‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
চাঁদ নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলল, “পাপীর শাস্তি! আর প্রিয়মের মুক্তি।” প্রত্যয় চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,”প্রিয়মকে ছাড়া থাকতে পারবে? কষ্ট হবেনা?”
কথাটা শুনে চাঁদ প্রত্যয়ের পা ধরে হাউমাউ করে কাদঁতে লাগল। প্রত্যয় দ্রুত চাঁদকে উঠিয়ে বসিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,” সবার জীবন কাহিনী এক নয় চাঁদ? সুখ দুঃখের সুতোয় বাঁধা আমাদের এই জীবন। একটা মানুষ আঘাত পেলে সময়ের পরিবর্তনে নিজেকে সামলে নিতে পারে। কিন্তু মানুষটা যখন সব আঘাত গুলো একসঙ্গে পায়। তখন তার উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা থাকেনা। আমার ভাইটাও তার ব্যাক্তিক্রম নয়। ওকেও ওর ক্ষতটা সারানোর একটু সময় দাও!”
চাঁদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে চোখ মুছে বলল, ” আমাদের সঙ্গে হওয়া অপরাধের শাস্তি চাই ভাইয়া। প্লিজ! প্লিজ আপনি কিছু করুন। নাহলে ইচ্ছের মতো আরো বাচ্চাদের এতিম হতে সময় লাগবেনা।” এর মধ্যে ইচ্ছের কথা শুনে প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। চাঁদ ঢোক গিলে নিচু স্বরে বলল,”মাহিম আমার ভাইয়ার ঘনিষ্ট বন্ধু। ওরা দু’জনেই কয়েক বছরে ধরে এসব কাজে লিপ্ত।”
কথাটা শুনে প্রত্যয় আর প্রত্যুত্তর করল না। চাঁদ ওর ভাইয়া রাশেদ এবং মাহিমের কুকর্মের কথা বলতে লাগল। সবটা শুনে প্রত্যয় শান্ত কন্ঠে বলল,”একথা আর কাউকে জানিও না চাঁদ। সময় হলে আমি সবাইকে জানাব।” চাঁদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে উঠে চলে গেল।
প্রত্যয় রনিতকে ফোন করে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করল। প্রত্যয়ের আলোচ্য বিষয় ছিল ইচ্ছেকে নিয়ে। রনিত প্রত্যয়ের পুরো কথা শুনে অবাক এবং দ্বিমত জানাল। এই নিয়ে দু’জনের বেশ কিছুক্ষণ কথা চলল। একপর্যায়ে প্রত্যয়ের যুক্তিতে হার মেনে রনিতকে সম্মতি দিতে হলো। আর প্রত্যয় কল কেটে ট্রাক ড্রাইভারদেরকে দু’টো বাসার ঠিকানা দিল। একটাতে, ইচ্ছেদের সব ইলেকট্রনিক জিনিস আর আরেকটাতে সব আসবাবপত্র। ইলেকট্রনিক জিনিস বিনা ব্যবহারে নষ্ট হয়ে যায়। অযথা জিনিস গুলো নষ্ট না করে রনিতরাই ব্যবহার করুক। এটা ভেবে ইলেকট্রনিক জিনিসগুলো প্রত্যয় রনিতদের বাসায় পাঠাল। আর ইচ্ছের আম্মু শখের আসবাবপত্র সব প্রত্যয়দের আগের ফ্ল্যাটে তোলা হলো। সেগুলো সহজে নষ্ট হবেনা। এগুলোর রাখার পেছনে একটা কারণ আছে। যাতে ইচ্ছে বড় হয়ে অভিযোগ করতে না পারে, ওর আম্মুর জিনিস কেন অন্যদের দিল? কেন প্রত্যয় আমানত হিসেবে রাখল না? আর ইচ্ছের আম্মু জিনিসে শুধু ইচ্ছের অধিকার। তাই প্রত্যয়ের এই ব্যবস্থা। যাতে ইচ্ছে বুঝতে শিখে ওর আম্মু জিনিস গুলো ছুঁয়ে দেখতে পারে।
