দেশলাই – ২২ পর্ব
সরু রাস্তায় এখন আর ভীড় নেই। ঝর্ণার পানির কলকল শব্দ আরও তীব্র হয়েছে। গাইড রাস্তার পাশে আরাম করে বসে বিড়ি টানছে।
রাফসান কাছে গিয়ে বললো,
– ‘কি মামা ডাকলেন না যে?’
– ‘খুঁইজা পাইলাম না তো।’
– ‘আমরা টিলায় ছিলাম। চলুন এবার যাওয়া যাক।’
গাইড তাদের নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আবার ঝর্ণার সম্মুখের ঝিরিপথ নামে। এদিকটায় অধিক পাথর। ইলি রাফসানের হাত ধরে পা টিপে টিপে হাঁটছে। ঝর্ণার পানির তীব্র গর্জন শোনা যাচ্ছে। কেমন একটা ঘ্রাণও নাকে ভেসে আসছে। খানিকটা পথ এগুতেই ইলি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে উত্তেজনায় ‘ওয়াও’ বলে লাফিয়ে উঠে।
চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক আশ্চর্য দৃশ্য। পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠেছে।
এভাবেই পাহাড়ের ডাকে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তারা পৌঁছে যায় প্রিয় গন্তব্য হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। বেশ খানিকটা আগে থেকেই কানে আসছিল হামহাম জলপ্রপাতের গর্জন। এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় ১৬০ ফুট ওপর থেকে আসা জলপ্রপাতের এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রচণ্ড গতিতে নিচের পাথরের ওপর গড়িয়ে পড়ছে ঝর্ণার পানি। পাথরের আঘাতে জলকণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করেছে কুয়াশা। সেগুলো ধোঁয়ার মতো উপরের দিকে ভেসে উঠেছে৷
– ‘দারুণ লাগছে তাই না ইলি?’
– ‘হ্যাঁ অনেক। আমি নামবো পানিতে।’
– ‘হ্যাঁ নামতে তো হবেই।’
রাফসান পাথরের ওপর তার ব্যাগটি রাখে। ছেলে-মেয়েরা লাফিয়ে পড়ছে পানিতে। ঝর্ণার সম্মুখের জলে পাথর নেই। কাচের মতো সচ্ছ শীতল পানি।
রাফসানকে রেখেই ইলি একা একা নেমে সাতার কেটে জলপ্রপাতের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু খানিক এগিয়ে দাঁড়াতেই পাথরে ঝর্ণার আছড়ে পড়া পানির কণা ইলিকে যেন ধাক্কাতে শুরু করে। চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না। শ্বাসও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাকে-মুখে আছড়ে পড়া জলকণার ঠান্ডা ছাট ভিজিয়ে দিচ্ছে।
রাফসান ব্যাগ রেখে পানির কাছটায় গিয়ে চারদিকে তাকায়।
কেমন শিতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে কোনোদিক থেকেই চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল দু’চোখ ভরে দেখে গিলে নিই প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টি। এই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে ভুলে যাচ্ছে সে কোথায় আছে, চারদিকে গহীন জঙ্গল, উপরে আকাশ, পায়ের নিচে বয়ে যাওয়া ঝির ঝির স্বচ্ছ পানির ধারা আর সামনে বহমান অপরূপ ঝর্না।
আয়নার মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেঁয়ে আছড়ে পড়ছে বড়ো বড়ো পাথরের গায়ে। গুড়ি গুড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের ১৫০ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের ডোবায়। চারিপাশে গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ি শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে। রাফসান সবকিছু বুঁদ হয়ে দেখছিল। কিন্তু আচমকা ধাক্কা খেয়ে পড়লো গিয়ে পানিতে৷ পেছনে কেবল শুনতে পেল ঝর্ণার পানির কলকল শব্দের মতো হাসি। পানি থেকে সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় ভেজা কাপড়ে হাস্যজ্বল এক মায়াবিনীকে। রাফসান মুখ মুছতে মুছতে বললো, ‘এটা কি করলি?’
