বাঁক ( ২২ পর্ব )

0
99

বাঁক ( ২২ পর্ব )
_____________

মানহা কাঁধ থেকে মাথা তুলে জল ছলছল চোখ মৃদুলের চোখে রেখে বললো,

– ‘কখন যাবে? ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে তো।’

– ‘ট্রেন তো নয়টায়, এখন আটটা মাত্র।’

– ‘কিছু খেয়ে উঠতে হবে না? তাছাড়া যেতে যেতেও তো ত্রিশ মিনিট চলে যাবে।’

– ‘হ্যাঁ, তা ঠিক, চলো যাই৷’

মানহা সবুজ ঘাসের ওপর থেকে নিজের ভ্যানিটিব্যাগটা হাতে নেয়৷ তারপর মৃদুলের হাত ধরে বলে,

– ‘চলো।’

দু’জন টিলা থেকে নেমে হাঁটতে থাকে।
পাহাড়ের মাঝখানের সরু পথ পেরিয়ে সিএনজি নিয়ে বন্দর আসে। একটা হোটেলে গিয়ে খাবার শেষে রিকশা নিয়ে যায় রেলস্টেশন। মানহা জানালার পাশটায় বসে। মৃদুল ওর পাশে বসতে বসতে বললো,

– ‘যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাহলে আমরা ট্রেন থেকে নেমে কোথাও রাত কাটিয়ে দিনে আমজাদ কলোনিতে যেতে হবে না-কি?’

– ‘না, কলোনিতে রাতেই যাওয়া ভালো। কারণ দিনে সবাই কাজে থাকবে। তাছাড়া ইরফান বলেছে আমজাদ লোকটা ভালো না। তবে টাকার লোভ দেখালে না-কি সবকিছুতে সহযোগিতা করবে৷ সুতরাং ওর মাধ্যমে আমরা থাকার ব্যবস্থা করে নিব।’

– ‘হ্যাঁ তা করা যাবে, লোভী মানুষদেরও দেখছি বিপদে-আপদে কাজে লাগে।’

মানহা ফিক করে হেঁসে ওর কাঁধে মাথা রাখে।
বেশিক্ষণ তাদের অপেক্ষা করতে হয় না। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। আশেপাশের সবুজ মাঠ, গাছগাছালি আর দূরের গ্রামের দিকে তাকিয়ে মৃদুলের আচমকা ফাতিহার কথা বড়ো মনে পড়ে। ওর ট্রেন চড়ার ভীষণ শখ। নাটক-সিনেমা ছাড়া বাস্তবে ট্রেন দেখেনি কখনও। কি অদ্ভুত ব্যাপার৷ কিছু কিছু মানুষের জীবন একটা সীমানার মধ্যে কেটে যায়। বাংলাদেশে এখনও লঞ্চ চলাচল থাকার পরও কিছু কিছু মানুষ সরাসরি লঞ্চ না দেখে মরে যায়। ট্রেন রোজ বাংলাদেশের বুক দিয়েই দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে গেলেও কিছু কিছু মানুষ সরাসরি ট্রেন দেখার সুযোগ পায় না। চড়বো চড়বো করেও চড়া হয়ে উঠে না। অথবা কেউ কেউ এসব বিলাসিতার প্রয়োজনবোধ মনে করে না।

– ‘মানহা।’

কাঁধ থেকে মাথা তুলে মানহা বললো,

– ‘কী?’

– ‘তাকিয়ে দেখো কী সুন্দর একটা গ্রাম।’

মানহা তাকায়। সত্যিই ছবির মতোন সুন্দর একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। সরু রাস্তা গেছে রেললাইনের পাশ ঘেঁষে। ‘হাওয়াই মিঠাই, হাওয়াই মিঠাই’ বলা লোকটির পিছু নিয়েছে খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরা একদল বাচ্চারা।
একটা নারিকেল গাছের নিচে বাক্সটা রেখে দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে ফেলে পিচ্চিদের দল। দৃশ্যটি পলকে পেছনে ফেলে যায় ট্রেন। সামনে দৃশ্যমান হয় সবুজ মাঠ। একটা গরুর কাঁধে বসা কালো ফিঙে। খুটিতে বসা কাক। গরু ঘাস থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দিকে।
মানহার ইচ্ছা করছে গ্রামটাতে নেমে যেতে। এতো সুন্দর গ্রাম ফেলে যেতে মন চাচ্ছে না। এই যাত্রাটা যেন মানুষের জীবনের মতোই। সুন্দর কত মুহূর্ত পিছনে ফেলে আসি আমরা। ফেলে আসি সোনালি অতীত। কিন্তু চাইলেই ফিরে যাওয়া যায় না।

সন্ধ্যা ছয়টায় তারা পৌঁছে যায় চট্টগ্রাম। স্টেশনের বাইরে এসে মৃদুল বললো,

– ‘ইরফানকে মেসেজ দিয়ে বলে দাও আমরা ট্রেন থেকে নেমেছি।’

