রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ৯
বড় মামা রোদেলাকে সাথে নিতে চায় নি এত রাত হয়েছে তাই। সিকিউরিটির কথা ভেবে তার দোকানের দুই কর্মচারীকে সাথে নিয়ে নিলো। তবুও একটু ভয় ভয় লাগলো বড় মামার, কারন দিনকাল খুব খারাপ। কোত্থেকে কি হয়ে যায় বলা মুশকিল। মোড়ের মাঠের সামনে দাড়িয়ে বেশ কয়েকবার কল দিলো রোদেলা। ফোনটা বন্ধ…
কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই একটা লম্বা ছেলে কোত্থেকে যেন এলো। সামনে আসার সাথে সাথেই ভড়ভড় করে বিকট একটা গন্ধ লাগলো নাকে। খুব সম্ভবত গাঁজার গন্ধ।
সালাম দিয়ে বললো –
: আপনারা কি নোভেলের বাড়ির লোক।
নাসিমা বললো হ্যা।
: ট্যাকাডা আনছেন…!
বড় মামা বললো –
: কি সমস্যা না জেনে তো টাকা দেয়া যাবে না…
: না দিলে আমি যাইগা, আপনাগো নেওয়া নিষেধ। ট্যাকা দিলে দেন, না দিলে আমি যাইগা….
নাসিমা ছেলেটার হাতটা ধরে অনুরোধ করলো, আমাদের নিয়ে চলো বাবা, ছেলেটার বিপদ… তোমারও তো ঘরে মা আছে বলো, এই মায়ের বিপদে তুমি একটু সাহায্য করো বাবা। আসাদের মনটা মনে হলো নরম হলো।
চলেন খালা, তয় আপনে আর আফা ভিত্তে যাইতে পারবেননা কলাম, মাইয়্যা মানুষ ঢুকা নিষেদ,
তারা রওনা হলো, ঘটনার কিছুই জানা গেলো না, আসাদকে ওদের গাড়িতে তোলা হলো, ওর দেখানো পথে সতেরো মিনিট পর পৌঁছালো ওরা। জায়গাটা জুরাইন রেলগেটের কাছে, খুব সম্ভবত কোন ফ্যাক্টরি। চারদিকে বাউন্ডারি দেয়া। এবার রোদেলার একটু ভয় লাগলো, মনে মনে বের হতে চাইলো না, কিন্তু কেও বললোও না যে তুই গাড়িতেই থাক। ও মনে মনে বললো কেউ বলুক একথা। ও আসলে নিরূপায় হয়ে এসেছে। না আসলে উঠতে বসতে ওর মা কথা শুনাতো। অথচ ওর মায়েরই উচিত ছিলো এ পরিস্থিতির কথাটা চিন্তা করার। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে ও নামল গাড়ি থেকে।
লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠলো তিনতলায়। ভিতরে ঢুকে বোঝা গেলো এটা একটা আয়রন মিল। আসাদ আগে গেলো, পেছনে রোদেলা, তারপর বড় মামা। তার পেছনে বাকীরা।
