নীরবতা #নাইমা_জাহান_রিতু #পর্ব_১৪_১৫_১৬

0
295

(Writer এর অনুমতি নিয়ে গল্পটা post করা হচ্ছে।)
#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৪_১৫_১৬

খানিকক্ষন থম ধরে মেসবাহর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর মুন্নি সরকার পা বাড়ালো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। বিয়ে তো সে দেবেই দেবে। এতে যা হবে দেখা যাবে। তাছাড়া মেসবাহই বা কে বিয়ের প্রস্তাবে মানা করে দেয়ার? দরকার পড়লে গ্রামে গিয়ে উল্লাসীর বাবামার সাথে কথা বলবে সে। তবুও এই মেয়েকে হাতছাড়া করবে না। গভীর কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো মুন্নি সরকার। অস্থির মনে অপেক্ষা করতে লাগলো ওপাশ থেকে মায়ের একটি সাড়ার।
-“আম্মা তুমিই কাল সকাল সকাল রওনা হবা। কাল দুপুরের মাঝে তোমাকে আমার বাসায় আমি দেখতে চাই। তুমি এখনি ভাইয়ারে বলো টিকেট করে রাখতে। নয়তো ঘুম নষ্ট করে ভোরে উঠে তোমাকে বাসে তুলে দেবে না ও।”
একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে ওপাশ থেকে শায়লা বেগম বললেন,
-“সে কী বাড়িতে আছে! পামু কই তারে আমি! রাত একটার আগে বাড়িতে আসে সেই মহারাজা?”
-“ফোন দাও। ফোন দিয়ে বলো।”
-“কেন? এত পারাপারি কিসের? কাল কেন তোর ওইখানে যাওয়া লাগবো?”
-“আরে আম্মা! তোমারে যে মেয়ের কথা বলছিলাম, ওই মেয়েকে দেখার জন্য কাল আসবা তুমি।”
-“কেন? কালকের পর কী ওই মাইয়া উইড়া যাইবো?”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। ছটফটিয়ে বললো,
-“উফফ! তুমি বুঝবা না! তোমারে কাল আসতে বলছি তুমি আসবা। ব্যস!”
-“আচ্ছা.. দেখি।”
-“দেখাদেখি না। তোমার আসতেই হবে। আমার পছন্দ করা মেয়েকে একবার দেখলেই তুমি ফিদা হয়ে যাবা। বলবা, এরেই আমার ছেলের বউ হিসেবে চাই।”
মেয়ে যে দুই ডিগ্রি বাড়িয়ে কথা বলে তা অজানা নয়। তাই তাতে একটা পাত্তা দিলেন না শায়লা বেগম। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,
-“সবই বুঝলাম! কিন্তু একা একখান মাইয়া একই বাড়িতে আরেক পোলার লগে থাকে। জিনিসখান কেবা না?”
-“আরে আম্মা! ওরা তো ভাইবোন। তুমি ওভাবে ভাবছো কেনো? তাছাড়া আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পছন্দ টছন্দ আছে নাকি বা গ্রামের কারো সাথে কিছু ছিল নাকি। কিন্তু মেয়ে তো মেয়েই! মাশাল্লাহ.. এসব বোঝেই না ও। প্রেম পিরিত তো দূরের কথা।”
-“ঠিকাছে.. ভালো হইলেই ভালো। তুই তাইলে রাখ। আমি শীতলরে ফোন দেই। দেখি টিকিটের কথা কই।”
-“আচ্ছা, রাখছি তাহলে। তুমি কিন্তু ভোরের বাসের টিকেট কাটাবা।”
ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুন্নি সরকার। যাক! একটা কাজ তো এগিয়ে রাখা হলো। বাদবাকি গুলো না হয় ধীরেসুস্থে হবে!

