আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ১১ পর্ব .

0
136

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১১ পর্ব
.
ফজরের নামাজে গেল না জিসান। ডাকে সাড়া না পেয়ে ইমরাজ সাহেব একাই চলে গেলেন।
ঘন্টা খানেক বাদে অন্তরা এসে দরজায় নক দেয়। গলা শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল জিসান। তার পরনে শর্ট প্যান্ট৷ গায়ে কালো সেন্টু গেঞ্জি৷ এলোমেলো চুল। লাল টকটকে চোখ।

অন্তরা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

–‘সে কি, আপনি এই অবস্থায় কেন? আমি চলে যাব না-কি আজ?’

জিসানের যেন মনে হল স্বপ্ন এখনও চলছে৷ সে তাড়াতাড়ি বলল,

— ‘না না, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি কাপড় পরে নিচ্ছি।’

জিসান তাড়াতাড়ি একটা নীল পাঞ্জাবি পরে অন্তরাকে ডাকল। অন্তরার কেন জানি স্যারকে আজ অস্বাভাবিক লাগছে। চোখে ঘোর। চেহারায় অস্থিরতা।

অন্তরা ফিক করে হেঁসে বলল,

–‘আপনি সাতসকালে হাত-মুখ না ধুয়ে দাঁত ব্রাশ না করে পাঞ্জাবী পরে বসে আছেন কেন?’

জিসান আচমকা উঠে এসে অন্তরার হাত ধরে বলল, ‘আচ্ছা আমি এক্ষুণি বালতির পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেব। তুমি এই সুযোগে সায়মার কচু পাতা রঙের শাড়িটি নিয়ে আস।’

— ‘কি বলেন এসব। শাড়ি এনে কি হবে? হাত ছাড়েন আমার।’

— ‘প্লিজ শাড়িটি আনো, তারপর বলছি। সায়মা ঘুমোচ্ছে। তাড়াতাড়ি যাও।’

অন্তরা কোনো কিছু না বুঝেই শাড়ি নিয়ে এলো।
জিসান বাইরে গিয়ে বলল, ‘রুমে গিয়ে শাড়িটি পরে নাও প্লিজ। তোমাকে এই শাড়িতে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷’ জিসানের চোখের দিকে তাকিয়ে অন্তরার মনে হল পরে ফেলি। মানুষটা দেখতে চাচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে সে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। দ্বিধাদ্বন্দে একপর্যায়ে কেঁদে ফেলল অন্তরা।

জিসান আঁজলা করে মুখ ধরে বলল,

–‘কাঁদছো কেন?’

অন্তরা ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে হাতজোড় করে বলল,

— ‘দয়া করে আপনি আমাকে প্রেমে ফেলবেন না। আমি চাইনা প্রেমে পড়তে। তবুও কেন আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না।’

— ‘তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করবে কেন? প্রেমে পড়লে সমস্যা কি?’

