দেশলাই – ২৭ পর্ব
ওপাশ থেকে মেসেজ আসার আগেই ইলির মোবাইলে মায়ের কল এলো।
রিসিভ করতেই ঝাঁঝালো গলায় রহিমা বেগম বললেন,
– ‘এই তুই না-কি দু’দিন থেকে হৃদের কল ধরছিস না?’
ইলির বুক খানিকটা কেঁপে উঠলো। আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘বাইরে ছিলাম মা, টিউন শুনিনি।’
– ‘বাইর থাইকা আইসা কি কল দেওয়া যায় না?’
– ‘আচ্ছা দেবো।’
– ‘বাড়িতে কোনদিন আসবি?’
– ‘আরও কয়েকদিন পর আসবো।’
– ‘এতো থাকাথাকির কি আছে? ফুপুকে দেখতে গেছিস দেখা শেষ হয়েছে কাল চলে আয়।’
– ‘কি বলো মা, এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবো?’
– ‘তাড়াতাড়ি কীভাবে হইল? আজ তিন রাত চইলা গেল।’
– ‘আমি ঘুরতে চাইছিলাম।’
– ‘ঘুরতে কয়দিন লাগে? এতো ঘুরাঘুরি বিয়ার পরে জামাইর লগে করন যাইব।’
ইলি খানিকটা রাগ করে বললো,
– ‘আচ্ছা কালই চলে আসছি। এরপর কোথাও যেতে বললে আমি যাবো না।’
ফোনের লাইন কেটে যায়। রাফসানের মেসেজ সিন না করে ইলি ম্লান মুখে বসে থাকে।
খানিক পর তাদের খাবার টেবিলে যাবার ডাক এলো। ইলি খেতে চাচ্ছিল না। সকলের জোরাজুরিতে খেয়ে চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ে। একটু পর রাফসানও এলো। ইলি ম্লান মুখে একা বিছানায় শুয়ে আছে। সে পাশে গিয়ে বললো,
– ‘হঠাৎ কি হয়েছে?’
– ‘কিছু হয়নি। কাল বাড়িতে চলে যাবো।’
– ‘কি বলিস, সত্যি চলে যাবি?’
– ‘হু।’
– ‘ফোনে কার সাথে কথা বলছিলি?’
– ‘আম্মার সাথে।’
– ‘ও আচ্ছা। তাহলে মামী যেতে বলেছেন?’
– ‘হ্যাঁ, এখন যাও তো। গিয়ে ঘুমাও।’
ইলির মেজাজ খারাপ দেখে রাফসান আর ঘাঁটাতে গেল না। বিছানায় এসে গা হেলিয়ে দিলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ দেয়,
– ‘ফোনে এমন কি কথা হলো হঠাৎ করে ম্যাডামের এতো মন খারাপ।’
খানিক্ষণ চলে যায়। কোনো রিপ্লাই না পেয়ে মোবাইল পাশে রেখে চোখবুঁজে। মেসেজ টিউন শুনতে পেয়ে আবার মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ইলি রিপ্লাই দিয়েছে, – ‘হৃদের কল রিসিভ না করায় আম্মা রাগ করেছেন। এখন বলো তো অনিচ্ছায় কারও সাথে কি কথা বলা যায়? তাও আবার হৃদ হবু স্ত্রী হিসেবে কথা বলে, আমার তখন অস্বস্তি লাগে।’
রাফসান কোনো রিপ্লাই দিলো না। ওপাশে আবার টাইপিং দেখাচ্ছে।
– ‘আমি আম্মাকেও মুখের উপর কিছু বলতে পারছি না, এবার বাড়িতে গিয়ে সোজাসুজি বলে দেবো হৃদের সাথে আমি যোগাযোগ রাখতে পারবো না।’
– ‘গিয়ে বুঝেশুনে বলিস, এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আচ্ছা এখন ঘুমা। শুভ রাত্রি।’
– ‘শুভ রাত্রি।’
কিন্তু ইলি ঘুমালো না। চ্যাট করে মন খারাপ ভাব খানিকটা কেটে গেছে। সে মোবাইল পাশে রেখে ফুপুকে দেখে নেয়৷ তিনি বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ইলি চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে রাফসানের রুমে চলে যায়। সে চোখবুঁজে শুয়ে আছে। ইলি আস্তে করে মাথায় হাত রাখে। রাফসান চমকিত চোখে তাকায়। ইলি কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘কামড় দিতে এলাম।’
রাফসান চারদিকে তাকায়,
– ‘কেউ দেখে ফেলবে তো।’
– ‘দেখুক।’ বলেই পালঙ্কে উঠে ওর বুকে মাথা রাখে।
রাফসান পিঠে হাত রেখে বললো,
– ‘কাল থেকে আর এতো কাছাকাছি পাবো না।’
– ‘হু।’
রাফসান মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আমাকে কামড় দিয়ে প্রতিশোধ নিবি তাই না?’
