অনুভূতিরা মৃত অষ্টম পর্ব

0
197

গল্প- অনুভূতিরা মৃত
অষ্টম পর্ব
.
পশ্চিমা আকাশে সূর্য ডুবছে, আলো ডুবছে, ঘরে ফিরছে মানুষ, ক্লান্তি হতাশায় নিমজ্জিত রুয়েল হেঁটে ছুটছে রাতের অন্ধকারে। কিছুদূর যেতেই কৃত্রিম আলোতে ঝলমল করছে আলোর শহর। যে-ই আলোতে স্বাদ নেই, আছে শুধু একরাশ হতাশা। দিনের আলোতে ঠোঁটের কোণে ঝলমল করে মানুষের কৃত্রিম হাসি। পশ্চিমের আকাশে সূর্য ডুবার সাথে সাথে মুছে যায় সেই হাসি। রাতের অন্ধকারে নেমে আসছে একাকীত্ব। পিচঢালা পথে ছায়া তার একমাত্র সঙ্গী। নীরবতার চাঁদরে ঢেকে গেছে ব্যস্ত শহর। চারদিক নিশ্চুপ। শহর কথা বলেনা। মাঝে মাঝে নিরবতা ভেঙ্গে গাড়ির শাঁ শাঁ শব্দ আবার মূহুর্তেই হারিয়ে যায়।
.
প্রকৃতির নিয়মে দিনের আলাে নিভে রাতের অন্ধকার নামার সাথে সাথে লক্ষ কোটি মানুষের দুঃখ কষ্ট জেগে উঠার সাথে ডিপ্রেশন নামক এক শূণ্যতা তাদের ঘিরে ফেলে। বর্তমান পৃথিবীতে অতি পরিচিত একটি শব্দ ডিপ্রেশন। এর বাংলা অর্থ বিষন্নতা। যাকে আমরা মন খারাপ বলে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন লোক এই বিষন্নতা ব্যাধিতে ভুগছে যা তাদেরকে অক্ষমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা একটি আবেগজনিত মানসিক রোগ। সহজ ভাষায় মনের রোগ। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, বাবা-মা শাসন করেছে, বন্ধুদের সাথে কিংবা প্রিয়জনের সাথে ঝগড়া হয়েছে এসব কারণে আমরা মন খারাপ করি। যুগের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে বলি ডিপ্রেশনে আছি, কিন্তু ডিপ্রেশন ও মন খারাপ বিষয়টা ভিন্ন। মন খারাপ সাময়িক কিছু সময় পর মন ভালোর মেডিসিন পাওয়া যায় কিন্তু ডিপ্রেশন দীর্ঘকালীন সমস্যা। যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা এবং পরামর্শের প্রয়োজন হয়।
.
মানুষ স্বপ্ন দেখে আবার স্বপ্ন ভাঙ্গে, এতে করে ডিপ্রেশন নামক এক ভয়ানক রোগ তাকে ঘিরে ফেলে। স্বপ্নে পূরণ ব্যর্থ হলে মনে রাখতে হবে, স্বপ্নটা গনতান্ত্রিক। জীবনে একটি মাত্র স্বপ্ন সাফল্যে পৌঁছাবে না। স্বপ্নের থাকতে হবে বিকল্প। মনে পড়ে যায় হেলান কেলারকে, বোবা, শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ হেলার কেলার লিখেছিলেন ১৪টি বই। বোবা, শ্রবণ প্রতিবন্ধী যদি জীবনে সফলতার চূড়ায় স্থান করে নেয় তাহলে আমরা কেন পারব না? এই প্রশ্নটিই হোক সকলের পাথেয়। এভাবেই কমে যাবে ডিপ্রেশন। কমে যাবে বিষন্নতা ব্যাধি। বিষন্নতা নামক মন খারাপে ভোগে রুয়েল। মিহির ভাবনায় বিভোর তার মন। মাথার আঘাতটা বেশ ভুগাচ্ছে, সারাদিনের ক্লান্তির পর চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। বাসায় ঢুকতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় সে। শেষ রাতে মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে, মুসলমান মাত্রই আজানের ধ্বনি শুনে আবেগাপ্লুত হন, আমোদিত হন, মন নেচে ওঠেন ভিতরে-বাইরে। আজান আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ ও তাওহিদের মহান আওয়াজ। এই মধুর আওয়াজ আল্লাহ আকবার ধ্বনি স্বীকার করে আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। গোসল করে পবিত্র হয়ে রুয়েল হেঁটে চলল মসজিদের উদ্দেশ্যে। পূর্বের আকাশে তখনও সূর্য উঠেনি তবে ধীরে ধীরে অন্ধকার মুছে যাচ্ছে, নামায শেষে রুয়েলের বিশেষ পার্থনায় ছিল মিহি। আকাশে সূর্য উঠার সাথে সাথে মিহির মুখে পড়ুক রবির কিরণ। অন্ধকার মুছে যাওয়ার মতো মিহির জীবন থেকে মুছে যাক কালো অাঁধার।
.