ইলি হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,
– ‘তুমি নামছিলে না তাই।’
– ‘দাঁড়া এখানে তোকে কি করি দেখ।’
রাফসান লাফ দিয়ে কিনারায় উঠে। ইলি খিলখিল করে হাসতে হাসতে পা টিপে টিপে এদিক-ওদিক দৌড়াতে থাকে। কিন্তু খানিক যেতেই সামনে শুধু পাথর৷ দৌড়ানো আর সহজ হচ্ছে না। ইলি বারবার বলছে, ‘রাফসান ভাই আমি পড়ে যাবো। আমার পিছু ছাড়ো।’
– ‘তাহলে থাম।’
– ‘তুমি পানিতে নিয়ে ফেলবে।’
– ‘তা তো ফেলবোই।’
ইলি আগের মতো দৌড়ায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। রাফসান পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে শুন্যে তুলে নেয়। ইলি হাপাচ্ছে আর ছাড়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করছে। কিন্তু রাফসান তাকে নিয়ে যাচ্ছে পানির দিকে।
মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো অন্যরা তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। দৃশ্যটি দেখে রাফসান ইলিকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– ‘যা ছেড়ে দিলাম।’
ইলি গিয়ে পাথরে বসে হাপাতে থাকে। রাফসান নেমে যায় পানিতে। অন্য সবার সঙ্গে সাঁতার কাটতে থাকে। মাঝে মাঝে জলপ্রপাতের সামনে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে চোখবুঁজে পানির ছাট নিচ্ছিল। দারুণ লাগে নাকে-মুখে এসে পড়লে।
আবার জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে যায় রাফসান। হাত মেলে চোখবুঁজে দাঁড়ায়। পুরো শরীরে এসে আছড়ে পড়ছে জলকণা। ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। হঠাৎ কারও স্পর্শে চোখ মেলে তাকাতেই পানির ছাট চোখ বন্ধ করে দেয়।
– ‘ইলি তুই..
কথা বলতেই মুখে ঢুকে গেল পানি। ‘থু-থু’ করে বামদিকে ফেলে। ইলি রাফসানের সামনের দিকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। পাথরের আছড়ে পড়া জলকণা পড়ছে এসে ইলির পিঠে। তার চোখ মেলে তাকাতে বা কথা বলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তবুও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখবুঁজে আছে৷ পিঠে শীতল পানি বেয়ে যাচ্ছে।
রাফসান দুই হাত সামনে নিয়ে জলকণা ফিরিয়ে বলল, -‘লোকজন দেখছে ইলি ছাড়।’
– ‘সবাই সাতার কাটছে। ওরা আমাদেরকে চিনেও না। তাছাড়া এসব জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকা, হাসবেন্ড-ওয়াইফ এগুলো করে।’
– ‘তবুও ছাড় ইলি।’
– ‘প্লিজ, চোখবুঁজে থাকো। আমাকে স্বর্গ সুখ থেকে বিতাড়িত করতে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছ।’
রাফসান হাত দিয়ে ছাড়াতে যাচ্ছিল। ইলি আরও শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ রেখেই ওর গালে নিজের নাক ঠোঁট দিয়ে ঘষতে থাকে।
– ‘ইলি করছিস কি কেউ দেখবে তো।’
– ‘তাহলে চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো প্লিজ।’
– ‘কি বলছিস এগুলো?’
ইলি চোখ মেলে সতর্কভাবে সামনের লোকগুলো দেখে ওর ঘাড়ের চুল খামচে ধরে গালে গাল ঘষে বলে,
– ‘কেন বিয়ে হয়নি বলে তো? যাও বলে দিচ্ছি কবুল কবুল কবুল। এখন আর এতো নিষেধ নেই।’
রাফসান হেঁসে ফেললো। তারপর অসহায়ভাবে বলে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না ইলি ছাড়।’
ইলি গাল ফুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– ‘কত অজুহাত, যাও লাগবে না।’
ইলি ছেড়ে দিয়ে পানিতে নেমে সাঁতার কেটে যেতে থাকে। রাফসাম যায় পিছু পিছু।
– ‘ইলি কি হলো গাল ফুলিয়ে চলে যাচ্ছিস কেন?’