সিগারেট হাতে অন্ধকার ব্যালকনিতে বসে চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল মেসবাহ। বেশ খানিকক্ষন হলো খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকেছে তাদের। তবে উল্লাসীর সঙ্গে আজ রাগারাগি করার পর মেয়েটি একদম চুপসে গেছে। খেতে বসেও চুপচাপ খেয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত মেয়েটির উপর রাগ ঝাড়া যেনো তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অভ্যাসটি পরিবর্তন করতে হবে। মেয়েটি ছোট। না বুঝে করে ফেলে একটি কাজ। অবশ্য এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখাও যায় না। কিন্তু কেনো রাখা যাবে না? সে তো স্ত্রী মানে না উল্লাসীকে। বাবার কথায় সে বিয়ে করেছে এবং একরকম বাধ্য হয়েই তাকে নিয়ে এসেছে নিজের সাথে। এবং দায়িত্ব হিসেবেই সে দেখে আসছে উল্লাসীকে। এছাড়া বেশি কিছু নয়। তাহলে উল্লাসীর বিয়ে আসুক বা অন্য কিছু তাতে তার এত মাথা গরম হবে কেনো? পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনার উপর মেজাজ খারাপ হলো মেসবাহর। আশ্চর্য চিন্তা ভাবনা তার! ছোট হোক বা বড়.. উল্লাসী তার বিয়ে করা বউ। বাবার কথায় হোক বা বাধ্য হয়ে, তিন কবুল পড়ে তো সে বিয়ে করেছে উল্লাসীকে। আর সেই উল্লাসীর জন্য যদি কেউ বিয়ের প্রস্তাব আনে তা অবশ্যই একজন স্বামী হিসেবে চুপচাপ মেনে নেয়া যায় না। কেনোই বা মেনে নেবে সে? উল্লাসী তার দায়িত্ব হলেও সর্বপ্রথম সে তার স্ত্রী।
-“আসবো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। জ্বলন্ত সিগারেট এশট্রেতে রেখে উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“চেয়ার নিয়ে এসো..”
চেয়ার টেনে ব্যালকনিতে এনে মেসবাহর পাশে বসলো উল্লাসী। উদাস মনে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকাতেই পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“ব্যালকনির জন্য ডাবল সিটের চেয়ার বা দোলনা কিনলে কেমন হয়?”
-“জানি না..”
-“কেনো জানো না?”
-“জানি না…”
-“মন খারাপ?”
এপর্যায়ে মেসবাহর দিকে ফিরলো উল্লাসী। ধীর গলায় বললো,
-“আমি কখনোই আর মুন্নি ভাবির সঙ্গে কথা বলবো না। উনি এলে কখনোই দরজা খুলবো না।”
-“না, তুমি বলবে।”
-“না, আমি বলবো না। কখনোই বলবো না।”
-“না, উল্লাসী। তুমি বলবে।”
মেসবাহর এমন কথায় অবাক চোখে তার দিকে তাকালো উল্লাসী। বললো,
-“কেনো?”
-“কারণ, ওই মহিলা আজকের পর থেকে তোমার এবং আমার লাইফ হেল করে ছাড়বে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ কলিংবেল বাজানোর পর যদি তুমি দরজা না খোলো, উনি পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলবে। সবাইকে ডেকে এনে দরজা ভেঙে হলেও দেখবে ভেতরে ঠিক কী চলছে! তাছাড়া নানান কথা ছড়ানো তো রয়েছেই। এ কারণেই তুমি দরজা খুলবে। তবে উনাকে দেখামাত্রই বলবে তুমি এখন ব্যস্ত আছো বা এখন তুমি গোসলে যাবে। এমন নানান এক্সকিউজ দেখাবে। অর্থাৎ দরজা খুললেও ভেতরে ঢুকতে দেবে না। এড়িয়ে চলবে। কী? বোঝাতে পারলাম তো?”
পুরোটা না বুঝলেও মাথা নেড়ে মেসবাহর কথায় সম্মতি জানালো উল্লাসী। অপরদিকে উল্লাসীর সম্মতি পেয়ে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেসবাহর। মৃদু হেসে সে বললো,
-“পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয় তোমার?”
-“হয়.. মাঝেমাঝে। জানেন আমি যখন পড়তে বসতাম তখন সুহা আমার পাশে বসে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।”
-“তাই?”
-“হ্যাঁ..”
উল্লাসী থেমে যেতেই হাতের ইশারায় কিছু একটা দেখিয়ে মেসবাহ বললো,
-“ওই যে দূরে খানিকটা আলো জ্বালানো একটি বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছো, ওটার দোতলায় একটি কোচিং সেন্টার আছে। তোমায় ভাবছি ওখানটায় ভর্তি করে দেব। পড়বে ওখানটায়?”
সময় নিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো উল্লাসী। তারপর ধীর স্বরে বললো,
-“আপনি বললে পড়বো।”
-“আমি তো বলছিই। ওখানে ক্লাস করতে থাকলে তারপর না হয় কোনো স্কুলে ঢুকিয়ে দিলাম। আর কোনো স্কুলে যদি নাও ঢোকাতে পারি তাহলে তুমি না হয় বোর্ড এক্সাম গ্রাম থেকেই দিলে। সমস্যা হবে কি?”
-“উহু..”
-“গ্রেট.. তাহলে কাল গিয়েই কথা বলে আসবো।”
আঁড়চোখে কিছুক্ষণ উল্লাসীকে দেখার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। এতটা নীরব কেনো উল্লাসী? পড়াশোনার ব্যপারে কী তাহলে আগ্রহ নেই তার? নতুবা অবশ্যই উচ্ছ্বসিত হতো সে। খানিকক্ষণ বেলকনিজুড়ে পায়চারী করে আবারও চেয়ারে এসে বসতেই পাশ থেকে হতাশ গলায় উল্লাসী বললো,
-“প্রতিদিন কোচিং করতে হবে?”
-“হ্যাঁ..”
-“তারমানে প্রতিদিন আমাকে নিচে নামতে হবে?”
-“তা তো নামতেই হবে..”
মেসবাহর জবাবে চোখমুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে তাকিয়ে সে থেমে থেমে বললো,
-“তাহলে আমি সিঁড়ি দিয়েই নামবো। ওসব দিয়ে নামবো না।”
-“কী? লিফট?”
-“হ্যাঁ.. দরজা বন্ধ হবার সাথেসাথেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর যখনই চলতে শুরু করে তখন আমার মাথা ঘুরায়। আমি সিঁড়ি দিয়েই নামবো।”
উল্লাসীর নীরবতার কারণ বুঝতে পারলো মেসবাহ। সামান্য হেসে সে বললো,
-“আমি পাশে আছি না? ভয়ের কী আছে? যখন তোমার খারাপ লাগবে তখন না হয় আমার হাত আঁকড়ে ধরবে।”

সকালে উল্লাসীকে ফেলে হাসপাতালে আসার পর থেকেই অস্থির লাগছে মেসবাহর। মুন্নি ভাবি যেমন মানুষ তাতে উল্লাসীর একার পক্ষে সবটা সামলে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নানান প্রশ্নের মুখে ফেলে পাগল করে দেবে মেয়েটাকে। তাছাড়া অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা তো রয়েছেই। তাই হাসপাতালে চাপ কম থাকায় দুপুরে বাসায় খেতে যাবার সিন্ধান্ত নিল মেসবাহ। অবশ্য এর পেছনে আরেকটি কারণও রয়েছে। কোচিং সেন্টারে উল্লাসীর ব্যপারে কথা বলা। কোনো সমস্যা না থাকলে না হয় আজই ভর্তি করিয়ে দেয়া যাবে উল্লাসীকে। তারপর তাকে ক্লাসে বসিয়ে সে নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারবে তার কাজে। এতে যেমন মুন্নি ভাবির হাত থেকে বাঁচা যাবে তেমন সে নিজেও শান্তিতে দু’দন্ড কাটাতে পারবে। স্বস্তি নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কাঁচা বাজার সেরে বাসার উদ্দেশ্যে রিকশা নিল মেসবাহ। বেলা বাজে দুপুর একটা। সূর্যের প্রখর তাপ এসে লম্বভাবে পড়ছে তার শরীরে। হুডটা উঠিয়ে দিলে ভালো হত। অবশ্য রাস্তাও বেশি একটা নেই। ততক্ষণ না হয় একটু গরম সহ্য করলো…

