– অনুভূতিরা মৃত পর্ব- দ্বিতীয়

0
361

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
পর্ব- দ্বিতীয়
.
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে বুলবুল স্যার। মাথা নিচু করে বসে আছে রুয়েল। স্যার তখন রুয়েল থেকে কয়েক হাত দূরে। বুকের ভিতর তার কম্পন শুরু। পুরো ক্লাস তখন থমথমে নিরবতা। সকলের চোখ রুয়েলের দিকে, এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে বুলবুল স্যার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যার বক্তব্যের সময় পুরো পৃথিবীর টিভি চ্যানেল তার দিকে মুখিয়ে থাকে এই বুঝি কোনো আজগবি বক্তব্য দিয়ে আবারও বিশ্ব শিরোনামের হেডলাইন বণে যাবেন। বুলবুল স্যারের ব্যপারটাও ঠিক এমনি! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস কোথায় শিক্ষার্থীদের সাথে ভাবের আদানপ্রদান করবেন তা না উনি পড়ে আছেন একজন শিক্ষার্থীর ছেঁড়া শার্ট নিয়ে। রাগে সে গজগজ করছে। বুলবুল স্যারের পার্সোনালিটির কথা পুরো ক্যাম্পাস জানে চেহারায় সবসময় একটা রাগী ভাব থাকে এবং তার চলাফেরায়ও সেটা প্রকাশ করে।
.
স্যার তখন রুয়েলের চোখ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, সে ভাবছে মুহুর্তের মধ্যে কিছু ঘটে যাবে। ক্লাসে উপস্থিত সকলে ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। সকলের চক্ষু চড়কগাছ। এই কী! স্যার রুয়েলের শার্টের বোতামে হাত দিচ্ছেন।
— এগুলো কি লাগানোর প্রয়োজন মনে করো না? আমার ক্লাসে এসব চলবে না।
রুয়েল বুঝতে পারে ছেঁড়া শার্টের তকমার কারণ! শার্টের বোথাম দুইটা খুলা। সে এমন কখনও করে না ভুলবশত অতি রোমাঞ্চে বোতাম লাগানো হয়নি। যেই কারণে ছেঁড়া শার্টের অপবাদ। সে ছোট করে “সরি’ বলে।
.
বুলবুল স্যারের রাগ কিছুটা কমে আসে। শান্ত গলায় আবার প্রশ্ন করেন।
— নাম কী?
— রুয়েল!
বুলবুল স্যার আবার রেগে উঠেন। গর্জন করে বলেন।
— নামের আগে পিছে কিছু নেই?
রুয়েল উত্তর দেয়, সাকিব হাসান রুয়েল। উত্তর দিয়ে সে এবার কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এই বুঝি স্যার থেমে গেছেন। আর কোন প্রশ্ন করবেন না। কিন্তু সে জানে না বুলবুল স্যার পৃথিবীর এমন এক শিক্ষক যিনি শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করলে করেই যান। শিক্ষার্থীকে না আটকানো পর্যন্ত থামার কোন ইচ্ছে নেই। স্যার আবার প্রশ্ন করেন৷ তার পুরো নামের অর্থ জানতে চান। রুয়েল উত্তর দেয়।
— সাকিব শব্দে অর্থ উপহার, হাসান শব্দের অর্থ ভদ্র, রুয়েল শব্দের অর্থ……..
রুয়েল শব্দের অর্থ তার জানা নেই, রুয়েল নামে এসে সে আটকে যায়। চোখেমুখে তার পরাজয়ের ছাপ। বুলবুল স্যারের মুখে বিজয়ের হাসি৷ মনে হচ্ছে এইমাত্র বুলবুল স্যার এভারেস্ট জয় করে এসেছে। হঠাৎ করে স্যারের ফোন বেজে উঠে, স্যার রিসিভ করে কথা বলে। ফোন আসায় আজকের মতো বুলবুল স্যার থেমে যান। রুয়েলকে ইশারা করে বসতে বলেন।
.
