আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ১২ পর্ব

0
130

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১২ পর্ব
.
অন্তরার নিচের ঠোঁট ডিমওয়ালা মাছের মতন ফোলে আছে। সেদিন ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। তবুও চিৎকার করে কাঁদতে পারেনি৷ এক হাতে ঠোঁট চেপে গলাকাটা মুরগির মতন যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে ছটফট করেছে। হাত বেয়ে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল। যেন রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।
দিনটি ছিল শুক্রবার। রাশেদা বেগমের পাশের রুমে তখন ময়নুল সাহেব চেয়ারম্যানের সঙ্গে অন্তরার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন। সবকিছু শুনে চোখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছিল। অন্তরা রান্নাঘর থেকে কেবল জানে চাচার রুমে কে একজন এসেছে৷ কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে তার কিছুই সে জানে না। ময়নুল সাহেব তখন বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। অন্তরা না জেনে রান্নাঘর থেকে এসে রাশেদা বেগমকে ফিসফিস করে বলল,
— ‘চাচার কাছে কে এসেছে তার জন্য কি চা বসাবো চাচি?’
রাশেদা বেগম আচমকা অন্তরার চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে বিছানায় ফেলে সুপারি কাটনি দিয়ে আঘাত করে বললেন,
–‘খানকি মাগীর বেটি তোর খদ্দরের দালালকে চা দিবি তাই না? চা দিবি? তা খালি চা দিবি না-কি রুমে নিয়ে শুইতেও চাস? তোর মা তো জাত-ধর্ম ছাইড়া এক জামাইর মাথা খেয়ে তোরে রাইখা আরেকটার লগে চলে গেছে। তুই ভালা হইবি কেমনে?’
সুপারি কাটনি দিয়ে আঘাতটি যেন আঁধারেই করলেন রাশেদা বেগম। চোখে কিংবা নাকে লেগে বড় ধরণের দূর্ঘটনা হতে পারতো। অন্তরা প্রথমে কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিল না। রাশেদা বেগম তখন চুলের মুঠি ধরা। অন্তরা ভয়ার্ত নয়নে তাকিয়ে কি হচ্ছে বুঝার চেষ্টা করছিল। আচমকা ঠোঁটে লাগলো সুপারি কাটনির বাড়ি। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুল। দাঁত অনেকটা ঢুকে গেল ঠোঁটে। যন্ত্রণায় ‘ওমাগো’ করে উঠলো অন্তরা। সায়মা এলো ওর রুম থেকে। চেয়ারম্যান সাহেবও পাশের রুম থেকে এলেন দৌড়ে। এসেই বললেন,
–‘এই কি হচ্ছে এখানে?’
চাচাকে দেখে অন্তরা নিঃশব্দে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে।
রাশেদা বেগম তখন স্বামীর প্রতি আরও চড়াও হলেন,
–‘কি হচ্ছে মানে? এইটা কি বেশ্যাবাড়ি? মাস্টার এই মাগীরে দেখলো কীভাবে? বিয়ের আলাপ কি এমনি দিছে? ওর যোগাযোগ না থাকলে বিয়ে আলাপ দিব? বাবা উনি আমাকে আইসা বলতেছে পাশের রুমে কি চা দেব? আগেই তো সব জানে, বুঝি না এইসব? এই খানকির ঘরের খানকিরে বাড়ি থেকে বাইর কইরা দাও। আমার মেয়েরেও নষ্ট করবো।’

চেয়ারম্যান বউকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ল্যাংড়ি তর মুখ বন্ধ কর।’ তারপর অন্তরার পেছনে লাত্থি মেরে বললেন, –‘পড়তে গিয়া নাগর জুটিয়েছিস, যা এখান থেকে উইঠা। কান্নাকাটির আওয়াজ শুনলে বড় অসুবিধা হইব। যা উঠ।’

অন্তরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে৷ ঠোঁটের আঘাত যেন ব্রেইনে গিয়েও লেগেছ। তবুও সে কোনোভাবে রান্নাঘরে গিয়ে যন্ত্রণায় কেবল চাপা কান্না করতে থাকে।

সায়মা রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। চেয়ারম্যান সায়মার দিকেও চড়াও হলেন,
— ‘তুমিও কম না৷ তোমার জন্যই পড়তে দিয়েছিলাম। আজ থেকে সব বন্ধ। তোমারও পড়তে যাওয়ার দরকার নাই। মাস্টারের ব্যবস্থা আমি করতেছি।’ কথাটি বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