লিফট ছেড়ে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা দেখতে পেয়ে যা বোঝার বুঝে নিল মেসবাহ। ঠিক একারণেই সকাল থেকে অস্থিরতার উপরে রয়েছে সে। এই মহিলার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব সহজ হবে মনে হচ্ছে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ দ্রুত পদে এগুলো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। তবে ফ্ল্যাটে ঢোকামাত্রই তার বিস্ময়ের সকল সীমা অতিক্রম করলো। মুন্নি সরকারের পাশেই বসে রয়েছে বয়স্ক এক মহিলা। যাকে প্রায়ই তার কাছে এসে থাকতে দেখেছে মেসবাহ। এবং ভুল না করলে উনিই মুন্নি সরকারের মা। মাথায় রক্ত উঠে গেল মেসবাহর। ঠিক কী করবে ভেবে না পেয়ে হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
-“কী চলে এখানে? আপনাকে আমি কাল নিষেধ করে দিয়েছি না?”
মেসবাহর গলার স্বর শোনামাত্রই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো মুন্নি সরকারের। চুপেচাপে কাজ সারতে চাইলেও মাঝ থেকে এই বান্দা কই থেকে উদয় হলো তা একদমই মাথায় আসছে না তার।
-“তারপরও আপনার এখানে কী কাজ? হোয়াই আর ইউ কামিং হেয়ার?”
উঠে দাঁড়ালো মুন্নি সরকার। পাশ ফিরে মেসবাহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
-“চিৎকার করছো কেনো? বসো.. বসে কথা বলি।”
-“কিসের বসবো? কেনো বসবো? আপনাকে আমি কাল নিষেধ করে দেই নি?”
-“শুনেই নিষেধ করে দিলে হবে নাকি? ঘরে বোন থাকলে এমন বিয়ের প্রস্তাব আসবেই। তাই বলে এমন হাইপার হওয়া যাবে?”
অস্থির মনে মেসবাহ বলো,
-“আশ্চর্য! আপনি তো প্রচন্ড ঘাড়ত্যাড়া স্বভাবের। প্লিজ আপনি বের হন।”
-“তুমি বসো, ভাই। বসে কথা বলি। তাছাড়া ভাই হিসেবে তোমার কাজ তোমার বোনের ভালো খারাপ বিবেচনা করা। তাছাড়া কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি? বাছবিচারের ব্যপার আছে না?”
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় দু’হাতের মুঠ চেপে লম্বা একটি দম ছাড়লো মেসবাহ। তারপর শান্ত গলায় বললো,
-“ওকে বিয়ে দেবো না। কাল আপনাকে সুন্দরভাবে নিষেধ করেছিলাম। তারপরও আজ আপনি আপনার মাকে কেনো নিয়ে এসেছেন?”
-“আমিও তোমায় বারবার বলছি, মেয়ে হয়ে জন্মেছে উল্লাসী। বিয়েতো একসময় ওকে দিতেই হবে। তাহলে আজ দিলে কী দোষ?”
-“আপনি প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করুন।”
-“তুমি বোঝো মেসবাহ। ভাই হয়ে বোনের ভালো চাওনা। এ কেমন ভাই তুমি? তাও যদি আমার ভাই কানা, বোবা বা খোড়া হতো! আমার ভাইয়ের মত ছেলে তুমি সারা জীবন খুঁজলেও উল্লাসীর জন্য পাবে না।”
আরও কিছু বলতে চাইছিল মুন্নি সরকার। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে উল্লাসীকে বেরিয়ে আসতে দেখে থেমে গেল সে।
-“আপনি কখন এলেন?”
উল্লাসীর প্রশ্নে পিছন ফিরে তার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। চড়া গলায় বললো,
-“তোমাকে কাল রাতে কী বলেছিলাম? একে বাসায় ঢোকাতে নিষেধ করিনি? কিন্তু তুমি আজ একে বাসায় তো ঢুকিয়েইছোই সাথে আদর আপ্যায়নের জন্যও নিশ্চিত খাবার বানাচ্ছিলে।”
মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো উল্লাসী। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“উনার মা এসেছিলেন। তাই আরকি….”
-“চুপ.. একদম চুপ।”
উল্লাসীর এক হাত চেপে তাকে টেনে ড্রইং রুমে নিয়ে এল মেসবাহ। তারপর মুন্নি সরকারকে উদ্দেশ্য করে স্থির গলায় বললো,
-“আপনিই ওকে জিজ্ঞেস করুন ও বিয়ে করবে নাকি। এই উল্লাসী, তুমি বিয়ে করবা?”
এসবের আগামাথা কোনোটাই মাথায় ঢুকলো না উল্লাসীর। তবে স্বামীর কথায় সম্মতি দেয়া শ্রেয় ভেবে ঢোক চেপে হালকা মাথা নাড়লো সে।
-“কী? হলো তো? এবার দয়া করে এসব বন্ধ করুন।”
ভ্রু কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“ও ছোট। ও এসবের কিছু বুঝবে না। ওর খারাপ ভালো দেখার দায়িত্ব ভাই হিসেবে তোমার।”
-“আমিও দিব না।”
-“দেব না বললেই হলো! ভাই হইছো কি এই কাজে?”
-“বারবার কী ভাই ভাই লাগাই রাখছেন? উল্লাসী আমার বোন না। ও আমার দুঃসম্পর্কের বউ।”
চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। একরাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“দুঃসম্পর্কের বউ মানে?”
-“ওইতো.. দুঃসম্পর্কের না শুধু বউ!”

(চলবে)

