রোদেলা লেখা: মাহাবুবা মিতু পর্ব: ১৫

0
946

রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১৫

হসপিটালে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে নয়টা বাজলো। হসপিটালে ঢুকতেই দেখলো বাইরের ওয়েটিং লাউঞ্জে সবাই বসে আছে। শোভন এখন ঘুমিয়ে আছে। বড় মামীকে দেখে নাতাশার শ্বাশুড়ি এগিয়ে এলেন। কিভাবে এমন হলো জিজ্ঞেস করতেই ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করলেন তিনি। শোভনের মা এক কোণের চেয়ারে বসে তসবিহ পড়ছেন। ধর্মকর্মে তিনি অনুকরণীয় ব্যাক্তিত্ব । এত বড় বিপদে ও কি সুন্দর স্থির তিনি। রোদেলার দিকে চোখ পরতেই একটা সৌজন্য হাসি হাসলেন। রোদেলা তার কাছে গেলো। তার পাশে বসলো, তিনি রোদেলাকে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছো……

রোদেলা কোন উত্তর দিলো না, তার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। রোদেলার ভিতরের অনুভূতি গুলো কেমন দলাপাকিয়ে আসছে, গলা, চোয়াল শক্ত হাতে শুরু করছে। কান্না আসছে মনে হয়। রোদেলা তার হাত স্পর্শ করলো। হাতটি দুই হাতে আলতো করে ধরে ওর কাছে এনে বললো
: আন্টি আপনি এই বিপদে কিভাবে এমন স্থির রয়েছেন আমাকে শেখাবেন…?
আমি যেন বিপদে আপনার মতো স্থির থাকতে পারি । একটু বলেই মুখের কাছে হাতটা নিয়ে কেঁদে দেয় রোদেলা। তিনি অন্য হাত রোদেলার মাথায় রাখলেন। বললেন দোয়া করো মা আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করো। বলে তিনিও কেঁদে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন কোন অপরাধের শাস্তি আল্লাহ আমার ছেলেকে দিলেন….
রোদেলা মাথা উঁচু করতে পরলো না, নিজেকে অনেক অপরাধী লাগছে ওর। কিভাবে তাকাবে ও….

পাশের সবাই ওদেরকে অবাক হয়ে দেখলো দেখলো। নাতাশার শ্বাশুড়ি বললেন
: ভাবী কোন বিপদের সময় এমনি পাথর হয়ে যান। কান্না পর্যন্ত করেন না, এটা উনার একটা সমস্যা। মাঝে মাঝে এমনও হয় যে বিপদের কথা শুনে তিনি শক্ত হয়ে বসে রইলেন। পরে তার স্ট্রোকের মতো হয়ে যায়। পরে তাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। এজন্য আমরা তাঁকে কোন দূর্ঘটনার খবর শুনাই না।

কল্লোল বললো আমার জ্ঞান হওয়ার পর এই প্রথম তাকে কাঁদতে দেখলাম। অনেক ছোটবেলায় বাবা-মাকে পরপর হারিয়ে তিনি এমন হয়ে গেছেন। না কাঁদতে পারায় তার হার্টে সমস্যা হয়ে গেছে। বড় মামী বাইরে থেকে এক পলক দেখতে চাইলো। কল্লোল তাঁকে কেবিনের সামনে নিয়ে গেলেন। কল্লোল বললো মাথায় সামান্য আঘাত পেয়েছে, হাতেও সামান্য ফ্র্যাকচার হয়েছে। তবে পায়ের হাড়ে বড় ফাটল হয়েছে। ঔষধে না সাড়লে ছোট্ট একটা অপারেশন করাতে হবে। রোদেলা শোভনের মায়ের পাশে বসেই এসব শুনছে।

রেদেলা শোভনকে দেখতে গেলো না। ও মনে মনে ভাবলো ওকে দেখার অধিকার ওর নেই। আজ ওর জন্যই এমন পরিণতি হয়েছে শোভনের। নাতাশা হঠাৎ এসে বললো বৌমা শোভন ভাইয়ার ঘুম ভেঙেছে চলেন কথা বলে আসবেন। এই ঘুম নিয়ে ভয়ে ছিলো ডাক্তাররা, এমন ঘুম অনেক সময় কোমায় পৌঁছে দেয় রোগীদের। সবাই কেবিনে ঢুকলো। শোভনের মা শুকরিয়া জানাতে দু’রাকাআত নামাজ পরলেন। তারপর ছেলেকে দেখতে গেলেন। রোদেলা ততক্ষণ ওখানেই বসে ছিলো।

