গল্প- অনুভূতিরা মৃত
সপ্তম পর্ব
.
অশ্রু টলমল করে ঝরছে, নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে; ‘না! মিহি এমন করতে পারে না। কী হতে কি হয়ে গেল। মিহি যদি না বাঁচে তাহলে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী মনে হবে। কথাগুলাে ভাবতেই হতাশায় ভেঙে পড়ে রুয়েল। প্রচণ্ড জেদি মেয়েগুলো যখন কাউকে ভালোবাসে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, আর যখন আঘাত পায় তখন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মিহিও তাদের দলে। মিহির প্রতি রুয়েলের অবহেলা তাকে করেছে মৃতপথ যাত্রী। অবহেলা রাগ, অভিমান, আনন্দ, ইত্যাদি সব অভিব্যক্তি নিয়েই তৈরি মানুষ। কিন্তু রাগ অভিমান এমন একটা জিনিস যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জীবন থেমে যেতে পারে। মিহির জীবনের সময়টুকু কী থেমে যাবে?
.
মিহির বান্ধবীর ভাষ্যমতে, গতকাল রাতে কী এক অজানা কারণে, নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল মিহি। যেটাকে ইংরেজিতে বলে Suicide বাংলায় আত্মহত্যা। আত্মহত্যা, হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশ। মানবচরিত্র বড়ই বিচিত্র। জীবনধারণের জন্যে মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ, রোজকার মতো এতো দৌড়ঝাঁপ, এতো সংগ্রাম, এতো ছলচাতুরী, এতো অপরাধ, এতো নিয়মের ভাঙা-গড়া, সবকিছুর পেছনে মানুষের একটাই কারণ– বেঁচে থাকা। অথচ সেই মানুষই একটা সময় নিজেকে আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ করে দিতে চায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন– জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে??
.
জীবনে মুক্তিলাভ নানা ভাবে সম্ভব। আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুতে জীবনের মুক্তি নয়। দিনের পর দিন অাত্মহত্যার গড় বেড়েই চলেছে,, বিশ্বে আত্মহত্যার হারে বাংলাদেশের স্থান দশম। যেখানে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করে যেখানে প্রতি দিন ২৮ জন। সারা পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। এদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অধিকাংশ দেশে নারীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ পুরুষ আত্মহত্যা করেন। অথচ এদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর আত্মহত্যার হার বেশি। প্রতিবেদনটির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১২ সালে ১০ হাজার ১৬৭ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৫ হাজার ৭৭৩ জন নারী, আর পুরুষ ৪ হাজার ৩৯৪ জন। মহান আল্লাহ জীবন দিয়েছেন লড়াই করে বাঁচার জন্য, হার মেনে পালিয়ে যাবার জন্য নয়। হার না মানা একজন বীরের মতো জীবনের সঙ্কটকালীন সময়গুলো উতরে যেতে হবে। মনের মধ্যে শক্তি রাখতে হবে। আত্মহত্যা কখনোই কোনো সমাধান নয়। নিজের উপরে বিশ্বাস রাখাই নিজেকে বাঁচানোর একমাত্র পথ।
.
মিহি পারেনি নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে, ঘৃণা ও এক বুক হতাশা নিয়ে নিজেক করেছিল রক্তাক্ত, লাল রঙে প্রবাহিত হচ্ছিল আকাশী রঙের বিছানা। ভাগ্যক্রমে চোখ পড়ে যায় কাজ করা মেয়েটি। মূহুর্তেই নিয়ে আসে হসপিটালে। রুয়েল ছুটে চলল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পাপবোধ বারবার নিজেকে দংশন করে চলছে, অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, রিকশায় করে কিছুদূর যেতেই বিশাল জ্যাম। এদেশ যানযটের দেশ। জ্যামের অতলে হারিয়ে যায় কোটি কোটি সময়। প্রিয়তম হারায় প্রিয়তমাকে, যান্ত্রিক শহরের ধুলোবালিময় ফুটপাতে দৌড়ে ছুটে চলল। উদ্দেশ্য মিহির কাছে পৌঁছানো। তার দৌড়ের গতি বলে দেয় আজ কিংবদন্তী দৌড়বিদ উসাইন বোল্টও হার মানতো। উসাইন বোল্ট এমনি এক মানব যিনি দৌড়ে ছুটে হয়েছেন বিশ্বসেরা। নামের পাশে ট্যাগ লাগিয়েছেন, পৃথিবীর সর্বকালের দ্রুততম মানব। বিশ্ব অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড় ৯.৫৮ সেকেণ্ডে এবং ২০০ মিটার দৌড় ১৯.১৯ সেকেণ্ডে শেষ করে জিতে নিয়েছেন দ্রুততম মানবের খেতাব।
.