প্রত্যয় নিচে গিয়ে রেডি হয়ে সরাসরি ব্যাংকে গেল। ইচ্ছের আব্বু আম্মুর টাকা, গয়না, এবং জমির দলিল ব্যাংকের লকারে রাখল। এবং ইচ্ছের আঠারো বছরের আগে ইচ্ছে ছাড়া অন্যকেউ এসব তুলতে পারবেনা। প্রত্যয় সেই ব্যবস্থাও করল। তারপর ব্যাংকের কাজ সেরে সে হসপিটালে চলে গেল। সন্ধ্যার পর, প্রিয়ম ইচ্ছেকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে এসেছে। পুরো পার্কে আরো অনেক মানুষ আছে। হরেক রকম লাইটের ঝলকানিতে পার্কটা দারুণ লাগছে দেখতে। ইচ্ছে কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে প্রিয়মকে বলল,”প্রিউুম প্রত্তুয়কে এতটু ফুন কলো।” প্রিয়ম সময়টা দেখে বলল,”ভাইয়া তো এখন হসপিটালে এখন মনে হয় ব্যস্ত আছে।” ইচ্ছে ভ্রু দু’টো কুঁচকে চোখ বড় বড় করে বলল,”ফুন দিতে বলেচি।”
প্রিয়ম ভয় পাওয়ার ভাণ করে মুখ কাচুমাচু করে বলল,”দ দি দিচ্ছি তো!” প্রিয়মের মুখ দেখে ইচ্ছে খিলখিল করে হাসতে লাগল। প্রত্যয় এই সময় প্রিয়মের কল পেয়ে ব্যস্তাতার সুরে বলল,”প্রিয়ম একটু পরে ফোন দিচ্ছি।” ইচ্ছে তখন ওর বুকে নিজে থাবা দিতে দিতে বলল,”আমি! আমি! আমি লাজকন্যা ইচ্ছে।” ইচ্ছের কথা শুনে প্রত্যয় মৃদু হেসে বলল,”রাজকন্যা আমি এখন একটা দুষ্টুকে সূচ দিচ্ছি। একটুপরে তোমার সঙ্গে কথা বলি!” সূচের কথা শুনে ইচ্ছে বলল,”আচ্চা শুনো তুমি একটা সূচ আনবা। আমি প্রিউুমকে সূচ দিব। প্রিউুম আমাল একটা কথাও শুনে না।” প্রত্যয় হেসে ‘আচ্ছা’ বলে কল কাটল। প্রিয়ম কথাটা শুনে ইচ্ছেকে দৌড়ানি দিল। আর ইচ্ছে খিলখিল করে হেসে ঘাসের উপর দৌড়াতে লগাল।
পরেরদিন সকালে রনিতকে বাসার সামনে মাল ভর্তি ট্রাক এসে থেমেছে। দিশার তো খুশির অন্ত নেই। সে দৌড়াদৌড়ি করে জিনিস গুলো আস্তে ধীরে নামাতে বলছে। কোথায় কোনটা রাখবে জায়গা ঠিক করে দিচ্ছে। দিশার দিকে তাকিয়ে রনিতের আম্মু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পলকের জিনিস গুলোও দিশা নিয়েছে। এখন ইচ্ছের আম্মুর এতোগুলো জিনিসও সে পেল। মাঝখান থেকে সব ওর। কালকে বিকালে প্রত্যয় রনিতকে এসব বিষয়ে কথা বলেছিল। রনিত ওর বাসায় একথা জানানোর পর দিশা সারারাত ঘুমাতে পারেনি। কখন ট্রাক আসবে সে সেই অপেক্ষাতেই ছিল।কয়েকজন মিলে একে একে সব জিনিস নামাল।
দিশা জিনিসগুলো চেক করে হঠাৎ চেঁতে গেল। ইলেকট্রনিক জিনিস ছাড়া কিছু না দেখে রেগে ওর শাশুড়িকে বলল,” ওই ডাক্তার খুব চালাক দেখলেন আম্মা। দামী দামী জিনিসগুলো নিজে নিয়ে। আমাদের কি সব হাজিবাজি দিয়েছে।”
রনিতের আম্মু ইশারায় দিশাকে থামতে বলছেন। কিন্তু দিশা থামছেনা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। রনিত তখন ভিডিও কলে ওর আম্মুর সঙ্গে কথা বলছিল। সে সবটাই শুনে ফোনটা দিশাকে দিতে বলল। দিশা কিছু বলার আগে রনিত বলল,” লোভটা কমাও! আজ মরলে কাল দু’দিন। বাপের জন্মে এসব জিনিস চোখে দেখেছ? যে এখন বড় বড় লেকচার দিচ্ছ! ওই ডাক্তারের নখের যোগ্যও তুমি নও! তাহলে কোন বিবেকে উনার দিকে আঙুল তুলছ?” দিশা রেগে বলল, “আমরা কি দান চেয়েছি? কে বলেছে উনাকে মহান হতে?” রনিত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “মহান হতেও মন লাগে। তোমার তো তাও নেই।” দিশা ফোনটা ওর শাশুড়ির হাতে দিয়ে চলে গেল। আর রনিত রেগে সঙ্গে সঙ্গে কল কাটল। রনিতের আজ মনে হচ্ছে, দিশা অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। নাহলে অবুজ বাচ্চাটার কথা না ভেবে জিনিসপত্রের কথা ভাবে!
