বাঁক ( ১৫ পর্ব )

0
121

বাঁক ( ১৫ পর্ব )
_____________

মানহা গেল দরজা খুলে দিতে। মৃদুল অমলেটে আরেকটা কামড় দিয়ে আনমনে ভাবছে হুট করে এখন কীভাবে কথাগুলো শুরু করা যায়? মানহা তো ক’দিন থেকে আগের মতো কথাও বলছে না।

– ‘রাতুল এখানে চলে আসো, আমাদের সাথে নাস্তা করবে।’

মৃদুল তাকিয়ে দেখে মানহার পেছনে সহকারী ছেলেটিও এসে প্রবেশ করছে। প্রচণ্ড রাগ হলো তার, সে জয়েন করার পরেরদিন থেকেই কলেজ বন্ধ হওয়ায় রাতুল ভোরে চেম্বারে এসে সন্ধ্যায় যায়। আগে কেবল বিকেলেই আসতো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মৃদুল, আজও বোধহয় কথাগুলো বলা হবে না। অতি স্বাভাবিক কথা, এগুলো বলা কোনো ব্যাপার না। অথচ কী অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কথাগুলো বলা হয়েই উঠছে না৷ কলেও বলা যায়, তবুও একটু একান্তে শান্ত পরিবেশে বলতে চেয়েছিল সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল আর অপেক্ষা না করে আজ রাতে কলে মানহার সঙ্গে কথা বলে নেবে। মাস খানেক থেকে কেন জানি মায়ের জন্য তার মনটা ভীষণ ছটফট করছে।
রাতুল তার পাশে সোফায় বসে সৌজন্যের হাসি দিয়ে বললো,

– ‘কেমন আছেন ভাই?’

– ‘ভালো।’

– ‘তোমার কলেজ কবে খুলবে?’

– ‘পরশু।’

– ‘ও আচ্ছা।’

মানহা চা বসিয়ে রাতুলের জন্য প্লেটে করে অমলেট নিয়ে এসে টি-টেবিলে রেখে চেয়ারে বসলো। তিনজন গল্প করতে করতে নাশতা করে। আজ পুরোদিন তাদের এক সঙ্গেই চেম্বারে কেটে গেল। সন্ধ্যায় রাতুলের সঙ্গে মৃদুলও চলে যাবে কি-না তাই ভেবে ইতিউতি করছিল। মানহাই তাকে বললো,

– ‘মৃদুল তুমি একটু পরে যাও দরকার আছে।’

রাতুল একা চলে গেল। মৃদুল আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘হ্যাঁ বলো কী দরকার।’

– ‘তুমি আজ থেকে এখানেই থাকবে।’

মৃদুল চেহারায় প্রচণ্ড বিরক্তি মিশিয়ে বললো,

– ‘না, এটা হবে না। আমি এখানে থাকবো না।’

– ‘আমি বলছি থাকবে, তুমি সবকিছু নিয়ে আসো।’

– ‘মানহা বেশি বাড়াবাড়ি করো না, তোমার যা ইচ্ছা তা বললেই হবে না-কি? দরকার হয় চেম্বার ছেড়ে দেবো আমি, তবুও থাকবো না।’

– ‘কেন? থাকলে কী সমস্যা?’

– ‘একটা অবিবাহিত মেয়ের সঙ্গে থাকাই তো সমস্যা?’

মানহা ফ্যাকাসে মুখে হেঁসে বললো,

– ‘নির্লজ্জ মেয়েটার সাথে তোমার থাকতে হবে না, একাই থাকবে তুমি। আমি চলে যাব বাড়িতে। তাই বলেছি সবকিছু নিয়ে এখানে উঠে যেতে।’

মৃদুল নিজের কাছে নিজে খানিকটা অপমানিত হলো। সে মুহূর্তে পরিবেশ স্বাভাবিক করে নিয়ে হাসে বলে,

– ‘তাই বলো, তুমিও না কেমন রহস্য করে কথা বলো।’

মানহার মনটাই ভালো হয়ে গেল ওর কথা বলার ভঙ্গিতে। ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘তুমি ভেবেছিলে আমার সাথে থাকতে বলছি?’

– ‘বাদ দাও তো এসব কথা।’

– ‘তাহলে কী কথা বলবো?’