অন্তরা কিছুই বুঝতে পারেনি। ঠোঁটের যন্ত্রণায় কারো কথাও ঠিক খেয়াল করেনি। কেবল শনিবারে জানতে পারে স্যারের লজিং তাদের বাড়িতে আর নেই। তিনি চলে গেছেন। বুকের গহীনে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হল। এই ব্যথা কি বিশেষ মানুষের জন্য হয়? না-কি ছোটবেলায় বাড়িতে মেহমান এসে কয়েকদিন থাকার পর বিদায় বেলায় আমাদের শিশু মনে যে কষ্ট পেতাম সেরকম ব্যথা?
অন্তরা নিজেও বুঝতে পারে না। তবে সবকিছু মরা বাড়ির মতো লাগছে। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টাই যেন অলস দুপুর কিংবা বিয়ের উৎসবের পরের নীরবতা।
অন্তরার রাতে শরীর কাঁপানো জ্বর এলো। জ্বরের সঙ্গে সর্দি কাশি। মাঝ রাতে বারংবার কাশি দেওয়ায় সায়মার ঘুম ভেঙে গেল৷ রাগে মাঝ পিঠে লাত্থি মেরে ফেলল খাট থেকে।
— ‘চিলানের ঘরের চিলান তুই আমার কাছে ঘুমাতে আসিস না। যা এখান থেকে।’

পরেরদিন জ্বর নিয়েও সারাদিন কাজ করতে হল অন্তরার। রাশেদা বেগমের প্যানপ্যানানি আরও বেড়েছে। সেই কখন বললাম গোসল করবো পানি গরম করে দিতে৷ বান্দির এখনও হল না। কাজে তো মন নাই৷ পানি গরম হবে কেমনে।

সাময়ার আচরণে কিছুদিন যে পরিবর্তন লক্ষণীয় ছিল তা যেন আচমকা খসে পড়ে আগের মতোই হয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার আগে কাপড় একগাদা দিয়ে বলল, ‘এগুলো ধুয়ে দিছ।’
জ্বর, কাশি আর ঠোঁটের ব্যথায় বিকেলের দিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল অন্তরা।
চেয়ারম্যান বক্কর আলীকে পাঠিয়ে পিয়াসের ফার্মেসি থেকে ঔষুধ আনালেন। পরেরদিনই অল্প একটু সেরে উঠলো সে।
ভোরে চা বসিয়েছে। তখন বক্কর আলী খাট এনে পাশে বসল। চা খেয়ে সে গরু নিয়ে যাবে।

অন্তরা স্যারের ব্যাপারটা আবছা আঁচ করতে পারছে। তবুও পুরোপুরি ক্লিয়ার হওয়ার জন্য অন্তরা বক্কর আলীকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল,

— ‘আচ্ছা স্যারের লজিং চেঞ্জ হল কেন বক্কর ভাই?’

বক্কর আলীর চেহারায় বেদনার ছাপ দেখা গেল। সে একটু ইতস্তত করে বলল,

— ‘ময়নুল মাস্টারকে দিয়ে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। এরপরই চেয়ারম্যান আর লজিংয়ে রাখলেন না।’

জিসানের প্রতি বেশ রাগই হল অন্তরার৷ ভালোই তো ছিল সে। মাঝপথে এসে সবার চোখের বিষ বানিয়ে দিয়ে চলে গেল। পড়াশোনার সামান্য পথটাও বাড়াবাড়ির কারণে রুদ্ধ হল।

— ‘চাচা বিদায় করে ভালোই করেছেন। লোকটা বাড়াবাড়ি একটু বেশিই করেছে।’

— ‘তোমরা বড় লোকের কারবার বুঝি না বইন। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া বাড়াবাড়ির কিছু না। চেয়ারম্যান সাব তোমারে বিয়ে দিতে চায় না এটাই আসল কথা।’

অন্তরা কিছুই বলল না। অবশ্য যতদূর বুঝতে পারে তারও মনে হয় বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই চাচার।

জিসানের থাকার ব্যবস্থা সভাপতির বাড়িতেও হয়নি। সেখানে একদিন থাকার পর সভাপতি প্রিন্সিপালকে জানালেন উনার বাড়িতে রঙের কাজ করাতে হচ্ছে। তাই আপাতত লজিং দেওয়া সম্ভব না। কোনো উপায় না দেখে ময়নুল সাহেব প্রিন্সিপালকে বললেন,
–‘আমার বাড়িতেই দেন। যদিও থাকার তেমন ভালো সুবিধা নেই। তবুও আপাতত একটা আশ্রয় দরকার।’

জিসান গিয়ে দেখল সত্যিই থাকার ব্যবস্থা নেই। তাকে দেওয়া হয়েছে একটা টিনের ঘরে। পাশের ঘরেই গরু-ছাগল থাকে। সেখান থেকে কটু গন্ধ আসছে।
বাড়ির উত্তর পাশে সবজি ক্ষেত। পশ্চিমদিকে হাফওায়াল টিনের ঘরে ময়নুল সাহেব পরিবার নিয়ে থাকেন।
সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে উঠোন ভর্তি হাঁস মুরগি। সেতারা বেগম আগলিয়ে ঘরে নিচ্ছেন।
জিসানের ঘরের উত্তর দিকে একটা জানালা। খাটে বসলে সবজি ক্ষেত দেখা যায়। সে আনমনে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খোলার শব্দে জিসান তাকাল।
(যারা গল্প পড়ছেন আজ কমেন্ট করে যাবেন। পেইজে রিচ কম। তাছাড়া যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি না। দেখি কারা সঙ্গে আছেন)
–চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here