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৫

কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে মেসবাহ। রাগের মাথায় সত্যিটা এভাবে বলে দিল সে? একবারো ভাবলো না পরবর্তীতে এটি কতবড় আকার ধারণ করবে? সাথে ফলস্বরূপ বাঁশ বাগান তো রয়েছেই। কপালের ঘাম মুছে সোফায় বসে পড়লো সে। করুণ দৃষ্টিতে তাকালো মুন্নি সরকারের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যে তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে।
-“উল্লাসী তোমার বউ?”
মুন্নি সরকারের কথার পিঠে কোনো জবাব দিল না মেসবাহ। ভাবতে লাগলো ভয়ংকর এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একটি উপায়…
-“কথা বলছো না কেনো? উল্লাসী তোমার বউ?”
-“জ্বি..”
-“তাহলে এতদিন বউকে বোন বলেছো কেনো?”
ঢোক গিলে পরিস্থিতি সামলাতে আবারও উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। গলা খাকড়ি দিয়ে সামান্য এগিয়ে এল মুন্নি সরকারের দিকে। তারপর স্থির গলায় বললো,
-“বোন বলিনি। দুঃসম্পর্কের বোন বলেছি। দুঃসম্পর্কের বোনও তো মাঝেমাঝে বউ হয়। তাই না?”
-“হলে হয়। তবে তুমি মিথ্যে বলেছো। সকলের কাছে নিজের বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছো।”
-“আলাদা করে আমি কারো সাথেই উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেইনি আপনি ছাড়া। আপনার জোরাজুরির সাথে না পেরে উঠে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আর বাদবাকি ছড়ানোর কাজটা আপনি করেছেন। তাহলে এখানে মিথ্যে কে বলেছে.. বলুন?”
ফুসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“একদম কনফিউজড করো না আমাকে। একদম না। এই আম্মা ওঠো তো। এসবের শেষ আজ আমিই দেখেই ছাড়বো।”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে শায়লা বেগম বললেন,
-“তুই চুপ করতো। তোরে বারবার আমি কইছি, আগে ভালো করে খোঁজ খবর নে। কিন্তু তুই শুনলে তো! প্রত্যেক বিষয়েই এত নাচানাচি করলে চলে?”
-“না চললে নাই। মেসবাহর মনের ভেতর কি আমি বসে রইছিলাম যে ওর মিথ্যে কথা আমি ধরতে পারবো?”
পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“আমি তো মিথ্যে বলিনি।”
-“আবারও বলছো মিথ্যা বলোনি?”
-“হ্যাঁ.. উল্লাসী আমার দুঃসম্পর্কের বোনও হয়।”
-“তো? বিয়ের পর বউকে তুমি বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিবা?”
আবারও কপালের ঘাম মুছলো মেসবাহ। এ কেমন অবস্থায় পড়লো সে! কী দরকার ছিল উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করে দেয়ার? সত্যিটা বললে আর যাই হোক আজকের মতো পরিস্থিতিতে তো পড়তে হতো না!
-“বিয়েই তো আমাদের হয়নি। না মানে গ্রামে হয়েছে। এখানে তো হয়নি। তাই গ্রামে উল্লাসী আমার বউ। আর এখানে দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“মানে? তুমি আবারও আমাকে কনফিউজড করছো!”
-“মোটেও না, ভাবি। এই যেমন ধরেন আপনি হাসান ভাইয়ের ওয়াইফ। কিন্তু আপনারা বিয়ের আগে একে অপরকে চিনতেন না। তাই বিয়ের পর আগের সেই পরিচয় নিজেদের মাঝে বাঁচিয়েও রাখতে পারলেন না। কিন্তু এদিকে আমি আর উল্লাসী তো দুঃসম্পর্কের ভাইবোন। তাই না? তাই আমরা সেই সম্পর্কের ছিটেফোঁটা নতুন জীবনে হালকার উপর ঝাপসা হলেও রাখার চেষ্টায় আছি। বলুন, ঠিক করছি না?”
বিষয়টি বোধগম্য হলো না মুন্নি সরকারের। চিন্তিত মুখে সে বললো,
-“হ্যাঁ.. তবে বউকে বোন?”
-“বোন না বোন না। দুঃসম্পর্কের বোন।”
-“ওই হলো! উহু.. কোথাও ঘাপলা আছে। অবশ্যই আছে। সত্যিটা বলো মেসবাহ। আসল কাহিনী কী?”
মুন্নি সরকারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চুপ করানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিপাকে পড়লো মেসবাহ। আকাশ পাতাল ভেবেও এর জবাব না পেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“এক সেকেন্ড! একটু ওয়াশরুমে যাবো আর আসবো। আপনি যাবেন না। বসুন। আমি আসছি।”
কোনোরকম দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে লিমনের নাম্বারে ডায়াল করলো মেসবাহ। দুইবারের মতো রিং বাজতেই ওপাশ থেকে লিমন ফোন ধরতেই তাকে সংক্ষেপে সবটা খুলে বললো সে। তারপর অস্থির গলায় বললো,
-“কী করবো এখন?”
-“আমি আগেই বলছিলাম তোরে! কী দরকার ছিল এসব বলার?”
-“এখন ওসব ভেবে হবে টা কী? এই মহিলাকে কিভাবে চুপ রাখবো সেটা বল। নয়তো এই মহিলা আমার মানসম্মান আর কিছু রাখবে না। পুরো সোসাইটিতে ব্যাপারটি নানানভাবে ছড়িয়ে দেবে।”
-“সময় দে একটু..”
-“সেই সময়টাই তো নেই।”
একদন্ড ভেবে লিমন ফোনের ওপাশ থেকে শীতল কন্ঠে বললো,
-“সময় যেহেতু নেই সেহেতু কমন কাহিনীই শুনিয়ে দে। সময় থাকলে না হয় আনকমন কিছে ভেবে দিতাম!”
-“কমন কাহিনীটাই কী?”
-“তুই উল্লাসী একে অপরকে পছন্দ করিস। কিন্তু উল্লাসীর বাবা ছোট মেয়ে বিয়ে দেবে না। প্লাস ওর বাবা গ্রামের সনামধন্য একজন ব্যক্তি। অনেক পাওয়ার আছে। তাই কোনো উপায় না পেয়ে তুই উল্লাসীরে নিয়ে ভাগছিস।”
লিমনের কথা শুনে বিস্ময়ের শেখরে পৌঁছে গেল মেসবাহ।
-“অসম্ভব!”
-“সম্ভব।”
-“মোটেও আমি এই কাজ করবো না। এতে আমার মানসম্মান যা আছে তার কাণিকোণাও আর থাকবে না।”
-“আরে শালা! প্রেম পিরিত খারাপ জিনিস না। বউকে বোন বানানোর তোমার এই অপকর্মের কথা ঢাকতে আপাতত একটা টপিক দরকার। আর আমার মনে হয়না এরচেয়ে বেটার অপশন পাবি।”
-“আমি পারবো না।”
-“না পারলে যা! পুরো সোসাইটির কাছ থেকে লুচ্চা উপাধি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা।”

মেসবাহর স্থানত্যাগের পর থেকেই উল্লাসীর উপর প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসেছে মুন্নি সরকার৷ একেরপর এক প্রশ্ন করে মেয়েটির কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। মেয়েটি জানিনা বিহীন মুখ থেকে কোনো আওয়াজই বের করছে না। ধৈর্যচ্যুত হয়ে আবারও সোফায় বসে পড়লো মুন্নি সরকার। অশান্ত গলায় বললো,
-“মেসবাহ তোমার স্বামী হয়?”
-“জানিনা..”
-“তো জানোটা কী?”
-“জানিনা..”
আগমন ঘটলো মেসবাহর। ঠান্ডা মাথায় উল্লাসীর পাশে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলো সে লিমনের বানানো মিথ্যা গল্প। সবশুনে মুন্নি সরকার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কিন্তু তুমি তো প্রতিষ্ঠিত একজন ছেলে। তোমার সাথে বিয়ে দিতে কী সমস্যা?”
-“উল্লাসীর তো বিয়ের বয়স হয়নি ভাবি।”
-“গ্রামেও এমন চিন্তাধারার মানুষ আছে?”
-“থাকবে না কেনো? অবশ্যই আছে। তাছাড়া ওর মা তো ঢাকাতেই মানুষ। উনার চিন্তাধারা অন্য পর্যায়ের।”
-“অহ.. কিন্তু আমার মাথায় এটা আসছে না, তুমি মেসবাহ কী করে এত ছোট এক মেয়ের প্রেম পড়লে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আপনার যেমন এক দেখাতেই ওকে মনে ধরেছিল তেমন আমারও ধরেছিল। সুন্দর মেয়ে। অবুঝ মন.. ভাবি।”
সন্তুষ্ট হলো না মুন্নি সরকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উল্লাসীর দিকে ছুঁড়ে বললো,
-“তাই বলে বউকে বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে?”
-“আরে ভাবি! বউ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে সোসাইটির সবাই জেনে যেত না? এটা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় হতো, নানান আলোচনা হতো। আর যা ওর বাবার কাছে পৌঁছুতেই বেশি সময় লাগতো না। বোঝেনিই তো! পাওয়ারের ব্যাপার। এজন্যই চুপচাপে ছিলাম। তবে একটি মেয়ে যেহেতু নিয়ে এসেছি সেহেতু পরিচয় তো দিতেই হবে। তাই আরকি দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া।”
-“তা ঠিকাছে। কিন্তু ওর বাবা কি তোমার ঠিকানা জানে না? বা কোন হসপিটালে বসো তা জানে না? তার ক্লু ধরেই তো মেয়েকে নিতে এতদিন এখানে এসে পড়বার কথা!”
টনক নড়লো মেসবাহর। যুক্তিযুক্ত একটি প্রশ্ন। এবং প্রশ্নটির কাছে লিমনের দুই পয়সার গল্পটি হার মানতে বাধ্য। মহিলার মাথায় গোবর নয় বরং খাটি সোনা রয়েছে। অদ্ভুত ভুলভাল একটি কাহিনী তার হাতে ধরিয়ে দিলেও সে তার লেজ টেনে ধরেই সত্যতা যাচাই করে নিচ্ছে। আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বুকচিরে বেরিয়ে এল মেসবাহর। পরিস্থিতি সামলাতে সে বললো,
-“এখানে আপন বলতে আমার কেউ নেই ভাবি। শুধুমাত্র আপনাকে এবং হাসান ভাইকে আমি কাছের মানুষ মনে করি। আপন মনে করি। আপনার সাথে কাল রাতে এবং কিছুক্ষণ আগে যে ব্যবহার করেছি এর জন্য আমায় ক্ষমা করুন। আসলে মাথা ঠিক ছিল না। ভাবি আপনিই বলেন! কেউ যদি আপনাকেই এসে অন্য মেয়ের সঙ্গে হাসান ভাইয়ের বিয়ে প্রস্তাব দেয়.. তা আপনি চুপচাপ মেনে নিতে পারবেন?”
-“অসম্ভব! তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তবেই আমি মানবো। তুমি ভুল কিছু করোনি। একদম ঠিক করেছো।”
-“বোঝার জন্য ধন্যবাদ ভাবি। আমাকে আপনি না বুঝলে আর কে বুঝবে বলুন!”
-“সেটাই তো। তা তোমরা পালিয়ে আসার পর বিয়ে করেছো তো?”
-“হ্যাঁ.. করেছিলাম। এই উল্লাসী, আমরা বিয়ে করেছিলাম না?”
উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। মেয়েটি চোখেমুখে একরাশ আতংক নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পাশে। মায়া হচ্ছে তার মেয়েটির জন্য। স্বল্প বয়সের এই জীবনে কত মিথ্যার না সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাকে! তবে আপাতত মিথ্যা ছাড়া সত্য বললে নারীবাদী লোকেরা তাকে পিটিয়ে ছাড়বে। অসৎ চরিত্রের লোক, নারী নির্যাতনকারী এমনকি নারী পাচারকারীর খাতায় নাম ফেলতেও এদের দু’দন্ড লাগবে না। তবে সে আবারও একই ভুল করছে। সম্মান বাঁচানোর ধান্দায় আরও একটি নতুন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। পূর্বের মিথ্যা নিয়েই যেখানে জান রফাদফা হয়ে যাচ্ছে সেখানে নতুন এই মিথ্যা নিয়ে কতদূর এগুতে পারবে সে! প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে।

সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো না মেসবাহ। উল্লাসীর কোচিং-এ আজ তাকে নিয়ে কথা বলতে যাবার জন্য হাসপাতাল ছেড়ে আসলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে বাসা ছেড়ে না বেরুনোই শ্রেয় মনে হলো তার। দুপুরে নানান কথা বলে কোনোমতে বুঝিয়ে শুঝিয়ে মুন্নি সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেলেও অস্থিরতা তার একবিন্দুও কমছে না। বরং সময় বাড়ার সাথেসাথে তা ক্রমে বাড়ছে। মহিলা নিশ্চিত এতক্ষণে পুরো সোসাইটিতে কথা ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে কথা কিভাবে ছড়িয়েছে ভালো না মন্দ.. তা কেবল সেই জানে! তবে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে সে।
-“আপনার চা..”
চিন্তার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল মেসবাহ। তারপর তাতে একবার চুমুক দিয়ে বললো,
-“আমাকে কি খুব খারাপ একজন মানুষ মনে হয় তোমার?”
-“উহু…”
-“সত্যি করে বলো।”
একমুহূর্ত ভেবে উল্লাসী বললো,
-“আপনাকে আমি বুঝি না। মাঝেমাঝে চেষ্টা করি, তবে আমার এই ছোট মাথায় আপনাকে ঢোকাতে পারি না।”
মৃদু হেসে আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিল মেসবাহ। মাঝেমাঝে মেয়েটি সহজ সরল, মাঝেমাঝে মেয়েটি চঞ্চল, আবার মাঝেমাঝে একেবারেই নীরব। তবে যেমনই হোক, মন্দ নয়। যার সঙ্গে বেশ সুখে-শান্তিতেই দিনের পর দিন পাড় করা যায়। তবে মেয়েটি যে ছোট! হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে সে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই উঠে পড়লো উল্লাসী। ধীর পায়ে এগুলো সদর দরজার দিকে। এবং দরজা খোলামাত্র হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো মুন্নি সরকার সহ কিছু মহিলা। মুখে তাদের অজস্র হাসি।
-“এই তোমার শাড়ি আছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় শাড়ি টাড়ি এনেছিলে কী?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নের জবাবে মুখ ঘুরিয়ে মেসবাহর দিকে তাকালো উল্লাসী। শাড়ি তো তার আছেই৷ তবে বলে দিলে যদি উনি রেগে যান!
-“ওর দিকে তাকাচ্ছো কেন? আর মেসবাহ তুমিও যাও। পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নাও।”
পুরো ব্যাপার বুঝে উঠতে পারলো না মেসবাহ। এভাবে মুন্নি সরকার তার দলবল নিয়ে বাসায় ঢোকার সাথেসাথেই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল। তবে পরবর্তীতে সকলের মুখে হাসি দেখে অস্থিরতা কিছুটা হলেও কমেছিল। কিন্তু এসব কী? হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো পড়বে সে?
-“নাকি তোমার বউয়ের মতো তোমারও পাঞ্জাবি নেই!”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো উপস্থিত সকলেই। তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“আছে। কিন্তু হঠাৎ পাঞ্জাবি কেনো?”
-“তো কী পড়ে বিয়ে করতে চাও তুমি? টিশার্ট পড়ে?”
কপাল কুঁচকে ফেললো মেসবাহ। প্রশ্নসূচক চোখে মুন্নি সরকারের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কিসের বিয়ে?”
-“তোমার আর উল্লাসীর।”
-“আমাদের বিয়ে তো হয়েই গেছে।”
-“বেশ ভালো কথা। তাহলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে তো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। তাছাড়া আমাকে যেহেতু কাছের মানুষ ভাবো.. সেহেতু আমার কথাটা রাখো। আমাদের সকলের সামনে আবারও বিয়েটা করে ফেলো। আমি সবাইকেই তোমার সমস্যার কথা বলেছি। আমরা আছি তোমাদের পাশে। উল্লাসীকে কেউ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আর না উল্লাসীর বাবার ভয়ে তোমার নিজের বউকে দুঃসম্পর্কের বোন বলতে হবে!”
আবারও উপস্থিত সকলেই খিলখিল করে হেসে উঠতেই তাদেরকে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। মেসবাহকে তাড়া দিতে বললো,
-“হাসানকে পাঠিয়েছি কাজী ডাকতে। এলো বুঝি ও! যাও তাড়াতাড়ি তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা এদিকে উল্লাসীকে তৈরি করে দেই। বাচ্চা মেয়ে! সবটা সামলে নিতে পারবে না।”
নড়লো না মেসবাহ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। নতুন বলা মিথ্যেটি আবারও কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে?

পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে লোকজনের সমাগমে গমগম করছে। কিছুক্ষণ হলোই পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে এসে বরবেশে নীরবে বসে সকলের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে যাচ্ছে মেসবাহ। বিয়ে করা বউকে আরো একটিবার বিয়ে করাই যায়। এ আর তেমন কী কঠিন কাজ! তবে একটি বিষয় প্রচুর ভাবাচ্ছে তাকে। যে মেয়েকে কিছুদিন আগেই একরকম বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছে সে, ভাগ্যের পরিহাসে আজ তাকে আরও একটিবার বিয়ে করতে হচ্ছে। তবে সেদিনের মাঝে এবং আজকের মাঝে প্রচুর তফাৎ। সেদিন মনে বাবাকে নিয়ে একরাশ ভয় কাজ করলেও আজ তা কাজ করছে না। আজ শুধুই কাজ করছে একরাশ ভালোলাগা। উপভোগ করছে সে সময়টিকে। যদিও খানিকক্ষণ আগে এর ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। হ্যাঁ, সে মুখোমুখি হতে চায়। দেখতে চায়, এবারের বলা মিথ্যেটি কোথায় নিয়ে যায় তাকে।

-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসী, আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখের সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।”
আঁড়চোখে পাশে বসা উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি পড়েছে সে। মাথায় গুঁজে দিয়েছে ঘোমটা। যার দরুন উল্লাসীর মুখটা নজরে আসছে না তার। কী চলছে মেয়েটি মনে? নিশ্চয় ভয় পাচ্ছে সে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে সকলের চোখের অগোচরে উল্লাসীর হাত আঁকড়ে ধরলো মেসবাহ। তারপর তাতে হালকা চেপে ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“বলো, উল্লাসী। আমি তো আছিই।”
ভরসার হাতের সন্ধান পেয়ে মনের ভেতরে চলা আতংক কমে গেল উল্লাসীর। জোরে চেপে ধরলো সে মেসবাহর হাত। তারপর ধীর গলায় বললো,
-“কবুল..”

মেয়ের মুখে তিনবার কবুল শুনে এবারে কাজী এলেন মেসবাহর দিকে। সময় নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,
-“১৫ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য্য করিয়া আপনি আলাউদ্দিন শেখের মধ্যম পুত্র মেসবাহ শেখ, রহমান নিয়াজির জ্যেষ্ঠ কন্যা আঞ্জুমান আরা উল্লাসীর সাথে বিবাহে রাজি থাকলে বলুন ‘কবুল’।
সময় নিল না মেসবাহ। সাথেসাথেই জোর গলায় বললো,
-“কবুল স্কয়ার। কিন্তু কাজী সাহেব মাইনাসে মাইনাসে যেমন ‘প্লাস’ হয়ে যায় তেমন এক মেয়েকে দুইবার বিয়ে করলে কবুলে কবুলে কি তা ‘না কবুল’ হয়? বা বিয়ে ভেঙে যাবার কোনো চান্স থাকে?”

(চলবে)

