বাঁক ( ২১ পর্ব )

0
100

বাঁক ( ২১ পর্ব )
_____________

মানহা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ইরফানের কল।
মৃদুল গেঞ্জি পরে সোফায় গিয়ে বসে তাকিয়ে আছে।
ভেজা চোখ মুছে নিয়ে মানহা কল রিসিভ করে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘ঘুম থেকে উঠে গেছো তোমরা?’

– ‘হ্যাঁ ভাই।’

– ‘তাহলে বের হয়ে যাও। ওদের বাসায় বৃদ্ধ মহিলা ছাড়া এখন আর কেউ নাই। ছেলেটিও টিউশনি পড়াতে চলে গেছে।’

– ‘দরজা তালা না দিয়ে চলে যাব এভাবে?’

– ‘না, দরজায় তালা ঝুলিয়ে রেখে গেছে সে। চাবি তার কাছে আছে, তালা মেরে চলে যাও।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘আর হ্যাঁ, ও বললো দরজার পাশে একটা চেয়ারে ফ্ল্যাক্সে চা রেখে এসেছে তোমাদের জন্য।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘রাখছি এখন।’

– ‘ওকে।’

মানহা ফোন রেখে দরজার ছিটকানি খুলে দেখে তালা ঝুলানো আর পাশের একটি চেয়ারে ফ্ল্যাক্সের সঙ্গে দু’টা কাপ আর পাউরুটির প্যাকেট। মানহা মুচকি হেঁসে সেগুলো নিয়ে ভেতরে এসে টেবিলে রাখলো। আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখে মৃদুল অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মানহার তাকাতেই লজ্জা লাগছে চা খেতেই বা ডাকবে কীভাবে?
সে দু’টা কাপে চা নিয়ে পাউরুটির প্যাকেট ছিঁড়ে একটা কাপ আর পাউরুটি ওর দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে বিছানায় বসে গেল।

মৃদুল কীভাবে ওর সঙ্গে স্বাভাবিক হবে বুঝতে পারছে না। তবুও চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘মানহা তুমি চাইলে এই টাওয়েল দিয়ে গোসল করে নিতে পারো।’

মানহা মনে মনে ভীষণ অবাক হলো। তারমানে মৃদুল আর রেগে নেই? মানহা কৃত্রিম ম্লান মুখ রেখেই বললো,

– ‘গোসল করবো না।’

– ‘কেন?’

– ‘ভালো লাগছে না।’

মৃদুল আর কী বলবে ভেবে না পেয়ে চা’র কাপে পাউরুটি ভিজিয়ে মুখে দেয়। মানহার বুঝতে পারছে মৃদুল বকা দিয়ে এখন উলটো অনুতপ্ত। সুতরাং সে কৃত্রিম ম্লান মুখ বজায় রেখেই কথা বলবে। তাতে অতিরিক্ত কিছু গুরুত্ব পাবে সে।

– ‘তোমার না প্রতিদিন ভোরে গোসল করার অভ্যাস, তাই বললাম আরকি গোসল করে নিতে। শাড়ি ঝেড়েঝুড়ে আবার এটাই পরে নিবে।’

মানহা জানে একটু আগে যে মানুষ বকা দিয়েছে তার সব কথার উত্তর দিতে হয় না। সুতরাং সে বিছানায় পা তুলে বসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চা’য়ে পাউরুটি ভিজিয়ে মুখে দেয় আর আপন মনে ভাবে, ‘ব্যাটা আনরোমান্টিক, খাটাশ, রোবট, পাথর, ঘুমের ঘোরে একবার জড়িয়ে ধরেছিস এই উষ্ণতা আর ছোঁয়া আমি গোসল করে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে যাব কেন? গোসল করার পর কী আবার জড়িয়ে ধরবি? তা তো পারবি না।’

– ‘ইরফান কী বললো ফোনে?’

মানহা চিন্তায় পড়ে গেল এই কথার উত্তর দেবে কি-না। না দিলে যদি আবার রেগে যায়? তাছাড়া যাওয়ার পথে অনেক দরকার হবে কথা বলার। সুতরাং দরকারি কথা বলাই যায়। সে মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিলো,

– ‘বিদায় না নিয়ে চলে যেতে বলছে।’

– ‘তালা মারতে হবে না?’

