দেশলাই – ২৯ পর্ব
***
মাস খানেক পর ইলি দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্নাঘরে আসে। রাহিমা বেগম চুলার কাছে। লতিফ মিয়া চেয়ারে বসা। দু’জন খোশগল্প করছেন। কাল রাতে ইলির মামা ফোনে জানিয়েছেন আগামী মাসের দুই তারিখ দেশে আসবেন। আরও সপ্তাহ দুয়েক বাকি। ইলি ব্রাশ হাতে পুকুরের দিকে যাচ্ছে। রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার। পিঠ ধীরে ধীরে দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। দুই পরিবারের সকল কথা বলা শেষ। এবার হৃদ দেশে ফিরলেই বিয়ে৷ তারপর ইলিকে ইংলিশ কোর্সে ভর্তি করানো হবে৷ তারা চলে যাবেন ইংল্যান্ড। সেখান থেকে তাকে নেবার প্রসেসিং করা হবে। আর মুখবন্ধ করে থাকা যাবে না। চিরতরে মুখবন্ধ হবার আগেই শক্তভাবে বলে ফেলতে হবে হৃদকে সে বিয়ে করবে না। অবশ্য তখন জিজ্ঞেস করা হবে কেন বিয়ে করবে না? তখনই সে রাফসান ভাইয়ের কথা বলে দেবে। কিন্তু রাফসান ভাই বলেছিল এখনই পরিবারকে তার কথা কিছু না বলতে। সময় মতো সে বড়ো চাচাকে দিয়ে বিয়ের আলাপ দেবে। কিন্তু এখন হাতে আর সময় নেই। তাছাড়া ইতোমধ্যে হৃদের কল এড়িয়ে চলতে গিয়ে মা’র সঙ্গে দুইদিন কথা কাটাকাটি হয়েছে। শেষপর্যন্ত ইলি পরিষ্কার বলে দিয়েছে হৃদের সঙ্গে সে কথা বলতে পারবে না।
এসব নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। সবই মুখবুঁজে সহ্য করেছে ইলি। কিন্তু এবার ওরা দেশে চলে আসবে। আর নীরব থাকার সময় নেই৷ রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে আজই কথা বলা দরকার। অবশ্য আশার ব্যাপার হলো রাফসানের ব্যবসা বেশ চলছে। সেও ভালো আছে। চাচাদের দুই পরিবারের সকল টাকা-পয়সা তার কাছে আসে। তাদের বাজার সহ সমস্তকিছু সে দেখাশোনা করে। সকলেই তার প্রতি অনেক খুশি। দোকানে একজন কর্মচারীও রাখা হয়েছে। বাজারে যাওয়া-আসার সুবিধার জন্য তিন চাচা মিলে বাইক কিনে দিয়েছেন।
বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিনই ইলিদের বাড়িতে উঠে। মাঝে মাঝে ইলির জন্য চকলেট আইসক্রিম জাতীয় এটা-সেটা আনে। ক’দিন আগে ইলিকে একটা পেইজের লিঙ্ক দিয়ে বললো নিজের জন্য ড্রেস পছন্দ করে তাকে জানাতে। ইলি নিষেধ করেছিল তবুও কল দিয়ে জোরাজুরি করায় সে পছন্দ করে। এটাই রাফসানের পক্ষ থেকে প্রথম গিফট। গতকাল আবার একটা প্যাকেটে করে তিনটা উপন্যাস নিয়ে এসেছিল। ইলি জিজ্ঞেস করার পর বললো রকমারিতে অর্ডার দিয়ে এনেছে। ইলি বেশ খুশি হয়েই গ্রহণ করে।
প্রতিদিন সকালে ইলি জানালা খুলে রাখে। বাইকের আওয়াজ শুনলেই তাড়াতাড়ি উঁকি দিয়ে বাইরে তাকায়। কখনও রাফসানের পেছন দেখা যায়। কখনও আবার পুরোপুরি৷ কিন্তু আজও চোখাচোখি হয়নি।
ইলি পুকুর থেকে রুমে আসে। খানিক্ষণ পায়চারি করে। হঠাৎ মনে হলো হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়া যায়। দেখা হলেও এসব কথা বলার সুযোগ কম। ইলি মোবাইল হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়,
