান লাভ ইউ। তোমার চুল গুলো না পাকলে তোমাকেই আমার বফ বানাতাম।” একথা শুনে সবাই হেসে উঠল। তখন প্রত্যয়ের আম্মু একটু রাগি দেখিয়ে বললেন, ” ফাজিল মেয়ে কি বললি তুই?” ইচ্ছে মুখ ভেংচি দিয়ে বাদাম খেতে খেতে বলল,”তোমার বুইড়াকে নিতে আমার বয়েই গেছে, হুম।” কথাটা বলে ইচ্ছে চানাচুর খেয়ে পড়তে বসল। এখন ওর পড়ার খুব বেশি চাপ যাচ্ছে। তাই সে অযথা সময় নষ্ট করল না।

তুরাগের ছেলের নাম রেখেছে পরাগ। পরাগ এখন হাঁটতে শিখেছে। বউ বাচ্চা নিয়ে তুরাগ বেশ সুখে আছে। সে দিনের পর ইলার সঙ্গে তুরাগের আর যোগাযোগ হয়নি। গতদিনে ইলার বান্ধবীর সঙ্গে তুরাগের দেখা হয়েছিল। ওর বান্ধবী জানিয়েছে ইলা সুইসাইড করেছে। রিকের অত্যাচার নাকি দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে রিক এক প্রকার ব্যবসা শুরু করেছিল। প্রথম প্রথম ওর বন্ধুদের আনলেও পরে কাস্টমার ধরে আনত। ইলা সে ডক্টরকে ব্যাপারটা জানালে ডক্টর বলেছিল, “মজা তুমিও নাও আর কাস্টমারদেরও দাও। এর মাঝে কিছু টাকা আসলে মন্দ কি?”

একথা শুনে ইলার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। আর এসব থেকে বাঁচতে সুইসাইডের পথ বেঁছে নেয়। পরে ইলার ডায়রি পেয়ে পুলিশ রিককে গ্রেফতার করে। এবং সেই ডক্টরের লাইসেন্স ক্যানসেল করে। ওরা দু’জনে এখন কারাগারে বন্দী। এ ঘটনা শুনে তুরাগ কষ্ট পেলেও কিছু বলল না। আর কি বা বলবে? ইলা তো নিজে ওদের সম্পর্কটা নষ্ট করেছে। তাছাড়া সে তুরাগ বাদে অনেক ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তাদের থেকেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছে। তারপর সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে। আজ ওর লোভ ওকে ধবংস করল।

রনিত থম মেরে ওর কেবিনে বসে আছে। আজ ওর কলিগের থেকে বসের সম্পর্ক অনেক কিছু জেনেছে। বসের বাঙালীদের অপছন্দের কারণ উনার মেয়ে। উনার মেয়ে এক বাঙালী ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। টূরে এসে বসের মেয়ে রোজের সঙ্গে ছেলেটার পরিচয় হয়েছিল। আর সেখান থেকে তাদের প্রেমের সূত্রপাত। আর ছেলেটা বেকার ছিল। তাছাড়া উনাদের সোসাইটির সঙ্গে মানানসইও ছিল না। এজন্য উনি মেয়েকে এই সম্পর্কটা এগোতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মেয়ে উনার কথা অমান্য করেছিলেন। তাই বস রেগে আজ পর্যন্ত মেয়ের খোঁজও নেয়নি। উনার ভাষ্যমতে, ‘যে মেয়ে বাবার সন্মানের কথা ভাবে না। তাকে উনি মেয়ে হিসেবে মানেন না।’ এই ঘটনার পর থেকে বাঙালী ছেলেরা উনার চোখের বিষ। উনার মনে হয় সব বাঙালী এমন ধাঁচের। এটাও
জানা গেছে, ছেলে এখন বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার পদে নিযুক্ত আছে। এসব শুনে রনিত খোঁজ নিয়েছে। এবং জানতে পেরেছ সে ছেলে হচ্ছে পুলিশ অফিসার সায়ন। আর সায়নের বউ রোজের সমস্যা কারণে এখনও ওদের বাচ্চা হয়নি। তাই সে ইচ্ছেকে দত্তক নিতে চেয়েছিল।

এদিকে, দিশা এখনও বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক নয়। সে ভাবে বাচ্চা মানে প্যারা। আর অল্প বয়সে বাচ্চা নিয়ে শারীরিক গঠন নষ্ট করার মানেই হয়না। স্ত্রীর মাঝে আকষর্ণীয় কিছু না থাকলে স্বামী পরনারীতে আসক্ত হয়। রনিতের মাও বার বার বলেন একটা বাচ্চা নিতে। কিন্তু দিশার একই কথা, ‘তার মনমতো সময়ে বাচ্চা নিবে। কারো কথা শুনে সে ডুবতে রাজি নয়।’ এজন্য রনিতের আম্মুর আর কিছু বলেন না।

