গল্প- অনুভূতিরা মৃত
অন্তিম পর্ব
.
কুঁড়ি দিন পর মুখোমুখি মিহি ও রুয়েল। ঠিক কুড়ি দিন আগে কথা হয়েছিল, দেখা হয়েছিল। সারপ্রাইজ দিয়েছিল। এত বড় সারপ্রাইজড হজম করতে পারেনি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অথচ দুরত্ব যেন আকাশ পাতাল। দেহের দুরত্বের চেয়ে মনের দুরত্ব বেশি। আজকে যেন তা প্রকাশ পাচ্ছে। নিরবতা যেন গ্রাস করেছে, ধমকা বাতাস বইছে, মিহির চুল উড়ছে, বাঁকানো চোখে রুয়েল তা দেখার চেষ্টা করছে। এভাবে হয়তো আর দেখা হবে না। এইতো কয়েকটা দিন সবই ঠিকঠাক। এবার শুধু নিজেকে গোছানো বাকি। দীর্ঘসময় ধরে দুজন নিরবতা বজায় রাখছে, কথা বলার চেষ্টা করে রুয়েল। কেননা তার ডাকেই মিহি এসেছে, যোগাযোগ কমতে কমতে একদমই কমে গেছে, অসংখ্যবার মিহির ফোন পেয়েও সাড়া দেয়নি। ছেলেরা অনেক সময় পাথর হয়ে যায়। কোন মায়া যেন আটকাতে পারে না।
.
রুয়েল ডেকে উঠল, মিহি! এর মাধ্যমেই নিরবতার সমাপ্তি ঘটল। ছোট করে উত্তর দেয় মেয়েটি। রুয়েল বলে।
— তপু কেমন আছে?
মানুষগুলো যখন একা থাকে, নিজের সাথে একজন বিশেষ মানুষ যোগ হয়। চলার পথে যোগ হয় বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড। ঠিক তখনি বন্ধু বা বন্ধুরা কেমন আছিস বা কেমন আছো জায়গায় বলে উঠে, তোর গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড কেমন আছে? কথাটি কেউ কেউ মজা করে বললেও রুয়েল বলেছে ভিতর থেকে একটা হাহাকার নিয়ে। মিহির উত্তর।
— ভালোই। তুমি কেমন আছো?
— ভালো তবে আমি চলে যাচ্ছি। কানাডার ভিসা পেয়ে গেছি। আগামী পরশু ফ্লাইট।
কথাটি শুনতেই থমকে যায় মিহি। পুনরায় প্রশ্ন করে সে, মজা করছো? রুয়েল উত্তর করে না”। এটাই তোমার সাথে শেষ দেখা। ভালো থেকো, ভালো রেখো।
.
রুয়েল চলে যাচ্ছে, বোবার মতো চেয়ে আছে মিহি। হঠাৎ করে কী হলো। মনে হয় এইমাত্র বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে, অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে, ইচ্ছে করছে তার হাত ধরে বলবে, না গেলে হয় না? জড়তা কাজ করছে, অধিকারের জড়তা। যেখানে অধিকার নেই সেখানে জড়তা কুড়ে কুড়ে খাই। এই মূহুর্তে মিহি পারছে না। অসহায় পথিকের মতো দাঁড়িয়ে রইল। দেখা হবে না আর! একটি ছেলে ছিল বন্ধু বা ভালোবাসা। একত্রে হাঁটবে না আর। দুরত্ব হবে হাজার হাজার মাইল। বুক ফেটে যাচ্ছে, অসামাপ্ত গল্পের মতো শেষটা হলো।
.
বিমানবন্দরে উপস্থিত সকলে। শেষ বেলায় বিদায় জানাতে আগমন সবার। এত সব মানুষের পদচারণায় সিক্ত বিমানবন্দর। রুয়েল খুঁজে মিহির পদচারণ। এক বুক হতাসা আর অাফসোস নিয়ে প্লেনে বসে পড়ে। প্লেনে বসার আগে, অজস্র কেঁদেছিল। বেদনায় সিক্ত রুয়েল ওয়াশরুমে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিল। শব্দ না করে চোখের জল ফেলেছিল মূহুর্তে সেই জল মুছে নিয়েছিল। পানির সাথে ধুয়ে দিয়েছিল। ছেলেদের কাঁদতে নেই, অতি শোকে কেঁদে দিলে বলতে হয়——- চোখে কিছু একটা পরেছে কিংবা বিয়ের আগে মেয়ের মায়ের কাছে হিসেব দিতে হয় মাইনে কত? পড়াশুনা শেষে চাকরি না হলে ট্যাগ লাগায় বেকারত্বের। এভাবেই একটি ছেলে নিজেকে আড়াল করে। আড়াল করার চেষ্টা করে।
.
বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ছয়টায় প্লেন উড়ল আকাশে। সাথে সাথে উড়ে গেলো অজস্র মূহুর্ত। যা স্মৃতি হিসেবে বেঁচে থাকবে। এক বুক যন্ত্রণায় কেঁটে যাবে। প্লেন যখন আকাশে উড়তে যাবে ঠিক সেই মূহুর্তে ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে মিহির নাম্বার। চমকে উঠে রুয়েল। ফোন রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে ভেসে আসে– রুয়েল তুমি কোথায়, বিয়ে করবে আমায়? চুপ করে আছো কেন? জবাব নেই তার। কী জবাব দিবে জানা নেই। এভাবেই বারবার ভেসে আসছে, রুয়েল তুমি কোথায়, বিয়ে করবে আমায়? চুপ করে আছো কেন? ফোনের এপাশে থাকা মানুষটি সবই শুনছে, অজস্র চোখের জল ফেলছে। ইতিমধ্যে, প্লেন আকাশ উড়ছে মূহুর্তে ফোন কেঁটে যায়। ঠিক যেন অঞ্জন দত্তের বেলাবোশ। সেবার অঞ্জন দত্ত বেলাকে ফোনে বলেছিল, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না, সম্বন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পারো, মা-কে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না। এভাবেই অঞ্জন দত্ত নিজ বেলাকে জানিয়েছিল বিয়ের কথা। বেলা কোন উত্তর দেয়নি, অসহায় আর আর্তি নিয়ে ডেকেছিল অঞ্জন দত্ত।
.
রুয়েলের মনে প্রশ্ন, মিহির তাে প্রেমিক রয়েছে তাহলে আমায় কেনাে বিয়ে করতে চাচ্ছে? তাহলে কি ওদের প্রেমটা মিথ্যে নয়তাে আমাকে বলা কথাটি মিথ্যে। ভাবনার দুয়ার দীর্ঘ হয় কোন উত্তর মিলে না। ফেইসবুক লগিন করে রুয়েল লিখে– আবার হয়তো দেখা হবে নতুন কোন অধ্যায়, নতুন কোন সন্ধ্যায়। সেদিন থাকবেনা কোন পিছুটান, থাকবেনা কোন মায়াজাল। তবুও মনে পড়বে তোমার মায়াবী মুখখানি। মিহি লিখে তাসলিমা নাসরিনের কবিতা- অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যাবে, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। এক শহরেই, অথচ দেখা হবে না। পথ ভুলেও কেউ কারও পথের দিকে হাঁটবো না, আমাদের অসুখ বিসুখ হবে, দেখা হবে না। কোনও রাস্তার মোড়ে কিংবা পেট্রোল পাম্পে কিংবা মাছের দোকানে, বইমেলায়, রেস্তোরাঁয়, কোথাও দেখা হবে না।
.
সাবধানতার গণ্ডি ভুলে নিয়ম ভেঙে যাই, তুমি আমি আমরা সবাই ভিতরে ভিতরে একা, ভুলের বশেই হঠাৎ করে কাউকে পাশে চাই, আসা যাওয়ার পথের মাঝে আচমকা হঠাৎ দেখা। তাদের দেখা হয়। সেদিনের পর কেঁটে যায় এক যুগ। সায়েদাবাদ বার্স টার্মিনালে নজর এড়াতে পারেনি মিহি। পাশাপাশি সিট, একই বাসের ছাদের নিচে অনুভূতিরা মৃত পড়ায় ব্যস্ত মিহি। রুয়েল ব্যস্ত নিজেকে আড়াল করার। দেখা দিতে চাচ্ছে না সে। পাশাপাশি বসে ওরা, হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে। চাদর সড়িয়ে নিলে, মিহির চোখের সামনে প্রকাশ পাবে রুয়েলের চেহারা। দীর্ঘ বছর পর নিয়তি তাদের বসিয়েছে একই বাসে।
.
বাস চলছে নিজস্ব গতিতে, সময় বাড়ছে, দুরত্ব কমছে, গন্তব্য ধেয়ে আসছে, বেদনায় সিক্ত মিহি। অনুভূতিরা মৃত পড়তে পড়তে সবটা পরিষ্কার। বইয়ের পাতায় নিজের নাম দেখছে পাশাপাশি রুয়েল ও বনলতা। ত্রিভুজ প্রেমের গল্পে সাজানো বইটিতে কী ছিল না। প্রচণ্ড বিরহ, রোমান্টিকতার সাথে লেখক তুলে ধরেছেন বাস্তবতা। জানিয়েছেন অসংখ্য তথ্য, পরিচয় করিয়েছেন নতুন কিছুর সাথে। রুয়েল কেঁদেছিল মিহির জন্য, না পাওয়ার যন্ত্রণায় নিজেকে ভাসিয়েছিল। আজ সে কাছে নেই, আছে তার লেখা বই, অপার যত্নে বইটিকে জড়িয়ে ধরে মিহি। চোখের কোণে জল মুছতে মুছতে প্রশ্ন কর, কেমন আছে রুয়েল?
.
আবেগ আপ্লুত রুয়েল। এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে শরীর থেকে চাদর ফেলে মিহির হাত ধরে বলতে, ভালো নেই মিহি। চলো দূরে কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। এভাবেই বাস চলে যাবে, গন্তব্যে নেমে পড়বে। মিহি জানতেও পারবে না এই বাসেই ছিল সেই মানুষটি। হয়তো জানবে কোন এক বইয়ের পাতায়। সে বইয়ের নাম হতে পারে “হঠাৎ দেখা”। মিহি সেই বইটি পড়বে আর জানবে আজকের দিনে দেখা হয়েছিল। কথা হতে হতেও হয়নি। আফসোস হবে মিহির। রুয়েলকে না দেখার আফসোস। আজন্ম এক আফসোসে আজকের কথা ভেবে নতুন করে জল ফেলবে আর বলবে, কেন ডাক দিলে না? একটিবার ডেকে উঠতে পারতে, মিহি।
.
গাল গড়িয়ে জল নামছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো একবার নিজেকে বুঝাচ্ছে রুয়েল। কিছু মানুষ মনেতে থাকে, জীবনে নয়।
.
সমাপ্ত
— সাকিব হাসান রুয়েল