– ‘হ্যাঁ ভালো কথা মনে করছো।’

মানহা মেসেজ পাঠায়। তারা একটা সিএনজি ডেকে ইরফানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাত আটটায় পৌঁছে যায় আমজাদের কলোনিতে। মানহা ভাড়া চুকিয়ে মৃদুলকে বললো,

– ‘কলোনির ভেতরে যাই।

– ‘হ্যাঁ চলো।’

দু’জন কলোনির একটা গলিতে গিয়ে দেখে একটা রুমের দরজা খোলা। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ পাটিতে বসে ভাত খাচ্ছে। স্ত্রী সামনে বসে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে।
মৃদুল এগিয়ে গিয়ে বললো,

– ‘ভাই ইশিকে চিনেন? ও কোথায় থাকে বলতে পারবেন?’

পুরুষ লোকটি বললো,

– ‘না চিনি না।’

মহিলাও মাথা নেড়ে না করলো। বিছানায় থাকা আরেকটা ছোট ছেলে শোয়া থেকে উঠে বললো,

– ‘চিনি উনার আম্মার অপারেশন হইছিল এখন তারা চলে গেছে দেশের বাড়ি।’

মৃদুল আগ্রহ নিয়ে তাকায়।

– ‘হ্যাঁ চিনতে পারছো তুমি। আচ্ছা ওরা কোন ঘরে থাকতো জানো?’

– ‘এই গলির পাশের গলির একেবারে মাথায়।’

মানহা একটু এগিয়ে গিয়ে বললো,

– ‘আমাদের একটু দেখিয়ে দিতে পারবে?’

ছেলেটি তাদের সঙ্গে এলো। পাশের গলির মাথায় গিয়ে একটা তালা ঝুলানো ঘর দেখালো।

মানহা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘ইশিরা কাদের সঙ্গে বেশি থাকতো তুমি জানো?’

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,

– ‘এই ঘরের কোকিলা আপুর লগে।’

মানহা ঘরের দরজায় নক দেয়। দরজা খুলে এক বয়স্ক মহিলা।

– ‘কোকিলা আছে?’

– ‘আমি ওর মা, কি দরকার কন?’

– ‘এই ঘরে ইশি এবং একজন বয়স্ক মহিলা থাকতো না?’

– ‘হ্যাঁ, ওরা এখন নাই এখানে।’

– ‘কোথায় গেছে বলতে পারেন?’

তখন কোকিলা এগিয়ে জবাব দিলো,

– ‘ইশিকে কল দিয়া পাইনা প্রথম দিন থাইকা। কোথায় গেছে জানি না।’

মানহা তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

– ‘কোথায় গেছে কে বলতে পারবে?’

– ‘আমজাদ ভাই পারবে উনি টিকিট কাইটা দিছে। লগেও সিলেট গেছিল।’

মৃদুল অবাক হয়ে বললো,

– ‘উনি লগে সিলেট গিয়েছিল মানে? ইশিদের লগে?’

– ‘হ।’

– ‘আমজাদের বাসা কোথায়?’

– ‘কলোনির সামনের দালান বাড়ি আছে না? ওইটায়।’

মানহা বললো,

– ‘আচ্ছা আপনার নাম্বার দিন আবার দরকার হলে কল দেবো, যাচ্ছি আমরা।’

মেয়েটি দরজা বন্ধ করে দেয়। কলোনি থেকে বের হয়ে দালান ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মানহা বললো,

– ‘ইরফানকে একটা কল দিয়ে আগে জানাই যে আমজাদ সিলেট গিয়েছিল ওদের সঙ্গে, এটা কি সে জানতো।’

– ‘আচ্ছা দাও কল।’

মানহা কল দিতেই ইরফান রিসিভ করলো,

– ‘হ্যালো মানহা, কি অবস্থা? কোথায় এখন?’

– ‘আমরা কলোনিতে ইশির পরিচিত এক মেয়ের সাথে কথা বলে এলাম।’

– ‘কিছু জানতে পারলে?’

– ‘ও বলছে আমজাদ না-কি সিলেট গিয়েছিল ইশিদের সাথে।’

– ‘তাহলে আমজাদ কী এখনও সিলেট?’

– ‘না সে এখানেই আছে।’

– ‘বলো কী? তাহলে তো আমজাদ সবকিছু জানবে। ও কিন্তু মানুষ সুবিধার না। তবুও সুন্দরভাবে লোভ দেখিয়ে হাতে আনতে হবে। তোমরা তাকে বলবে যে ইরফান ইশিদের খুঁজে পাচ্ছে না। যে ওর খোঁজ দিতে পারবে পনেরো হাজার টাকা নগদ পাবে। এরকম তার লাভ দেখাবে বুঝেছো? কোনোভাবে তর্কবিতর্ক বা রাগারাগিতে যাবে না।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘রাখছি এখন।’

মানহা কল কেটে মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে রেখে বললো,

– ‘চলো যাই।’

উঠোন পেরিয়ে দালান ঘর। বারান্দায় গ্রিল। মৃদুল ছিটকানি নাড়া দিয়ে ডাকলো,

– ‘আমজাদ সাহেব বাড়িতে আছেন?’

