দেশলাই – ১২ পর্ব
বিশাল পাহাড়ের ওপরে মন্দির। সেখান থেকে চারপাশে তাকালে গাছগাছালিকে মনে হয় সবুজ রঙের লোমশ চাদরে ঢাকা।
সপ্তাহ খানেক খুবই কষ্টে থাকতে হয়েছে তাদের। রাতে ঘুমোতে পারলেও দিনে মন্দিরে থাকা যায় না। এদিকে লক ডাউনের কারণে রাস্তায় গেলে বিপদ।
সুতরাং দিনে তারা জঙ্গলে কাটায়। মোবাইলে চার্জ থাকে না। মন্দির থেকে বের হয়ে পাড়ার সম্মুখের মুদির দোকানে বাবলা দা’র সঙ্গে ফোনে কথা বলানোর পর থেকে মোবাইলে অল্প চার্জ দিয়ে দেয়।
সেখান থেকেই কেবল কলা পাউরুটি জাতীয় খাবার খেয়েই কাটাতে হয়েছে পুরো সপ্তাহ। তবে আশার ব্যাপার হলো অনিমেষ খানিক আগে কল দিয়ে জানিয়েছে, সাত দিনের লকডাউন আজ শেষ হয়েছে। আবার দিয়ে দিতে পারে। সুতরাং অটো নিয়ে হাওড়া যেন চলে যায়। সেখান থেকে বাসে করে বনগাঁ।’
অনিমেষের কথামতো তারা অটো নিয়ে হাওড়া যায়। সেখান থেকে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বনগাঁর বাস খুঁজে বের করতে হয়েছে। অনেক ঝুকিপূর্ণ ছিল। কারণ হাওড়া থেকে দালালরা দেখেশুনে লোক আনে এবং নেয়। অথচ তারা নিজে গাড়ি খুঁজে বের করে যেতে হয়। বনগাঁ এসে অনিমেষ দেখা না করলেও দালালরা তাদেরকে রিসিভ করে। অনিমেষ শেষ কল দিয়ে শুধু বলল,
– ‘জানে বেঁচে গেছিস মাইরি। করোনার মাঝে তোরা এতোদিন বেঁচে আছিস এটাই অনেক ভাগ্য বাড়া। সবই ভগবানের কৃপা আর মা-বাবার আশীর্বাদ, বুঝলি? আমি দেখা করতি পারলাম না। করোনার সময় বুঝিস তো। তোদের বৌদি যেতি দিচ্ছে না। তা ভালো থাকিস, রাখছি। ভগবান তোদের মা-বাবার কাছে ভালোভাবে পৌঁছাক।’
রাফসান আর শফিকের চোখ জলে ভরে গেল। ভাষা আর আদি বন্ধনের কারণে বাংলাদেশীদের প্রতি তাদের সীমাহীন ভালোবাসা। অনিমেষের এতটুকু উপকারের জন্য তারা চির কৃতজ্ঞ থাকবে।
দালালরা তাদেরকে দু’দিন জঙ্গলের খুপরি ঘরটিতে রাখে। সেখানে আরও ছয়জন পাওয়া গেল। তারা কলকাতায়ই ছিল। এখন বাংলাদেশে যাবে। কিন্তু লাইন ক্লিয়ার হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে লকডাউন পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশী দালালদের চাপে তারা ঝুঁকি নিয়ে আটজনকে নিয়ে যায় নদীয়ার দিকে। দিনে একটা বাড়িতে রেখে রাতে হাঁটিয়ে সীমান্তে নেয়। কিন্তু কাঁটাতারের পাশে যেতেই বিএসএফরা দৌড়ানি দেয়। সবাই দৌড়ে জঙ্গলের নানান দিকে ছুটে গিয়ে হারিয়ে যায়। দালালরা আবার সকলকে খুঁজে এনে একত্র করে। একপর্যায়ে গালাগালি করে জানায়, বিএসএফ কখনও জঙ্গলের ভেতরে আসবে না। শুধু সীমান্তের পাশে পেলে ধরবে। সুতরাং দৌড়ে হারিয়ে যাওয়া যাবে না। পুরো রাত রক্ষীদের সঙ্গে লুকোচুরি করে তিনটার দিকে কাঁটাতার কেটে দিল। লাইন ধরে পার করছে। সবার পেছনে শফিক তার আগে রাফসান। আচমকা বিএসফরা চলে এলো কোত্থেকে। রাফসানের আগের সবাই বাংলাদেশ ঢুকে গেছে। সেও দৌড়টা দিল বাংলাদেশের দিকেই। কিন্তু শফিক দ্বিধাদ্বন্দের কারণে ধরা পড়ে গেল বিএসএফের হাতে। রাফসান যেদিকে চোখ যায় খানিকক্ষণ দৌড়াল। তার সামনের ছয়জনের কাউকে পেল না। দৌড়ে কে, কোনদিকে ছুটে গেছে বুঝা যাচ্ছে না৷ রাফসান একা চুপচাপ গহীন জঙ্গলে বসে হাপাচ্ছে। ক্ষুদার্ত নিদ্রাহীন ক্লান্ত বিধস্ত শরীর। এখন সে কোন জায়গায় আছে ঠিক বুঝতে পারছে না। মোবাইলে এখনও ভারতের নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে। অনিমেষকে কল দেয়। অনিমেষ লাইনের লোকদেরকে রাফসানের নাম্বার দিচ্ছে বলে ফোন রাখে। ঘন্টা খানেক পর লাইনের লোকেরা তাকে ফোনে কথা বলতে বলতে বের করে। রাফসান তখনও জানে না শফিক কোথায়। তার ধারণা ওপারে রয়ে গেছে হয়তো।
দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনের লোকদের বলল, ‘আমার সাথের জন কোথায়?’
