অনুভূতিরা মৃত পর্ব- তৃতীয়

0
214

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
পর্ব- তৃতীয়
.
দোকানি এবার ট্যারা ট্যারা চোখে তাকিয়ে আছেন। রুয়েল আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে, দোকানি স্বাভাবিক হয়। চকলেট নিয়ে রুয়েল হাঁটতে শুরু করে। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে দোকানি। সে ভাবে এমন ছেলের সাথে যেন আর দ্বিতীয় বার দেখা না হয়। ক্লাস আজ জনমানব শূন্য। ক্লাস শুরু হতে বিশ মিনিট বাকি রুয়েল ছাড়া এখনও কেউ ক্লাসে পা রাখেনি।
.
ক্লাসের দ্বিতীয় দিন। বুলবুল স্যারের অপেক্ষায় শিক্ষার্থীগণ অধীর আগ্রহে বসে আছে। বুলবুল স্যার প্রবেশ করতেই সকলে নড়েচড়ে বসলেন। স্যারের মুখে বিষন্নতা ফুটে উঠেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মিসেস বুলবুলের সাথে ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার তেজ কিছুটা রয়ে গেছে, মিসেস বুলবুলের উপর রাগ যেন কোনভাবে শিক্ষার্থীদের সাথে না ঝাড়তে হয়। সেদিকে বেশ সতর্ক। মূহুর্তেই স্যারের চোখ হোয়াইট বোর্ডে আটকে গেল। হোয়াইট বোর্ডে একটি অদ্ভুত ছবি আঁকা। ছবির মানুষটির এক হাতে বেত আর অন্য হাতে মার্কার পেন। চোখ দুটো বড় বড়। চেহারায় রাগী ভাব। অনেকটা বিশ্রী দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ বুলবুল স্যারকে আঁকতে চেয়েছিল। নিচে একটা ক্যাপশনে লেখা এনএইচবি। এনএইচবির পূর্ণরূপ বুঝতে বুলবুল স্যারের কষ্ট হয়নি এনএইচবির অর্থ হলো এনামুল হক বুলবুল। তার মানে স্যারের এই বিশ্রী ছবিটি ক্লাসের শিক্ষার্থী এঁকেছে? চিৎকার করে বুলবুল স্যার প্রশ্ন করে কিন্তু সকলে নিশ্চুপ। এক এক করে জানতে চাই, ক্লাসে উপস্থিত প্রতিটি শিক্ষার্থীর বুক কাঁপছে, কে করেছে এই কাজ? একজন আরেক জনের দিকে তাকাচ্ছে, রুয়েলের ইনোসেন্ট ফেইস দেখে কেউ টেরও পাবে না এটা তার কাজ। স্যার রাগছে মনে মনে সে হাসছে।
.
স্যারের চোখ তখন রুয়েলের দিকে, মুহুর্তেই তার বুক ধক করে উঠে। স্যার কি বুঝে ফেলেছে?
— কি খাচ্ছো?
বুলবুল স্যারের প্রশ্নের উত্তরে সে বলে।
— চকলেট
স্যার কিছুটা রেগে বলল।
— আমরা এতগুলো মানুষ ক্লাসে মনোযোগী আর তুমি চকলেট খাচ্ছো?
রুয়েল স্যরি বলে। স্যার নিশ্চুপ। ক্লাস শেষ করে দিবে। সকালে মিসেস বুলবুলের সাথে ঝগড়া, ক্লাসে এসে এমন অদ্ভুত ছবি দেখে জনাব এনামুল হক বুলবুল স্যারের মেজাজ ঠিক নেই। যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের উপর ঘটে যেতে পারে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। প্রথম ক্লাসের মতো দ্বিতীয় ক্লাসটি স্যার শেষ করতে চাইনি৷ প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে হাসিমুখে ক্লাসের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।
.
ভার্সিটির দ্বিতীয় দিন। রুয়েল এখনও কারো সাথে বন্ধুত্বে যায়নি। তার জীবনটা এমনি সে একলা চলতে পছন্দ করে। মাঝেমধ্যে নিজের সাথে নিজে দুষ্টমি করে। এই যে, সকালে টঙ দোকানে মামার সাথে কী দুষ্টমিটা না করল। বুলবুল স্যারের অদ্ভুত ছবিটা কি স্যার এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে? জীবনে চলার পথে বন্ধু প্রয়োজন কিন্তু সে বন্ধুহীন। স্কুল জীবন কাটিয়েছে সুনামগঞ্জের সীমান্ত ঘেরা এক মফস্বল গ্রামে। কলেজ জীবন শুরু করেছিল বন্দর নগর চট্টগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সবে শুরু। ক্যান্টিন থেকে এক কাপ লাল চা হাতে ক্যাম্পাস থেকে প্রস্থান করল।
.