চাঁদের এখন আট মাস চলছে। মাঝ রাতে হঠাৎ পেটের ব্যাথায় ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। বাচ্চাটা মনে হচ্ছে স্বজোরে কিক মেরেছে। আর ব্যাথাতে সে কুঁকিয়ে উঠেছে। প্রিয়ম আলতো করে চাঁদের পেটে হাত বুলিয়ে হেসে বলল,”এমন করে না সোনা বাবা টা! আম্মু তো ব্যাথা পাচ্ছে।” একথা বলতে বলতে আরেকটা লাথিতে চাঁদ প্রিয়মের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। প্রিয়ম আর এই কাহিনীর বিচার করতে পারল না। সে হেসে চাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

প্রত্যয় সারাদিন হসপিটালে থাকে। কিন্তু ওর মন তুয়াতে সীমাবদ্ধ । সারাদিনে কতবার খবর নেয় তার হিসেবে নেই। রাতে প্রত্যয় তুয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ তুয়া প্রত্যয়ের বুকে বমি করে দিল। প্রত্যয় দ্রুত উঠে তুয়ার কপালে চেপে ধরে মুখ মুছিয়ে পানি খাওয়াল। কিছুক্ষণ আগে তুয়া একটা আপেল খেয়েছিল। সেটাই এখন তুলে দিল। প্রত্যয় তুয়াকে সোফাতে বসিয়ে বেডশীট বদলে শুইয়ে দিল। আর নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে হালকা কিছু খাবার আনল। তুয়াকে খেতে দিলে সে কেঁদে কেঁদে বলল,”খুব জ্বালাচ্ছি সবাইকে। সারাদিন কষ্ট করে রাতেও আমার জন্য ঘুমাতে পারছ না। আমার না মরে যেতে ইচ্ছে করছে।” প্রত্যয় মৃদু হেসে তুয়ার কপালে আদর দিয়ে বলল,”ধুর পাগলি! কষ্ট না করলে বাবা হওয়ার যায় না। আর আমার সোনা বউটার কষ্টের কাছে আমার কষ্ট কিছু না।” তুয়া আদুরে বাচ্চার মতো প্রত্যয়ের বুকে চুপটি করে পড়ে রইল। আর প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার মাথাতে হাত বুলাতে লাগল।

সবার আদর ভালবাসা আর যত্ন নিয়ে দিনগুলো কেটে গেল।
আর নিদির্ষ্ট সময়ে সুষ্ঠুভাবে চাঁদের মেয়ে প্রিয়। আর তুয়ার ছেলে প্রাণের আগমন ঘটল। চাঁদের ডেলিভারির দিন প্রিয়ম টেনশনে প্রচন্ড অস্থির ছিল। সে পারছিল না চাঁদের সব কষ্ট এক নিমিষে মুছে দিতে। চাঁদের চিৎকার যেন প্রিয়মের কলিজায় গিয়ে বিঁধছিল। তারপর কষ্টের সীমানা অতিক্রম করে প্রিয় উচ্চশব্দে কেঁদে উপস্থিতি জানান দিল। প্রিয়ম ছোট্ট প্রিয় কে বুকে জড়িয়ে ধরে সবার সামনে কাঁদল। বাবার হওয়ার অনুভূতি এতো মিষ্টি ওর জানা ছিল না। প্রিয়মের কান্না দেখে ছোট্ট প্রিয় ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। মেয়ের তাকানো দেখে প্রিয়ম কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল। আর ভাইয়ের এমন কান্ড দেখে প্রত্যয় মৃদু হেসে চোখ জুড়াচ্ছিল।

তুয়ার বেলায় তুয়া প্রত্যয়কে ছাড়া ওটিতেই ঢুকতে চাচ্ছিল না। ওর একটাই কথা ছিল,’জানিনা আমার সঙ্গে কি ঘটবে? আমি সব অবস্থাতে তোমাকে চাই।’ সেদিন প্রত্যয় তুয়ার কথা মতো ওটিতে থাকতে ঢুকেছিল। ডেলিভারীর সময় তুয়ার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। কিছুতেই ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছিল না। প্রত্যয় শান্ত থাকলেও বোঝাতে পারেনি ওর বুকের তোলপাড়। তুয়ার আত্মনার্দ প্রত্যয়ের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তবুও ওর প্রচেষ্টা এবং কাজ থামায়নি। প্রত্যয় ওর ছেলের নাড়ি নিজে কাটল। আর এই অদ্ভুত সুন্দর অনুভুতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। প্রত্যয় শুভ্র তোয়ালে পেঁচানো ছেলের কপাল আদর দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,”আসসালামু আলাইকুম সোনা বাবাটা। সুন্দর এই পৃথিবীতে তোমাকে সু-স্বাগতম।”

