আমার_হৃদয়ে_সে #রোকসানা_আক্তার পর্ব-৩১

0
593

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩১

চোখের অশ্রু চেপে রাখতে পারলাম না।অবাধ্য পানি গড়গড় করে আবার বেয়ে পড়লো!গালে থাকা হৃদয়ের আলতো হাতটা পানিগুলো পরম স্নেহে মুছে নিল।তারপর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বললো,
“বউ কাঁদে না আর।শুয়ে রেস্ট নাও।আমি ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে আসতেছি।”

বলে হৃদয় আমাকে ছেড়ে বাথরুমে চলে যায়।আমি তাকিয়ে থাকি তার গোপন পথে।চোখের দৃষ্টি হঠাৎ আবেগী হয়ে ওঠে।এই ছেলেটাকে যত দেখছি বরাবরই মুগ্ধ হচ্ছি।এতটা সুন্দর করে মানুষ কীভাবে পারে স্নেহ করতে!কীভাবে পারে সান্ত্বনা স্বর শুনিয়ে তার অপর মানুষটিকে খুব আগলে কাছে টেনে নিতে !এতটা উদার হৃদয়ের কেন মানুষটা?আমি কি পারবো না এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে নিতে?সব অতীত,দুঃখকষ্ট,সবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা এড়িয়ে এই মানুষটিকে খুব করে ভালোবাসতে?

“বউ মা?”

মনের উল্টাপাল্টা ভাবনার ছেদ ঘটে শাশুড়ী মার কন্ঠস্বরে।মনে মনে নিজেকে ধাতস্থতা করে দরজার দিকে এগিয়ে ছিটকিনি টা খুলে দিই।তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি।উনি আমার হাসির পিঠে কেনজানি হাসলেন না। আমাকে পাঁশ কেঁটে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।আপনাআপনি হাসিটা আমার আবার ঠোঁটে চেপে গেলো।উনি চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বলেন,
“হৃদয় কোথায়?”
“জ্বী মা,উনি ওয়াশরুমে।”
“ওহ।”

বলে উনি আমার দিকে ফেরেন।আমার কাছে আসেন।আমার দুই কাঁধে হাত রাখেন।আমি চমকে ফের উনার দিকে তাকাই।এবার উনার মুখটা কেনজানি খুব মলীন মলীন দেখাচ্ছে।চোখের কোলে কিছু পানি চিকচিক করছে আমি তা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি।উনি বলেন,

“বউমা?তোমার শ্বশুরের কথায় একদম মন বেজার করবে না।আসলে ছেলেটা হঠাৎ উনার অগোচরে কিছু করে ফেললাম তো তাই এ নিয়ে একটু মন খারাপ আর কি।আসলে আমার উনাকে আগে বলা উচিত ছিল বিষয়টা।কিন্তু কেন যে বলি নি নিজেও জানি না।তবে,দেখো পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।এই রাগ আর থাকবে না।আর রাগ তখন তো একদমই না যখন আমাদের ছোট্ট নাতি-নাতনীটা হাঁটি হাঁটি পায়ে এসে বলবে,দাদ দাদ দাদ..আবার দু দু…।”

উনার শেষ কথাগুলোতে লজ্জা পেয়ে গেলাম।
তবে শাশুড়ী মা বলে কথা লজ্জা জিনিসটা তো আর উনার সামনে দেখানো যাবে না।তাই লজ্জাটাকে ঢাকতে মুখে মুচকি হাসি টানলাম।উনি আবার বললেন,

“খাবার নিয়ে আসতেছি।সকালে কিছুই তো খাও নি,না?”
“নাহ, খেয়েছি মা।”
“মিথ্যা কথা!তুমি কিছুই খাওনি।হয়তো রাতেও খাওনি।কেননা রাতে না খেলে মুখ শুকনো শুকনো দেখায়।তোমাকে তাই দেখাচ্ছে।চেয়ারে বসো তোমার জন্যে এবং হৃদয়ের জন্যে খাবার নিয়ে আসতেছি।”

বলে উনি এক সেকেন্ড দাঁড়ালেন না।বেগতিক পায়ে দ্রুত হেঁটে গেলেন।উনাকে দেখে আজ আমার কেনজানি আমার আগের শাশুড়ী মার কথা মনে পড়ে গেলো!ইনার মতো আমার সেই শাশুড়ী মাও এভাবে কথা বলতেন।তবে,ইনি সম্ভবত একটু রসিক ধরনের।আর উনি গম্ভীর।ধরনের প্রকারভেদ আলাদা হলেও ভালোবাসা,মায়ার দিক দিয়ে দুজনকে এক লাগছে।একদম এক।উনার চোখেও যেই ভালোবাসা দেখেছিলাম।ইনার চোখেও সেই ভালোবাসাটা দেখলাম!চোখে পানি এসে গেলো।ওড়না টেনে দুই চোখ চেপে ধরলাম।বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে তরতর করে ওড়নাটা নিচে নামিয়ে নিলাম।হৃদয় ওয়ারড্রবের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