– ‘হু।’
– ‘তাইলে দে।’
ইলি পুরোপুরি ওর উপরে উঠে মুখের উপর মুখ এনে তাকায়। গরম শ্বাস দু’জনের মুখে আছড়ে পড়ছে। ইলি ধীরে ধীরে মুখ নামিয়ে নাক ঠোঁট ঘষে ওর পুরো মুখে। ইলি কানে মুখ নিয়ে বললো,
– ‘কামড়টা ঠোঁটে দেই?’
– ‘হু।’
– ‘না ঠোঁটে কামড়টা তোলা থাক, বিয়ের পর দেবো।’
– ‘আচ্ছা।’
ইলি ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেঞ্জিটা উপরে তুলে বললো,
– ‘খুলে ফেলো।’
রাফসান বাধ্য ছেলের মতো গেঞ্জি খুলে পাশে রাখে। ইলি ওর লোমশ বুকে মাথা রেখে খানিক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর ফিসফিস করে বললো,
– ‘কামড় দিতে ইচ্ছা করছে না। এর চাইতে তুমি একটু আদর করে দাও চলে যাবো।’
রাফসান ওকে নিচে ফেলে কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘বিয়ের পর অনেক আদর করবো, এখন চলে যাও।’
– ‘ইশ, এই প্রথম ‘তুমি’ করে বললে।’
রাফসান কোনো জবাব না দিয়ে পাশ থেকে মোবাইলটা নেয়। তারপর নিচের দিকে এসে কামিজটা উপরে তুলে ডিসপ্লের বাতি ফেলে। খানিকটা মেদজমা ধবধবে সাদা পেটের নাভীর পাশে রক্ত জমে আছে। রাফসান মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ইশ এটা কি করলাম।’
ইলি কোনো জবাব দিলো না। রাফসান ওর ক্ষতস্থানে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। নরম পেটের একপাশে হাত লাগতেই নিজের শরীরে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। ইলিও চোখবুঁজে আছে। রাফসান মোহনীয় পেট থেকে নিজেকে সামলে নেবার জন্য কামিজ টেনে দেয়। পাশে শুয়ে ওর এক পা তুলে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
– ‘যাবে না?’
– ‘ইচ্ছা করছে না। নিজের বরটাকে রেখে একা থাকতে ভালো লাগে বলো?’
রাফসান ওর গলায় নাক ডুবিয়ে বলে, -‘আমারও ছাড়তে ইচ্ছা করছে না ইলি। যদি বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা যেতো।’
– ‘অ্যাঁ, আমি গতকাল বললাম এই কথা।’
– ‘হু, আমাদের ইচ্ছা তো একই তাই আমিও বললাম।’
– ‘আসলেই? না-কি আমাকে বাচ্চাদের মতো মন বুলানো কথা বলছো?’
– ‘আমি কি মন বুলিয়ে তোমাকে কিছু করছি না-কি?’