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৬

পুরো ঘরজুড়ে বিরাজ করছে শুভ্রতা। ফুলের সৌরভে চারিপাশটা ম ম করছে। চারিদিক থেকে অদ্ভুত এক শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে। পুলকিত মনে বিছানায় এসে বসলো মেসবাহ। তাকালো খানিকটা দূরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা উল্লাসীর দিকে। মেয়েটির মুখে উজ্জ্বল এক আভা ফুটে উঠেছে। এইরূপে দারুণ দেখাচ্ছে তাকে। তাদের প্রথম বিয়ের দিনেও কি উল্লাসীর মুখে একই আভা ফুটে উঠেছিলো? হয়তোবা। তবে সেদিন তা নজরে আসেনি। অপার্থিব এক পরিবর্তন ঘটেছে তার নিজের মাঝে। আজ খুব করে ইচ্ছে করছে বয়সের ব্যবধান ভুলে উল্লাসীর প্রতি প্রত্যাশা রাখতে। ধীরস্থির ভাবে তাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে। তবে একদিন না একদিন তো বড় হবে উল্লাসী। সব কিছু বুঝতে শিখবে। সেসময় যদি বেঁকে বসে সে? নিজের জীবনে আর তার প্রয়োজন বোধ না করে! তখন? তখন কী অন্যায় করা হবে না মেয়েটির সাথে? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। নিজের চিন্তাভাবনা সংযত করে ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা টেনে সে বললো,
-“গরম লাগছে না?”
মুখ তুলে মেসবাহকে দেখামাত্র উল্লাসী এগিয়ে এল তার দিকে। মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে বললো,
-“উহু.. রাতে আপনি খেয়েছেন?”
-“খেয়েছি.. তুমি?”
-“আমিও খেয়েছি। একটা সত্যি কথা বলুন তো। মুন্নি ভাবির রান্না আপনার ভালো লাগে নাকি আমার হাতের রান্না?”
-“তোমার।”
-“আমি জানতাম! আমি জানতাম আপনি এটাই বলবেন।”
-“তাহলে প্রশ্ন করলে কেনো? যেহেতু জানাই ছিল!”
-“মুন্নি ভাবি জিজ্ঞেস করতে বলেছিলো বলে। ভাবি যে আজ ইলিশ মাছ ভাজি করেছিলো ওটায় কিন্তু ভাবি লবণ দেয়নি। আপনি খেয়ে বুঝেছিলেন?”
-“বুঝেছিলাম…”
-“আমিও বুঝেছিলাম। কিন্তু কিছু বলিনি।”
-“গুড.. ভালো কাজ করেছো।”
বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে আবারও বিছানায় এল মেসবাহ। পা উঠিয়ে আরাম করে বসে বললো,
-“তুমি গ্রামের মেয়ে হয়েও যথেষ্ট শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। ব্যপারটি প্রথম আমায় বেশ ভাবিয়েছে। অনাও এভাবে কথা বলেনা যেভাবে তুমি বলো। দারুণ লাগে শুনতে।”
হাসলো উল্লাসী। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
-“আমার মা শিখিয়েছে।”
-“তোমার মার পড়াশোনা কতদূর?”
-“জানি না। তবে অনেক পড়েছে। পড়তে পড়তে বাবার সাথে বিয়ে হয়ে যাবার পর আর পড়েনি।”
-“তোমার বাবামায়ের কাহিনী টা কী বলোতো! কিভাবে কী হলো উনাদের মাঝে? ঢাকা থেকে সব ছেড়েছুড়ে সরাসরি গ্রামে!”
-“আমিও খুব বেশি জানি না। তবে মার মুখে যেটুকু শুনেছি তাতে মার বাবারা ছিল অনেক বড়লোক। মা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বাবাকে নতুন ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেয় নানা। মাকে নিয়ে যাওয়া আসাই ছিল তার প্রধান কাজ। দীর্ঘদিন এভাবে চলার পর মা বুঝতে পারে উনি বাবাকে পছন্দ করে। তার ধীর স্বভাব, তার মুখের হাসি, তার নীরবতা.. সবটাই নাকি মাকে খুব করে টানতো। আমার বাবাকে দেখেছেন তো আপনি। সুন্দর মনে হয়নি আপনার?”
মাথা নেড়ে উল্লাসীর কথায় সম্মতি জানাতেই আবারও সাদাকালোর দুনিয়ায় নিজের বাবামাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ শুরু করলো উল্লাসী। বেশ লাগে তার এই গল্পটি সকলের কাছে শুনাতে। তবে আজকাল আর এগল্প কেউ শুনতে চায়না। শুনলেও বা নাক শিটকোয়। তবে আজপর্যন্ত তাদের এই অদ্ভুত কাজকর্মের কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পায়নি সে।
-“মা একদিন হুট করেই বাবাকে বলে সে বাবাকে বিয়ে করতে চায়। সবশুনে বাবার নাকি একঘন্টার মতো কোনো মুখের জবান ছিল না। হাস্যকর না ব্যাপারটি?”
-“হ্যাঁ.. তারপর?”
-“তারপর আর কী? বাবা রাজি ছিল না ওদিকে মাও ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না। ঠিকই নিজের মায়াজালে বাবাকে আটকে ফেলে মা। এসব কিন্তু আমি না, মা বলেছে।”
বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। তারপর বললো,
-“বুঝেছি.. তারপর?”
-“তারপর যখন মায়ের বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে, তখন বাবাকে হুট করেই বিয়ে করে ফেলে মা। নানাকে জানায় তবে সে মেনে নেয় না। বের করে দেয় বাড়ি ছেড়ে। ঘুড়েফিরে গ্রামে মাকে নিয়ে ফিরে আসে বাবা। তারপর আসি আমি.. মা আমাকে কী বলতো জানেন?”
-“কী?”
-“আমি নাকি তাদের ভালোবাসার ফসল বুনতেই পৃথিবীতে এসেছি। আমিও তখন মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, কোথায় মা? ফসল তো বুনছে বাবা। আমি তো ফসল বুনছি না। মা আমার তখন হেসে কুটিকুটি হতো।”
গলা হঠাৎ ধরে এল উল্লাসীর। চোখভর্তি জল নিয়ে বিছানার চাদরে দৃষ্টি স্থির করে আবারও বললো,
-“মা যেদিন মারা যায় সেদিনও মা আমার চুল বেঁধে দিয়েছিলো। কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল, বলতো আমাদের ভালোবাসার ফসল বুনতে তোর ভাই আসছে না বোন? আমি বলেছিলাম, বোন। ওকে আমি খুব আদর করবো মা। সারাদিন নিজের কোলে রাখবো। মা বলেছিল, আর পড়াশোনা? আমি বলেছিলাম, গোল্লায় যাক!”
স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারলো না মেসবাহ। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো উল্লাসীর দিকে। ওদিকে উল্লাসী বলার উপরেই রয়েছে,
-“আশেপাশের সবাই বলছিলো, মারে শেষ দেখা দেইখা দে। আর কখনোই আসবো না তোর মা। আমিও খুব করে শেষ দেখা দেখে নিয়েছিলাম সেদিন। মার ঘুমন্ত মুখে হাজার হাজার চুমো দিয়েছিলাম। চিৎকার করে কেঁদে বলেছিলাম, মা আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না.. যেতে পারে না।”
উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলো উল্লাসী। পাঁচ বছর আগের সেই দৃশ্য আজও স্পষ্ট দেখতে পায় সে। সাথেসাথেই বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রণা হয় তার। মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, মুখে চুমো দিতে ইচ্ছে করে। তবে কোথায় পাবে সে তার মায়ের দেখা!
-“আমি মায়ের আদর পেয়েছি, কিন্তু আমার বোন তা পায়নি। কথা বলতে, ভালোভাবে চলতে না পারলেও ও যে মায়ের আঁচল খুঁজে বেরায় তা আমি খুব বুঝি। ওর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। আপনি তো ডাক্তার.. সব কিছুর ঔষধই আপনার কাছে আছে। আমার বোনটাকে ভালো করে দেবেন আপনি? ওর কষ্ট কমিয়ে দেবেন?”
বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো মেসবাহর। এপরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিৎ ভেবে পেল না সে। তবে মেয়েটির কান্নার বেগ ধীরেধীরে বাড়ছে। কিছু একটা করা উচিৎ তার…
-“ছোটমা কথা দিয়েছে আমায়।আপনাকে বিয়ে করলে ছোটমাও খোকনের মতোই আদর করবে সুহাকে। সুহাও মায়ের আদর পাবে। আমি তো বিয়ে করেছি আপনাকে। কিন্তু ছোটমা কী তার কথা রেখেছে? যে মেয়েটি আমায় ছাড়া একদন্ড থাকতে পারতো না, সেই মেয়েটি আজ আমায় ছাড়া কী করে থাকে বলতে পারবেন? আমি ছাড়া ওর দুনিয়ায় আর কেউ নেই। প্রতিবন্ধী বলে কেউ ওকে ভালোবাসে না, কেউ আদর করে কাছে টেনে নেয় না। কী দোষ ওর? বলুন না..”
এগিয়ে এসে উল্লাসীকে নিজের বুকে আঁকড়ে নিল মেসবাহ। মেয়েরটির বলা একেকটি কথা তার বুকে এসে বিঁধছে তীরের মতো। মেয়েটির মা নেই ভাবতেই বুকের ভেতরটায় শূন্যতা অনুভব হচ্ছে। মায়া হচ্ছে মেয়েটির জন্য। নাম না জানা এক কষ্ট বারবার এসে গলা চেপে ধরছে।
-“ওর কেউ নেই। ওকে কেউ আদর করে না। বাবাও না.. বাবাও ওকে আদর করে না। আমার কত কষ্ট হয় জানেন?”
-“জানি..”
-“জানেন না। আপনি জানেন না। কেউ জানে না।”
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেসবাহ বললো,
-“ঠিকাছে। কেউ জানে না। একটু শান্ত হও তুমি।”
মেসবাহর মমতাময়ী স্পর্শে ধীরেধীরে শান্ত হয়ে এল উল্লাসী। তবে খানিকটা ফোঁপানি রয়েই গেল। মেয়েটির নীরবতা যতটা ভালোলাগে, ততটাই কষ্ট হয় মেয়েটির কান্নামাখা মুখ দেখলে। বুকের ভেতরটায় উথালপাথাল শুরু হয়, অস্থির লাগে। উল্লাসী কি বোঝে তার এই অস্থিরতার কারণ? নিজের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে দু’হাতের আঁজলে মেসবাহ তুলে ধরলো উল্লাসীর মুখ। মৃদু আলোয় মেয়েটির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। কী আছে তার ওই দুই চোখে? প্রশ্নের জবাব না পেলেও নিজের ঠোঁটজোড়া নিয়ে সে ঠেকালো উল্লাসীর কপালে। চোখজোড়া বুজে সময় নিয়ে তাতে এঁকে দিল স্নেহের স্পর্শ।
-“সেদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা মাকে যতটা ভালোবাসতো আপনিও কি আমায় ততোটাই ভালোবাসেন? কিন্তু আজ বলছি, আপনি কখনোই আমাকে সেভাবে ভালোবাসবেন না, যে ভালোবাসা আমি হারিয়ে গেলেই ফুরিয়ে যাবে। আপনি আমাকে সেভাবেই ভালোবাসবেন, যে ভালোবাসায় আমি মার মতো হারিয়ে গেলেও ছোটমার মতো কেউ কখনোই আসবে না।”
বুকচিরে আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। ঠোঁটজোড়া উল্লাসীর কপাল থেকে উঠিয়ে বালিশে মাথা গুঁজলো সে। ভাগ্য তাকে একোন স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? যার একূল অকূল দুকূলই ঘন আঁধারময়।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত উল্লাসীকে আগাগোড়া লক্ষ্য করলো মুন্নি সরকার। তারপর ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-“গোসল দাও নি?”
-“উহু.. বাড়িতে আম্মা সকালে গোসল দিতে বললেও উনি তো আমাকে সকালে গোসল করতে নিষেধ করে দিয়েছেন।”
-“কে? মেসবাহ?”
-“হ্যাঁ…”
উদ্বিগ্ন মনে প্রশ্নের হাঁড়ি খুলে বসলো মুন্নি সরকার। মেসবাহ কেনো উল্লাসীকে সকালে গোসল করতে নিষেধ করবে? এটুকো বোঝার বয়স তো মেসবাহর হয়েছে৷ তাহলে কী তেমন কিছুই হয়নি দুজনের মাঝে? পরমুহূর্তেই নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই করে নিল মুন্নি সরকার। কেনো হবে না ওসব? তাহলে প্রেম করে বিয়ে করেছে কী কাজে? অবশ্যই রান্নাবান্না করে শুধু খাওয়ানোর কাজে তো নয়। তবুও নিজের মনে চলা প্রশ্নোত্তরের পাঠ চুকাতেই উল্লাসীকে নিজের কাছে এনে বসালো মুন্নি সরকার। একদন্ড ভেবে ক্ষীণ গলায় বললো,
-“তোমায় মেসবাহ আদর করে?”
মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়ে উল্লাসী বললো,
-“করে তো।”
-“কোথায় কোথায় করে?”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো উল্লাসী। বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“আদর আবার জায়গায় জায়গায় করা যায় নাকি!”
-“যায় তো.. জানো না?”
-“উহু..”
মনের ভেতরে চলা সন্দেহ আরও জোরজার হলো মুন্নি সরকারের। উল্লাসীর দিকে চেয়ে আগ্রহী গলায় বললো,
-“মুখে, গলায়, ঠোঁটে আলাদা আলাদাভাবে পুরো শরীরেই তো স্বামীরা আদর করে। কেনো? তোমায় মেসবাহ এভাবে আদর করে না?”
চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে উল্লাসী জবাব দিল,
-“না তো।”
পুরো ব্যপার বোধগম্য না হলেও এর কারণ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলো মুন্নি সরকারের মন। কেন করবে না মেসবাহ এসব? সে যতটুকু মেসবাহকে চেনে জানে তাতে অত্যন্ত ভদ্র সুলভ একজন ব্যক্তি সে। কথাবার্তা খুব একটা না বললেও অত্যন্ত আন্তরিক। এবং ডাক্তার হবার সুবাদে প্রচুর স্বাস্থ্য সচেতন। তাহলে কী ঠিক একারণটাই তাদের ভালোবাসার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? মেসবাহ উল্লাসীকে এতটাই বাচ্চা ভাবে যে পারলে তাকে এখনি ধরে ফিডার খাওয়াবে! সেখানে বাচ্চা একটি মেয়ের সাথে মেসবাহর মতো ছেলে এসব করতে অবশ্যই দশবার ভাববে। কারণ খুঁজে পেয়ে বেস উচ্ছ্বসিত হলো মুন্নি সরকার। উল্লাসীর দিকে আবারও ফিরে সে ফিসফিস করে বললো,
-“আমার কথা মন দিয়ে শুনো। আমি যা বলবো তাই করবে। কী? করবে তো?”

