-‘এলোকেশী কন্যা’-
[২৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
রোদের এমন লুকোচুরির আড়ালে কেটে আরো তিন’টে দিন। এই তিনদিনে আলো চাইলেও রোদের সঙ্গে কথা বলতে পারে নি। মেঘকে একদন্ড কাছে পায় নি। তোতাপাখির মতো করে মেঘ বউমনি বলে ছুটে আসে নি। রোদ সেই সুযোগই দিচ্ছে না। ওর ফোনও ধরে না। গতকাল রাতে রোদ নাকি রাকাকে কড়া ভাবে জানিয়েছে, ‘আলো ভুলেও যেন ওর অফিসের না যায়, তাহলে খুব খারাপ হবে।’
এই তিন’টে দিন ওর কেমন গেছে কেবল সেই জানে। অস্বস্তি আর অভিমান ওকে জাপটে ধরেছে। যার ভরসায় এসেছিল এখন সেই এমন করছে। কোন লজ্জায় এখানে থাকবে ভেবে পাচ্ছে না। ঠিক এই কারণে আলো এখানে আসতে চাচ্ছিল না। সে জানত, ওর সঙ্গে ঠিক এমনটাই হবে। কয়েকদিন পর সবার কাছে সে বোঝা হয়ে যাবে। হলোও তাই! ওর ভয়টাই সত্যি হলো। রোদ ওকে সহ্য করতে পারছে না বিধায় এড়িয়ে চলছে। মেঘকেও কাছে আসতে দিচ্ছে না। ওর তৈরী খাবার খাচ্ছে না। রোদ কী জানে না এসবে আলো খুব কষ্ট পাচ্ছে, সে পারছেনা ওর অবহেলা সহ্য করতে। মেয়েটা ওদের ভরসা করেই আবার বাঁচতে চেয়েছে। কান্না, খাওয়াতে অনিহা, রাত জাগা, চিন্তামগ্ন, সব মিলিয়ে ওর শরীর’টা খুব খারাপ যাচ্ছে। শরীরে জ্বরও আছে। আলো আজ সকালে উঠে নি, খায় নি, কলেজেও যায় নি। নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। রাকা কয়েকবার ডেকেও তুলতে পারল নি। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
রোদ মেঘকে স্কুলে রেখে ফোন’টা সাইলেন্ট করে মিটিংয়ে ব্যস্ত। আজকে মিটিং’টা একটা রেস্টুরেন্টে হচ্ছে, ওর সাথে আকাশও আছে। রাকা রোদকে বেশ কয়েকবার কল করেও পেলো না। পরে রবি অফিসে ফোন করে জানল; রোদ এখন মিটিংয়ে ব্যস্ত। আজ আর অফিসে আসবে না। জুরুরি কাজে বাইরের যাবে, ফিরতে অনেক রাত হতেও পারে। রাকা আর কিছু অপেক্ষা করল। সেকেন্ডের কাটাও টিকটিক করে সময় গড়াতে লাগল। অর্ধদিন পেরিয়ে গেল তাও আলো বের হচ্ছে না। রাকা বসে না থেকে রবি আর সাগরকে ডেকে কাঠমিস্ত্রি অথবা চাবিওয়ালাকে ডেকে আনতে বলল। ওর দরজার লক ভাঙ্গতে হবে, এভাবে বসে থাকলে হবে না। অনেক খুঁজে রবি একজন কাঠমিস্ত্রিকে এনে রুমের লক ভাঙ্গতে সক্ষম হলো। রাকা দ্রুত রুমে ঢুকে দেখে আলো জ্বরে অবচেতন হয়ে পড়ে আছে। ফর্সা মেয়েটা মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। রাকা রবিকে ডাক্তারকে খবর দিতে বলে ওয়াশরুমে ছুটল পানি আনতে।
পানির ছিঁটা এবং কিছুটা নিঃশ্বাস রোধ করে আলোর জ্ঞান ফিরল। জ্বরের উত্তাপে ওর শরীর ঘেষে বসা যাচ্ছে না।রাকা আলোকে উঠে বসিয়ে একটু পানি খাওয়াল। রুমাল ভিজিয়ে
কপালে জলপট্টি দিতে দিতে বলল,
“কষ্ট হচ্ছে?”