দুইদিন আগে তুরাগ তিন্নিকে নিয়ে সাজেক ঘুরতে গেছে। ইলার সঙ্গে দেখার হওয়ার পর ওর মনটা বিগড়ে গিয়েছিল। ওর শুদ্ধ বাতাস আর একাকী পরিবেশের প্রয়োজন ছিল। ছেলের সিধান্তে তুরাগের আব্বু আম্মু সম্মতি দিয়েছে। কারণ ছেলে মেয়ের খুশিতে উনারা খুশি। যদিও তুরাগ তুয়াকে যেতে বলেছিল। তুয়ার পরীক্ষা, প্রত্যয়ের হসপিটাল আবার ইচ্ছেকে নিয়ে ওর ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। তাই তুয়া তিন্নিকে নিয়ে ঘুরে আসতে বলেছে।
বিকালে, প্রত্যয় ওটি থেকে বের হয়ে ওর চেম্বারে যাচ্ছিল। তখন সায়ন ওকে ফোন দিয়ে জানাল মাহিম এখন লকাপে।
সে একটা গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। মাহিমকে ধরে সায়ন নাকি ইচ্ছেমতো মেরেছে। মাহিমের বউও লকাপে আর ওদের বাচ্চাটা পুলিশ কাস্টাডিতে। প্রত্যয় সায়নকে রাশেদের কথা জানাল। সায়ন ওর মন্ত্রী মামার সাহায্যে ইতালিতে রাশেদের খোঁজে ফোর্স পাঠাল। সাথে গুপ্তচরও পাঠাল। এরা এক একটা নর্দমার কীটের থেকেও জঘন্য। এরা বাইরে থাকা মানে কারো প্রাণনাশ। প্রত্যয়ের কথা, পাওয়ার এবং প্রমানের ভিত্তিতে সায়ন শক্ত হতে কেসটা ধরল।
গুটি গুটি পায়ে সময় দিন এগিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ তুয়ার চারটে পরীক্ষা হয়ে গেছে। দু’জনের মোটামুটি ভালোই পরীক্ষা দিচ্ছে। ইচ্ছে এই কয়েকদিনে দুই একবার ওর আব্বু আম্মুর জন্য কেঁদেছে। ইচ্ছে খুব কাঁদলে ওর আব্বু আম্মুর কবর দেখিয়ে আনা হয়। ইচ্ছে এখন জানে ওর আব্বু আম্মু অসুস্থ। তাই উনারা আল্লাহর কাছে গেছে। আল্লাহ ওর আব্বু আম্মুকে খুব ভালবাসে। ছোট্র অবুজ বাচ্চাটা তাই বিশ্বাস করেছে। সে প্রত্যয় প্রিয়মের জন্য গিয়ে আব্বু আম্মুর কবরে দোয়া করে আসে। কবরে পাতা বা ময়লে পড়লে পরিষ্কার করে। আর বাসায় ফিরার আগে দুই কবরে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,”ধুমাও আব্বু! ধুমাও আম্মু! আল্লাহ তুমাদের অনেক ভালুপাশে। তুমলা মুন খালাপ কলবা না। আমি আদল করছি তুমলা ধুমাও!” প্রত্যয় প্রিয়ম ইচ্ছেকে নিয়ে গেলেই কবর জিয়ারত করে আসে। এখন যতদিন যাচ্ছে, ইচ্ছে প্রত্যয়দের আপন করে নিচ্ছে। ইচ্ছে এখন ওর মনমতো প্রত্যয় প্রিয়মের কাছে ঘুমায়। ওর জন্য সব রুম উন্মুক্ত করা।
প্রিয়ম কয়েকমাস আগে গানের সঙ্গে মডেলিং শো এর অফার পেয়েছে। প্রথমে সে না বললেও পরে প্রত্যয়ের কথাতে রাজি হয়েছে। আজকে প্রিয়মের মডেলিং শো এর ডেট। তাই সকালে রেডি হয়ে সে সেখানে যাচ্ছিল। ইচ্ছে জেদ ধরায় ইচ্ছেকেও প্রিয়ম সঙ্গে নিল। আর প্রত্যয় গেল হসপিটালে। সে দুপুরে আসবেনা এটাও জানাল। চাঁদ তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুর সঙ্গে টুকটাক কাজ করছে। আবার একটু করে পড়ছে। প্রত্যয়ের আম্মু নিষেধ করলেও শুনছেনা। দুপুরের ইচ্ছে প্রিয়ম ফিরল না। বরং ফোন করে জানাল ফিরতে রাত হবে। তাই প্রত্যয়ের আব্বু আম্মুসহ সবাই খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। সন্ধ্যার পরে ইচ্ছেরা ফিরল।