তারা জানায় লাইনের দু’জন লোক সহ শফিক বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছে।
রাফসানের মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল।
আমতা-আমতা করে বলল, ‘এখন কি হবে ওর?’
– ‘ক্যাম্পে আমাদের লোক গিয়ে কথা বলবে। যদি বিএসএস টাকা চায়। শফিককে বলা হবে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে টাকা আনতে। কিছুই হবে না।’
তারপর মোবাইল হাতে অন্যদেরও ফোন দিয়ে একত্র করে। সীমান্ত থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় একটা বাজারে। দালালদের মাধ্যমে মানিব্যাগের সকল রুপি দিয়ে টাকা এনেছে। সেখান থেকে রাফসানকে বাসে তুলে দেয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে পুলিশ সবার ব্যাগ-প্যাক চেক করে। রাফসানের কাছে কোনো ব্যাগ নেই। কেবল মোবাইলে জিও সীম ভরা। কিন্তু কিছুই হলো না। বাস আবার ছেড়ে দেয়। দেশে ফিরেছে অবশেষে৷ হাফ ছেড়ে বেঁচেছে৷ আহা নিজের দেশ। মুক্ত বাতাস। কিন্তু শফিক? শফিকের জন্য খারাপ লাগছে। মনটা বারংবার হু-হু করে কেঁদে উঠছে। তবে ওর ব্যাগে মোটামুটি সব টাকাই রয়ে গেছে। এই টাকা দিয়ে ছুটে আসতে পারলেই হলো। খানিকটা ঘুম পায়। এক সময় ঢাকা আসে। খাওয়া-দাওয়া করে ঢাকা থেকে বাসে উঠে পরেরদিন ভোরে সিলেট। পুরো রাস্তা ঘুমিয়েছে। বকুল পুর ঢুকতেই রাস্তাঘাটে মানুষের প্রশ্নের নির্যাতনে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে গেল সে। প্রশ্ন করারই কথা৷ কেউ জানতো না এতোদিন সে কোথায় ছিল। স্কুল, ট্রেনের রাস্তা, এই মাটি, মানুষ সবকিছুর প্রতি অন্য এক নয়নে তাকাচ্ছে আজ। কবরগলি পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পাকা দালান ঘরের উপরে সবুজ রঙিন টিন ওয়ালা বাড়ি। আহা ইলি। এই একমাত্র মেয়ে। যে কি-না তাকে প্রথমেই মুখের ওপর বলে দিয়েছিল ইন্তিশা ভালো মেয়ে মনে হচ্ছে না। সেদিন যদি সে ওর কথা শুনতো তাহলে তার জীবনটা আজ এমন হতো না। রাফসান পরবর্তীতে সবই জেনেছিল। ইন্তিশার বিয়ের আলাপ-টালাপ কিছুই আসেনি। সবই ছিল ওর ছলনা, প্রতারণা। রাফসান গেইট খুলে ইলিদের ঘরে ঢুকে। দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিয়ে খুলেই প্রথমে পেল রহিমা বেগমকে। তিনি চমকে উঠার আগেই সে ঠোঁটে আঙুল নিয়ে বলল, ‘চুপ মামী, ইলি কোথায়?’
তিনি হা করে তাকিয়ে রইলেন। কিছুই বলতে পারলেন না। রাফসান ধীরে ধীরে ইলির রুমে গেল। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খুলতেই ইলি মুখের সামনে থেকে উপন্যাস সরিয়ে তাকায়। তারপর আর কোনো কথাই যেন বলতে পারছে না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। এ কোন রাফসানকে সে দেখছে? এ কি অবস্থা হয়েছে ওর?