— ‘আপনাকে সায়মা পছন্দ করে। আমি চাইনা প্রেমের কলংক লাগাতে। চাই না চাচার অবাধ্য হতে। তাছাড়া যত কষ্টই হোক এ বাড়িতেই আমি থাকতে চাই৷ এই পরিবার আমার পরিবার। এই পরিবারের সঙ্গে আমার রক্তের বন্ধন আছে। তারা যখন নিজেদের মতো বিয়ে দিয়ে বের করে দিবেন তখনই যাব৷ আড়ালে-আবডালে আমি প্রেম করতে চাই না।
আমি তখন খুবই ছোট। এখানে আসার বছর খানেক হল। একদিন চাচা আমাদেরকে নিয়ে গেলেন এক পীর সাহেবের কাছে।
চাচার তখন খুব বেশি পীর ফকিরে বিশ্বাস। সায়মার বড় ভাইও তখন দেশে ছিলেন। তার মামাতো বোনের সঙ্গে বিয়ের আলাপ চলছে৷ বিয়ে করে ইংল্যান্ড যাবে। চাচা একদিন আমি সহ সবাইকে নিয়ে গেলেন জর্দা পীরের কাছে৷ পীর সাহেব জর্দা দিয়ে মুখ জবজবে করে পান খান। সেই পানের পিক ভক্তরা একটা তাগারিতে পানি মিশিয়ে তুলে রাখে। চাচা আমাদেরকে সেই ‘পিক’ খেতে বললেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম সবাই রক্তের মতো লাল টকটকে পানের পিক আয়েশ করে খাচ্ছে। যারা আসে সকলেই খায়। তাতে শরীরের রোগ বালাই দূর হয়৷ এলাকার সবাই সেটাকে সর্ব রোগের মহা ঔষুধ বলে। ঘেন্না করে খেলে হবে না। তাতে অমঙ্গল আসবে, ধ্বংস হবে। আগ্রহ নিয়ে পিক খাওয়ায় অনেক ছেলে বিলেতি বউ পেয়েছে বলেও লোকমুখে প্রচলিত আছে। সবাই খেল। সায়মার বড় ভাইকে ইংল্যান্ড যাওয়ার কামনায় একটু বেশিই খাওয়ানো হল। আমি পারলাম না। অন্যদের খাওয়া দেখেই বমি পাচ্ছিল। বারংবার থুথু ফেলছিলাম। পীর সাহেব সেটা টের পেলেন কি-না জানি না৷ কিন্তু সবার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিলেন। আমি সামনে গেলাম। চাচা পীর সাহেবকে বললেন মেয়েটির বাবা-মা নাই আমিই লালন-পালনের দায়িত্ব নিয়েছি। পীর সাহেব আচমকা রেগে গেলেন। চোখ বন্ধ করে বললেন এই মেয়েকে গৃহ বন্দী করে রাখতে হবে। বংশের সর্বনাশ করবে। এই কুলক্ষ্মীনি, সর্বনাশী, অপেয়াকে আমার সামনে থেকে সরাও। এই মেয়ে যার আশেপাশে থাকবে তারই অমঙ্গল হবে। বিপদ আসবে৷
চাচাও আমার উপর রেগে গেলেন। গৃহবন্দীর বদলে রেখে আসলেন একটি এতিমখানায়। তখনই আমি বুঝতে পারি এই পরিবার ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। সায়মার জন্য আমার টানে৷ চাচার জন্য টানে। নিজেকে একা মনে হয়। এদিকে চাচি পঙ্গু হয়ে আছেন। কাজের মেয়ে দিয়েও তাদের চলছে না। চাচা একদিন দেখা করতে আসলেন। আমি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম তাদের কথামতো চলব। আমাকে যেন বাড়িতে নিয়ে যান। চাচা সেদিন নিয়ে আসলেন। এরপর থেকে আমার দ্বারা কোনো ক্ষতি হতে দেইনি এই পরিবারের। তাদের কোনো কথার অবাধ্য হইনি। অথচ সায়মা যাকে পছন্দ করে তারই সঙ্গে আমি লুকিয়ে প্রেম করার পথে পা বাড়াচ্ছি। ছিঃ আমি এতো অকৃতজ্ঞ স্বার্থপর হলাম কবে থেকে। আর আসবো না আপনার কাছে পড়তে।’
এই কথাগুলো বলেই অন্তরা ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। তিনদিন হয়ে গেল সে আর পড়তে এলো না।
কি করবে। কার সঙ্গে কথা বলবে কিছুই খোঁজে পাচ্ছিল না জিসান।
মাদ্রাসার বাংলা স্যারের সঙ্গে তার ভালো একটা সম্পর্ক আছে। ক’দিন থেকে তিনিও খুব ব্যস্ত দিনকাল কাটাচ্ছেন। মাদ্রাসা থেকেও ঘন ঘন ছুটি নিচ্ছেন। জিসান আজ বিকেলে দেখা করার জন্য ফোন করেছিল। তিনি আসলেন। জিসানের থেকে বয়সে অনেক বড় হলেও তাদের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুত্বের কাছাকাছি।
মাদ্রাসার মাঠেই বসলেন।
সবকিছু খুলে বলল জিসান। অন্তরাকে বিয়ে করতে চায়। তার বাবা ঢাকায় একজন সফল বিজনেসম্যান। সে ইংলিশে অনার্স করে এখন মাস্টার্সে পড়ছে।
ময়নুল সাহেবকে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। তিনি মাঠের ঘাস ধরে টানছেন।