”না আপু।”
এতটুকু বলে আলো চোখ বন্ধ করে জীবনের হিসাব কষতে লাগল। ওর এই ছোট্ট জীবনে শূন্যতার সংখ্যা বেশি। এসবই হয়তো ওর প্রাপ্য! তবু আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।
আররাকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এমন মুখচোরা মেয়ে সে খুব কম দেখেছে। এত জ্বরেও নাকি কষ্ট হচ্ছে না। কাউকে বলেও নি।
এমন কেন মেয়েটা? একটুপরে, রবি রোদের পরিচিত ডাক্তার এনে আলোকে দেখাল। ডাক্তার জ্বর মেপে ওষুধ দিয়ে বিদায় নিলেন। রাকা আলোকে নাস্তা করিয়ে নিজে ওষুধ খাওয়াল।
রাকা ওর শরীর মুছে জলপট্টি দিতে থাকল।আলো চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঘুমিয়েও গেল। ওকে ঘুমাতে দেখে রাকা হাফ ছেড়ে বাঁচল। আলোর জন্য খু্ব চিন্তা হচ্ছিল।ওদিকে আকাশ মেঘকে নিয়ে ওর বাসায় গেল। আজ মেঘ সারাদিন এখানেই থাকবে। জুরুরি কাজে রোদকে নাকি ঢাকার বাইরে যেতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য। এজন্যই মেঘ এখানে! আকাশের ভাগ্নে রিফাতকে পেয়ে মেঘ খেলায় মজে গেছে। দু’জনে সমবয়সী আর মিশুকও বটে। মেঘ এর আগেও রিফাতের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। রিফাত ওর ভালো বন্ধু। খেলার ছলে মারলেও কিছু বলে না। বরং মুখ কাঁচুমাচু করে রিফাতই উল্টে সরি বলে। এজন্য রিফাতকে মেঘ পছন্দ করে। আজ অনেকদিন পর রিফাতকে পেয়ে মেঘের আর কিছু লাগবে না। খেলার সঙ্গী বলে কথা। আকাশ খেলার ছলে দু’জনকেই খাইয়ে দিলো। দু’জনে কার্পেটের উপরে বসে নানান রকমের খেলনা নিয়ে খেলছে। একটুপরে বিপত্তি’ও বাঁধল। মেঘ প্লেন নিবে আর রিফাত দিবে না। আর এই নিয়ে দু’জনে ফিসফিস করছে। আকাশের জন্য মেঘ কিছু বলতেও পারছে না। তাই মেঘ রিফাতকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল,
“প্লেন না দিলে আমি আমার পোষা ভূতকে দিয়ে তোকে মার খাওয়াব। এমন মার মারবে তুই মুতু করে দিবি।”
রিফাত চোখ বড় বড় তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল,
“তোর ভূত আছে? কী কালারের ভূত রে? ওদের নাম কি?”
মেঘ মুখ বাঁকিয়ে একটু ভাব নিয়ে উত্তর দিলো,
“হাওঝাও ভূত, ঝুনঝুনি ভূত, ঘুরান্টি ভূত, টিউপিউ ভূত,ঘন্টি ভূত, এমন আরো অনেক আছে। তবে তোর মতো বেদ্দপকে সব বলা যাবে না।”
রিফাত ভয়ে ঢোক গিলে প্লেনটা মেঘকে দিয়ে দিলো। ভূতকে সে প্রচুর ভয় পায়। ওদের নামগুলোও সব ভয়ওয়ালা, বাবা!
তারপর দু’জনে আবার খেলায় মন দিলো। গুটিগুটি পায়ে সময় গড়িয়ে দুপুর হলো তারপর এলো বিকালের আগমন।
কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সন্ধ্যা নামতেও বিলম্ব করল না। আর
এখন বাজে রাত নয়’টা আটত্রিশ। লাইটের ঝলকানিতে রাত এখন দিনের মতো পরিষ্কার। আলো কেবল গোসল সেরে ওর বেলকনিতে বসল। ঘামে শরীর চ্যাট চ্যাট করছিল এখন বেশ লাগছে। জ্বরটাও নেই!আলোর দৃষ্টি এখন আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে। মিটিমিটি করে নক্ষত্র গুলো আকাশের বুকে নিদারুণভাবে জ্বলছে। দেখতে বেশ লাগছে। আচমকা হর্ণের শব্দে আলোর ভাবনার ছেদ ঘটল। সে কিছুটা চমকে উঠে সদর দরজার দিকে তাকাল। একটা সাদা গাড়ি গেট দিয়ে প্রবেশ করছে। এটা রোদের গাড়ি! অন্ধকার বেলকনিতে বসে আলো উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। তখন ঘুমন্ত মেঘকে বুকে নিয়ে রোদ গাড়ি থেকে নেমে বাসায় প্রবেশ করল। মেঘ কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে! ঘুমাবেই তো সারাদিন খেলে, বকবক করে, দুষ্টুমি করে, সে বড্ড ক্লান্ত। রোদ বাসায় ঢুকে রাকার সঙ্গে কথা বলে ওর রুমে চলে গেল। মেঘকে শুইয়ে সে ফ্রেশ হয়ে নিচে খেতে গেল। রিফাত, মেঘ, দু’জনেই নাকি একসাথে খেয়েছে। সারাদিন খেলায় মজে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছে।
রাকা আলোর রুমের দরজা নক করে জানাল, রোদ খেতে ডাকছে। আর দুই মিনিটের মধ্যেই যেতে হবে। রাকার কথা শুনে আলো নিঃশব্দে নিচে গিয়ে রোদের থেকে দুরত্ব নিয়ে বসল। ভেজা চুল দেখেও রোদ কিছু না বলে খেয়ে উঠে চলে গেল। ওকে যেতে দেখে আলো মাথা নিচু করে মলিন হাসল।
তারপর অনিচ্ছায় সত্ত্বেও দু’লোকমা খেয়ে ছাদে চলে গেল। এখন থাকা’টা খুব প্রয়োজন। আলো ছাদের দোলনায় দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। নিরবে অশ্রু ঝরে ওর হাতের কব্জি বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওর বেহায়া চোখ দু’টো অকারণে অশ্রু ঝরাচ্ছে। এই কান্নার না আছে শব্দ আর না আছে আতনার্দ। তখন ওর পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠল,
“কাঁদছ? কিছু হয়েছে?”