মৃদুল সঙ্গে সঙ্গে ভাবলো এখন প্ল্যান নিয়ে কথা বলা যায়। সে স্মিত হেঁসে জবাব দেয়,

– ‘আগে বলো আজ শাড়ি পরোনি কেন?’

মানহার মনের জানালা দিয়ে যেন একফালি শীতল হাওয়া এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। সে অত্যন্ত মিষ্টি গলায় বললো,

– ‘কেন শাড়ি ছাড়া খুব খারাপ লাগে বুঝি?’

– ‘আরে না, কামিজেও ভালো লাগছে। আচ্ছা চলো আমরা ভেতরে গিয়ে কথা বলি।’

মানহার মনে পড়ে গেল ছোট খালাকে রাস্তায় যেতে যেতে কল দিতে হবে। লতার জন্য আইসক্রিম নেবে৷ আইসক্রিম ওর ভীষণ পছন্দ৷ মামীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি কথা বলে খুশি করতে হবে। কিন্তু তার ভীষণ ইচ্ছে করছে মৃদুলের সঙ্গে খানিক্ষণ সময় কাটিয়ে যেতে। তবুও নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে বললো,

– ‘না মৃদুল, আমার যেতে হবে৷ কাল ভোরে চলে আসবো, আমি গেলাম।’

মানহা ওর হাতে চাবি দিয়ে ভ্যানিটিব্যাগ আর ছাতা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে যায়। মৃদুল পেছন থেকে বললো,

– ‘কিছু জরুরি কথা আছে কল দেব রাতে।’

মানহা জুতো পায়ে দিতে দিতে বললো,

– ‘না, তুমি মেসেজ দিয়ে রাইখো আমি পড়ে নেব।’

– ‘আচ্ছা, ঠিকাছে।’

মৃদুল একটু পরে দরজা তালা মেরে ইদ্রিস ম্যানসন থেকে সবকিছু নিয়ে এখানে চলে আসে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রুমে গিয়ে ব্যাগ-প্যাক একপাশের মেঝেতে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। এখন থেকে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ফাতিহা পাঁচটা কল দিয়েছে। রোজ চেম্বারে আসার আগেই তার ফোন সাইলেন্ট করে আসে৷ তাই বুঝতে পারেনি কখন কল এলো। ব্যাক করে মৃদুল। ওপাশে রিং হতেই রিসিভ হয়।

– ‘হ্যালো ফাতিহা।’

– ‘হ্যালো, কী হইল কও তো? কয়দিন থাইকা তুমি কল দাও না। আমি আজ দিলাম তাও উঠাইতাছো না কেন?’

– ‘আসলে হইছে কী ফাতিহা, আমি একটা কোম্পানিতে কাজে ঢুকেছি৷ ওইখানে মোবাইল নিয়া ঢোকা নিষেধ। তাই রাইতে শুধু মোবাইল হাতে পাই।’

– ‘ও আইচ্ছা, তা কেমন আছো তুমি?’

– ‘ভালাই আছি, তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন আছে?’

– ‘ভালা আছে সবাই।’

– ‘ওদিকে পুলিশের খবর কী? ছবি দেইখা কেউ কিছু কইছে?’

– ‘না।’

– ‘আইচ্ছা, তাইলে রাখতাছি।’

– ‘আইচ্ছা।’

মৃদুল মোবাইল হাত থেকে রাখতেই মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখে মানহার মেসেজ,

– ‘তোমার রান্না করতে হবে না, ডাল আর ডিম ভাজি করে রেখে এসেছি। আজ এগুলো খেয়ে নিয়ো।’

মৃদুল হাফ ছেড়ে বাঁচে। যাক আজ আর রান্না করতে হবে না৷ এই কাজটা করতে তার ভীষণ বিরক্ত লাগে। ইদ্রিস ম্যানসনে তারা একেকদিন একেকজন রাঁধতে হতো। এখানে সে একা, সুতরাং বাজার করে নিজেই রেঁধে খেতে হবে। ফিরতি মেসেজ দিলো সে,

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে মানহা, ধন্যবাদ।’