রোদেলা একা বসে আছে দেখে নাতাশা ওর কাছে এসে বললো
: আপা চল ভাইয়াকে দেখবি…
: না, আমি যাবো নারে।
: হসপিটালে এলি, এতক্ষণ বসে রইলি, না দেখলে খারাপ দেখায়। চল আপা…
: নারে নাতাশা, আমি ওনাকে এইভাবে দেখতে চাই না।
এমন সময় কল্লোল এসে বললো
: ভিজিট আওয়ার শেষ হয়ে যাবে, চলুন।
রোদেলা ভয়ে যাচ্ছে না, পাছে ও কেঁদে ফেলে, আর সবাই জেনে যায় যে এত রাতে ওর সাথে দেখা করতেই শোভন হাসনাবাদে গিয়েছিল।

নাতাশা একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলো ওকে। ঘরে ঢুকতেই রোদেলা দেখলো মাথায় ব্যান্ডেজ করা। হাতেও ব্যান্ডেজ। পায়ে হাঁটুর কাছে ছিদ্র লোহা ঢুকিয়ে দিয়ে
পাঁচ লিটার পানির বোতল দিয়ে টানা দেয়া।

কল্লোলের মা তার বেয়াইন কে বলছেন-
মাথায় তেমন আঘাত পায়নি , হাতে সামান্য ফ্র্যাকচার, পায়ের হাড়ে সামন্য ফাটল হয়েছে, ডাক্তার বলেছেন ঔষধে সেড়ে যাবে। এসব কোন ব্যাপার না আজকাল। চিকিৎসা বিজ্ঞান কত উন্নত হয়েছে। কথা গুলো শোভনের মাকে সান্ত্বনা দিতে বলছেন তিনি তা সকলেই জানেন।

ও সবার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। কেমন যেন ধরা পরার ভয়ের মতো ভয় ওর মনে জেঁকে রইলো। এমন সময় শোভনের বোন হুড়মুড় করে কেবিনে ঢুকলো। রোদেলা গেইটের কাছে থাকায় ধাক্কা লাগলো ওর গায়ে, তিনি এটা খেয়ালও করলো না। রোদেলা ভাবলো মনের যা অবস্থা তাতে খেয়াল না করাই স্বাভাবিক।
ভাইয়ের কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল –
কিভাবে এসব হলো ভাই, কে তোর এমন ক্ষতি করলো…
এত রাতে তুই কেন ঐখানে গিয়েছিলি….

এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করে কান্নায় ভেঙে পরলেন তিনি। কল্লোল ওকে বকা দিয়ে বললো
: পাগল হইছিস এ্যামি… এসব কথা বলার সময় কি চলে যাচ্ছে… উনি পাশের সোফায় বসে কাঁদতে থাকলো। এমন সময় একজন নার্স এসে বললো রোগীর গার্জিয়ানদের ডাকছেন ডাক্তার। আর ঘরের ভিড় কমান। এত লোক দেখলে ডাক্তার রাগ করবেন।
কল্লোল, কল্লোলের মা, এ্যামি, নাতাশা, বড় মামী সবাই গেলো ডাক্তারের কথা শুনতে। শোভনের মা আর রোদেলা রইলো ঘরে। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। রোদেলা সেখানেই দাড়িয়ে। হঠাৎ শোভন উফ্ করে কাতরে উঠলো। ওর মা বলছে…
: আহা… বাবা ব্যাথা পাইছিস,
: না, মা তুমি চুলে হাত বুলিয়ে দাও, ভালো লাগছে

রোদেলার হাত-পা কেমন ভেঙে আসছে, ও দাঁড়াতে শক্তি পাচ্ছে না। তাই কাছের সোফাটায় বসতে যেতেই হাত লেগে ঔষধের প্যাকেটটা পরে যায়, সেই শব্দে শোভন মাথাটা ঘুরিয়ে তাকালো। দেখলো রোদেলা ঔষধ গুলো তুলছে। শোভন জানতো না ওর মা ছাড়া অন্য কেও এ ঘরে আছে…

ও কেমন কাচুমাচু করে বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো, শোভন বললো-
: আপনি এসেছেন…?
মনে মনে বলে রোদেলা –
: আপনি….!
: এত কষ্ট কেন করলেন। তেমন কিছু না সামন্য একটু ব্যাথা বলে শরীর ঘুরাতেই আবার কাতরে উঠলো ব্যাথায়। রোদেলা দৌড়ে এসে বললো আপনি নড়বেন না। ব্যাথা অল্প না বেশী তা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে।

একজন নার্স এসে বললেন রোগীর মা কে…
জরুরি কিছু পেপার সাইন করতে হবে, আপনি আসুন আমার সাথে। শোভনের মা নার্সের সাথে চলে গেলো। রোদেলাকে বললো তুমি ওর পাশে থাকো একটু। আমি আসছি….