ছেলের বাবার কথা বুঝতে না পারলেও চোখ খুলে বাবাকে দেখল। কিছুক্ষণ পর তুয়াকে কেবিনে দেওয়া হল। একে একে সবাই দেখা করে যাওয়ার পর প্রত্যয় তুয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,”প্রচন্ড ভালবাসি তোমাদের।” তুয়াও দূর্বল গলায় প্রত্যুত্তরে বলল, “আমরাও বাবুর আব্বু।”

এদিকে, ইচ্ছের আবদার ছিল প্রত্যয়ের পর সে প্রাণকে আগে কোলে নিবে। প্রিয় কে নিতে পারেনি সেদিন ওর পরীক্ষা ছিল। তাই প্রত্যয় প্রাণকে ইচ্ছের কোলে তুলে দিল।ছোট্ট প্রাণের কান্না দেখে সেও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল। ইচ্ছে
প্রাণের দিকে তাকিয়ে কেঁদে বলল, “আমার ছোট্ট পাখিটা কাঁদিস না। আমি তোকে চানাচুর খাইয়ে তাড়াতাড়ি বড় করে তুলব।”

তিন বাচ্চার হাসি কান্নাতে প্রত্যয়দের বাসাটা গমগম করছে। ইচ্ছে প্রত্যয়ের চাওয়াটা রেখেছে। সে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তাই প্রিয়ম ইচ্ছেকে স্বর্ণের প্রজাপতি লকেট উপহার দিয়েছে। আর প্রত্যয় চাঁদ তুয়ার মতো একই বেসলেট উপহার দিয়েছে। ইচ্ছের বেসলেটের মাঝখানে ‘ইচ্ছেমণি’ লিখা আছে। ইচ্ছে বেসলেট টা আর হাত থেকে খুলেনি! বরং সব সময় হাতে পরে থাকে। প্রত্যয়ের আব্বু ইচ্ছেকে দারুণ একটা ড্রেস দিয়েছে। ইচ্ছে ওর মডেলিং শো এর টাকা দিয়ে প্রান ও প্রিয় কে ড্রেস আর স্বর্ণের চেইন উপহার দিয়েছে। আজকে পার্ট নিয়ে কিছু বলুন। আর পরবর্তী অর্থাৎ সমাপ্ত পার্টের জন্য অপেক্ষা করুন, ধন্যবাদ।

আর এভাবে হাসি খুশিতে কেটে গেল আরো কয়েকটা মাস।
কিন্তু হঠাৎ দিশার আগমনে সবার মনটা বিষিয়ে গেল। দিশা যুক্তি আর আবদার শুনে সবাই থমকে গেল। প্রত্যয় প্রিয়ম তখন বাসায় ছিল। ওরা তখনও বুঝতে পারছিল না দিশার উপস্থিতির কারণ। তুয়া কিছু বলার আগে দিশা হাউমাউ করে কেঁদে প্রত্যয়ের পা জড়িয়ে ধরল। দিশার এমন কাজে সবাই হতবাক। প্রত্যয় দ্রুত ওর কোলে থাকা প্রিয় কে তুয়ার কোলে দিয়ে দিশার থেকে ওর পা ছাড়িয়ে নিল। এবং দিশাকে তুলে সোফাতে বসাল। এদিকে ছোট্ট প্রিয় প্রত্যয়ের কোলে যাবে বলে কান্না জুড়ে দিয়েছে। সে আবার প্রত্যয়ের অন্ধভক্ত। প্রত্যয় প্রিয়কে কোলে নিতেই প্রিয় থেমে গেল। অপর সোফাতে চাঁদের কোলে তখন প্রান ঘুমাচ্ছিল।

সবার দৃষ্টি তখন দিশার দিকে। দিশা সবার দৃষ্টির মানে বুঝে কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বলল,

“ডক্টর বলেছে আমি কখনও মা হতে পারব না। দয়া করুন আমাকে! প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমি দুই হাত পেতে আজ সাহায্য চাইতে এসেছি। ইচ্ছেকে আমি নিতে এসেছি ভাই, প্লিজ।”

To be continue….!!

গল্প নিয়ে আলোচনা বা আড্ডা দিতে জয়েন হন:-
📚 Nurzahan’s Family 📚 (আড্ডাঘর)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here