প্রথম ক্লাসে পরিচয় পর্ব হয় ততোক্ষণে শিক্ষার্থীরা ভুলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় এক স্বপ্নের নাম। যেই স্বপ্ন প্রতিটি শিক্ষার্থী পুষে রাখে। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের অভিষেক ক্লাসে শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল অন্য রকম একটা দিন। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বুলবুল স্যার আছেন সেখানে বোধহয় পরিচয় পর্ব হয় না। মূহুর্তেই সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে স্যার পরিচয় পর্বের ঘোষণা দিলেন। প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করেন এরপর এক এক করে সকল শিক্ষার্থী তার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। সেদিকে রুয়েলের মনােযােগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসটা তাকে লজ্জায় ডুবতে হলো! হতে পারতে অন্যরকম। পরিচয় পর্ব শেষে বুলবুল স্যার জীবনের অতি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে ক্লাসের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
.
নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখরিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। কেউ কেউ ছুটছে, সিনিয়রদের সাথে পরিচয় বাড়াতে, কেউবা নতুন বন্ধুদের সাথে কফি মগে আড্ডার ঝড় তুলছে। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ ভেসে উঠছে নবীনদের চোখে–মুখে। পরিচয় পর্ব থেকে শুরু করে শিশির ভেজা শীতের স্নিগ্ধ রোদে সবুজ ঘাসের বুকে আড্ডায় মেতেছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। এসবে যেন রুয়েলের মন নেই।
.
প্রথম দিনের ক্লাস শেষে সে হেঁটে ফিরছে। পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তা। শীতল বাতাস। জনমানব শূন্য রাস্তা তাকে হাঁটতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই তার মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো একটি মেয়ে। তার স্পষ্ট মনে আছে মেয়েটি তার ক্লাসে ছিল নাম মিহি। কিন্তু সে কেন তার পিছু হাঁটবে? ভাবতে থাকে রুয়েল। তার ভাবনায় জল ঢেলে মিহি নামক মেয়েটা রিকশায় করে চলে যাচ্ছে। আজ তার হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগছে। হেঁটে হেঁটে এসে থামল নদীর পাড়। নদী মাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের অঙ্গে বহমান তেরো শত নদী। শ্যামল মাটির অঙ্গে এ নদীগুলো যেন দেশের প্রাণ। নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। নদী নিয়ে গান কবিতা লিখেছেন অসংখ্য কবি লেখকরা। নদীর কাঁদা মাটিতে দৌড় ঝাপ খেলেছেন, জীবনানন্দ, জসিম উদ্দীনরা। নদীর পাড় বসে অগণিত গান লিখেছেন বাউল শাহ আব্দুল করিম। বলেছেন, নদী ও তার বুকে ভেসে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের কথা। স্কুল জীবনে প্রতিটি শিশুর মনে গেঁথে আছে রূপসী বাংলার অমর কবি জীবনানন্দ দাশের অমর কবিতা– আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে। কিংবা সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক তার আত্মপরিচয়ের কথা তো সবারই জানা। নিজের আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে সৈয়দ শামসুল হক এ দেশের নদীর কথা বলেছেন কবিতায়- ‘আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি। চলি পলি মাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে। কিংবা তেরো শত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে? আহা মা ও মাটি নিয়ে কত সুন্দর লিখেছেন দেশের সন্তানরা। গান রচিত হয়েছে– এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে, আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়। এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম, আনন্দ বেদনা মিলন বিরহ সংকটে। নদী নিয়ে গান কবিতাগুলো যখন ভেসে উঠে রুয়েলের মন শীতল হয়ে যায়।
.