চা প্রিয় বাঙালি দিনের শুরুতে এক কাপ চা না পেলে কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে,,
কাজের চাপ বা অলসতার ফাঁকে অথবা দিনের যে কোন সময় চায়ের কাপে ঠোঁট বুলাতে ভালোবাসেন এদেশের মানুষ। এক এক জনের এক এক রকমের চায়ের তৃষ্ণা। কারো পছন্দ দুধ চা আবার কারো লাল চা। গবেষণা বলছে দুধ চায়ে কোন উপকারিতা না থাকলেও লাল চায়ে রয়েছে ব্যপক উপকারিতা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো থেকে শুরু করে, ট্যানিন ফ্লু, ঠান্ডা, ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। হজম ভালো করে। মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মনোযোগ বাড়ায় সেই সাথে
ক্যানসার প্রতিরোধে লাল চায়ের ভূমিকা অপরিসীম।
.
শহরের ফুটপাত দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে আনমনে হাঁটছে রুয়েল। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলাে কেউ তাকে অনুসরন করছে, ব্যস্ত দুপুর কেউ কারো দিকে প্রয়োজন ছাড়া মূল্যবান দৃষ্টি বুলায় না। এই শহরে তাকে অনুসরণ করে হাঁটার মতো মানুষের বড্ড অভাব। পিছন ফিরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আবারও হাঁটা শুরু করল। কিছুদূর যেতেই আবার মনে হলাে কেউ অনুসরণ করছে, রৌদ্রময় দুপরে ছায়া দেখতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে আবিষ্কার করল গতকালকের মেয়েটি। নাম মিহি। রুয়েল তাকাতেই মিহি ইশারা করে হ্যালো বলল। মেয়েটির ডাকে রুয়েল কোন সাড়া দেইনি। গত দুই বছর হলো মেয়েদের এড়িয়ে চলে। কোনরকম মেয়ে বন্ধুও নেই। মিহির ডাকে সাড়া না দিয়ে রিকশায় উঠে বসল। বোকার মতো তাকিয়ে আছে মিহি। এমন কেন ছেলেটা? কেমন যেন অদ্ভুত! অদ্ভুত মানে খারাপ না। অদ্ভুত মানে অদ্ভুত। একটা মেয়ে তাকে ইশারা করে ডাক দিল আর সে চুপচাপ চলে গেল। মনে হয় কিছুই হয়নি, কিছুই বলেনি। মিহির রাগ হয় বেশ।
.
বাসায় এসে টিভি অন করে বসে রুয়েল। আজ বাংলাদেশ পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। বাঙ্গালির আবেগ নিয়ে ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি খেলছে, বাংলাদেশের খেলা মানে ভিন্নরকম এক দিন। অফিসে কাজের ফাঁকে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে শো-রুমের টিভিতে, পথে রেডিওতে, কিংবা ক্লাসে বসে ইন্টারনেটে স্কোর দেখা ক্রাড়ীপ্রেমী বাঙ্গালির সংখ্যা নেহাত কম নয়। মিরপুর মাঠে লাল সবুজের জার্সিতে কানায় কানায় ভরে উঠছে, এ যেন বাংলাদেশের ভিতর ছোট একটা বাংলাদেশ। বাঙ্গালির উৎসবমুখর পরিবেশ জিতলেই এশিয়ার চ্যাম্পিয়ান। মাঠে নেমেছে ওরা এগারজন। লক্ষ্য একটি শিরোপা। মাঠ ও মাঠের বাইরে টিভি স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে কোটি বাঙ্গালি। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। পাকিস্তান নামটি শুনলে এখনও এদেশের যুবকদের রক্ত শিরা গর্জে ওঠে। বায়ান্ন, ছয়শট্টি কিংবা একাত্তর ইতিহাসের পাতায় বাঙ্গালির জয়। আজকেও আসুক এমন একটি বিজয়। যে বিজয়ের উৎসবে মেতে উঠবে রাজপথ। হোক না একটা দিন শুধুই ক্রিকেটময়। রাজপথে মিছিল হোক জয় বাংলা উৎসবে।
.