আসাদ বললো খালা আপনেরা দুজন আইসেন না, বসের কড়া নিষেদ। নাসিমা রোদেলাকে ইশারা দিলো যাওয়ার জন্য। রোদেলা না শোনার ভান করে ঢুকে পরলো। চারদিকে বস্তা টাল দেয়া, বড় বড় ক্যামিকেলের ড্রাম লাইন করে সার দেয়া। সামনে একটা টেবিলের চারদিকে চেয়ারে ঘিরে বসে আছে কতগুলো ছেলে। ওদের সবার বয়স ২৩-২৫ বছরের মধ্যে হবে। এক পলকে সবাইকে দেখে নিলো রোদেলা। সামনের টেবিলে বিরিয়ানির প্যাকেট খালি অবস্থায় পরে আছে, কিছু হাড়, লেবুর খোসা, আধখাওয়া কাঁচা মরিচ, বিরিয়ানির প্যাকেট প্যাচানো রাবার ছড়িয়ে আছে টেবিলময়, কিছু মাউন্টেন ডিউয়ের বোতলের মুখ ও ছড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। কিছু বোতল টেবিলো কিছু নিচে পরে আছে। পরিস্থিতি দেখে বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হয়েছে।
রুমে ঢুকার বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই রোদেলাদেরকে দেখতে পায় নোভেল, ওদের দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো, ওর এক হাতে মাউন্টেন ডিউয়ের বোতল, অন্য হাতে জলন্ত সিগারেট। হাতে থাকা সিগারেটটাকে কায়দা করে লুকিয়ে ফেললো। রোদেলা ভাবলো আটকে রাখলে কেউ এমন অবলীলায় বসে থাকতে পারে না। ওর চেহারায় আতঙ্কের ছিটেফোঁটা ও নেই। ওর চোখের সদ্যজাত ভীতিটাও আমাদের দেখে। ও হয়তো কল্পনাও করে নি আমরা এখন অব্দি আসবো। ওদের পেছনে চালাকি করে নাসিমাও ঢুকলো।
ওদের মধ্যে বস যিনি তিনি আসাদকে ধমক দিয়ে বললেন এরা এখানে কেন। আসাদ পিছন ফিরে দেখে রোদেলা এবং ওর মাও এদিকে ঢুকেছে। নোভেল বড় ভাইকে বললো-
ভাই এরা আমার বাড়ির লোক। বাকীরা ভেবেছিলো বসের কাছে বিচার চাইতে এসেছেন তারা। তিনি নিচের অফিসে এলাকার ছোটখাটো বিচার-আচার করেন। বড় মামা বললো বাবারা কি সমস্যা কিছুই জানি না, তারপর ঘটনা খুলে বললেন তাদেরকে যে তারা কিভাবে জানলো নোভেল এখানে আটকে আছে।
বড় ভাই দাড়িয়ে ওদের বসার জায়গা পরিষ্কার করে দিতে বললেন। বড় মামা বললেন- সমস্যা নাই বাবা, বাড়ির ছেলের এমন খবর শুনে আমরা দৌড়ে এলাম। রাত দিন সময় এসব কিছুই বিবেচনা করি নি।
কিরে নোভেল কি সমস্যা….
নোভেল আমতা আমতা করে…..
পাশে বসা একজন বললো-
আসলে নোভেল একটা বাইক কিনবো, বস কইছে তুই ৫০ হাজার জোগাড় কর, বাকীটা আমি ব্যাবস্থা কইরা দিমুনে। তয় ওয় যে এই নাটক সাজাইবো তা আমরা জানতাম না মামা।
বড় মামা শান্ত চোখে নোভেলের দিকে তাকায়। নোভেল মাথা নিচু করে রাখে। নাসিমা নির্বাক….
