আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ১৩ পর্ব .

0
132

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৩ পর্ব
.
উঠোন ভর্তি হাঁস-মুরগী। সেতারা বেগম আগলিয়ে ঘরে নিচ্ছেন।
জিসানের রুমের উত্তর দিকে ছোট্ট একটি জানালা। খাটে বসলে সবজি ক্ষেত দেখা যায়। সে আনমনে তাকিয়ে আছে লাল টকটকে একটি টমেটোর দিকে। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খোলার শব্দে জিসান তাকাল।
ছিপছিপে গড়নের একটি ছেলে। গায়ের রঙ শ্যামলা। বিনয়ী চেহারা। মাথা ঠাসা চুল। দরজা খুলেই সালাম দিল,

— ‘আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন স্যার? হারিকেন নিয়ে আসলাম।’

— ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, ভালো আছি। তুমি বোধহয় ময়নুল স্যারের ছেলে পিয়াস, তাই না?’

— ‘জ্বি স্যার।’

— ‘তোমার বাবা কোথায়, দেখছি না যে?’

— ‘আমার ফুপু অসুস্থ৷ উনার আবার সন্তানও নাই। ফুপাও বয়স্ক মানুষ। তাই আব্বা গেছেন হসপিটাল নিয়া।’

— ‘ও আচ্ছা। তুমি শুনলাম ফার্মেসি দিয়েছো? কেমন চলছে?’

— ‘ভালোই চলছে স্যার। ধীরে ধীরে পুরো এলাকার মানুষ জানছে। গতকাল আপনার লজিং বাড়ির মেয়ের জন্য ওষুধ নিতে এসেছিল বক্কর আলী। চেয়ারম্যানের ভাতিজি না-কি অসুস্থ। তারমানে আমার ফার্মেসির কথা পূব পাড়ার মানুষও জেনে গেছে। আল্লা পাকের রহমতে ব্যবসা আরও জমবে।’

চেয়ারম্যানের ভাতিজির অসুখ শুনে জিসানের মনে হল কেউ তার কলিজা শক্ত করে হাতের মুঠোয় নিয়ে ডান-বামে একটা মোচড় দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বিস্ময়ে বলল,

— ‘চেয়ারম্যানের ভাতিজির অসুখ মানে, কি অসুখ?’

— ‘জ্বর-কাশি। ঠোঁটও কীভাবে জানি কেটে গেছে বলল। ব্যথার ঔষুধ দিয়ে দিছি।’

পিয়াস হারিকেন আঙটায় রেখে রুম ত্যাগ করে। জিসানের মনটা ছটফট করতে শুরু হল। অন্তরার জ্বর-কাশি? ঠোঁটও আবার কীভাবে কাটলো? কি করবে এখন সে? লজিং থেকে আসার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। আসার সময় বলে আসতেও পারেনি। কেমন আছে অন্তরা। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ভেজা চোখের সহজ সরল গোলগাল একটি মুখ। বুক থেকে মাথা অবধি কালো ওড়না পেঁচিয়ে রাখা আরবীয় কোনো সুন্দরী রমনী। জিসানের শরীরের লোম যেন দাঁড়িয়ে গেল। ক’দিন থেকে এরকমই হয়। অন্তরার কথা ভাবলেই হাতের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে এই মেয়েটি কি তাকে সম্পূর্ণ দখল করে নিয়েছে? নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে জিসানের। ক্রমশ একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে সে। মেয়েটিকে কি ভালোবেসে ফেলেছে? ঠিক বুঝতে পারে না। কেবল মায়া লাগে৷ ওর জন্য কষ্ট হয়। দেখতে ইচ্ছে করে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টানতে লাগল। কেমন অস্থিরতা। দরজা খুলে বাইরে বেরুল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। গ্রামে সন্ধ্যার পর পরই যেন নেমে আসে ঘন আঁধারে ঢাকা গভীর রাত। ঝি ঝি পোকারা পেছনে বাতি জ্বালিয়ে উড়াউড়ি করছে। নাম না জানা অসংখ্য পোকার ‘খেউ-খিউ’ ডাক শোনা যাচ্ছে। জিসান পায়চারী করে সিগারেট টেনে নানান ভাবনায় ডুবে গেল। চেয়ারম্যান বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল কেন? তাকেই বা লজিং থেকে বের করে দিল কেন? বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া কি এতোটাই বড় অপরাধ? সেই অপরাধের শাস্তি অন্তরাকেও পেতে হচ্ছে কি-না কে জানে!
ওর খোঁজখবরই বা কীভাবে জানবে সে? দেখতেও যে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷ এসব ভাবতে ভাবতে নিজের মাথার চুল ধরে টানছিল। কিছুই ভালো লাগছে না৷
যতদূর জানে বাড়ির পেছনে বাইরের চুলোয় রান্নাবান্না করে অন্তরা৷ উপরে শুধু টিন। চারদিক খোলা। কিন্তু সেখানে যাওয়াটাই বিপজ্জনক। বাড়ির উত্তরে উঁচু দেয়াল। দক্ষিণে কবরস্থান৷ পূবদিকে উঠোন। পশ্চিমে বাড়ির পেছনে বিশাল একটা বিল। লুকিয়ে দেখা করার একটাই সময়, সেটা সন্ধ্যা। আর একটাই পথ সেটি বিল দিয়ে কবরস্থানে যাওয়া। কিন্তু তার দ্বারা সেদিকেও যাওয়া সম্ভব মনে হচ্ছে না। হাওরের রাস্তাঘাট সে চিনে না। কোনদিকে কীভাবে সে বিলের পাড়ে যাবে তাও জানে না। তাছাড়া এতো বিশাল বিল সে সাঁতার কেটে পাড়ি দিবেই বা কি করে? কারো সহযোগিতা দরকার। ময়নুল সাহেবের মতো মধ্য বয়স্ক পুরুষ কি তাকে একটা মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করার জন্য সহযোগীতা করবেন? এদিকে মোবাইলও অফ হয়ে আছে। ময়নুল সাহেব মোবাইল কোথায় চার্জ দেন কে জানে। পিয়াসকে বলে চার্জের ব্যবস্থা করতে হবে।