ইলি ফিক করে হেঁসে ফেললো,
– ‘কিছু না করার জন্য মন বুলানো কথা বলে বিদায় দিচ্ছ।’
– ‘তাহলে কি করবো বলো।’
– ‘ঠোঁটে না হোক গালে একটা আদর তো দিতে পারো। কপালে চুমু দিয়ে শুধু বিদায় করতে চাচ্ছ। একটুও আন্তরিক না তুমি।’
রাফসান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর গালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
– ‘উদ্যানে কত আন্তরিক ছিলাম। এখন তো রাত, এতো মিষ্টি একটা মেয়ে পাশে থাকলে কখন কি হয় নিজেরই ভয় লাগে।’
ইলি ফিক করে হেঁসে মুখ ঢেকে নেয়। তারপর ফিসফিস করে বলে,
– ‘বাবা তাহলে তো তোমার কাছ ঘেঁষা যাবে না। বেচারা নিজেকেই সামলানো নিয়ে আতংকে থাকে।’
– ‘ইন্ডিয়া থেকে এসেই তোমাকে দেখে আমি অবাক হয়ে হয়েছিলাম। আগে এতটা খেয়াল করিনি। ওইদিন প্রথম খেয়াল করেছি।’
– ‘কি খেয়াল করলে?’
– ‘খেয়াল করলাম শুধু সুন্দরী না। আরও কেমন যেন।’
– ‘মেয়েদের মতো কথাবার্তা বলো কেন? কেমন যেনটা কি?’
– ‘আমি কি সাহিত্যিক? মনে মনে অনেক কিছু বুঝলেও ঠিক গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারি না।’
– ‘আচ্ছা এতো গুছানো লাগবে না। কেমন যেনটা কি? মানে খারাপ না ভালো?’
– ‘মানে শুধু সুন্দরী বললে সেই সৌন্দর্য প্রকাশ পায় না এমন। অনেক বেশি মায়া লাগে। হেঁটে যাবার সময় পেছন থেকে তাকালে ভেতরে কেমন কেমন করে।’
– ‘কি আবোল-তাবোল কথাবার্তা। ঠিকমতো প্রশংসাও করতে পারে না।’
– ‘হু।’
– ‘আদরও করতে পারো না।’
– ‘বিয়ের পর পারবো।’
– ‘কচু পারবে।’
– ‘উদ্যানে করিনি?’
– ‘অ্যাঁ পাইছে একটা, উদ্যানে যেন উনি রোমান্টিকতার ইতিহাস করে ফেলছেন।’
রাফসান মুচকি হেঁসে ওর গালে চুমু খেয়ে বললো,
– ‘প্লিজ রাগ করো না। এখন আদর করতে গেলে বাদর হয়ে যাবো।’
ইলি ফিক করে হেঁসে বললো, ‘আদর বাদর শুনে ফেইসবুকে পড়া একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেছে।’
– ‘কি?’
– ‘কান দাও বলছি।’
রাফসান কান পেতে দেয়। ইলি ফিসফিস করে বলে,
– ‘অল্প একটু ছোঁয়া দাও
আরও খানিক আদর,
তুমি আমার লতানো দেহ
কাঁপিয়ে তোলা বাদর।’
রাফসান দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘কি? তুমি নিজে বানিয়ে বলে আমাকে বাদর ডাকলে তাই না?’
– ‘আরে না, আমি ফেইসবুকে পড়েছি।’
– ‘লেখক বাদর বললো কেন? ওরে বয়কট করলাম।’
ইলি ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘এখানে “বাদর” মানে “দুষ্ট” বুঝানো হয়েছে হয়তো।’
– ‘দুষ্টকে বাদর কেন বলা হলো?’
– ‘এতো প্রশ্ন করো না তো। কবিতা যারা বুঝে বুঝেই। অন্যদের এতো বুঝালেও লাভ হয় না।’
– ‘রেগে যাচ্ছ কেন?’
– ‘রাগবো না? এই রাতে কাছে পেয়েও আদর না করে অযথা প্রশ্ন করছো।’
– ‘না এতো রাতে আদর করতে গেলে বাদর হয়ে যাব।’
– ‘তোমার আদর করতেই ইচ্ছা করছে না সেটা বলো।’
– ‘কি যে বলো না।’
– ‘হু ঠিকই বলেছি। মানুষ কি সারাক্ষণ শাড়ি পরে ঘুরতে হবে আদর পাওয়ার জন্য?’
– ‘ইশ, এভাবে বলছো কেন?’
– ‘একশোবার বলবো, হাজারবার বলবো।’
– ‘আচ্ছা যা ইচ্ছা বলো। বিয়ের পর দেখাবো মজা।’
– ‘কচু দেখাবে তুমি।’
রাফসান টেনে বুকে তুলে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত রেখে বললো,
– ‘এতো রাগ করছো কেন?’
