দেশলাই – ২৪ পর্ব
গাইড তাদের নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। পাহাড়ি উঁচু-নীচু পথ হেঁটে দু’জনই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। পায়ের গতি কম। কলাবন পাড়া ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। পাখিরা নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সূর্য লাল হয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।
গাইড তাদেরকে সিএনজির সামনে দিয়ে নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার পর্দা ফেলে ঘুমিয়ে আছে। রাফসান মাথা ঢুকিয়ে ডাক দেয়,
– ‘মামা আমরা চলে এসেছি।’
এক ডাকেই চোখ মেলে তাকায়।
– ‘চলুন ওই বাড়িতে তিনজনের খাবার অর্ডার দেওয়া। সিএনজি বাড়িতেই ঢুকিয়ে নিন। আমরা গোসল করেই খেতে বসবো।’
– ‘আইচ্ছা আপনেরা যান। আমি সিএনজি নিয়েই আসছি।’
– ‘আচ্ছা।’
ইলি আর রাফসান হেঁটে চলে গেল বাঁশের বেড়া দেয়া বাড়িতে। ড্রাইভার বাড়ির ভেতরে সিএনজি এনে রাখে। ইলি নিজের ব্যাগ নিয়ে ভেতরে যায়৷ ঠান্ডা পরিষ্কার পানিতে তারা গোসল সেরে ভেজা কাপড় পাল্টে নেয়। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
কাস্টমারদের খাবার দেয়া হয় খোলা বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে। খাবার আয়োজনও ঘরোয়া পরিবেশে। রাফসানের গোসল আগে শেষ হওয়ায় সে মাদুরে বসে আছে। ইলি গোসল করে উঠোনে ভেজা কাপড় চিপা দিয়ে পলিথিনের ব্যাগে ভরে গাড়িতে নিয়ে রাখে। রাফসান মাদুরে আসন পেতে বসে তাকিয়ে দেখছে ইলিকে। কামিজ পরা। হাতা কনুই আবধি। চুল খোঁপা করা। কপালের কয়েক গোছা চুল বেয়ে পানি পড়ছে। ক্লান্তি শেষের শান্ত স্নিগ্ধ চেহারা। তবে মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। ইলি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রাফসানের পাশে এসে বসে। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অস্বস্তি, বিব্রতবোধ যেন তার অভিধানে নেই। কিন্তু খাবার শুরু করার আগেই কারেন্ট চলে গেল। চারধারে অন্ধকার। ইলির শয়তানী চাপে মাথায়। পাশের হাঁটুতে চিমটি দেয় একটা। রাফসান আচমকা চিমটি খেয়ে অস্ফুটে ‘উফ’ করে উঠে।
ড্রাইভার পাশ থেকে বললো, ‘কি হইছে, কোনো সমস্যা ভাই?’
– ‘না ঠিকাছে, হঠাৎ মশা কামড় দিলো।’
ইলি অন্ধকারে মুখ ঢেকে হাসে। তবে মনে মনে ভয় করছে রাফসানও পাল্টা চিমটি দেয় কি-না। কিন্তু না, অন্ধকারে রাফসান পিঠের দিকে হাত নিয়ে তাকে আদুরে গলায় বললো, ‘আজ অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না?’
ইলি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। রাফসান ভাই তাকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরে এভাবে আদর করে কথা বললো? দু’চোখ ছলছল করে উঠলো নিমিষেই৷ প্রিয় মানুষের খানিক যত্নও চোখে জল এনে দেয়। এ কেমন অসুখ। বারান্দায় হারিকেন জ্বেলে দেয়া হলো। তারা খাওয়া শুরু করে। কিন্তু ইলি খেয়াল করে রাফসান খেতে খেতে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। ইলি ওর পেটে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে ভুরু উঁচিয়ে ইশারা করে। যার অর্থ হলো কি সমস্যা? বারবার তাকাচ্ছো কেন?