রাতের খাবার টিফিনে করে রুমে এনেই দেওয়া হল ৷ জিসান ভেবেছিল বলবে,
–‘আমি আপনাদের ঘরে গিয়েই খাব। এখানে পাশের ঘর থেকে বাজে গন্ধ আসছে।’ শেষমেশ বলতে পারলো না৷ বলা ঠিক হবে কি-না ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। পারফিউম থাকলে হয়ে যেত। এখন সেটাও নেই। কোনোভাবে খাবারটা খেয়ে সে শুয়ে গেল। খানিকবাদেই গভীর ঘুম চোখে নেমে এসে পাতা বুঁজে দিল। হঠাৎ করে স্বপ্নে দেখলো সে আর অন্তরা একটি স্কুলের মাঠে হাঁটছে৷ ওর হাত ভর্তি বাচ্চাদের রঙিন চুড়ি। খোলা চুল। পরনে নরম সুতোর খয়েরী রঙের শাড়ি। টাকনু অবধি বৃষ্টির চপচপে পানি জমেছে মাঠে। হাত ধরে দু’জন শব্দ তুলে হাঁটছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস। অন্তরার শাড়ির আঁচল উড়ছে। উড়ছে কাক কালো চুলও। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে যেয়ে পেছনে তাকিয়ে জিসান বারংবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অন্তরা হাতে হালকা টান দিয়ে বলছে, ‘কি হল? দাঁড়িয়ে যাচ্ছ কেন বারবার?’
জিসান আবার হাঁটে। স্বপ্নের ভেতর তার ওইদিনের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। আচমকা দাঁড়িয়ে বলে, ‘ক’দিন আগে স্বপ্নে দেখলাম আমাদের বাসর রাত বাইরে কাটাচ্ছি৷ একটা সবুজ গরু এবং মানুষও দেখেছি। স্বপ্নে তোমার শাড়ি পরনে ছিল। বাস্তবে আজ প্রথম দেখলাম। হালকা স্বাস্থবতী মেয়েদের শাড়িতে দারুণ লাগে।’

অন্তরা ফিক করে হেঁসে বলে,
–‘সবুজ গরু, সবুজ মানুষ। হা-হা-হা। কি অদ্ভুত স্বপ্ন তোমার।’

আবার তারা হাঁটে। খানিক এগুতেই অন্তরা বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ‘জোক জোক’ বলে চিৎকার শুরু করে দেয়।
জিসান ঠান্ডা মাথায় বলল,
— ‘সমস্যা নাই আমি দেখছি। লাফাবে না দাঁড়াও।’

অন্তরা তাকে ধাক্কা দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— ‘তুমি পারবে না, প্লিজ অন্য কাউকে ডেকে আনো।’

জিসান চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সে ছাড়া অন্তরাকে জোক থেকে বাঁচানোর মতো আশেপাশে কেউ নেই৷ তখনই কেঁপে উঠলো ঘুম থেকে। পাশের ঘরের টিনে বোধহয় গরু লাত্থি কিংবা লেজের আঁচড় মারল। এরপর সারারাত চোখে ঘুম এলো না। এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটে গেল। দূর দূরান্ত থেকে মুয়াজ্জিনের মধুর সুরে ভেসে এলো, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান-নাউম।’
তার কাছে সুরটা কেমন অপার্থিব লাগছে। ভেতর নাড়া দেওয়ার মতন সুর। অন্তরা এখন কি নামাজ পড়বে? এক ইশ্বরের ইবাদতে এখন মাথা নত করবে সে? কি মনে করে জিসান উঠলো। দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই ভোরের শীতল হাওয়া ভিজিয়ে দিল শরীর। চারপাশ মেঘাচ্ছন্ন।
এখনও পুরোপুরি ভোরের আলো ফোটেনি। সবজি ক্ষেতের সামনে খানিক্ষণ পায়চারী করলো সে। বদ্ধঘর থেকে সমস্ত নীরবতাকে ফালাফালা করে কাঁপিয়ে তুলছে মুরগীর ডাক। ভোর হলে চিৎকার করে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া তাদের অঘোষিত দায়িত্ব। সবজি ক্ষেতের পশ্চিম পাশে বাঁশ বাগানের মাথা থেকে হঠাৎ কিছু সাদা বগ উড়ে যেতে দেখা গেল। আরেক দিকে কাকের ‘কা কা’ ডাক। সবকিছু জিসানের কাছে কেমন অপার্থিব লাগছে। চাপাকলের দিকে পা বাড়াল নামাজের জন্য অযু করতে। সেখানে গিয়ে কি এক দ্বিধাদ্বন্দে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর অযু না করেই ফিরে এলো নিজগৃহে।
–চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here