নির্ধারিত ওভার ব্যাট করে পাকিস্তানের সংগ্রহ ২৩৬ রান। ২৩৭ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে শুরুটা ভালোই হয় মাঝে দিয়ে ছন্দপতন আবার উঠে দাঁড়ায়। শেষ ওভারে প্রয়োজন ১০ রান। ওরা পারবে কি? পারবে কি প্রথমবারের মতো এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে? গোটা ক্রিকেট বিশ্বের তখন মিরপুরে চোখ৷ কী হতে চলছে, কোন মিরাক্কেল ঘটবে না তো? কফি হাতে তাকিয়ে আছে রুয়েল। গরম কফি রেখে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ দাঁড়িয়ে পরল সে। দুই রাকাত সুন্নত আদায় করে বাংলাদেশের প্রার্থনায় কেঁদে উঠেছে। লাস্ট ওভারের প্রথম বলটি করে ফেললেন পাকিস্তান পেসার আইজাজ চিমা। পাঁচটি বল শেষে ম্যাচের পরিসংখ্যান দাঁড়ায় এক বলে চার রান। পুরো স্টেডিয়াম থমথমে নিরবতা। গােটা বাংলাদেশ তখন এক সুতােয় বাঁধা।
.
কী হতে কী হয়ে গেল? মিরপুরে তখন গোটা জাতির বিষাদমাখার উৎসব। জয় পেতে পেতেও না– পাওয়ার হতাশা বাংলাদেশ শিবিরে ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে,, কান্না ছেয়ে ফেলল খেলোয়াড়দের। মাত্র দুটো রান হাজার ক্রোশের ব্যবধান। দুই রানের পরাজয়। তামিম ইকবাল শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে, যে দৃষ্টিতে ছিল সবকিছু হারিয়ে ফেলার চাহনি। পাথর হৃদয়ের মানুষ সাকিব আল হাসান শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। মুশফিকুর রহিম আটকাতে পারলেন না নিজেকে, সাকিবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। হাঁটু ঘেরে বসে আছেন মাশরাফি। দেখতেই গা শিউরে ওঠে! কী ভয়াবহ দৃশ্য। সবার মতো কাঁদতে থাকে রুয়েল। ভাবতে থাকে দুইটি রান অতিরিক্ত না হলে কী হতো, কী হতো সাকিব যদি দুইটি রান বেশি করতো। মাশরাফি কেন বোলিংয়ে এসে দুইটি রান কম দিলো না। এসব ভেবেই তার দু’চোখ ভার হয়ে আসে। তার মতো কোটি বাঙ্গালি মেতে উঠে এই বিষাদ মাখা উৎসবে। সবার চোখের ভাষা এক, সবার বুকের কষ্ট এক, সবার চাওয়া ছিল এক, সবার ভালবাসাও এক! এটাই দেশপ্রেম। দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
.
চোখের অশ্রু তার গড়িয়ে পরছে, মুহুর্তেই মনে হলো ‘শীতকালীন গল্প প্রতিযোগিতা’র কথা। ফাইনাল রাউন্ড চলছে, শত শত গল্পকারদের পিছনে ফেলে ফাইনাল রাউন্ডে সেরা গল্পকার নির্বাচনে সে বেশ এগিয়ে। আগামীকাল গল্প জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। লিখতে হবে তাকে, ল্যাপটপ অন করে লিখতে বসল। গল্পের প্লটটি অসাধারণ। নিঃসন্দেহে পাঠকদের কাঁদাবে। এমন একটি গল্প লিখতে সে নিজেই বারবার কেঁদে উঠছে, শব্দগুলো খেয় হারিয়ে ফেলছে, টানা তিন ঘন্টা বিশ মিনিট ল্যাপটপের কিবোর্ডে চেষ্টার পর সম্পুর্ণ করল গল্পটি। প্রতিযোগিতার কতৃপক্ষের মেইলে সেন্ড করে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তখন তিনটা অতিক্রম করছে। প্রচণ্ড ঘুমে তার চোখ অবশ হয়ে আসছে। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় সে৷ ঘুম ভাঙ্গে সকাল ন’য়টায়। তড়িঘড়ি করে ভার্সিটির উদ্দেশ্য ছুটে চলে। ক্লাসে পৌঁছাতে ত্রিশ মিনিট লেইট। বুলবুল স্যারের ক্লাস। ভয়ে তার বুক কাঁপছে৷ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল সে। ‘মে অ্যাই কামিং স্যার’ বলতেই চোখ বড় করে তাকালেন মিস্টার এনামুল হক বুলবুল স্যার।
.
চলবে……………
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here