শুক্রবার হওয়ায় বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠলো মেসবাহ। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে এসে বসে জোর গলায় কয়েকবার উল্লাসীকে ডাকতেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। টেবিলে গোছানো সব খাবারের দিকে ইশারা করে বললো,
-“সব মুন্নি ভাবি দিয়ে গেছে।”
-“আশ্চর্য! সে আবার কেনো দিয়েছে এসব? তুমি নিষেধ করোনি?”
-“উহু..”
-“এটা কী ঠিক করেছো?”
-“কী যে!”
আর কথা বাড়ালো না মেসবাহ। থালায় খিচুড়ি উঠিয়ে মাংসের ঝোল নিয়ে মুখে পুড়তে শুরু করলো একের পর এক।

খাবার শেষে মেসবাহ ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই তার পিছুপিছু এল উল্লাসী। পাশে বসে নরম গলায় বললো,
-“আপনি আমায় আদর করেন না কেনো?”
প্রশ্ন শুনে বড়সড় একটি ধাক্কা খেলো মেসবাহ৷ চোখজোড়া প্রশস্ত করে বললো,
-“মানে?”
-“মানে আপনি আমায় কেনো আদর করেন না? স্বামী তো তার স্ত্রীকে অনেক জায়গায় আদর করে। আপনি কেনো আমায় করেন না?”
ওপাশ থেকে মেসবাহর কোনো জবাব না পেয়ে উল্লাসী আবারও বললো,
-“মুখে, ঠোঁটে, গলায় আলাদা আলাদাভাবে পুরো শরীরেরই তো স্বামীরা আদর করে। তাহলে আপনি কেনো করেন না? একটু সবজায়গায় আদর করলে কী এমন হয়?”
ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। আশেপাশে নজর বুলিয়ে ধীর গলায় বললো,
-“কাল রাতে তো করলাম। ঐযে কপালে…”
-“ওটা তো চুমু ছিলো।”
-“আরে পাগলি! চুমু আদর একই।”
একমুহূর্ত ভেবে মুন্নি সরকারের বলা কথাগুলো স্মরণ করলো উল্লাসী। তারপর আহ্লাদী গলায় বললো,
-“তাহলে এখনি ঠোঁটে একটু আদর করে দিন..”
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। দ্রুত পায়ে সদর দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললো,
-“সর্বনাশ! আমি ফোন করেছিলো, না মানে লিমন ফোন করেছিলো। দেখা করে আসি। লিমন লাগাও। না মানে.. ইশশ! দরজা লাগাও।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here