মসজিদ থেকে বের হয় সে। হাঁটতে শুরু করল৷ সকালে কুয়াশা ভেঁজা ঘাসের উপর পা রাখতেই শিহরিত তার মন। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলছে, আশেপাশে তাকিয়ে রিকশার দেখা মিলেনি। উদ্দেশ্য হসপিটাল। মন তার আনচান আনচান করছে, কেমন আছে মিহি? হসপিটালের গেইটে পা রাখতেই একটা এম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে ঢুকছে, এম্বুলেন্স শব্দটা শুনলেই মনে হয় আহারে কার বুঝি সব শেষ হয়ে গেলো, আহারে কার জানি আবার বুক খালি হয়ে গেলো। আহা কার কোল জুড়ে আবার নতুন কেউ আসতে চলল। হসপিটালের প্রায় মানুষ এখনও ঘুমিয়ে। মিহির কক্ষে পা রাখতেই নার্স জানাল– ভালো আছে মিহি। গ্লাসের ওপাশ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘুমন্ত মিহিকে, ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। মায়াবি লাগে বেশ। ঘুমন্ত মেয়েদের মায়াবি চেহারা নিয়ে কবিতা লিখেছে অসংখ্য। অগণিত গল্পে বলা হয়েছে ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়ের মায়াবি চেহারার কথা। রুয়েল ভাবে, কোন এক গল্পে মিহির এই রূপটি তুলে ধরবে। বর্ণনা করবে তার এই মায়াবি চেহারা। সেই মূহুর্তে কাঁধে কারো স্পর্শ। পিছনে তাকাতেই আবিষ্কার করল ডাক্তার এম এ রকিবউজ্জামান। মূহুর্তেই সালাম দিলো রুয়েল। ডাক্তার এম এ রকিবউজ্জামান আশার বানী শুনালেন। হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন– মেডিসিনটা নিয়ে আসো। টেনশন করো না ইয়ংম্যান।
.
মেডিসিন নিয়ে হসপিটালের গেইটে পা রাখতেই মিহির বাবার সাথে দেখা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফেলল রুয়েল। এতো সকালে হসপিটালে সে। ভদ্রলোক কী ভাবতে পারে? নিজেকে সামলে সালাম দিয়ে বলল– আঙ্কেল ডাক্তার দুইটা মেডিসিন দিয়েছে আমি এনে রেখেছি। আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়লেন, জড়িয়ে ধরলেন ভদ্রলোক। চোখের কোণে উনার অশ্রু– আমাদের জন্য আর কত করবে বাবা? নিশ্চুপ রুয়েল। কিছু মূহুর্তে মানুষ বোবা হয়ে যায়। বিজ্ঞান বলে, কখনো কখনো মানুষ কী বলবে তা ভুলে যায়৷ বোবা থাকে কয়েক সেকেন্ড। মিহির বাবার আন্তরিকতায় মুগ্ধ সে। হসপিটাল থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরছে সাথে মাথার ভিতর অজস্র চিন্তা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, মিহি কি আগের মতো গ্রহণ করবে। কীভাবে সামনে দাঁড়াবে তার? সেই ভাবনায় বিভোর তার মন৷ বাসায় আসতেই মায়ের আদেশ ব্যাংকে যেতে হবে। এই মূহুর্তে একদমই বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। না গিয়েও উপায় নেই, পরিবারের বড় ছেলে সে। বাবা প্রবাসে। ছোট ভাই বোনের সাথে দাদিকে নিয়ে পরিবার। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৬৫ দিনও দাদিকে পাওয়া যায় না। আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়ানোই তার কাজ। বাবার অনুপস্থিতিতে সকল দায়িত্ব বড় ছেলের উপর বর্তায়। সেও পালন করে দায়িত্বশীল আচরণ।
.
সকালের রৌদ্রে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, তাপমাত্রা ৩৬ অতিক্রম করেছে। চা হাতে দাঁড়িয়ে রিকশায় অপেক্ষারত সে। হঠাৎ করেই একটা কালো গাড়ির আগমন। গ্লাস নামাতেই চোখে পড়ল মিহির বাবা। ইশারা করে বললেন– চলে এসো, রিকশা পাবে না। রুয়েল এগিয়ে গেলো। পিছনের সিটে বসতে যাবে তখনি ভদ্রলোকের ডাক, পিছনে নয় সামনে বসো। লাজুক ছেলে রুয়েল লজ্জায় ডুবে যায়। গাড়ি চলছে আনমনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, ভাবনার দরজা বহুদূর।
— ডাইভিং পারো?
মিহির বাবার প্রশ্নে বাস্তবে ফিরল রুয়েল। ছোট করে রিপ্লাই করে।
— জ্বি পারি
— ডাইভ করো।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকিয়ে সে। ভদ্রলোক কত সম্মান করছে, ভালোবাসার সাথে স্নেহের চোখে দেখছে, যখন জানবে উনার মেয়ের এমন অবস্থার পিছনে সে দায়ী তখন কি মেনে নিবে, ভালোবাসার সুরে ডাকবে? মূহুর্তেই মিহির বাবার প্রশ্ন।
— আচ্ছা রুয়েল, হঠাৎ মিহির এমন পাগলামির পিছনে কারণ কী? মূহুর্তেই বুক ধক করে উঠে, অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুয়েল।
.
চলবে…………….
— সাকিব হাসান রুয়েল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here