– ‘জানি না, অযথাই রাগ হচ্ছে।’
– ‘আচ্ছা তাহলে আমরা বসে কানে কানে গল্প করি। তুমি ঘুম পেলে চলে যাবে।’
– ‘আচ্ছা।’
রাফসান বাঁ পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ইলিকে টেনে কোলে বসায়। ইলি ওর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে। রাফসান ওর পেটের দিকে হাত নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা। তার উষ্ণ শ্বাস আছড়ে পড়ছে ওর পিঠে। আলগোছে ওর চুলের খোঁপা খুলে দেয়। চুলে নাক ডোবায়। আবার চুল তুলে নগ্ন ঘাড়ে চুমু খায়৷ ইলি বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাফসান এবার পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে পেট মৃদু চেপে ধরে। ইলি এবার ঘুরে ওর মুখামুখি হয়ে কোলে বসে মুখটা আঁজলা করে ধরে অন্ধকারে খানিক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চোখবুঁজে ফিসফিস করে বলে, -‘আর কবে যে এমন কাছাকাছি তোমাকে পাবো।’
– ‘পাবে না?’
– ‘উহু, বিয়ে ছাড়া হয়তো আর এভাবে পাবো না।’
– ‘তা ঠিক।’
– ‘আমার ভীষণ ইচ্ছা করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে সারারাত বেঘোরে ঘুমোতে।’
– ‘একদিন ইচ্ছা পূর্ণ হবে ইলি।’
– ‘জানো? আমার প্রায়ই মনে হয় আমাদের মিলন হবে। আবার মনে হয় এটা অসম্ভব। মৃত্যুর আগে কেউ কি স্বর্গ পেতে পারে? পৃথিবীতে স্বর্গসুখ পাওয়ার কি নিয়ম আছে?’
– ‘ইশ, এভাবে ভাবিস না ইলি।’
ইলি ওর কাঁধে মুখ গুঁজে মৃদু কান্নায় কেঁপে উঠে। রাফসান বিরক্তির সুরে বলে,
– ‘আচ্ছা এখন কাঁদছিস কেন বলতো? তুই অযথা হারানোর ভয় পাস তাই না?’
– ‘না, আমি ভয় পাই না। আমি জানি পাবো।’
– ‘তাহলে কাঁদিস কেন?’
– ‘জানি না।’
– ‘তুই আমাকেও ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস।’
– ‘আচ্ছা আর এমন করবো না। কিন্তু তুমি আমাকে আবার ‘তুই’ বলছো কেন? আমি তোমার বউ না বলো?’
রাফসান অন্ধকারে ওর মুখটা আঁজলা করে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘আমার বউটা।’
ইলি চুপচাপ লোমশ বুকে চোখবুঁজে থাকে। একটুও নড়ে না। এই বুকেই যেন জগতের সব সুখ-শান্তি। এই বুকের ধুকপুকেই যেন জগতের সকল রহস্যের সমাধান। এখন ভূমিকম্প হলেও ইলি চোখ খুলবে না। রাফসানকে ঘোর লাগা গলায় বলবে, ‘এই নড়ছো কেন?’
রাফসান অস্থির হয়ে বলবে, ‘ইলি বাইরে তো খুব হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, চলো তো দেখি বাইরে কি হচ্ছে।’
ইলি আঁটকে বলবে,
– ‘মানুষ তো হৈচৈ করবেই। এই বেরসিক মানুষগুলোর কাজই হচ্ছে অন্যের সুখ-শান্তি বিনষ্ট করা।’
আধা ঘণ্টা এভাবেই চলে গেল। রাফসান ওর মাথায় হাত দিয়ে আস্তে করে ডাকে। কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। ইলি ঘুমিয়ে গেছে। এখন কি করবে? ওর এমন শান্তির ঘুম থেকে জাগাতেও ইচ্ছা করছে না। রাফসান আলগোছে ইলিকে কোলে নিয়ে পালঙ্ক থেকে নামে। সতর্কভাবে ওই রুমে তাকায়। ডিম লাইট জ্বলছে। রাফসান পা টিপেটিপে ইলিকে ভালোভাবে বিছানায় রেখে চলে আসে।
চলবে….