খুব পরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আলো পাশ ফিরে তাকাল।
রোদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে। এতকিছুর পর কী সুন্দর ভাবে জিজ্ঞাসা করছে, ‘কিছু হয়েছে?’ এটা মানুষ নাকি রোবট? একরাশ অভিমান নিয়ে আলো অন্য দিকে তাকাল। আজ প্রায় চারদিন রোদ ওর সঙ্গে কথা বলছে। অথচ এই কয়েকদিন ওর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে নি। উনি আসলেই অনুভূতিহীন মানুষ একটা। আলোকে চোখ মুছতে দেখে রোদ বলল,
“কোনো কিছু অভাব তো রাখি নি তাহলে কাঁদছ কেন? আর কেনই বা এত অভিমান, হুম?”
একথা শুনে আলো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে তেজী গলায় উত্তর দিলো,
“জুতা মেরে গরু দান করতে এসেছেন? চেয়েছি বিলাসিতা?
সব দিয়ে কুকুরের মতো ব্যবহার করে জানতে এসেছেন, কী হয়েছে? আপনি অনেক উপকার করেছেন, দয়া করে আর
একটা উপকার করেন। আপনার পা ধরছি, আর একটাবার দয়া করুন আমাকে।”
কথাগুলো বলতে বলতে আলো রোদের পা ধরে বসে পড়ল। রোদ লাফ দিয়ে উঠে ওর পা ছাড়িয়ে নিলো।এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে নাকি? এসবের মানে কী? কী লাগবে সুন্দর করে বললেই তো হয়!রোদ ওকে কাঁদতে দেখে গম্ভীর ভাবে বলল,
“তোমার কান্না দেখতে এখানে আসি নি। যা বলার মুখে বলো নয়তো গেলাম।”
আলো চোখ মুছে উত্তর দিলো,” আমাকে রাঙামাটি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এখানে আমি আর একমুহূর্তও থাকতে চাই না।”
“কেন?”
“জানি না। আমি রাঙামাটি যেতে চাই, ব্যস! কারো দয়া নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না। কারো অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতাও আমার নেই।
আলোর কথা শুনে রোদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ” অবহেলা? তা কে করল অবহেলা?”
রাগে ক্ষোভে আলোর চোখ ফেটে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগল। সে কথা বলতে পারছে না। রোদের এমন ব্যবহার ওর কাছে অপমান মনে হচ্ছে। সব জেনে রোদের কথাগুলো ওর শরীরে সূচের মতো বিঁধছে। আলো সহ্য করতে না পেরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সে এই মুহূর্তেই এখান থেকে বিদায় হবে। দরকার হলে নিজের ইচ্ছায় গাড়িতে নিচে চাপা মরবে, তবুও আর এখান থাকবে না। অনেক হয়েছে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। হঠাৎ হাতে টান পড়াতে আলো থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রোদ ওর হাত ধরে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাব যেন সে কিছু করেই নি। আলো হাতটা ঝাড়া মেরে প্রচন্ড রেগে রোদের বুকে ধাক্কা মেরে বলল,
“সমস্যা কী আপনার? আর কত অপমান করবেন আমাকে?
গরীব বলে কী মানুষ মনে হয় না? নাকি ভাবেন যে গরীবদের অপমানবোধ নেই।”
রোদ মিটিমিটি হেসে ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলো। ওর হাসি দেখে আলোর রাগটা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। ওর কথা শুনে রোদ হাসছে। ওর কান্না দেখে রোদের খুব হাসি পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ওর, রোদের এই ব্যবহার কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আলো ওখানে বসে মাথা নিচু করে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের পানির ফোঁটাগুলো ছাদের মেঝেতে জমা হতে লাগল। কষ্টগুলো যত তীব্র হচ্ছে কান্নাগুলো জটলাবেঁধে অশ্রু হয়ে ঝরে যাচ্ছে। রোদ আলোর পাশে বসে চুপ করে ওর কান্না দেখতে লাগল। ওর কাছে ভালোই লাগছে। রোদ ওকে না নিষেধ করল, আর না থামানোর চেষ্টা করল। আলো উঠে চলে যেতে চাইলে এবারও পারল না। রোদ যেতে দিচ্ছে না! অর্থাৎ কাঁদবে খুব ভালো কথা। আমার সামনে বসে কাঁদো। আলো কামড় দিয়ে হাত ছাড়াতে চাইলে রোদ ‘উফ’ শব্দ করে অন্য হাতে ওকে আটকাচ্ছে। ওর ব্যবহারে আলো না পারছে সহ্য করতে, আর না পারছে স্থান ত্যাগ করতে। সে দাঁড়িয়ে শুধু ফুঁপাচ্ছে!
To be continue………….!!