মানুষ যখন আবেগ সাগরে ডুবে থাকে তখন ভুল করে, আবার ভুল করে চিন্তায় হতাশায় নিমজ্জিত সময়টুকুতে, অবচেতন মনে ধাক্কা খেয়ে রিকাশার সাথে মাথা দিয়ে রক্ত ঝরে, সেদিকে নজর নেই তার। টেনশনে তার যন্ত্রনা হচ্ছে, কেমন আছে মিহি? তাকে বাঁচানো যাবে তো কোনরকম দুর্ঘটনা ঘটলে অপরাধী হয়ে কাটাতে হবে বাকি জীবন। মেনে নিতে পারছে না রুয়েল। হসপিটালে পৌঁছেই দেখতে পেলো, মিহির পরিবারের শোকের মাথম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, হসপিটালের বারান্দায় ছুটোছুটি কিংবা ব্লাড ব্যাংকে খুঁজ করেও মিলছে না বিরল জাতের ও নেগেটিভ (O-) রক্তের দেখা। ও নেগেটিভ রক্ত হলেই মিলবে মিহির ট্রিটমেন্ট, বিশ্বের ৮০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ও নেগেটিভ গ্রুপের সংখ্যা ২.৫৫ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৩৯ শতাংশ মানুষের ও নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ। চারদিকে ছুটোছুটি করেও যখন মিলছে না বিরল প্রজাতির এই রক্তের গ্রুপ তখন হাতের নাগালে থাকা রুয়েলের ও নেগেটিভ রক্ত নিতে ডাক্তার নারাজ। তার কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে, দায়িত্বশীল ডাক্তার তার দায়িত্বশীল আচরণ করছেন, কিন্তু রুয়েলের এক কথা হাতের কাছে ব্লাড পেয়েও ট্রিটমেন্ট শুরু না করে রোগিকে মৃত্যুর দুয়ারে টেলে দেওয়ায় মামলা করবে রুয়েল। ডাক্তার কিছুটা ভীতু হয়৷ তাকে শুয়ানো হয় মিহির ব্রেডের পাশে। অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে মিহি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুয়েল। ফর্সা মুখখানি কালো হয়ে গেছে, হাতে অনেকগুলো সেলাই সম্ভবত ক্ষুর চালিয়েছিল, চেষ্টা করেছিল জীবননাশের ভাগ্য সহায় ছিল ফেরেশতা রূপে আসেন কাজের মেয়ে।
.
ডাক্তার ট্রিটমেন্টে ব্যস্ত, মিহির বাবা ব্লাড খুঁজায় ব্যস্ত, অসহায়ত্বের মতো দাড়িয়ে আছেন বাবা। এই বুঝি ব্লাডের অভাবে হারাবে মেয়েকে, একজন বাবা জানে মেয়ের কষ্ট, ছেলেরা যেমন মায়ের বাধ্য হয়। মেয়েরা বাবার বাধ্য হয়। মিহির জীবন ব্যতিক্রম। মা মরা মেয়ে, সন্তানের তাগিদে তিনিই বাবা আবার কখনো হয়েছেন মা। বুঝতে দেননি, মায়ের অভাব। হতাশায় নিমজ্জিত বাবা যখন হসপিটালের বারান্দায় পায়চারি করছেন। ডাক্তার এসে জানালেন, ডোন্ট ওয়ারি! ব্লাড পাওয়া গেছে। খুশিতে নেচে উঠে বাবার মন। দৌড়ে ছুটে যান রক্তদাতার কাছে, ধন্যবাদ ইয়াং ম্যান। আজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। মুচকি হাসে রুয়েল। পরিচিত হোন মিহির জন্মদাতার সাথে। আশ্বাস দেন, পার্থনা করবেন মিহির সুস্থতায়। এক পর্যায়ে বিদায় নেন। পশ্চিমা আকাশে সূর্য ডুবছে, আলো ডুবছে, ঘরে ফিরছে মানুষ, ক্লান্তি হতাশায় নিমজ্জিত রুয়েল হেঁটে ছুটছে রাতের অন্ধকারে।
.
চলবে……………
— সাকিব হাসান রুয়েল