রুয়েল সাধারণত প্রকৃতি প্রেমী। ভ্রমণ পিপাসী, বইপড়ুয়া একটি ছেলে। মাঝেমধ্যে টুকরো টুকরো লিখে পাহাড়, সমুদ্র তার ভীষণ ভালো লাগে। তার কাছে পাহাড় যদি প্রেম হয়, সমুদ্র তবে ভালোবাসা, পাহাড় যদি কাছে টানে সমুদ্র তবে আঁকড়ে ধরে। প্রকৃতির প্রতি এই ভালোবাসা তাকে বারবার ছুটে নিয়ে যায়৷ সবুজ পাহাড়ের বুকে ছাউনিতে বসে কফি মগে চুমুক দিতে দিতে অসংখ্য বার পাহাড়ের প্রেমে পড়েছে কিন্তু ভালোবাসা? অসংবার প্ল্যান করেও ভালোবাসা সমুদ্রের দর্শন মিলেনি তার। এই নিয়ে রুয়েলের বড্ড আফসোস। সেই ভালোবাসাকে যেন নদীর মধ্যে খুঁজে বেড়ায়। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা নামা দেখে, কখনো ছোট ছোট ঢেউয়ে সমুদ্রের গর্জন খুঁজে।
.
নদীর পাড়ে ভালোবাসা সমুদ্রকে খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। পায়ে হেঁটে রিকশায় করে বাসায় পৌঁছাল। কলিংবেলে চাপ দিতেই মা এসে দরজা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকতেই মায়ের প্রশ্ন।
— বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন কেমন কাটলো?
রুয়েল তখন শুরু করে বুলবুল স্যারের অপবাদ। বুলবুল স্যারের নামে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর কথা মাকে বলেন। মা রাগেন এই মূহুর্তে বুলবুল স্যারকে কাছে পেলে তেলে ভেজে ডিনার বানিয়ে রুয়েলের জন্য ডাইনিংয়ে পাঠাতেন। রুয়েল তখন বুলবুল স্যারের তেলে ভাজা মগজ তৃপ্তি করে খাবে। খাওয়া শেষে বলবে “আহা স্বাদ”। এসব ভেবেই মা ছেলে রসিকাতায় মেথে উঠে।
.
ডিনার শেষে ক্লান্তির ছাপ৷ রাতের আঁধার নিভে সকালের সূর্য মামা জেগে উঠে। শীতের আলস্য ঘুম ভেঙ্গে কোনরকম নাস্তা শেষ করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে ছুটে। তার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুর্বলতাগুলো দেখে। রাস্তার টঙ দোকানে গরুর দুধের চা খেতে বিরতি দিয়ে থামে রুয়েল। এক কাপ চা খেতেই শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে গেল৷ এই কারণে বোধহয় শীতকালে চা খোর বেড়ে যায়। এক কাপ চায়ের বিনিময়ে টঙ দোকানে মধ্য বয়স্ক দোকানি সাত টাকা বিল ধরিয়ে দেয়। ওয়ালেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দোকানির হাতে দিতেই দোকানি তাকে একটি মিল্ক চকলেটের সাথে দুই টাকার নোট দিলো। চোখ বড় করে রুয়েল জানতে চাই।
— চকলেট কেনো?
দোকানি জানায়।
— এক টাকার কয়েন না থাকায় খুচরা দিলাম।
রুয়েল চোখ বাকা করে বলে,সে চকলেট নিবে না তাকে এক টাকার খুচরা দিতে হবে। দোকানি বিরক্ত হোন কিন্তু তা প্রকাশ করেন না। অনেক খুঁজে এক টাকার কয়েন তার হাতে দিল। রুয়েল হাসিমুখে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটা ধরল। কিছুদূর যেতেই আবার পিছন ফিরে আসেন অবাক দৃষ্টিতে দোকানি চেয়ে থাকেন। এক টাকার কয়েনটি দোকানির হাতে দিয়ে বলেন। একটা মিল্ক চকলেট দিন। দোকানি এবার ট্যারা ট্যারা চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
.
চলবে……………
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here