কিন্তু মানুষটি বুঝলো কি-না কে জানে? তাকিয়ে আবার খেতে শুরু করলো।
সিএনজিতে উঠলো তারা রাত আটটার আগেই। ইলি মোবাইল আর ইয়ারফোন বের করে কানে গুঁজে চোখবুঁজে আছে। রাফসান আলগোছে এক লাইন এনে তার কানে গুঁজে। বাজছে রবীন্দ্র সঙ্গীত,
“দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার
গানের ওপারে।।
আমার সুরগুলি পায় চরণ,
আমি
পাই নে তোমারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার
গানের ওপারে।
বাতাস বহে মরি মরি
আর বেঁধে রেখো না তরী।।
এসো এসো পার হয়ে মোর
হৃদয়- মাঝারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার
গানের ওপারে।
তোমার সাথে গানের খেলা
দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায়
সকল বেলা যে।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি
বাজাবে গো আপনি আসি।।
আনন্দময় নীরব রাতের
নিবিড় আঁধারে।
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার
গানের ওপারে…।
গান শুনতে শুনতে ইলি ঝিমচ্ছিল ঘুমে। রাফসান টান দিয়ে দুই পাশের পর্দা ফেলে দিয়ে বললো, ‘মামা ভেতরের বাতিটা নিভিয়ে দেন৷ ইলি খানিকক্ষণ ঘুমাক।’
আবছা অন্ধকার হয়ে গেল৷ ইলি তখনও জেগে আছে। রাফসান ওর কাঁধের দিকে হাত নিয়ে বুকে জায়গা দিয়ে বললো, ‘ঘুমা খানিক্ষণ।’
ইলি ওর বুকে মাথা রাখে। রাফসান একটা ইয়ারফোন আবার গুঁজে দেয় ওর কানে। নিজের কানে অন্যটি। বাজছে বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর মানুষের সৃষ্টি গান। সিএনজি চলছে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে। পাছে ওর মাথা নড়ে ঘুম ভেঙে যায় তাই রাফসান ওর গালে এক হাত রেখে বুকের সঙ্গে চেপে রাখে। ইলির উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পড়ছে তার বুক জুড়ে।
বাড়িতে ফিরতে তাদের রাত দশটা হয়ে যায়। ইলি তখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙাতে তার একদম ইচ্ছে করছিল না৷ কোলে করেও নেয়া যায়। তবুও কে কি ভাববে সেটার জন্য ডেকে তুলে। ইলি ঘুম ঘুম চোখ চারদিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নামে। রাফসান ভাড়া চুকিয়ে ব্যাগ দু’টা হাতে নিয়ে বলে,
– ‘চল ইলি।’
রাতের খাবার না খেয়েই ইলি ঘুমিয়ে গেল। রাফসানেরও খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবুও সবার জোরাজুরিতে খায় সে। টুকটাক কথা হয়। তারপর দেরি না করেই বিদায় নিয়ে বিছানায় চলে আসে। প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই চোখভরে ঘুম আসে। কিন্তু মাঝ রাতে আচমকা কারও গরম শ্বাস-প্রশ্বাসে তার ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার রুম। কেউ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। শরীর থেকে বেরুচ্ছে যেন আগুনের ভাপ। তার বুঝতে বাকী থাকে না মানুষটি ইলি। কপালে হাত দেয়। হ্যাঁ জ্বর এসেছে৷ কিন্তু ও এখানে কেন? কেউ দেখে ফেললে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার বুক ধুকপুক করছে। ফিসফিস করে মাথায় ধাক্কা দিয়ে রাফসান ডাকে, ‘ইলি উঠ প্লিজ৷ কেউ দেখে ফেললে কি হবে জানিস?’