ইলি কোনো জবাব দিলো না। সে একা একা বুক সমান পানিতে সাঁতার কাটতে থাকে। রাফসান তাড়াতাড়ি গিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। ইলি উল্টো হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে পানি ছিটা দিতে থাকে। রাফসান চোখ মেলতেও পারে না। ইলি খিলখিল করে হাসছে। রাফসান বুদ্ধি করে পানিতে ডুব দিয়ে গিয়ে পেট জড়িয়ে ধরে উপরে তুলে পানিতে ছেড়ে দেয়। নাকে-মুখে পানি ঢুকে কাশি উঠে ইলির। রাফসান হাসতে থাকে। ইলি দাঁত কটমট করে তেড়ে যায়। রাফসান সাঁতার কাটতে থাকে। ইলি ধরে ফেলে পায়ে। ওর সাঁতারের গতি কমে আসে। ইলি বেয়ে বেয়ে কোমর থেকে উপরে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে কামড় দেয়। রাফসান আর্তনাদ করে উল্টে গিয়ে ইলিকে নিচে ফেলে দেয়। কিন্তু আবার কোমর জড়িয়ে পেট কামড়ে ডুব দিয়ে দূরে সরে যায়। রাফসান রাগান্বিত হয়ে তাড়া করে। ইলি এক ডুবে চলে যায় অন্য মানুষদের মাঝখানে। রাফসান মাথা তুলে চারদিকে তাকাচ্ছে। ইলি একা একা দূর থেকে হাসছে। হঠাৎ দেখে এদিকে আসতে থাকে। ইলি আবার ডুব দিয়ে জলপ্রপাতের দিকে ইচ্ছে করে ছুটে যায়। সাঁতার কেটে গিয়ে জলপ্রপাতের সামনে হাত মেলে দাঁড়িয়ে চোখবুঁজে একা একা জলকণার শীতল ছাট নিতে থাকে। খানিক পর আচমকা ইলি ঘাড়ের দিকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। বুঝতে পারে রাফসান প্রতিশোধ নিচ্ছে। ইলি চুপচাপ ব্যথা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিক্রিয়া না পেয়ে রাফসানের বোধহয় একটু রাগই হলো। সে আবার একটু জোরে কামড় দেয়। ইলির ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি এসে যায় তবুও প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ রাফসান রেগেমেগে ইলির মতোই সামনে গিয়ে কোমর জড়িয়ে পেটে নাক ডুবিয়ে কামড় দেয়। ইলি যন্ত্রণায় দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে। রাফসান দাঁড়িয়ে হাত সরিয়ে দেখে কাঁদছে ইলি। অবাক হয়ে বলে, ‘ওমা, এমন ভাব নিচ্ছিলি যেন লাগছেই না তোর। এখন কাঁদছিস কেন?’
ইলি জবাব না দিয়ে আবার মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকে।
– ‘কিরে বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’
ইলি আচমকা জড়িয়ে ধরে রাফসানকে। পানির ছাট এসে চোখে-মুখে পড়ে। কথা বলার জন্য ইলি রাফসানের চওড়া বুকে লুকিয়ে বলে, ‘হুম ব্যথা পেলেও সহ্য করেছি।’
– ‘কেন?’
– ‘তুমি তো ব্যথা দেবার জন্যই কামড় দিয়েছো। আদর করে তো দেবে না।’
– ‘তাই বলে কামড়ের সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠবি না? তুই নড়লেও আমি ছেড়ে দিতাম৷ এমন ভাব করছিলি যেন কিছুই টের পাচ্ছিস না।’
ইলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘ব্যথাই লাগুক। তবুও তো তোমার ছোঁয়া।’
– ‘কি বলিস এগুলো? সিরিয়াসলি না-কি কোনো উপন্যাস বা সিনেমা দেখে ন্যাকামো করছিস?’
ইলি মাথা তুলে আহত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘এমন মনে হয় কেন তোমার? মানুষ কি প্রেমের জন্য মরে না? তাহলে আমি প্রিয় মানুষের স্পর্শের জন্য সামান্য ব্যথাও সহ্য করতে পারবো না কেন? তোমার মতো কি সবাই অনূভুতিহীন রোবট হয়ে গেছে?’
রাফসানের বুকটা যেন শিরশির করে। হাত বাড়িয়ে ইলির মুখটা আঁজলা করে ধরে চোখের দিকে তাকায়।
– ‘আল্লা জানেন ইলি তোর কপালে কতো দুঃখ আছে। গোপনে এতো ভালোবেসে যে ফেললি। এর পরিণতি কি শুভ হবে?’
– ‘তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে মেয়েদের মতো আচরণ করছো রাফসান ভাই।’
– ‘কীভাবে?’
– ‘কিছু না।’
– ‘শক্ত হ ইলি৷ বাড়িতে গিয়ে দেখ হৃদের সাথে বিয়েও ভেঙে দিতে পারবি না।’
– ‘তো কি হয়েছে? সেই ভয়ে কি এমন সুন্দর জায়গায় এসে প্রিয় মানুষকে পাশে রেখেও গোমড়ামুখো হয়ে থাকবো।’
– ‘সেটা না, তুই খুশিতে যতো বেশি উড়ছিস। সেখান থেকে নিচে পড়লে ঠিক ততটাই ব্যথা পাবি। তাই আগে বাড়িতে গিয়ে দেখ বিয়ে ভেঙে দিতে পারিস কি-না৷ আর তুই তো এমন ছিলি না কখনও৷ কত বুদ্ধিমান, বুঝমান, ম্যাচিউর মেয়ে। এখন এতো দূর্বল হয়ে যাচ্ছিস কেন?’
ইলি রাফসানের কথাগুলো শুনে মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বললো,
– ‘ইশ, আমার বরটা কত সুন্দর করে বুঝায়।’
চলবে…