– ‘তালা বাইরে আছে।’

– ‘ও আচ্ছা, তা ঘড়ির টাইম তো সাতটা হয়ে গেছে, নয়টায় ট্রেন তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

মৃদুল কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘তাহলে বেরিয়ে পড়ি।’

মানহা কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত কয়েক চুমুক দিয়ে চা শেষ করে টেবিলে কাপ রাখলো।

– ‘পাউরুটির প্যাকেট ভাঁজ করে টেবিলে রেখে যাই আর কাপগুলো ধুয়ে যাওয়া উচিত।’ কথাটি বলে মৃদুল তার কাপ হাতে নিয়ে মানহারটা টেবিল থেকে নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই মানহা পলকে নিজেরটা নিয়ে নিল। মৃদুল ভাবলো মানহা হয়তো ধুবে তাই তারটাও বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে৷ কিন্তু মানহা সেটা না নিয়ে নিজের কাপ নিয়ে চলে গেল বেসিনের দিকে। মৃদুল বুঝতে পারে এর অর্থ হচ্ছে তোমারটা তুমি ধুবে। সে মুচকি হেঁসে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মানহা চোরা চোখে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। কাপ ধুতে ইচ্ছাকৃত একটু দেরিই করলো সে। সারাজীবন এভাবে পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলে আরও বেশি ভালো লাগতো তার। আজ দিনটা এতো সুন্দর কেন কে জানে। সবকিছু এতো ভালো লাগছে। কৃত্রিম রাগ দেখানোর খেলাটাও কী ভীষণ সুন্দর। মানহা নিজের কাপ ধুয়ে নিয়ে টেবিলে রাখে। মৃদুল এসে বললো,

– ‘চলো বের হই।’

মানহা ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে বাইরে এলো। মৃদুল দরজা তালা দেয়ার পর তারা টিলার ওপর থেকে নামে। টিলার পাশ দিয়ে একটা নির্জন পাকা রাস্তা গিয়েছে বটে। কিন্তু কোনো রিকশা নেই।

– ‘মানহা এদিকটা তো হেঁটে যেতে হবে মনে হচ্ছে।’

মানহা কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করলো। মৃদুল পিছু পিছু এসে বললো,

– ‘কী হলো কথা বলছো না কেন?’

– ‘কথা তো বলছিই।’

– ‘কই বললে, এইযে কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করেছো।’

– ‘তাহলে কী না হেঁটে বলবো তুমি কোলে করে নিতে?’

– ‘এভাবে কথা বলছো কেন?’

– ‘আমি যা বলি সব এভাবে, ওভাবে হয়ে যায় যেহেতু আর কথাই বলবো না।’

মানহা আবার হাঁটতে শুরু করে৷ মৃদুল কাছাকাছি গিয়ে বললো,

– ‘দেখো এই রাস্তাটা কী সুন্দর। পাহাড়ের মাঝখানে দিয়ে গেছে। পাশে ছোট ছোট টিলা। গাছগাছালি আর পাখির ডাক।’

– ‘তো এখন আমি কী করবো?’

– ‘কিছু করতে বলছি না।’

মানহা আর কিছু না বলে পুনরায় হাঁটতে শুরু করে। মৃদুল পেছনে আসতে আসতে বললো,

– ‘বুঝি না, জামাই একটু বকা দিলে বউ এতো রাগ করবে কেন? নিজের জামাইই তো বকা দিয়েছে বাবা। তাও যদি বুঝতাম একটা বকার সঙ্গে সঙ্গে দাঁত পড়ে গেছে, আরেকটার সঙ্গে চোখ উড়ে গেছে, আরেকটার সঙ্গে ব্যাংক ব্যালেন্স খালি। আরেকটার সঙ্গে বাড়িঘর ভেঙে খানখান। একরকম কিচ্ছুই হয় না, গায়ে ব্যথাও লাগে না। তাহলে শুধু শুধু এতো রাগ করার কী আছে।’