– ‘কেমন আছিস ইলি?’
– ‘তুমি কোথা থেকে? কোথায় ছিলে এতোদিন?’
– ‘বলবো। সবই পড়ে বলবো। শুধু এটা জানতে পারিস৷ আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। এখন আমাদের বাড়ি চল। আম্মা অনেক বকাঝকা দেবেন জানি। তুই থাকলে একটু সামলে নিবি। হা-হা-হা। চল।’
রাফসানের আচমকা মনে হলো ইলির চেহারা ধপ করে নিভে গেছে। ধীরে ধীরে মুখ লাল হলো। তারপর ঠোঁট নড়তে নড়তে নাক ফুলে গেল। অস্ফুটে বলল,
– ‘দাঁড়াও আসছি।’
রাফসান কিছুই বুঝতে পারলো না। ইলি কি কাঁদছে? কিন্তু কাঁদার কারণ কি?
রহিমা বেগম ম্লান মুখে রাফসানের কাছে এসে বললেন, ‘বাবা গোসল করে আমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়া করে যাও।’
– ‘না, বাড়িতে চলে যাই মামী। ভয়ে আছি আম্মাকে কি বলবো। আর মামা কোথায়? দেখছি না যে?’
– ‘তোমার মামা বাজারে বাবা। আর তুমি এখানে গোসল করে খেয়ে নাও। আমিও যাবো তোমাদের বাড়িতে।’
রাফসান কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কেমন ভয় ভয় করছে তার।
রহিমা বেগম লুঙ্গি আর গামছা এনে দিলেন। রাফসান সাবান হাতে পেছনের শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে যায়। খানিক সাঁতার কাটে। বেশ আরাম লাগছে। তবুও মনের ভেতর কীসের আশংকায় ভয় করছে। গোসল করে সে খেতে বসে। রহিমা বেগম টুকটাক কথা বললেন। ইলিও একটা কামিজ পরে ওড়না পেঁচিয়ে বসেছে পালঙ্কে।
রহিমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?’
– ‘ভারত।’
চমকে উঠলেন রহিমা বেগম। ইলিও পালঙ্ক থেকে বলল,
– ‘ভারত মানে? ভারত তুমি হঠাৎ কীভাবে গিয়েছিলে?’
রহিমা বেগম বাঁধা দিলেন,
– ‘বাদ দাও, খাওয়ার সময় এতো কথা বলা ভালো না।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাফসান উঠে দাঁড়ায়। রহিমা বেগম ইলিকে বললেন,
– ‘তুই বাড়িতে থাক মা। আমি যাচ্ছি। বাড়ি খালি রেখে দু’জন যাব না-কি?’
– ‘আচ্ছা তুমি যাও।’
রহিমা বেগম রাফসানকে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়িতে। রাফসান নিজেদের ঘরে গিয়ে মা’কে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে তার চাচি আর মামীরা কীভাবে বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ছেলেটি আবার বাড়ি থেকে যদি চলে যায়? আবার যদি মাথায় সমস্যা আসে? রাফসান নিজে থেকেই ছোট চাচীকে এসে বলল,
– ‘আম্মা কোথায় গেছেন?’
তিনি রহিমা বেগমের মুখের দিকে তাকান। রহিমা বেগম বললেন, ‘এখানে বসো বাবা। মাথা ঠান্ডা করে বসো। সব বলছি তোমাকে।’
রাফসান আঁজলা করে মুখ ঢেকে পালঙ্কে বসে। সে যেন খানিকটা বুঝে গেছে। তার জন্য হয়তো কোনো বড়ো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। রহিমা বেগম রাফসানের পিঠে এক হাত রেখে বললেন, ‘তোমার মা দুই সাপ্তাহ আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন রাফসান।’
সে মুখ তুলে তাকালো না। মুখ ঢেকেই কেঁপে কেঁপে উঠলো কান্নায়। মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে তার৷ ছোট্ট জীবনে সে একটু বেশিই ভুল করে ফেলেছে। বিধবা মা’কে রেখে সেদিন বেরিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি৷ এখন সে কি করবে? কি করার আছে? তার জীবনটা এমন হয়ে গেল কেন? মাথা তুলে বলল,
-‘আম্মার কবর কোথায়?’
– ‘তোমার বাবার পাশেই।’
ছুটে গেল পশ্চিমের পারিবারিক কবরস্থানে। তাকিয়ে দেখলো বাবার পাশেই নতুন আরেকটি কবর৷ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সবাই গিয়ে টেনে আনেন বাড়িতে।
চলবে…