ওপাশ থেকে আর কোনো মেসেজ এলো না। সে উঠে গেল ভাত খেতে। ভাত খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে আজ। প্লেট ভরে ভাত নেয়। ডাল নেয় বাটিতে।
দারুণ একটা ঘ্রাণ আসছে নাকে।
ফ্রাইপ্যান থেকে ডিম নিতে গিয়েই দেখে পাশে রাখা একটা পলিথিনের ব্যাগে লেবু আর কাঁচা মরিচ রেখে গেছে। ডিমটা ভাতের ওপর তুলে হাত ধুয়ে তাড়াতাড়ি লেবু কেটে নিল। কয়েকটা কাঁচা মরিচ আর লেবু সহ সবকিছু নিয়ে সে রান্না ঘরেরই চালের বস্তায় বসে খাওয়া শুরু করে। অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে সে খাচ্ছে। ডিম ডাল একসঙ্গে৷ ডাল দিয়ে মাখিয়ে এক লুকমা ভাতের সঙ্গে ডিম মুখে দেয়। তারপর লেবুতে একবার কামড় আরেকবার কাঁচা মরিচে। তার খাওয়ার ভঙ্গি একটু অদ্ভুত। প্রথম যেইই দেখে অবাক হয়ে বলে, ‘এ কী করছো? খাবার কেউ কেড়ে নেবে না-কি তোমার কাছ থেকে? এভাবে খাও কেন?’

সে কোনো সদুত্তর দিতে পারে না। তার এভাবে খেতে ভালো লাগে এটাই কেবল জানে। আজ পর্যন্ত কারও রান্না তার কাছে খারাপ লেগেছে বলেও মনে পড়ে না৷ তবে মানহার রান্না একটু বেশিই ভালো। মায়ের রান্না কেমন ছিল?
পুনরায় মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। মৃদুল ভাতের প্লেট মেঝেতে রেখে বাঁ হাতে মোবাইল বের করে।

– ‘মৃদুল ফ্রাইপ্যানের পাশে দেইখো লেবু আর কাঁচা মরিচ আছে। আগে বলতে ভুলে গেছিলাম।’

মুচকি হাসে মৃদুল। কিছু কিছু মানুষ এতো খারাপ আবার কিছু কিছু মানুষ এতো ভালো হয় কীভাবে ভেবে পায় না সে।
ফিরতি মেসেজ দেয়,

– ‘পেয়েছি।’

পুনরায় গোগ্রাসে ভাত গিলতে শুরু করে সে। কেউ দেখলে মনে করবে কত কাজ পড়ে আছে তার। অথচ এটাই তার স্বাভাবিকভাবে খাবার চিত্র। খাওয়া শেষ করে বাতি নিভিয়ে বিছানায় গা হেলিয়ে দেয়। মানহাকে মেসেজ দিতে হবে। তার পড়ালেখা অতি অল্প। তবুও বাংলা পড়া এবং লেখার পাশাপাশি ইংলিশ উচ্চারণও করতে পারে৷ লম্বা করে একটা মেসেজ দিয়ে দেখে যাচ্ছে না। তারপর আবার টুকরো টুকরো করে বিস্তারিত লিখে মানহাকে পাঠিয়ে অপেক্ষা করে সে। ফিরতি কোনো মেসেজ আসে না। অপেক্ষা করে সে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম ভাঙলো ভোরে কলিং বেলের শব্দ শুনে।
হাই তুলে গিয়ে দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল ঘ্রাণে আর রূপে। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে মানহার থেকে। ওর পরনে শাড়ি। ডান হাতে এপ্রোন আর ভ্যানিটিব্যাগ।

– ‘হা করে তাকিয়ে আছো কেন?’

মৃদুল লজ্জা পেয়ে বললো,

– ‘আসো।’

– ‘ঘুম থেকে এখন উঠলে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘এই শার্ট প্যান্ট পরেই ঘুম?’

মৃদুল অত্যন্ত লজ্জার একটা হাসি দিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘পঁচা একটা, তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে শার্ট ধুয়ে নাও।’

– ‘গোসল করবো না?’

– ‘আমি আসার আগেই গোসল করে নাস্তা বানানো উচিত ছিল, তাই এখন গোসল বাদ।’

মৃদুল স্মিত হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা।’

মানহা এপ্রোন একপাশে রেখে সোফায় বসে ইয়ার ফোন কানে গুঁজে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে বসে রইল। খানিক পর বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে তাকায়৷ মৃদুল খালি গায়ে শার্ট ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করে বের হয়েছে। মৃদুল বেলকনির দড়িতে কাপড় মেলে রেখে এসে বললো,

– ‘শেষ ম্যাডাম, এবার কী করতে পারি?’