মানহা ফিক করে হেঁসে ফেললো। মৃদুল ওর হাত ধরে টেনে নিজের দিকে নিয়ে বললো,

– ‘তুমি হাসছো দেখেছি আমি, সুতরাং রাগ শেষ।’

– ‘আজাইরা কথা শুনে আমি হাসি না। কথার নাই কোনো যুক্তি আগামাথা আমি হাসবো কেন? ছাড়ো আমার হাত।’

মৃদুল না ছেড়ে টেনে আরও কাছে এনে হাতে বন্দী করে বললো,

– ‘ছাড়বো না।’

মানহা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে বললো,

– ‘এটা রাস্তা জনাব।’

– ‘কেউ নাই তো আশেপাশে।’

– ‘তো কী হয়েছে? ছাড়েন বলছি, আমাকে খুশি করার জন্য প্রেম দেখানো হচ্ছে।’ মানহা নিজেকে ছাড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে।
মৃদুল কাছাকাছি হাঁটতে হাঁটতে বললো,

– ‘খুশি করার জন্য প্রেম দেখাবো কেন?’

– ‘যে মানুষ সারারাত কাছে পেয়েও রোবটের মতো থাকে তার হঠাৎ দিনেদুপুরে মাঝ রাস্তায় প্রেম, এগুলো আমি বুঝি।’

– ‘বাবা এতো অভিমান।’

– ‘আমার কারও প্রতি অভিমান নেই।’

তাদের পাশ দিয়ে একটা রিকশা টুংটাং শব্দ করে চলে গেল।
মানহা আবার হাঁটে। মৃদুল চারদিকে তাকায়। হঠাৎ দেখে রাস্তার পাশের একটা ছোট টিলার পর খানিকটা সমান জায়গায় সবুজ ঘাস তারপর আরেকটা টিলা। মৃদুল চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই, আচমকা সে মানহাকে কোলে নেয়। আঁতকে উঠে মানহা।

– ‘কী করছো এসব?’

– ‘আজ তোমাকে শেষ করে ফেলবো, নায়িকাদের মতো বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করো।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘ছাড়ো তো হঠাৎ কেউ দেখে ফেলবে।’

– ‘না আজ ছাড়াছাড়ি নাই।’

মৃদুলকে টিলার দিকে উঠতে দেখে বললো,

– ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’

– ‘জঙ্গলে।’

– ‘কেন?’

– ‘আমি না রোবট, তাই আজ দেখাবো আমি যে রক্ত মাংসের পুরুষ।’

মমৃদুল দুই টিলার মাঝখানের সবুজ ঘাসে মানহাকে শুইয়ে রেখে সেও একপাশে শুয়ে হাঁপাতে থাকে।

– ‘এতো ওজন আমি হাঁপিয়ে গেছি।’

– ‘এই তোমার নিজেকে রক্ত মাংশের পুরুষ দেখানো?’

মৃদুল পাশ ফিরে তাকায় মানহার দিকে। নীল শাড়ি আর সবুজ ঘাসে পেটের ওপর রাখা মানহার ফর্সা হাত কী ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে। সে ওর হাতটি এনে গালে চেপে ধরে ঠোঁট দিয়ে আলতো চুমু খায়। মানহা লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘চলো এবার যাই।’

– ‘এতো তাড়াহুড়ো কিসের?’

মানহা হাত ছাড়িয়ে শুয়ে থেকে দাঁড়িয়ে বললো,

– ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।’

মৃদুল দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে ওর দিকে যায়। কাছাকাছি যেতেই মানহা বললো,

– ‘কী হয়েছে?’

মৃদুল ওর মুখটা আঁজলা করে ধরে পবিত্র গ্রন্থের মতো চুমু খায়। মানহা একবার চোখ তুলে তাকিয়ে পুনরায় মাথা নুইয়ে ফেলে। মৃদুল আচমকা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মানহা ওর পেছনের চুলে আঙুল ডুবিয়ে কাঁধে গালটা চেপে ধরে চোখবুজে। আজ দিনটা এতো অদ্ভুত সুন্দর কেন সে ভেবে পাচ্ছে না। চোখটা জলে ঝাপসা হয়ে এলো প্রশান্তি আর আনন্দে।

____চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here