দেশলাই – ৩য় পর্ব

0
384

দেশলাই – ৩য় পর্ব

বাউন্ডারির দেয়ালে রোজ একটি কালো ফিঙে এসে বসে থাকতে দেখা যায়। জায়গাটি বোধহয় তার ভীষণ পছন্দের। আচ্ছা ওর কাছে কি আমি পরিচিত? অবশ্যই ফিঙেটি আমাকে চেনে। দেয়ালের ভেতরে কয়েকটি পেঁপে গাছ আছে। পেঁপে গাছে নানান ধরনের পাখির আনাগোনা। তবে দুপুর বেলা জানালায় চড়ুই পাখিরা বেশ হৈচৈ করে। বাড়িতে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে উত্তরের এই জানালা।

সেদিন সন্ধ্যার মুহূর্তটি আমার কাছে খুব বেশি নতুন না।
এরকম ঘটনা আমার সঙ্গে অনেকবার রাফসান ভাই করেছে। তবে সবকিছুই শহরে চলে যাবার আগে। তারপর তো সে ভিন্ন এক রাফসান। এর আগে অনেকবার আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে। ধরুন বাড়িতে আমি ইয়ারফোন কানে গুঁজে একা মুভি দেখছি। হঠাৎ রাফসান ভাই কোত্থেকে এসে আমার পাশে শুয়ে পা ওপরে তুলে গলায় নাক ডুবিয়ে দেবে। আমি আর কি করবো তখন? শুধু ‘এই বদমাশ, ছাড়ো, ছাড়ো’ বলে প্রতিবাদ করি। প্রতিবাদ না ছাঁই। যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বনারীরাও প্রতিবাদ করার নামে এভাবে পুরুষদের আরও তাতিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
তারপর ছেড়ে দিয়ে একদম স্বাভাবিকভাবে বলতো, ‘কোন মুভি দেখছিস?’
যেন কিছুই হয়নি। অথচ আমাদের মধ্য প্রেম-টেম কিছুই ছিল না। তবে আমার আর কোনো ভাই না থাকায় আব্বু-আম্মু নানান কাজে তাকে ডাকেন। প্রায় সময় রাফসান ভাইকে দিয়ে আমাকে নানাবাড়ি, খালার বাড়িও পাঠিয়ে দেন। আম্মু অসুস্থ। আব্বু কোনো কাজে ব্যস্ত থাকায় যেতে পারছেন না, রাফসান ভাইকে আম্মুর সঙ্গে ডাক্তারে পাঠিয়ে দেবেন। মাঝে মাঝে বাজার করাও। পরিবারের সঙ্গে এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকায় আমাদের বন্ধুত্ব বোধহয় আরও গাঢ় হয়েছে।
একটা সময় রাফসান ভাইয়ের এইসব প্রেমহীন চুমু আর জড়িয়ে ধরার ব্যাখ্যা আমি খোঁজে পেয়েছি। এই যে অনেক পুরুষ মানুষরা পতিতালয়ে যায়। সেখানে তো ওই নারীকে সে ভালোবাসেনি। ওর সঙ্গে তার প্রেমও নেই। তবুও কীভাবে শারীরিক চাহিদা মেটায়? তারমানে সিনেমা আর উপন্যাসের মতো কেবল প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী এসব করে তা না। বাস্তব অনেক ভিন্ন। এবং সেটা আমরা গোপনে জানি। কিন্তু সেভাবে আলাদা করে ভাবী না। কৈশোরে আমরা যখন এসবের সঙ্গে নতুন পরিচিত হই, তখন খেলার ছলে, কোলাহলে, নানানভাবে সমবয়সীদের সঙ্গে এই জড়াজড়ি, চুমাচুমি হয়। সবার না হোক, যারা এইসব পরিবেশে বড় হয় তারা সভ্য সমাজ আর বড়দের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগুলো করে বেড়ায়। রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে কৈশোরে আমার এরকম সম্পর্ক ছিল। বউ বউ খেলা। পুতুল খেলা। লুকোচুরি খেলা। কত কিছুর ছলে এগুলো আমাদের হয়েছে৷ কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর নিজেদের মধ্যখানে লজ্জা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি। কিন্তু ওইদিন রাতে হঠাৎ রাফসান ভাই চুমু খাবে আমি ভাবিনি। তখন তো আমরা মোটামুটি অনেক বড় হয়ে গেছি। তবে বড় হওয়ার পরও মুখে মুখে সবই গল্প করতাম। যেমন রাফসান ভাইয়ের সবকিছু আমি জানি। তার বন্ধুদের প্রেমের কাহিনী। আমার সব বান্ধবীরও। এজাতীয় সবকিছু নিয়ে আমাদের বড় হওয়ার পরও গল্প হতো। রাফসান ভাইয়ের ব্যাপারে আমি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলি, তাকে আমি ভালোবাসি না। আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম-টেমের সম্পর্ক নেই। শুধু ভালো লাগে এটা বলতে পারি। রাফসান ভাইও আমাকে ভালোবাসেনি। যখন সে পড়ালেখা করতে সিলেট মেসে গিয়েছিল তখন সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। একদিন হোয়াটসঅ্যাপে তার সঙ্গে একটা মেয়ের ছবি দিয়ে বললো প্রেমিকা। আমি আঁতকে উঠেছি। ওইদিন সন্ধ্যায় আমাকে চুমু খাওয়ায় খানিকটা হলেও ভেবেছিলাম রাফসান ভাই হয়তো আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম সবকিছু প্রেমহীন ছিল। মেয়েটির ছবি দেখে আমার কাছে তার থেকে বয়স্ক মনে হলো। তবে দেখতে অনেক রূপবতী। কীভাবে প্রেম হলো জানার জন্য আমি আগ্রহে মরে যাচ্ছিলাম। কল দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘রাফসান ভাই কীভাবে প্রেম করলে? আর মেয়েটি তো তোমার বয়সে বড় হবে।’
সে জানাল, ‘হ্যাঁ বড়োই। অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে আর আমি ইন্টার ফাস্ট ইয়ার।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বলো কি? এটাও সম্ভব? কীভাবে পরিচয় হলো?’