“পারু?দাঁড়িয়ে না থেকে বসো।ক্লান্ত তুমি।দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে তো।”

বলে এলোমেলো চুলের গোছাতে চুলে হাত বুলাতে থাকেন।তবে তার এহেন কথায় বেজার মুখটা মুহূর্তে ফিক করে হেসে উঠে।তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠি,
“এত কেয়ার?নতুন নতুন সবাই এরকম কেয়ার।পরে আবার তাকে অসহ্যকর বস্তুর মতন লাগে।”

আমার কথা শুনে হৃদয়ের চুলের গোছায় হাত থেমে যায়। সরু চোখে তাকায়।তবে ওর চোখজোড়া দেখে আমার কেনজানি ভয় ভয় লাগছে খুব।ওর চোখ জলজ্যান্ত আগুনের মতন দেখাচ্ছে।টুপ করে একটু ছুলেই যেন গরম ধোঁয়া বেরুবে।সে চোখজোড়া নিয়েই আমার দিকে ধীর পায়ে এগুতে থাকে।আমি বড়সড় একটা ঢোক গিলে পিছু হটতে থাকি।ভয়ে বুকটা ধুকপুক করছে।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।পিছু হটতে হটতে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে যায়।এবার আর উপায় না দেখে বলে উঠি,

“আর এ’কথা বলবো না।প্লিজ?ওই চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকায়েন না।ভয় করে খুব!”

“কান ধরো!”
“কী!কান ধরবো মানে?”
“বলছি কান ধরো!”
উঁচু গলার স্বর।আবারো আরেক দফা ভয় পেয়ে কেঁপে উঠি। কান ধরি।বলেন,
“দশবার উঠবস করবে।”
“কী উঠবসও করতে হবে?”

হৃদয় সেই গরম চোখেই তাকিয়ে।উঠবস না করলেও দেখি এই ছেলে ছাড়বে না আমাকে।মেরেই ফেলবে!মাগোমা এই ছেলের মার খেলে আর দ্বিতীয়বার শ্বাস নেওয়ার নাক থাকবে না।তারচে মারের থেকে উঠবস করাই ভালো। উঠবস করতে যাবো।ওমনি হৃদয় দয়ার ফুরসত খুলে ফেলে।হাত উঁচিয়ে বলে,

“থাক লাগবে না আর কষ্ট করা।এবার বলো ওরকম নীচক কথা আর কখনোই বলবে না!বলো!?”
“আ-আচ্ছা আর বলবো না।”
“হাত ছুঁয়ে বলো!”

বলে ওর ডান হাত মেলে দেয়।আমি আমার কম্পিত হাত ওর হাতে উপর আলতো রাখি।বলি,
“প্র-মি-জ!”

এবার হৃদয় চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে আসে।মুখে আগের মতন সেই রাগ ভাবটা আর নেই।তাকে স্বাভাবিক দেখে বুকে স্বস্তি আসে।লম্বা করে একটা হাঁক ছাড়ি।সে ঘুরে বিছানার দিকে ছুটে যেতে আমি ধপ করে তার ডান হাতটা ধরে ফেলি।ঘুরে তার সামনে পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তার কপালের উপর লেপটানো ভেঁজা চুলগুলোতে চাপ করে একটা চুমু বসিয়ে দিই। আমার এহেন কান্ড দেখে হৃদয় বরাবর বাকরুদ্ধ।সাথে বিস্ময়ের শীর্ষে।আমি বলে উঠি,
“আপনার ডেভিল মুখে তাকিয়ে তখন ভেঁজা চুলের প্রতি অবাধ্য ইচ্ছেটা লুকিয়েছি।এখন ইচ্ছেটা পূরণ করেছি।আহা শান্তি!”

এমন সময় মা রুমে ঢুকেন।প্লেট ভরা খাবার আনেন।তাগাদা করে বলেন,
“হৃদয়কে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে বসে।বউমা রাত থেকে কিছুই খায়নি।”

“রাতে কিছু খাইনি” কথাটা শুনে হৃদয় বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকায়।আমি মাথা নত করে ফেলি।মা রুম থেকে বেরুবার পরপরই সুযোগ পেয়ে যায় হৃদয় আবারো রফাদফা করতে।হাত চাপড়ে ধরতেই বলে উঠি,

“কালরাত আপনার জন্যে খেতে পারি নি,ডেভিল!”