— ‘কাল রাতে কল দিলাম ধরলে না কেন? দেখা হলেও কথা বলার সুযোগ কম হয়। তাছাড়া কেউ শুনে ফেলতে পারে তাই তুমিও ভয় পাও এসব নিয়ে কথা বলতে। এদিকে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। জানো? কাল রাতে মামা ফোনে জানিয়েছেন তারা দুই তারিখ দেশে ফিরবেন। আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকী। প্লিজ একটা কিছু করো। অথবা আমি বলে দেই তোমার কথা যা হয় হবে।’
মেসেজ সিন দেখালো না। কখন সিন করবে কে জানে৷ ইলির অশান্তি লাগছে।
রহিমা বেগম নাস্তার জন্য ডাকছেন। আহ্লাদী ডাক। ইলির গা জ্বলছে। সে ধীরে ধীরে টেবিলের দিকে যায়।
রাফসান ঘুম থেকে উঠে মেসেজ এসেছে দেখেও কর্মাচারীকে কল দিয়ে আগে জিজ্ঞেস করে নিলো দোকান খুলেছে কি-না। তারপর মেসেজ সিন করে পড়ে। তার বুকটা কেমন ধড়ফড় করছে৷ এই সমস্যার মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতেই হবে এটাই ভয়৷ মামা-মামীরা সীমাহীন বিশ্বাস করতেন। ইলির সঙ্গে বোনের মতো মিশতে দিয়েছেন। অন্যদিকে ওর বিয়েও পুরোপুরি ঠিক। কি করবে সে ভেবে পায় না। তবুও তো সে ইলিকে চায়৷ ইলিও পাগলের মতো ভালোবাসে। একটা কিছু করা দরকার। বড়ো চাচাদের ওখানে এখন রাত। রাফসান ঠিক করে বিকেলে কল দিয়ে বলে ফেলবে ইলিকে বিয়ে করতে চায়। তারা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে। অস্বস্তি লাগবে কথাগুলো বলতে। তবুও বলতে হবে। জীবনে অস্বস্তিকর অনেক কিছুরই মুখোমুখি হতে হয়। ছোট চাচি চা-নাস্তা এনে রাখলেন টেবিলে। সে মুখ ধুয়ে এসে নাস্তা করে দোকানের উদ্দ্যশ্যে বাইক নিয়ে বের হয়। আজ কবর গলির সামনে গিয়ে বাইকের গতি কমে গেল। ইলিদের বাড়ির দিকে তাকায়। ইলি দাঁড়িয়ে আছে জানালার গ্রিল ধরে। চোখাচোখি হতেই মুচকি হাসি দিলো। চুল খোঁপা করা। ওড়ানাটা গলা থেকে বুকে ঝুলে আছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তার বুক শিরশির করে। রাফসান বুঝতে পারে, ইলি মুখে মুখে হাসিখুশি আর আত্মবিশ্বাস দেখালেও শুরু থেকে ওর বুকে কি একটা ভয় ঘাপটি মেরে আছে।
রাফসান বাইকের গতি বাড়ায়। দোকানের কর্মচারী ঝাড়ঝুড় দিচ্ছে। সে ভেতরে একটা চেয়ারে বসে মোবাইল বের করে। ইলিকে সাহস দেয়া দরকার। মেসেজ দিলো,
– ‘আমি আজই চাচাকে বলবো বিয়ের আলাপ দিতে। এখন তো আর আমি বেকার না। ব্যবসা করেছি। মোটামুটি ভালোই চলছে সবকিছু। আশাকরি মামা-মামীরা বুঝবেন।’
খানিক্ষণ পরেই মেসেজ সিন হলো। ইলি প্রতিবারই কীভাবে জানি সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ সিন করে ফেলে।
– ‘হ্যাঁ, ব্যবসা করছো এটাই আমাকে সাহস দিচ্ছে। বেকার থাকলে আব্বা-আম্মাকে কিছু বলাই যেতো না। কিন্তু সমস্যা হলো হৃদের সাথে বিয়ে ভেঙে দেওয়া। আব্বা-আম্মা এতো সহজে চাইবেন না৷ ওদের সাথে কথা পাকাপাকি।’
– ‘হু, এটাই একটু সমস্যা।’
– ‘আচ্ছা রাফসান ভাই। এমন কেন হচ্ছে বলো তো? এক মাস হয়ে গেল শ্রীমঙ্গল থেকে এলাম। তোমাকে একবারও একান্তে পেলাম না কেন?’
– ‘কীভাবে হবে? আমি ব্যস্ত থাকি। তোরও ভার্সিটি বন্ধ। দু’জন কোথাও না গেলে তো একান্তে পাওয়া যাবে না। তোদের বাড়িতে গেলে এখন অস্বস্তি লাগে কথা বলতে। চোরের মনে পুলিশ পুলিশ বলে একটা কথা আছে।’
– ‘হু, আচ্ছা সন্ধ্যায় উঠবে তো আমাদের বাড়িতে?’