‘ফেইসবুকে ওর বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। তার কাছ থেকে ওর সঙ্গে পরিচয়। আচ্ছা তোকে সবকিছু বাড়িতে এলে বলবো।’

মাস কয়েক পর রাফসান ভাই বকুল পুরে এলো। আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। সে পড়ে ইন্টার ফাস্ট ইয়ার। আমি চলে গেলাম তাদের ওখানে থাকতে। পনেরো-ষোল বছর বয়স। এটা না-কি মেয়েদের জন্য খুব ভয়াবহ সময়। আমি তখন সেই সময় পার করছিলাম। ফুপুর বাড়ি যৌথ পরিবার হলেও আলাদা ঘর। ফুপুরা থাকেন একেবারে মাথায়। সন্ধ্যার দিকে এলো বৃষ্টি। আমি রাফসান ভাইয়ের ঘরে। ফুপু রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। শুরু হলো গল্প। আমি এক অসাধারণ শ্রোতা৷ নিজে বেশি কথা বলি এবং অন্যদের প্রেমের কাহিনী শুনতে সব সময় ভীষণ আগ্রহী। আর শুনেছি প্রথম প্রেমে জগতের সকল প্রেমিকই না-কি নিজের প্রেমের গল্প, প্রেমিকার গল্প করে বন্ধুদের নির্যাতন করতে একপায়ে খাড়া থাকে। সারাক্ষণ তাদের ঠোঁটে ফুটে প্রেমিকার প্রশংসা। ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায় সেদিন এক অসাধারণ গল্পের আসর জমে উঠেছিল।
রাফসান ভাই তাদের প্রেমের কিছুই আমার কাছে আড়াল রাখতে পারেনি। গল্প করায় একটা মজা আছে। এই মজায় তার ভেতর থেকে সবই বের হয়ে গিয়েছিল। একপর্যায়ে প্রেমিকার সঙ্গে একই বিছানার অন্তরঙ্গ ছবি দেখালো রাফসান ভাই৷ ছবিতে কেবল তাদের দু’জনের মুখ দেখা যাচ্ছে না।
রাফসান ভাই কোলে বালিশ নিয়ে পালঙ্কে বসেছে। আমিও দেয়ালে হেলান দিয়ে বসা। তার চোখমুখ ঝলমল করছে। যেন স্বর্গ সুখ হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে৷ প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের প্রেম কীভাবে হলো? আর এতো তাড়াতাড়ি অন্তরঙ্গ ছবি, মেলামেশা। কীভাবে সম্ভব?’

রাফসান ভাই মোবাইলে একটি ফেইসবুক আইডি দেখালো, নাম সুলতানা জান্নাত।
তারপর বলল,
– ‘সুলতানা জান্নাত আমার ফেইসবুক ফ্রেন্ড ছিল। মেয়েটি অনেক ফ্রী মাইন্ডের। আমাদের ইনবক্সে কথা হতো। একদিন জিজ্ঞেস করলাম সিঙ্গেল কি-না। ‘

হাসির ইমুজি দিয়ে বলল,
— ‘কয়েকটা প্রেমিক আছে৷’

বুঝতেই পারছিস কিরকম খোলা মনের মেয়ে।
আমি বললাম,
— ‘এদিকে আমার একটাও প্রেমিকা নাই স্যাড লাইফ।’

সে রসিকাতা করে স্যাড ইমুজি দিয়ে বলল,
— ‘আহারে।’

আমি রিপ্লাইয়ে বললাম,
–‘তোমার কোনো বান্ধবী সিঙ্গেল থাকলে দাওনা পরিচয় করিয়ে।’

সে হাসির ইমুজি দিয়ে বলল,
— ‘তোমরা ছেলেরা কিন্তু অনেক ছ্যাঁচড়া আছো। নতুন মোবাইল বের হওয়ার পর ছেলেরা ভুলবাল নাম্বার তুলে মেয়েদের সন্ধানে কল দিতো, হা-হা-হা।’

আমি আর কি বলবো। তবুও বললাম, –‘আরে এতো কথা না বলে কারও সাথে দাও না সেটিং করিয়ে।’

সে আশ্বাস দিলো,
–‘আচ্ছা আমার এক বান্ধবী আছে প্রেম করেনি এখনও। তবে তোমার সিনিয়র হবে। কাল ওর বাসায় গিয়ে থাকবো। তাকে বলে দেখবো। সে চাইলে তুমি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারবে।’

আমি মহাখুশি হয়ে বললাম,
— ‘ধন্যবাদ বাডি।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here