৪৯.
এভাবে হৃদয়ের সাথে আরো দুই তিনদিন হাসিতামাশা, দুষ্টভরা খুনশঁটি এবং আনন্দে দিনগুলো পার হয়।তবে এরমাঝে আমার শ্বশুর আমার সাথে এক শব্দও কথা বলেনি।আমি উনার রুমে খাবার নিয়ে গেলে উনি বারান্দায় চলে যান।কথা বলতে চাইলে তা এড়িয়ে যান।কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকেন।মোটকথা উনি আমার সাথে কিছুতেই কথা বলতে চাচ্ছেন না।এসব নিয়ে মাঝে মাঝে মনখারাপ হয়েছে। রুমের দরজা বন্ধ করেও বার দুয়েক কেঁদেছিও। হৃদয়ের কথা ভেবে নিয়ে পরক্ষণে নিজেকে আবার ধাতস্থতা করার চেষ্টা করেছি।

৫০.
এখন বিকেল।সন্ধের নাস্তা বানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছি।চায়ের কেটলিটা চুলায় বসিয়ে ডাইনিং এ এসেছি টেবিলটা গোছাতে।টেবিলে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা পিরিচ ছিল সেগুলো রেকে রাখি।গ্লাস ছিল সেগুলোও রেকে রাখি।দরজায় কলিংবেলের বাজে।মা সম্ভবত রুম থেকে বেরুলেন।তিনি আমার পেছনে দিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দেন।আমি তখন আরও ওটা খেয়াল করিনি আর সেদিকে।আমাকে হুট করে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে।পেছন ঘুরে তাকিয়ে হতবাক!মুখ হা করে থাকি।হাসনা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ভাবী?হোয়াট আ সারপ্রাইজ!তোমাদের না জানিয়েই চলে আসলাম।”

আমি হেসে উঠে ওর সাথে নাকে নাকটা ঢলে নিলাম। হৃদয়ের সাথে বিয়ে হবার পর থেকে মেয়েটির সাথে আমার একদিনও দেখা বা কথা হয়নি।আমাদের বিয়ের সেই প্রথম থেকেই শুনেছি তার ফাইনাল পরিক্ষা চলতেছে।পড়ার ভীষণ চাপ।তাই আসতে পারছে না।পরিক্ষা শেষ হলে একবারে আসবে।আজ হয়তো পরীক্ষাটা চুকিয়ে বাসায় ফিরেছে।মেয়েটি নেক্সট বছর ক্লাস টেনে উঠবে।একটা গার্লস হোস্টেলে থাকে।সেখান থেকেই পড়াশুনা করছে।বাসায় রাখে কারণ সে নাকি বাসায় পড়তে চায়না।মেয়েটিকে আমি হৃদয়ের পাঠানো কয়েকটা ফটোতে দেখালম।একদম সিমসাম,শ্যামলা গাঁয়ের রং।বেশ মায়াবী মায়াবী দেখতে।এখন বাস্তবে দেখে তারথেকেও আরো মায়ায় পড়লাম মেয়েটার।গালে হাত ছুঁয়ে বললাম,

“সারপ্রাইজটা বেশ ছিল ননদী।আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।”
“ভাবী,শুনো?কিছু খাবো এখন।প্রচন্ড খিদে লেগেছে।তারপর তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দেব।”
“আচ্ছা,ঠিক আছে।ফ্রেশ হয়ে আসছি।ভাবী ভাত বাড়ছি।”

হাসনা মাথা নেড়ে এক পা বাড়িয়ে আবার থেমে গেলো।ঘাড় বেঁকে,
“ভাবী ভাইয়া কোথায়?”
“হয়তো বাইরে।”
“কলেজে গেছে আজ?”
“হ্যাঁ।সেই দুপুরের পরই ফিরে এসেছে।”
“এখনো ভাইয়ার আড্ডা গেল না?আসুক আজ বাসায়।নতুন বউ রেখে এখনো আড্ডায় পড়ে আছে?বুঝামু!”

বলে হনহন পায়ে ওর রুমের দিকে চলে গেল।শাশুড়ী মা সেদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন,

“বউ মা?হাসনা একটু বেশিই মিশুক ধরনেরর।ওর কথায় কিছু মনে করো না।”
“আরেহ নাহ মা!কি মনে করবো!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here