তারপর মুচকি হেঁসে বললেন,

–‘ভালো প্রস্তাব। বিয়ে করবেন। আপনার অবস্থাও ভালো। কিন্তু চেয়ারম্যানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না। তবুও আপনার জন্য আমি যাব। মেয়েটিরও কেউ নাই শুনেছি৷ আপনার সাথে বিয়ে হলে মেয়েটিও সুখী হবে।’

ময়নুল সাহেব পরেরদিন জুম্মার নামাজ পড়ে চেয়ারম্যানের কাছে এসে প্রস্তাবটি দিলেন। কিন্তু তাকে বিস্মিত করে অনেকটা মুখস্থের মতোই চেয়ারম্যান বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
ময়নুল সাহেব ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেন জিসানের অবস্থান। তবুও তিনি একটা কথাই বললেন,
–‘অন্তরাকে এখন বিয়ে দিতে চাচ্ছি না।’

ময়নুল সাহেব অনেকটা সরলভাবে বললেন,
— ‘কি যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব। মেয়ের তো বিয়ের বয়স অনেক আগেই হয়ে গেছে। তাছাড়া এমন পাত্র কি আর পাবেন? মেয়েটির মা-বাবা কেউ নেই, একটা ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হোন।’

চেয়ারম্যান প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,

— ‘শুনলাম আগামীতে মেম্বারিতে দাঁড়াচ্ছেন?’

খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন ময়নুল সাহেব,

— ‘এই আরকি লোকজন চাচ্ছে।’

— ‘আমি আপনার সঙ্গে এমনিতেই দেখা করতে যেতাম। বলছিলাম কি আপনি পরেরবার দাঁড়ান। এবার আখলাছুর দাঁড়াবে। আমি তাকেই সাপোর্ট দেব। আপনাকে সে টাকা দিবে প্রয়োজনে। তবুও এবার না দাঁড়ালে আমি খুশি হব।’

ময়নুল সাহেবের চেহারা ধুপ করে নিভে গেল। তবুও স্বাভাবিকভাবে বললেন,

— ‘আখলাছুর যে একাই দাঁড়াতে হবে তা কেন? হাজার জন দাঁড়ালেও জনগণ আখলাছুরকে চাইলে তাকেই ভোট দিবে।’

চেয়ারম্যান সিগারেটে একটা টান দিয়ে বললেন,

— ‘আখলাছুর আগেই বলেছিল আপনি দাঁড়াবেনই। আমি ভেবেছিলাম কথা বললে সমাধানে আসবেন। কি আর করার।’

ময়নুল সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,

— ‘তা বিয়ের প্রস্তাব কি আরেকটু ভেবে দেখবেন। ইংলিশ স্যার কিন্তু বড়ই ভালো মানুষ। আপনাদের বাড়িতেই যেহেতু আছেন দেখতেই পাচ্ছেন।’

— ‘ভাবাভাবির কিছু নাই। মেয়েকে বিয়ে দেব না এখন৷ আপনি আসতে পারেন।’

ময়নুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে গেলেন। তাকে চা-পানের ভদ্রতাটুকুও দেখানো হল না।
এরপরের ব্যাপারগুলো দ্রুত ঘটতে লাগল।
বিয়ের প্রস্তাবে চেয়ারম্যান মনে মনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলেন। তবুও ভদ্রভাবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন। এর কিছুদিন পর মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জিসানকে ডেকে জানালেন চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে তার লজিং ছুটে গেছে। আপাতত মাদ্রাসার সভাপতির বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কালই একজন নিতে আসবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখতে জানিয়ে দিলেন। জিসান কি করবে ভেবে পেল না৷ অন্তরার সঙ্গেও দেখা হচ্ছে না। তবুও বক্কর আলীকে নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখল। পরেরদিন সভাপতির লোক এসে তাকে নিয়ে গেল।
–চলবে..
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here