রোদেলা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, শোভনও ওর দিকে তাকানো।

বেশ কিছু সময় পর রোদেলা ওর কাছের চেয়ারটাতে বসে শোভনের হাত দুটো ধরলো, ওর মায়ের হাত যেভাবে ধরেছিলো ঠিক একই ভবাে। হাতদুটো ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,

এসব কিছুর জন্য একমাত্র আমিই দায়ী….
: আরেহ্ কি বলছো তুমি…? তুমি কেন দায়ী হতে যাবে…?

: আমি যে কতটুকু অপারগ তা যদি আপনি জানতেন।
: আমি এ ঘটনাকে পুঁজি করে তোমায় কোন প্রকার জোর করতে চাই না রোদেলা। আমার জীবণটা অন্ধকারে ঘেরা। এই যে বাইরের আমাকে দেখ এটা আমার একটা খোলস। ভিতরকার আমি ভাঙাচোরা, ক্ষতবিক্ষত। আমি চেয়েছি তোমার আলোতে নিজেকে আলোকিত করতে।

এরপর বেশ কিছু সময় নিরবতা দুজনেরই….

: এসব বলে তোমার সিম্প্যাথি নিতে চাই না আমি। আর হ্যা এসবের জন্য তুমি নিজেকে কেন দোষী ভাবছো। তুমি মোটেও দোষী নও। দোষী তে আমি, অনাধিকার চর্চা করে তোমার জীবণের সীমানায় প্রবেশ করতে চেয়েছি।

: আমার জীবণটা অন্য রকম শোভন, আপনি তা জানেন না, আমি চাইও না জানেন। আমাদের মধ্যে খুব ভালো একটা আত্নীয়ের সম্পর্ক রয়েছে, এর বেশী কিছু আমার পক্ষে ভাবা
অসম্ভব। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

শোভন চোখের পানি আড়াল করতে ওপাশে ঘাড় ফিরিয়ে রাখে। এমন সময় এ্যামি দড়জা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করে দেখে রোদেলার হাতে শোভনের একটা হাত। উনাকে দেখে রোদেলা দ্রুত শোভনের হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে। এ্যামির মুখ মুহুর্তেই কালো হয়ে যায়।

এ্যামীর পেছনে সবাই একসাথে ঘরে ঢুকলো। বড় মামী বললো রোদেলা চল মা আমরা যাই, বিকেলে আবার আসবো নি। আর বেয়াইন সাহেবা হসপিটালে কে কে থাকবেন। আমি বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসবো। নাতাশার শ্বাশুড়ি বলে – আরে কেন আপনি ঝামেলা করতে যাবেন। আমাদের বাড়ি থেকেই খাবার আসবে। শুধু শুধু কষ্ট করার দরকার নেই। শোভনের মা বললো, আপনারা এসেছেন আমি খুবই খুশি হয়েছি। আমার ছেলেটার জন্য দেয়া করবেন। খাবার আনার কোন দরকার নেই।

ওরা বিদায় নিয়ে চলে এলো। রোদেলা বের হয়ে শুনলো রাতে শোভনের পায়ে অপারেশন হবে। ভাঙা হাড়ে সাপোর্ট হিসেবে পাত জুড়ে দিবে। হাড় জোড়া লাগলে ডেটা আনার খুলে ফেলা হবে। রেদেলা নাতাশা কিংবা কল্লোল কারো কাছ থেকেই বিদায় নিলো না। অনমনা হয়ে ফিরে এলো।

বাড়ি ফিরে রোদেলা ওর মাকে খুঁজে পায় না। কাজের খালাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন-
: খালাম্মায় বাসা দেখবার গেছে… পছন্দ হইলে এডভান্স ও কইরা আসবো নাকি।
রোদেলা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়, দিনের ঝকঝকে আলো যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে তাই সবগুলো পর্দা টেনে দেয়, দরজা আটকে ঘরটাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। ভাবতে থাকে জীবণটা এমন কেন…?

কারো সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলা যায় না,
কারো কথার প্রতিবাদ করা যায় না, মুখ বুজে সব শুনতে হয়,
কাওকে ভালোবাসা যায় না…
ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা যায় না….?

দুচোখ বেয়ে পানি পরতে থাকে রোদোলার।
ওদের জীবণটা এমন কেন….?
কেন এমন……..!

চলবে….
Previous :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1496537807474072/
Next:
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/1500729357054917/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here