বড় ভাই বললো আরে মামা পোলা তো সোনার টুকরা, আসলে হইছে কি বয়সের দোষ। ওরে আটকায়া রাখবো এমন কেউ আছে এই এলাকায়। আপনে একদম চিন্তা করবেন না। ওর দায়-দায়িত্ব সব আমার। আপনারা ওরে নিয়া যান, বকাবকির দরকার নাইকা। ওই নোভেল মাপ চা ব্যাটা মা আর মামার কাছে, এত রাইতে এই শরীর নিয়া আসছে বেচারাগো কি কষ্ট হলো। নোভেলের মাফ চাওয়া পর্ব শুরুর আগেই এক ছেলে ওয়ান টাইম কাপে কফি নিয়ে হাজির। আমরা সবাই বসলাম তাদের অনুরোধে। এ সময় কফিটা খুব দরকার ছিলো। নাসিমা বসে কাঁদা শুরু করলো। বড় ভাইয়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলো৷ ওকে নিয়ে তিনি যে সবার চোখে আজ বিষ তাও জানালো। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হলো কতগুলো টাকা খরচ করে। ক্লাসে একদিন যায় তো আরেকদিন যায় না, কই যায় কি করে কোন ঠিক ঠিকানা থাকেনা। খাওয়ার ঠিক নাই, সময় মতো বাড়ি ফিরে না। বড় ভাই এসব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। সবার হাতে হাতে কফি তুলে দিলেন। রোদেলার দিকে কাপ এগিয়ে তিনি নোভেলকে বলেন – কিরে ব্যাটা তর যে বইন আছে আমাগো তো কস নাই আগে। রোদেলা কফি নিতে নিতে বলে-
আমরা ওর ফুফাতো বোন তাই বলে নাই,
নোভেল নিচে তাকিয়ে মাথা চুলকে নখ খুঁটতে লাগলো। যেন এই মুহুর্তে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর নেই ওর কাছে।
বড় ভাই লোকটা খুব আন্তরিকতা দেখালেন। লম্বা লিকলিকে শরীর, তবে পেটটার দিকে তাকালে মনে হয় এটা তার পেট না। বয়স ত্রিশ বত্রিশের মতো, পান খেয়ে দাঁত কালো করে ফেলেছে। বাম হাতের সব গুলো আঙুলে আংটি। এই লোকটাকে কোন দিক দিয়েই বস গোছের লোক মনে হয় না। এর চেয়ে চা আনলো যে সেও দেখতে ভালো। অথচ তাকে ঘিরে আছে স্বাস্থবান কতগুলো তরুন। তারা বস বস করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। রোদেলা বসে বসে বসেকে অবজার্ভ করছে। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে।
বড় ভাই….!
বস….!
হু…..
বড় মামা আর রেদেলার মাকে একটা কারে কার্ড দিলেন। বললেন এক নামে সবাই চিনে আমারে। কোন সমস্যা হইবো সোজা কইবেন আমি আবু সুফিয়ানের আত্নীয়। বইন শুন এলাকায় চলতে ফিরতে কোনরকম সমস্যা হইলে এই ভাইয়ের কথা স্মরণ করবা। এই কুদ্দুস ফুফুগো বাসায় দিয়া আয়। বড় মামা এবার বললেন –
লাগবে না বাবা, আমরা গাড়ি সাথে নিয়া আসছি।
ওরা বিদায় নিয়ে চলে এলো। নোভেল লম্বা লম্বা পায়ে গাড়ির পিছনে গিয়ে বসলো। সবাই গাড়িতে উঠে গেছে গাড়ি স্টার্ট দিবে এমন সময় বড় ভাই দৌড়ে এলো পার্স হাতে। রোদেলা বললো আহা…
আপনি কেন আসলেন এত কষ্ট করে। উনাদের দিয়েই তো পাঠিয়ে দিতে পারতেন। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আমাদের বাসায় আসবেন একদিন। চায়ের দাওয়াত রইলো।
আচ্ছা আসমুনি ইনশাআল্লাহ। পরিচয় যখন হইলাম আসমুনি ঐদিকে গেলে। মামা বাড়িত গিয়া একটা কল কইরা দিয়েন। আসসালামু আলাইকুম….
ওরা যখন বাড়ি পৌছালো তখন রাত পৌনে তিনটা….
বাড়ি ঢুকে যে যার ঘরে চলে গেলো। নাসিমা গেলো নোভেলের ঘরে। এর পর কি হবে, কি হচ্ছে একটুও জানতে ইচ্ছে করছে না রোদেলার। শরীর খুব ক্লান্ত, সকালে আবার উঠতে হবে, কাল আবার ওদের দুইবার করে পড়াতে হবে, পরশু গণিত পরীক্ষা তাই। রোদেলা কোনমতে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। বিছানাটা যেন ওর পুরো শরীরটাকে ডুবিয়ে দিলো ঘুমের সাগরে। ক্লান্ত রোদেলা মুহূর্তেই ডুব দিলো অতল ঘুমে।
চলবে…..
previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1488433018284551/
next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1490455208082332/