কোনো সাড়া পেল না। আবার সে ডাক দেয়। লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পরনে এক জন বের হয়ে এসে বললো,

– ‘কে আপনারা?’

– ‘আপনি কী আমজাদ সাহেব?’

– ‘হ।’

– ‘ভেতরে গিয়ে কী বসা যাবে? একটু দরকার ছিল।’

আমজাদ দরজা খুলে দিয়ে বললো,

– ‘আসেন।’

তাদের বারান্দার বেঞ্চিতে বসতে দিয়ে বললো,

– ‘কন তো কী দরকার।’

মৃদুল বলতে যাবে মানহা তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বললো,

– ‘আসলে আমাদেরকে ইরফান সাহেব পাঠিয়েছেন৷ এখান থেকে ইশি উনার কাছে যাওয়ার কথা ছিল৷ সে যায়নি এবং কলেও পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ ওর খোঁজ দিতে পারলে পনেরো হাজার টাকা দেয়া হবে ঘোষণা দিয়েও লাভ হয়নি। এখন আপনাকে খুঁজে বের করলাম আরকি। যেহেতু ইশি এখানে ছিল আপনি জানতে পারেন কোথায় গেছে।’

আমজাদ চিন্তায় পড়ে যায়। তারপর নিমিষেই তার চেহারা ঝলমল করে উঠে। কারণ সিলেট তার আর দরকার নেই। এমনিতেই আলেয়া বেগমের সাথে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে। টাকা ফিরিয়ে দিতে কল দেয় প্রায়ই। সুতরাং এদিকে কিছু টাকা হাতিয়ে নিলে ক্ষতি কী। সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘হ, ওর খোঁজ আমি জানি, মেয়েটির ট্রেনে মোবাইল ছিনতাই হয়েছিল। তারপর ইরফান সাহেবের নাম্বার নাই তাই খোঁজে পায়নি। আমাকে বললো একটা কাজ দিতে তখন পরিচিত এক জায়গায় কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছি৷’

মৃদুল আর মানহা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললো,

– ‘ওরা এখন কোথায়?’

– ‘এইটা তো বলা যাবে না, অপরিচিত মানুষকে আরেকজনের ঠিকানা আমি দিতে যাব কেন? তবে ইরফান সাব ইশির পরিচিত জানি। উনার সাথে কলে কথা বলান’ তারপর খানিকটা গলা কেশে নিয়ে বললো, ‘আমার বিকাশ নাম্বারও দিয়ে দিন।’

মানহা মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে দিচ্ছি।’

ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ইরফানকে কল দেয় মানহা। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে সে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘হ্যাঁ ইরফান ভাই, আমজাদ সাহেব তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। উনি না-কি একটা জায়গায় ইশিকে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।’

– ‘কোথায়? ওর ফোন বন্ধ কেন?’

– ‘আমরা অপরিচিত তাই বলতে চাচ্ছেন না, আপনাকে বলবেন।’

– ‘দাও কথা বলি।’

মানহা মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘নিন আমজাদ সাহেব।’

আমজাদ মোবাইল নিয়ে সালাম দিয়ে বললো,

– ‘ইরফান সাব কেমন আছেন?’

– ‘হ্যাঁ ভাই ভালো।’

– ‘ইশিরা কোথায় আছে বলুন তো।’

– ‘এবার ওদের কাছে বলতেছি সমস্যা নাই। আপনি যেহেতু তাদের চিনেন। তা আগে আমার বিকাশ নাম্বারটা নিন।’

– ‘হ্যাঁ বলুন।’

আমজাদ বিকাশ নাম্বার দিয়ে কল রেখে অপেক্ষা করে৷ খানিক পরেই মোবাইলে মেসেজ টিউন বেজে উঠে। সঙ্গে মানহার মোবাইল।

– ‘হ্যাঁ, ইরফান ভাই।’

– ‘জিজ্ঞেস করো টাকা গেছে কি-না।’

– ‘আমজাদ সাহেব টাকা আসছে তো?’

– ‘হ আসছে।’

ইরফানকে লাইনে রেখেই বললো,

– ‘এবার বলুন কোথায় আছে।’

আমজাদ কোনো জড়তা ছাড়াই তাদের স্থানটি বুঝিয়ে বলে দেয়। মানহা আমতা-আমতা করে ইরফানকে বললো,

– ‘তুমি কী চিনেছো?’

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আলেয়া বেগমের বাড়ি কীভাবে পাব বুঝতে পারছি না।’

আমজাদ সেটা শুনতে পেয়ে বললো,

– ‘খেয়ার ঘাটের মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেই চিনিয়ে দেবে।’

____চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here