সারাদিন দুষ্টুমি করে রাতে খেয়ে ইচ্ছে প্রিয়মের বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে। প্রিয়মও আলতো করে ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাসায় সবার প্রাণ এখন ছোট্র ইচ্ছে। ওর খিলখিল করা হাসি, দুষ্টুমি, অভিমান, দিয়ে বাসাটাকে মাতিয়ে রাখে।
রাতে প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু উনারা বেলকণিতে বসে আছেন। স্বামীকে চিন্তিত দেখে প্রত্যয়ের আম্মু উনার পাশে বসে বললেন,” কিছু হয়েছে তোমার? দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে।” প্রত্যয়ের আব্বু চিন্তিত হয়ে বললেন, “আমার দুই ছেলে ইচ্ছেকে খুব ভালবাসে। তাই বলে ওদের রুমে রোজ ইচ্ছেকে রাখাটা ঠিক হবেনা। ছেলেরা বিয়ে করেছে! তাদের প্রাইভেসি দরকার আর ইচ্ছেও বড় হচ্ছে। চাঁদ তুয়া আজ কিছু না বলছেনা। কাল বলবেনা এর গ্যারান্টি কি? চাঁদ প্রিয়মের সম্পর্ক কেমন আমরা সবাই জানি। এখন ওদের সঙ্গে ইচ্ছে থাকা মানে,, আমি কি বলতে চাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছ? শুধু ইচ্ছে নয় আমাদের সবার কথা ভাবা উচিত।”
প্রত্যয়ের আম্মু স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এতটুকু বাচ্চা বোডিংয়ে থাকতে পারবে? আর তোমার ছেলেরা কি রাজি হবে?” প্রত্যয় আব্বু কিছুক্ষণ থম মেরে বললেন, “সবার জন্য যেটা ভালো হবে আমি তাই করব। আর আমার কথা শুনতে ছেলেরা বাধ্য।”
তখন রাত একটা বাইশ। চাঁদ তখন টেবিলে বসে একমণে পড়ছিল। প্রিয়ম ইচ্ছেকে ওর আব্বুর রুমে রেখে চাঁদকে উঠিয়ে স্বজোরে বিছানায় ধাক্কা দিল। আচানক এমন করাতে চাঁদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রিয়মের এমন ব্যবহারের কারণ চাঁদের অজানা। চাঁদ কিছু বলার আগে প্রিয়ম ওর শার্ট খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে বলল,” আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার খুব শখ তোর, তাই না? আমার ছোঁয়া শরীরের মাখার বড্ড ইচ্ছে তোর? ওকে আজকেই আমি তোর শখ পূরণ করব। ”
To be continue….!!
গল্প নিয়ে আলোচনা করতে জয়েন করুন –
📚 Nurzahan’s Family 📚 (আড্ডাঘর)
এবং যারা পেইজে লাইক দেননি এখনো, তারা পেইজে লাইক দিয়ে ফেভারিট করে রাখুন। তাহলে গল্প পোষ্ট করার সাথে সাথে আপনার নিউজফিডে চলে যাবে।