ইলির কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মাথায় আরও কয়েকবার ধাক্কা দিতেই বুক থেকে মাথা তুলে তাকায়। কিন্তু কেউ কারও মুখ দেখছে না। রাফসান ফিসফিস করে বললো, ‘ইলি এখানে কেন তুই? কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি যা প্লিজ।’
ইলি খানিক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো,
– ‘আচ্ছা যাচ্ছি।’
তারপর সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে দেখে রাফসানের কেমন যেন লাগে। ঘুম আর এলো না। ঘুম ছুটি নিয়েছে না-কি ইলি চুরি করেছে কে জানে। ঘন্টা খানেক এপাশ-ওপাশ করে নির্ঘুম কেটে যায়। তারপর আবার ঘুম আসে।
কিন্তু ভোর ছয়টায় ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে নেমে বুঝতে পারে পুরো শরীর ব্যথা করছে। আড়মোড়া ভেঙে ব্রাশ হাতে পুকুরে যায়। মিনহাজের বউ ছাড়া আর কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। হাত-মুখ ধুয়ে রাফসান রুমে এসে ব্রাশ রেখে ইলির বিছানার পাশে যায়। তার জ্বর আন্দাজ করার জন্য কপালে হাত রাখে৷ খানিকটা কমই মানে হচ্ছে। কিন্তু রাতে হঠাৎ জ্বর উঠে আবার কমে যাবে কেন? রাফসান কিছুই বুঝতে না পেরে চলে যাচ্ছিল। তখনই ইলি বিছানা থেকে উঠে বসে হাই তুলে বললো, ‘আল্লা শরীর নাড়ানো যাচ্ছে না ব্যথায়।’
রাফসান ঘুরে তাকায়, ‘কিরে তুই উঠে গেলি?’
– ‘হু উঠে গেছি।’
– ‘আচ্ছা হাত-মুখ ধুয়ে নে।’
কথাটি বলে রাফসান বাইরে চলে গেলো। সূর্য এখনও উঠেনি৷ তবুও অন্ধকার কাটিয়ে চারপাশ পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছে। হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিমের পাহাড়ে গিয়ে উঠে। পাহাড়ের ওপরে একটা বিশাল আম গাছ৷ নিচে সবুজ ঘাস। কোনো ঝোপঝাড় নেই। খানিক দূরে আরও কয়েকটি পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সেখানে সারি সারি চা গাছ। ফুরফুরে বাতাসে পাতাগুলো নড়ছে। রাফসান এদিক-ওদিক হেঁটে আম গাছে হেলান দিয়ে বসে। খানিক পরেই ‘ভাউ’ শুনে পেছনে তাকায়।
ইলি এসেছে। বাচ্চাদের মতো ‘ভাউ’ বলে ভয় দেখানোর বৃথা চেষ্টা করে পাশে বসতে বসতে বললো,
– ‘কি অবস্থা জনাব? নির্জন স্থানে এসে চুপচাপ বসে আছো, প্রাক্তনের কথা মনে পড়ছে না-কি?’
– ‘প্রাক্তনের কথা না। ভাবছি তোর আর আমার বউয়ের কথা। তুই আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছিস। না হয় ওকেই ঘরে তুলে নিতাম। মেয়েটির সাথে আমি অবিচার করেছি। তখন মাথাও ঠিক ছিল না।’
ইলি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘সিরিয়াসলি? কি বলছো তুমি এসব?’
– ‘তুই এতো অবাক হচ্ছিস কেন? আমি জাস্ট বললাম আরকি তুই আমাকে ভালোবাসিস সেটা কাল না জানালে ওকে ঘরে তুলে নিতাম। কারণ সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা তো সে ইচ্ছা করে হারিয়ে ফেলেনি। ওরই বা দোষ কি বল?’
ইলি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সে এতটাই পাষাণ না যে অন্যের স্বামীকে ছিনিয়ে আনবে। সে ভাবতেও পারেনি রাফসান ভাই হঠাৎ বউকে ফিরিয়ে আনার কথা দ্বিতীয়বার ভাবতে পারে। অজান্তেই ইলির চোখ ফেটে জল বেরুলো।
– ‘তাহলে তুমি ওকে ঘরে তুলো। অন্যের স্বামীকে ছিনিয়ে আনতে আমি চাই না। তাছাড়া সত্যিই ওর কোনো দোষ নেই। তুমি তাকে ঘরে তুলে মহান পুরুষ হও। আমি কিছুই বলবো না।’
চলবে…