মানহা চোখবুজা অবস্থা বললো,

– ‘আমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে পারো।’

মৃদুল আজ কোনোভাবেই ঝগড়াঝাটির পরিবেশ তৈরি করতে চায় না। তাই মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘সারাক্ষণ রসিকতা করতে মন চায় তোমার তাই না?’

– ‘উহু, সত্যিই ধরবে একবার জড়িয়ে? আমার আজ খুব মন খারাপ।’

– ‘বাচ্চাদের মতো কথা বলছো কেন? আর তোমার আবার কেন মন খারাপ?’

– ‘থাক এতোকিছু শুনতে হবে না তোমার।’

– ‘কাল কোনো মেসেজ রিপ্লাই দিলে না যে?’

– ‘সিম্পল ব্যাপার মৃদুল। তুমি অযথা চাপ নিচ্ছ।’

– ‘তা ঠিক, তুমি চাইলে সিম্পল।’

– ‘আমি চাইলে না, আরেকজনের সহযোগিতা নিব।’

মৃদুল বিস্ময়ে বসা থেকে উঠে মানহার পাশে এসে বললো,

– ‘কার?’

– ‘বলবো, তার আগে আমাকে একটু আদর করবে?’

– ‘কীসব বাচ্চামি করো মানহা।’

মানহা আলগোছে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,

– ‘তোমার বিশ্বাস হয় না আমার মন খারাপ?’

মৃদুল অবাক হয়ে আঁজলা করে ওর মুখ ধরে বললো,

– ‘আরে তোমার চোখে পানি কেন হঠাৎ? মুখ লাল হয়ে গেছে দেখছি, কী সমস্যা বলো তো।’

মানহা ধরা গলায় বললো,

– ‘কিচ্ছু না, তোমার এগুলো শোনার দরকার নেই, একবার জড়িয়ে ধরো শুধু।’

মৃদুল ওকে টেনে দাঁড় করালো। মানহা ভেজা চোখ নিচের দিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুলের কেন যেন আচমকা মানহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই জড়িয়ে ধরার পেছনে তার কোনো স্বার্থ আছে কি-না সে নিজেও জানে না। কী অদ্ভুত এক শান্তিতে ছেয়ে গেল তার দেহ আর মন। মৃদুল তাকে ছেড়ে দিয়ে আঁজলা করে মুখ ধরে। মানহা চোখবুজে আছে।

– ‘তাকাও।’

– ‘না লজ্জা লাগে।’

মৃদুল মুচকি হেঁসে বলে,

– ‘আসলেই লজ্জা লাগছে না-কি ন্যাকামো?’

– ‘জানি না।’

– ‘আচ্ছা আজ কী হয়েছে বলো তো?’

– ‘বলা যাবে না।’

– ‘ও আচ্ছা, তা এভাবে কী চোখবুজেই থাকবে?’

– ‘উহু।’

– ‘তাহলে এবার বলো কার সহযোগিতা নেব আমরা বলছিলে।’

– ‘বলবো তুমি আমাকে প্রথমে কপালে একটা চুমু দাও৷ তারপর জড়িয়ে ধরে কাছে নাও।’

– ‘কিন্তু চোখবুজে আছো কেন?’

– ‘চোখ মেলে এগুলো বলতে লজ্জা লাগবে।’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা দিচ্ছি।’

– ‘রোবটের মতো না দিয়ে একটু আদর করে দিয়ো।’

মৃদুল হেঁসে বললো,

– ‘কিন্তু তোমার কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।’

– ‘তাহলে তোমার চুমু লাগবে না। জড়িয়ে ধরে কাছে নাও বলি কার সহযোগিতা নেব।’

মৃদুল তাকে জড়িয়ে ধরে কাছে আনে। নরম, উষ্ণ এক কিশোরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেও চোখ না বুজে পারলো না। তখনই কানের কাছে মানহা ফিসফিস করে নাম উচ্চারণ করলো,

– ‘ইরফানের সহযোগিতা নেব।’

____চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here