– ‘হ্যাঁ, উঠবো। আচ্ছা তোর জন্য কি আনবো?’
– ‘কিছুই লাগবে না।’
– ‘আইস্ক্রিম? কিটক্যাট না-কি ডার্ক চকলেট?’
– ‘বললাম না কিছুই আনবে না।’
– ‘আরে বল না। তোর পছন্দ-অপছন্দ বুঝা যায় না কেন বলতো?’
– ‘বুঝা যায় না?’
– ‘না।’
– ‘ভালো হইছে।’
– ‘আচ্ছা ফোসকা আনবো?’
– ‘কলেজে থাকতে ভালোই লাগতো, এখন লাগে না।’
– ‘তাহলে ভালো লাগেটা কি?’
– ‘তোমাকে।’
– ‘ফাজলামো করবি না তো। আর তোর অবস্থা কি? চোখের নিচে কালি পড়ে যাচ্ছে।’
– ‘তোমার কি হলো ‘তুই’ করে বলছো কেন?’
– ‘অভ্যাস তো খেয়াল থাকে না।’
– ‘বউ ভাবলে খেয়াল থাকতো।’
– ‘চাচাকে বিকেলে কীভাবে বলবো? আমার লজ্জা লাগছে।’
ইলি ফিক করে হেঁসে মেসেজ দিলো,
– ‘তুমি ভীতুর ডিম না শুধু, মেয়েও।’
– ‘হ্যাঁ আমি আরও কত কি।’
– ‘আহারে অভিমান।’
– ‘বই পড়েছিস?’
– ‘একটু একটু পড়েছি। মন বসে না।’
– ‘কেন?’
– ‘বরটাকে পড়তে ভীষণ ইচ্ছা করছে।’
রাফসান মুচকি হেঁসে মেসেজ দিলো,
– ‘পরে কথা হবে। এখন কাস্টমার আসছে।’
– ‘এই শোনো।’
– ‘কি?’
– ‘কাল তো হরতাল। দোকান বন্ধ থাকবে না? বন্ধ থাকলে ঘরে বলে-কয়ে কোথাও যেতাম।’
– ‘হরতাল হলে আমাদের বাজারে বেশি কিছু হবে বলে না মনে হয়। তাছাড়া চাচাকে আজ বললে মামা-মামীরা রাতেই জেনে ফেলতে পারেন। কি হয় আগে দেখ।’
– ‘ও, তাও ঠিক। আচ্ছা পরে কথা হবে।’
রাফসান বিকেলে চাচাকে কলে আমতা-আমতা করে বলে দিলো। তিনি অবাক হলেন। তবে রাফসান যখন বললো ইলিও আমার কাছে বিয়ে বসতে রাজি। মামা-মামীরা ওর খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু সে রাজি না।
চাচা বললেন মা-বাবা জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা বলবে তো? না হলে বাবা নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য আসবে। আমরা অন্যখানে তোর জন্য মেয়ে দেখবো।
রাফসান সোজাসুজি বলে দিলো ইলিকেই বিয়ে করবে।
তিনি বললেন আচ্ছা রাতেই লতিফ মিয়াকে কল দেবেন।
সত্যি সত্যি রাতে তিনি কল দিলেন। তখন লতিফ মিয়া খাবার টেবিলে। পাশে রহিমা বেগম এবং ঠিক সামনে ইলি বসা। ফোনে কথা বলতে বলতে লতিফ মিয়া বারংবার ইলির দিকে তাকাচ্ছেন। ইলির বুক কাঁপছে। খাবার গলায় আঁটকে যাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে কি নিয়ে কথা হচ্ছে। রহিমা বেগম ঠিক বুঝতে পারছেন না। ইলি খাবার রেখেই চলে গেল রুমে। সে জানে কাজটা ঠিক হয়নি। এর মানে আব্বা-আম্মা বুঝে ফেলবেন ইলি পূর্ব থেকে সবকিছু জানে। তবুও ইলির কিছু করার ছিল না। পারছিল না সেখানে থাকতে। সবকিছু জেনে রহিমা বেগমের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে। এটা কীভাবে সম্ভব? আসমান যেন মাথায় ভেঙে পড়েছে। খানিক পরে মায়ের চিল্লাচিল্লি শুনতে পেল ইলি।
চলবে..